প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০৭. বিঘ্নরাজ থেকে সিদ্ধিদাতা

বিঘ্নরাজ থেকে সিদ্ধিদাতা

শাসকসম্প্রদায়ের মুখপাত্ররা এককালে গণেশের প্রতি যে-বিদ্বেষ প্রকাশ করেছিলেন তার আরো কিছু নমুনা সংগ্রহ করা অসম্ভব নয়। কিন্তু গণেশের অভিজ্ঞাওতাতেই তার চেয়েও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটতে দেখা গিয়েছে। কেননা, এককালে যিনি ছিলেন ওই রক্তকলুষিত বিঘ্নরাজ আর এককালে তিনিই খোদ সিদ্ধিদাতা সেজে বসলেন, সমাজের সদরমহল এককালে যাঁর ভয়ে আতঙ্কিত ছিলো আর এককালে দেখা গেলো তাঁকেই বরণ করে নিচ্ছে আভিজাতিক দেবদেবীদের জমকালো সভায়।

কিন্তু খোদ বিঘ্নরাজকে একেবারে সিদ্ধিদাতা করে তোলা যেন এক অসম্ভবকে সম্ভব করবার চেষ্টা। তাই, দরকার পড়লো গণেশের এই নব্যরূপকে প্রচার করবার অজস্র তোড়জোড়। ওই প্রচার-প্রচেষ্টা অবশ্যই সার্থক হয়েছে। গণেশের সেই ভয়াবহ রূপটিকে ভুলে গিয়ে আজকের দিনে আমরা শুভকর্মের সূচনায় তাঁরই আশীর্বাদ অপরিহার্য মনে করি।

গণেশের এই নব্যরূপের প্রচার বহুমুখী ও ব্যাপক। শুধুমাত্র সাহিত্যের ক্ষেত্রেই তার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় দিতে হলে হয়তো ছোটোখাটো একটি পুঁথি রচনা করা প্রয়োজন।

দেশের পুরাণগুলি গণেশের মাহাত্ম্যে মুখর হয়ে উঠলো। বিশেষ করে দুটি পুরাণে—ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে ও স্কন্দপুরাণে(৬৫),—গণেশ জুড়ে বসলেন সুদীর্ঘ স্থান। স্কন্দপুরাণ(৬৬) গণেশকে অবতার বলে ঘোষণা করলো। গণপতি-তত্ত্ব(৬৭) বলে আর একটি গ্রন্থে আরো এক-পা এগিয়ে গিয়ে বলা হলো গণেশও যা আর উপনিষদের ব্রহ্মও তাই। শুধুমাত্র গণেশের মাহাত্ম্য প্রচার করবার আশাতেই রচিত হলো একটি উপপুরাণ ও একটি নতুন উপনিষদ—গণেশপুরাণ ও গণেশউপনিষদ(৬৮)। এমনকি, একথাও হয়তো বলা যায় যে, অনেক সময়ই প্রচারের প্রচেষ্টাটা সচেতন। কেননা, নারদপুরাণের গণেশস্তোত্রে(৬৯) লেখা আছে :

অষ্টানাং ব্রাহ্মণানাং চ লিখিত্বা যঃ সমর্পয়েৎ।
ভস্য বিদ্যা ভবেৎ সদ্য গণেশস্য প্রসাদতঃ।।

–মোদ্দা কথায়, স্তোত্রটি লিখেলিখে বিলি করতে হবে। অনেকটা আধুনিক কালের হ্যাণ্ডবিল বিলি করবার মতোই নয় কি?

অবশ্যই, এখন থেকে গণেশকে আর অপর কোনো আভিজাতিক দেবদেবীর পায়ের তলায় নিপীড়িত হতে দেখবার কথা নয়। কেননা, গণেশ নিজেই আভিজাতিক হয়ে উঠেছেন, তাঁর মূর্তিতে জমকালো অলঙ্কার দেখা দিলো। কিন্তু এইখানে একটি খুব জরুরী কথা মনে রাখা দরকার, কথাটি আনন্দকুমার কুমারস্বামী(৭০) আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন : ভারতীয় ভাস্কর্যের ইতিহাসে গণেশের এ-হেন মূর্তি একটি নির্দিষ্ট যুগ থেকে হঠাৎ দেখা দিতে শুরু করেছে। এবং কুমারস্বামীই বলছেন, গণেশের এই আবির্ভাব যেমন আকস্মিক তেমনি বহুল।

কিন্তু গণেশের এই নব্যরূপের প্রচার যতোই জমজমাট হোক না কেন, এরই মধ্যে যেন কয়েকটি ফাটল থেকে গিয়েছে। সেই ফাটলগুলির ভিতর দিয়ে উঁকি মারলে স্পষ্টই বুঝতে পারা যাবে সমস্ত প্রচেষ্টাটুকুই কী রকম কৃত্রিম! এখানে দু’-একটা নমুনার উল্লেখ করবো।

খাপছাড়াভাবেই গণপতির বিদ্যা ও জ্ঞানের গৌরব প্রচার করতে শুরু করা হলো। নজির হিসেবে বলা হলো, ব্যাসদেব যখন মহাভারত রচনা করেন তখন লিপিকার হিসেবে গণেশ ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায়নি। অথচ, এই কাহিনী মহাভারত রচিত হবার অনেক পরের রচনা, এতএব কৃত্রিমভাবে কোনো এক সময়ে মহাভারতের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রমাণ : মহাভারতের শুধুমাত্র উত্তর-ভারতীয় সংস্করণে এই গল্পটি দেখতে পাওয়া যায়, দক্ষিণ-ভারতীয় সংস্করণে গল্পটি নেই। এ-বিষয়ে উইনটারনিৎস-এর আলোচনা(৭১) দ্রষ্টব্য।

আর একটা নমুনা : গণেশকে জ্ঞানিশ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করতে হলে তাঁর মুখে খুব গুরুগম্ভীর দার্শনিক কথাবার্তা বসিয়ে দেওয়া দরকার। সচেতনভাবে এই চেষ্টা থেকে হোক আর নাই হোক, উত্তরযুগে দেখা যায় গণেশগীতা বলে একটি পুঁথি রচিত হলো। কিন্তু পুঁথিটি যে কতোখানি কৃত্রিম তা বুঝতে পারাও কঠিন নয় : গণেশগীতা আগাগোড়াই শ্রীমদ্ভাবগতগীতাই—তফাতের মধ্যে শুধু, কৃষ্ণের বদলে কোনোমতে গণেশের নামটি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে(৭২)।

তার মানে, গণেশের বিদ্যাবুদ্ধির খ্যাতিটা গণেশের তুলনায় অনেক অর্বাচীন, পরের যুগের রচনা। এই কথাটি স্পষ্টভাবে মনে রাখেননি বলেই আধুনিক কালের অনেক বড়ো বড়ো বিদ্বানও এ-বিষয়ে কৃত্রিম ও বিচারবিরুদ্ধ মতবাদ দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছেন। মনিয়ার-উইলিয়মস(৭৩) বলছেন, গণেশের বুদ্ধিটা যে কতোখানি তা বোঝাবার জন্যেই তাঁর অমন এক হাতির মাথা কল্পনা করা হয়েছে। হাতির মাথার তাৎপর্য নিয়ে পরে আলোচনা তোলা যাবে এবং আমরা আগেই বলেছি গণেশের রকমারি নাম দেখেই সন্দেহের অবকাশ রয়েছে হাতির মাথাটা তাঁর আদি ও অকৃত্রিম অঙ্গ না হতেও পারে। আপাতত মন্তব্য হলো, হাতির সঙ্গে জ্ঞানের আনুষঙ্গ ভারতীয় ঐতিহ্যে যদিই বা থাকে তাহলেও তার স্থান নিশ্চয়ই গৌণ।

স্যর ভাণ্ডারকর(৭৪) বলছেন, গণেশের বিদ্যাবুদ্ধির খ্যাতিটা খুব সম্ভব তাঁর নামের সঙ্গে বৃহস্পতির নামের যোগাযোগের দরুনই। অবশ্যই, গণেশের নামের সঙ্গে বৃহস্পতির নামের যোগাযোগ নিয়ে আলোচনা তোলা দরকার : ওই যোগাযোগ এবং অন্যান্য তথ্য থেকেই দেখতে পাওয়া যায় গণেশের ইতিহাস কতো—কতো পুরোনো। সিদ্ধিদাতা হিসেবে ঘোষিত হবার আগে,—এমনকি বিঘ্নরাজ হয়ে আতঙ্ক সঞ্চার করবার অনেক আগে,—ভারতের ইতিহাসে গণেশ দেখা দিয়েছিলেন এক আশ্চর্য রূপে : না বিঘ্নরাজ, না সিদ্ধিদাতা। সে-ইতিহাসের কথায় একটু পরেই ফেরা যাবে। আপাতত, স্যর ভাণ্ডরকরের মন্তব্য সম্বন্ধে আমাদের মন্তব্য হলো, তিনি নিজেই বলছেন মানবগৃহ্যসূত্র এবং যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতি অনুসারে গণেশের দৃষ্টি পড়লে আচার্য্যের শিষ্য জোটে না, বিদ্যার্থীর বিদ্যালাভ হয় না। তাই গণেশের বিদ্যাবুদ্ধির খ্যাতিটা সূত্র ও স্মৃতি সাহিত্যের অনেক পরের যুগে রচিত হয়েছে। অতএব এই খ্যাতি যে বৈদিক-সাহিত্যে ঘোষিত তাঁর সঙ্গে বৃহস্পতির সম্পর্কেরই রেশ—এ-কথা বললেও মাঝখানের যুগটিতে গণেশের প্রকট বিদ্যাবিরোধিতা যে কেন সে-প্রশ্নের মীমাংসা বাকি থেকে যায়।

—————–
৬৫. ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এবং স্কন্দপুরাণের গণেশখণ্ড।
৬৬. বিশ্বকোষ ৫:২০২।
৬৭. ঐ : “গণপতিতত্ত্ব নামক গ্রন্থের মতে গণেশই পরব্রহ্ম”…।
৬৮. A. Getty G 5.
৬৯. Ibid—Quotations in Title pages.
৭০. A. Coomarswamy BBMFA 26 (1928) 30—“the figure of Ganesa appears suddenly and not rarely in the Gupta period.” cf. P. V. Kane HD 2:215 & 725.
৭১. JRAS April, 1898. cf. A. Coomarswamy. BBMFA 26 (1928)—30; A. Getty G. 3.
৭২. ERE 6:175.
৭৩. M. Monier-Williams SED 343: “and to denote his sagacity, has the head of an elephant.”
৭৪. R. G. Bhandarkar VS 149.