প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০৯. বিঘ্নরাজেরও আগে

বিঘ্নরাজেরও আগে

গণপতির ইতিহাসে এই চিত্তাকর্ষক পরিবর্তনটি আধুনিক বিদ্বানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা এই পরিবর্তনের একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। সে-ব্যাখ্যার মূল কথা হলো, আদিতে গণপতি ছিলেন স্থানীয় অনার্যদের দেবতা। তাই আর্যরা বা বৈদিক ঐতিহ্যের অনুগামীরা, শুরুতে এই দেবতাটিকে ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করেন। কিন্তু কালক্রমে তাঁরা গণেশকে গ্রহণ করে নেন। সেই কারণেই গণপতির রূপান্তর ঘটে।

এই সিদ্ধান্তের দৃষ্টান্ত হিসেবে শ্রদ্ধেয় ক্ষিতিমোহন সেন(৮৮) মহাশয়ের রচনা উদ্ধ্বৃত করা যায় : “অনার্য অনেক দবেওতাকে আর্যেরা স্বীকার না করিয়া পারেন নাই। চারিদিকের প্রভাবকে দীর্ঘকাল ঠেকাইয়া রাখা অসম্ভব। তাহার পরে গণচিত্তকে প্রসন্ন না করিলে মানুষকে যে অতিষ্ঠ হইতে হয় এই কথা প্রাচীন আর্যেরাও বুঝিতে পারিয়াছিলেন। তাই গণদেবতা গণপতির পূজা সকল যজ্ঞের অগ্রে অনুষ্ঠান করা হইত।” শ্রদ্ধেয় হরিদাস মিত্র(৮৯) মহাশয় অবশ্য গণেশকে অনার্য-উপাসিত দেবতা বলছেন না,

As Ganesa was perhaps originally the special deity of the ‘Ganas’—wild Aryan tribes, inhabiting desert wastes, mountains and forests,—he was probably in later times affiliated to ‘Pasupati’ (Sankara) and ‘Bhutapati’ (Siva); and when he was admitted to the highter Aryan pantheon, various descriptions of his origin were given in the Purans, as necessity arose. These explanations might have taken centuries to grow.
যেহেতু গণেশ আদিতে সম্ভবত বিশেষ করে গণগুলিরই—অর্থাৎ, মরুভূমি, পর্বত ও বনজঙ্গলের বুনো আর্য উপজাতিগুলিরই—দেবতা ছিলেন সেই হেতু খুব সম্ভব উত্তরযুগে তাঁকে পশুপতি (শঙ্কর) ও ভূতপতির (শিব) সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়; এবং তাঁকে যখন উচ্চতর আর্য দেবলোকে গ্রহণ করা হলো তখন প্রয়োজনের খাতিরে পুরাণে তাঁর জন্ম-সংক্রান্ত নানারকম উপাখ্যান রচনা করা দরকার হলো। এই ব্যাখ্যাগুলি গড়ে উঠবার জন্যে সম্ভবত অনেক শতাব্দী সময় লেগেছিলো।

আমাদের মন্তব্য হলো, এ-জাতীয় ব্যাখ্যায় দেবলোকের ইতিহাসকে মরলোকের ইতিহাসের প্রতিবিম্ব বলে দেখবার চেষ্টা নেই। তাই, আধুনিক বিদ্বানদের এ-জাতীয় গবেষণা দুর্মূল্য হলেও পূর্ণাঙ্গ হতে পারেনি। প্রথমত, গণেশ বলতে এককালে নির্দিষ্ট একজনকে বোঝাতো না—প্রাচীন পুঁথিপত্র থেকে প্রমাণ হয় বিনায়ক ছিলেন বহু। গণেশের নানাবিধ নামের মধ্যে দ্বিজিহ্বক, বৃষকেতন প্রভৃতি নাম দেখে সন্দেহ হয় প্রাণীজগতের মধ্যে শুধুমাত্র হাতির সঙ্গেই তাঁর সম্পর্ক ছিলো না, সাপ ষাঁড় প্রভৃতির সঙ্গেও সম্পর্ক ছিলো। যাঁরা গণেশকে এ-জাতীয় নামে চিনতেন যাঁরা গণেশের মূর্তি রচনা করলে আজকের দিনে আমাদের পক্ষে সেই মূর্তিগুলিকে গণেশ বলে চেনাই হয়তো দুঃসাধ্য হতো। তাই, উন্নততর আর্যেরা অনার্যদের কাছ থেকে, বা অনুন্নত আর্য উপজাতিদের কাছ থেকেই, এই গণেশকে গ্রহণ করেছিলেন—এ-জাতীয় মতবাদ স্বীকার করলেও অনেক প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যায়। কেন গ্রহণ করলেন? এবং, তারচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, বহু বিনায়কের মধ্যে, কিংবা, বিনায়কের বহু রূপের মধ্যে ওই একটিমাত্র নির্দিষ্ট রূপই কেন গৃহীত হলো? আমরা একটু পরেই দেখতে পাবো, এই দ্বিতীয় প্রশ্নটির জবাব হয়তো আজ স্পষ্টভাবে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, এমন হতে পারে যে, এই প্রশ্নকে অনুসরণ করেই ভারতবর্ষে রাষ্ট্রের উৎপত্তিসংক্রান্ত অমীমাংসিত সময়ার মীমাংসা অন্বেষণ করা যেতে পারে।

এইখানে আমরা আমাদের মূল যুক্তির আভাস দিয়ে রাখতে পারি।

আমাদের মূল যুক্তি হলো, অন্যান্য দেশের মতোই ভারতবর্ষেও রাষ্ট্রশক্তি ও শ্রেণীবিভক্ত সমাজের কাহিনী অনাদি নয়। প্রাগ-বিভক্ত সমাজের ধ্বংসস্তূপের উপরই রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু সারা ভারতবর্ষ জুড়ে একসঙ্গে তা ঘটেনি। শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের পাশেই থেকেছে প্রাগ-বিভক্ত প্রাচীন সমাজ। এমনকি, প্রাগ-বিভক্ত সমাজ যেখানে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে সেখানেও তার সমস্ত চিহ্ন নির্মূল হয়ে যায়নি।

আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো, ভারতীয় সাহিত্য ওই প্রাগ-বিভক্ত সমাজেরই নাম হলো গণ। ইংরেজী পরিভাষা অনুসারে ট্রাইব। অবশ্যই, দুর্ভাগ্যবশত এই ট্রাইব শব্দটিকে প্রায়ই এলোমেলোভাবে ব্যবহার করা হয়—মর্গান-এর আলোচনা অনুসরণ করে ওই ট্রাইব্যাল-সমাজ বা গণ-সমাজকে স্পষ্টভাবে চেনবার চেষ্টা করা হয়নি। তার বদলে সাধারণত একরকম আধো-অস্পষ্ট আদিম জীবনের চিত্রই উল্লেখ করা হয়। মর্গান-এর গবেষণা অনুসরণ করলে দেখা যায় এই গণ-সমাজের চিত্রটিকে অস্পষ্ট বা অনির্দিষ্ট মনে করবার কারণ নেই। তার বদলে এখানে সমাজসংগঠনের একটি নির্দিষ্ট ও স্পষ্ট রূপ রয়েছে। শুধু তাই নয়। ওই গণ-সমাজেরও একটা ইতিহাসও আছে, বিকাশ আছে : মর্গান-এর পরিভাষা অনুসারে মধ্য-বন্য-দশা থেকে মধ্য-বর্বর-দশা পর্যন্ত। মধ্য-বর্বর-দশার পর থেকেই ওই গণ-সমাজের গড়নে ভাঙন দেখা দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত সেই ধ্বংসস্তূপের উপরেই গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রশক্তি। এই গণ-সমাজকে আমরা প্রাগ-বিভক্ত সমাজ বলছি, কেননা, যতোদিন পর্যন্ত এই গণ-সমাজে ভাঙন দেখা দেয়নি ততোদিন পর্যন্ত শ্রেণীবিভাগেরও পরিচয় নেই—পরিচয় নেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির, আধুনিক স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের (পরিবারের) এবং রাষ্ট্রশক্তির।

নামেই প্রমাণ, ওই গণ-সমাজের সঙ্গেই গণপতির সম্পর্ক।

কিন্তু ভারতবর্ষে রাষ্ট্রশক্তির পাশাপাশিই ওই গণ-সমাজও টিকে থেকেছে,—সারা ভারতবর্ষ জুড়ে সমাজ-পরিবর্তন একতালে ঘটেনি। রাষ্ট্রশক্তির দেখা দেবার পর তার অধিনায়কেরা আশেপাশের গণ-সমাজকে কীরকম বিষনজরে দেখেহচিলেন তার নমুনা মহাভারত এবং অর্থশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃত করবো। আর, তাঁদের এই মনোভাবে থেকেই মূলসূত্র পাওয়া যাবে গণেশ সম্বন্ধে এককালের ওই বিদ্বেষ-বিতৃষ্ণাকে বোঝবার : যাজ্ঞবল্ক্যের বিনায়ক-আতঙ্ক আর কৌটিল্যের সংঘবৃত্ত হয়তো সম্পর্কহীন হয়। অবশ্য, এই বিঘ্নরাজ বিনায়কই যে শেষ পর্যন্ত কী করে সিদ্ধিদাতার সম্মান পেলেন সে-সমস্যা স্বতন্ত্র। গণচিত্তকে তুষ্ট করবার উদ্দেশ্যেই এই গণদেবতাকে গ্রহণ করা হয়েছিলো—এমনতরো সমাধান সহজ হলেও সন্তোষজনক নয়। কেননা, বিনায়ক এক ছিলেন না, বহু। কখনো তাঁর চেহারায় হাতির চিহ্ন, কখনো তাঁর নামে সাপের চিহ্ন, ষাঁড়ের চিহ্ন, কিংবা হয়তো আরো অন্যরকম। উদ্দেশ্যটা যদি গনচিত্তকে তোষণ করাই হয়—যদিও অবশ্য একথার অর্থ খুব স্পষ্ট নয়,—তাহলে ওই বহুবিনায়কের মধ্যে এক-বিনায়ককে কেন বেছে নেওয়া হলো সে-প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায় না। তাছাড়া, বিঘ্নরাজ বিনায়ক এবং সিদ্ধিদাতা গণেশের মধ্যে যে-মৌকিক প্রভেদ আছে তাও এই মতবাদ ঠিকমতো গ্রাহ্য করে না। তাই, গণনায়কের পক্ষে সিদ্ধিদাতা গণেশ হয়ে যাওয়ার সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল ও কঠিন। আজকের দিনেই হয়তো এ-সমস্যার সমাধান করা যাবে না; কিন্তু তার থেকেই প্রমাণ হবে না যে, আগামীকালের উন্নততর গবেষণার ভিত্তিতেও সে-সমাধান সুদূরপরাহত থেকে যাবে। আমরা শুধু এইটুকুই দেখাবার চেষ্টা করবো যে, এই সমস্যার সঙ্গে প্রাচীন ভারতে রাষ্ট্রশক্তির অভ্যুত্থান কাহিনীর সম্পর্ক রয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রাগ-বিভক্ত সমাজ ভেঙে রাষ্ট্রশক্তির অভ্যুত্থান কী করে হলো ঠিক এই বিষয়ে গবেষণা এখনো হয়নি। আজই হোক বা আগামীকালই হোক, আমাদের ঐতিহাসিকদের এ-বিষয়ে মনোনিয়োগ করতে হবে।

কিন্তু আপাতত যে-বিষয়টির দিকে বিশেষ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই : গণপতির ইতিহাসে ওই বিঘ্নরাজ-চরিতের চেয়েও পুরোনো একটি পরিচ্ছেদ আছে। তার প্রমাণ ঋগ্বেদে, তার প্রমাণ যজুর্ব্বেদ—মানবগৃহ্যসূত্র যা যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির চেয়েও অনেক আগেকার সাহিত্য।

ঋগ্বেদের দ্বিতীয় মণ্ডলে(৯০),—অর্থাৎ, আধুনিক পণ্ডিতদের হিসেবে ঋগ্বেদের প্রাচীনতম অংশে,—দেখতে পাওয়া যায় গৃৎসমদ ঋষি গান রচনা করেছেন :

গণানাং ত্বা গণপতিং হবামহে
কবিং কবীনামুপমশ্রবস্তমম্।
জ্যেষ্ঠরাজং ব্রহ্মণাং ব্রহ্মণস্পতে
আ নঃ শ্রৃণ্বন্নূতিভিঃ সীদসাদনম্।।
অর্থাৎ,
হে ব্রহ্মণস্পতি, তুমি গণগুলির মধ্যে গণপতি, কবিগণের মধ্যে কবি, সমস্ত অন্নের উপমাস্বরূপ অন্ন যাঁদের আছে তুমি তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, জ্যেষ্ঠদের মধ্যে তুমি বিরাজমান, তুমি মন্ত্রসমূহের স্বামী। তুমি আমাদের আহ্বান শ্রবণ করে আশ্রয় প্রদানার্থ যজ্ঞস্থানে উপবেশন কর।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে এই গান ছান্দোগ্যের সেই কুকুরগুলির গান মনে পড়িয়ে দেয়। কেননা, এখানেও অধ্যাত্মবাদী বা ভাববাদী ধ্যানধারণার পরিচয় নেই, তার বদলে এ-গানের মূলে রয়েছে অন্নকামনাই : শ্রব মানে অন্ন এবং সায়ন বলেছেন ব্রহ্মণস্পতি শব্দে ওই ব্রহ্মণ্‌ বলে কথাটি অন্নবাচকই : ব্রহ্মণঃ অন্নস্য পরিবৃঢ়স্য কর্মণো বা পতে পালয়িতঃ। অবশ্যই, ব্রহ্মণস্পতির অর্থ নিয়ে আমাদের পক্ষে পরে দীর্ঘতর আলোচনা তোলবার দরকার পড়বে, কেননা, দেশের ঐতিহ্য অনুসারে এই ব্রহ্মণস্পতি বা বৃহস্পতিই হলেন লোকায়ত-দর্শনের আদিগুরু। তাই, আমরা এই নামটির আলোচনায় পরে ফিরবো। আপাতত বৈদিক সাহিত্যেই গণপতির আদি-রূপটির দিকেই দৃষ্টি রাখা যাক।

বাজসনেয়ী সংহিতায়(৯১) দেখা যায় অশ্বমেধযজ্ঞ প্রসঙ্গে মেয়েরা দল বেঁধে গাইছে :

গণানাং ত্বাং গণপতিং হবামহে।।
প্রিয়ানাং ত্বাং প্রিয়পতিং হবাহমে।।
নিধীনাং ত্বাং নিধিপতিং হবামহে।।
অর্থাৎ,
গণদের মধ্যে তুমি গণপতি, আমরা তোমার যজ্ঞ করি। প্রিয়দের মধ্যে তুমি প্রিয়পতি, আমরা তোমার যজ্ঞ করি। নিধিদের মধ্যে তুমি নিধিপতি, আমরা তোমার যজ্ঞ করি।

ওই গানে নিধি শব্দটির প্রতি দৃষ্টি আবদ্ধ রাখলে সন্দেহ করা যেতে পারে যে, এখানে প্রাগ-বিভক্ত সমাজের,—ব্যক্তিগত সম্পত্তি দেখা দেবার আগেকার পর্যায়ের—স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। মনিয়ার উইলিয়ামস(৯২) বলছেন, সংহিতা সাহিত্যে নিধি শব্দ store, hoard, treasure, ইত্যাদি বুঝিয়েছে; ‘ধা’ ধাতু (to deposit) থেকে শব্দটির নিষ্পত্তি। নিধি বলতে তাই এক জায়গায় জমা করা ধনসম্পত্তি বোঝায়। কিন্তু কার ধনসম্পত্তি? উত্তরযুগের পৌরাণিক সাহিত্য আর আইনের বই থেকে সন্দেহ হয় এ হলো এমন ধনসম্পত্তি যার উপর কারুর ব্যক্তিগত মালিকানা নেই। পৌরাণিক সাহিত্যে(৯৩) সাধারণত ন’জন (কখনো আটজন) নিধির উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের নামগুলিতেই টোটেম-বিশ্বাসের—অতএব আদিম সমাজের—চিহ্ন টিকে রয়েছে : পদ্ম, মহাপদ্ম, শঙ্খ, মকর, কচ্ছপ, ইত্যাদি, ইত্যাদি। পৌরাণিক সাহিত্যে যদিও এই নিধিদের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন করে কুবের বা লক্ষ্মীর অনুচর হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে তবুও অনুমিত হয় এ-কল্পনার পিছনে কোনো-না-কোনো বাস্তব সমাজ-পরিবেশ এককালে ছিলো। কিন্তু তার চেয়েও চিত্তাকর্ষক হলো আইনের পুঁথিগুলির সাক্ষ্য। কেননা, আইনের বই(৯৪) থেকে এটুকু নিঃসন্দেহে প্রমাণ হয় যে, নিধি হলে এমন ধনরত্ন যার উপর কারুর ব্যক্তিগত স্বামিত্ব নেই। অবশ্যই, এ-যুগে আমরা যাকে চিরপ্রনষ্ট স্বামীক (গুপ্তধন?) বলি, মিতাক্ষরা প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত একালের আইনের বইতে নিধি বলতে হয়তো তাই-ই বুঝিয়েছে; কিন্তু এ-কথা কল্পনা করা সত্যিই কঠিন যে, বাজসনেয়ী সংহিতার যুগেও এ-ধরনের গুপ্তধনের বাস্তব সম্ভাবনা ছিলো(৯৫)। তাই, সেকালের স্বামীবিহীন সম্পদকে প্রাচীন সমাজের যৌথ-সম্পদ মনে করবার অবকাশ আছে—উত্তরকালের আইনকর্তাদের রচনাতেও নিধি শব্দ থেকে ব্যক্তিগত মালিকানার অভাবসূচক তাৎপর্যটা মুছে যায়নি। কিন্তু তাঁদের সমাজে এ-হেন সম্পত্তি বলতে যৌথ-সম্পদ নয়—মালিকহীন সম্পত্তি বলতে শুধুমাত্র প্রনষ্টস্বামীক সম্পদ।

সংহিতার এই দুটি উদ্ধৃতিতে আমরা বিশেষ করে দুটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করলাম : প্রথমটিতে প্রাগ-অধ্যাত্মবাদী চেতনার স্মৃতি; দ্বিতীয়টিতে প্রাগ-ব্যক্তিগত-সম্পত্তির পর্যায়ের স্মৃতি। আমাদের মূল যুক্তি অনুসারে দু’-এর মধ্যে যোগাযোগ আছে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিকাশ এবং অধ্যাত্মবাদী চেতনার বিকাশ সম্পর্কহীন নয়। এবং আমাদের কাছেও গণেশ সত্যিই যেন সিদ্ধিদাতা : তাঁর ইতিহাস অনুসন্ধান করতে করতে আমরা সমাজ-বিকাশের এমন এক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে যাই যেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, পরিবার ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়নি এবং সেই সঙ্গেই আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখি, অধ্যাত্মবাদী বা ভাববাদী ধ্যানধারণারও নয়!

তাই, গণপতির প্রসঙ্গ ছেড়ে যাওয়া চলবে না। তাঁরই কথায় ফিরে আসা যাক।

ভারতবর্ষের ইতিহাস একটি আশ্চর্য ঘটনা বারবার চোখে পড়ে। যে-কোনো কারণেই হোক, এদেশে রাষ্ট্রশক্তির অধিনায়কেরা বৈদিক ঐতিহ্যের গরিমা চেয়েছিলেন। এমনকি, অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক কালেও শূদ্র শিবাজী রাষ্ট্রশক্তি লাভ করবার পর কাশী থেকে গার্গভট্ট বলে জনৈক পণ্ডিতকে আনিতে তাঁর সাহায্যে নিজেকে ক্ষত্রিয় বলে ঘোষণা করবার ব্যবস্থা করলেন(৯৬)।

এবং বৈদিক-গরিমা-লোপুপ রাষ্ট্রশক্তির এই অধিনায়কেরাই গণ-সমাজ সম্বন্ধে বিদ্বেষ ও বিতৃষ্ণায় মুখর হয়েছিলেন।

ফলে, ঐ বৈদিক মানুষদেরও যে একটা অতীত ছিলো,—তাঁরাও যে এককালে গণ-সমাজেই বাস করতেন,—এ-কথা আমরা আজকের দিনে প্রায়ই ভুলে যাই। অথচ, তারই স্মৃতি টিকে রয়েছে সংহিতার উদ্ধৃতি দুটির মধ্যে। তাই, আমরা আগে যে যুক্তির উল্লেখ করেছি এখানে তারই পুনরুল্লেখ করা প্রয়োজন : আর্য-অনার্য মতবাদের সাহায্যে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ব্যাখ্যা করবার চেষ্টায় একটা বিপদ হলো, ওই আর্যদেরই অতীত ইতিহাসটাকে ভুলে যাবার বা ভুল বোঝবার সম্ভাবনা থাকে। কেননা, আর্যদের রচনায় সেই অতীতের যে-কোনো স্মৃতিচিহ্ন দেখলেই তা অনার্যদের কাছ থেকে গৃহীত হয়েছিলো বলে ব্যাখ্যা করবার ঝোঁক এসে যায়। গণপতির ক্ষেত্রেই ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের রচনা এই ঝোঁকের একটি দৃষ্টান্ত : এদেশের অনার্য অধিবাসীদের যেন খুশি করবার জন্যেই বৈদিক আর্যরা অনার্য গণপতিটিকে গ্রহণ করেছিলেন। আমাদের যুক্তি হলো, তা না হতেও পারে। এককালে তাঁরা নিজেদেরই খুশি করবার জন্যে গণপতি নিয়ে গান রচনা করেছিলেন। কেননা, পৃথিবীর বাকি সব মানুষের মতোই এই আর্যরাও এককালে গন-সমাজেই বাস করতেন—তার চিহ্ন বৈদিক সাহিত্য থেকে বিলুপ্ত হয়নি।

সংক্ষেপে : গণপতির ইতিহাসে মোটের উপর তিনটি পর্যায় দেখতে পাওয়া যায়। এক : প্রাগ-বিভক্ত সমাজের স্মৃতি বহন করে এককালে বৈদিক মানুষেরাই গণপতিকে নিয়ে গান রচনা করেছিলেন। দুই : শ্রেণী-বিভক্ত সমাজের রাষ্ট্রশক্তির প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতির গ্রন্থে কৌটিল্য ওই গণ-সমাজের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেন এবং আইনের গ্রন্থে যাজ্ঞবল্ক্য প্রমুখ গণপতিকে দেখলেন বিষনজরে—কেননা, সারা ভারতবর্ষ জুড়ে সামাজিক পরিবর্তন একতালে ঘটেনি, শ্রেণীসমাজের আশপাশেই বেঁচে ছিলো প্রাক-বিভক্ত গণসমাজ। তিন : বহু বিনায়কের মধ্যে গজাননধারী একটি নির্দিষ্ট বিনায়ক সিদ্ধিদাতা দেবতা হিসেবে ঘোষিত হলেন এবং বহুভাবে তাঁর এই নব রূপটির প্রচার করা হলো। গণপতির ইতিহাসের এই তিনটি পর্যায়ের সঙ্গে আদিম সাম্যসমাজ থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি পর্যন্ত সুদীর্ঘ সমাজ-ইতিহাসের সম্পর্ক রয়েছে। শুধু তাই নয়। সম্পর্ক রয়েছে লোকায়তিক চেতনার স্তর থেকে অধ্যাত্মবাদের বিকাশ পর্যন্ত ধ্যানধারণার ইতিহাসেরও।

গণপতিরই আর একটা নাম হলো লোকবন্ধু, লোকনাথ(৯৭)। লোকায়তিক ধ্যানধারণার উৎস-সন্ধানে আমরা তাই এই লোকবন্ধুরই পদাঙ্ক অনুসরণ করবার পণ করেছি। সে-পথে এগোতে গেলে সর্বপ্রথম নিশ্চয়ই প্রশ্ন তুলতে হয় : গণ মানে কী? কেননা গণনায়ক শুধুই গণের নায়ক নন, তাঁর একটি নামই হলো গণ—শুধু গণ। তাই গণের রহস্য না বুঝলে গণনায়কের রহস্য বোঝা যাবে না।

———————–
৮৮. ক্ষিতিমোহন সেন : জাতিভেদ ৬৪।
৮৯. H. Mitra op. cit. 1935, 104.
৯০. ঋগ্বেদ ২.২৩.১।
৯১. বাজসনেয়ী সংহিতা ২৩.১৯।
৯২. M. Monier-Williams op. cit. 548.
৯৩. Ibid.
৯৪. বিশ্বকোষ ১০.১২৬-৭।
৯৫. এই গ্রন্থের চতুর্থ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
৯৬. H. P. Shastri AV 2.
৯৭. ক্ষিতিমোহন সেন : জাতিভেদ ৬৪।