প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০২. তেত্রিশকোটি দেবদেবীর কথা

তেত্রিশকোটি দেবদেবীর কথা

আমাদের মন আমাদের অতীত সম্বন্ধে একটা গর্বের ভাব নিশ্চয়ই রয়েছে। এবং নানান রকম প্রচারের ফলে এ-গর্ব প্রধানতই আমাদের আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য নিয়ে। তাই, হেগেলের ওই অধ্যাত্মবাদী সমালোচনাটা আমাদের অনেকেরই মনঃপুত হবে না।

হেগেলের তরফ থেকে কিন্তু তর্ক তুলে বলা যাবে, এ-দেশে অন্তত তেত্রিশকোটি দেবদেবীর ভিড় রয়েছে। তাঁদের বাদ দিয়ে দেশের কথাটা তো সত্যিই বোঝা যায় না! আর, ওই তেত্রিশকোটি দেবদেবী থেকেই প্রমাণ হয়, এ-দেশে মানুষ যা-কিছু সামনে পেয়েছে তাকেই একেবারে ভগবান বলে আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করেছে : সূর্য, চন্দ্র, জানোয়ার, ফুল্ম সবকিছুই! তাই, একে একরকম ঘোরের দশাই বলতে হবে। স্বপ্নের ঘোর। শুধু তাই নয়, ওই ঘোরের মধ্যে একেবারে বিলীন হয়ে যাওয়াও।

তেত্রিশকোটি দেবদেবী! সত্যিই তো, ভিড় বড়ো কম নয়। কে যেন বলেছিলো, এ-দেশে মানুষের চেয়েও দেবতারা দলে ভারি। কথাটা অবশ্যই রসিকতা, হেগেলের মতো প্রগাঢ় দার্শনিকতা নয়। তবুও, রসিকতা হলেও উড়িয়ে দেওয়া চলে না। হিসেবে তার প্রমাণ রয়েছে। হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে, ষোড়শ শতাব্দীতে(৪) ভারতবর্ষের জনসংখ্যা মাত্র দশকোটির মতো হচিলো আর দেবতারা যে তখন দলে কম-ভারি ছিলেন তা নিশ্চয়ই ভাবা যায় না। এমনকি, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাশেষি(৫), যখন সর্বপ্রথম দেশের মানুষ ভালো করে গুনে দেখা হলো তখন, দেখা গেলো মানুষের সংখ্যা মোটের উপর পঁচিশ কোটির চেয়ে সামান্য বেশি। তেত্রিশকোটির পাশে পঁচিশ কোটি নিশ্চয়ই খুব একটা জাঁকালো সংখ্যা নয়।

দেশের শাসকেরা এই ভিড় নিয়ে স্বভাবতই বিব্রত ও বিরক্ত হন। কিন্তু, অন্তত আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, তাঁদের মনোভাবে একটি বিরোধ থেকে গিয়েছে। কেননা, শাসকসম্প্রদায়ের বিরক্তিটা একান্তভাবেই ভিড়ের ছোটো অংশটুকু সম্বন্ধেই, সংখ্যালঘু ওই মরলোকের মানুষগুলি সম্বন্ধেই। ঐশী বাসিন্দারা দেশের ভিড়কে যতো অসহ্যই করে তুলুন না কেন তাঁদের সম্বন্ধে শাসকসম্প্রদায়ের বিরক্তি নেই, বরং একটা প্রকাশ্য শ্রদ্ধাভক্তির ভাবই দেখা যায়(৬)

অবশ্যই, ভালো করে বিচার করলে শাসকদের এই আপাত-বিরোধী মনেওভাবের ন্যায়সঙ্গত তাৎপর্য বোঝাবার ব্যাপারে তাঁদের তরফ থেকে ক্লান্তির পরিচয় পাওয়া যায়নি।

রক্তমাংসে-গড়া এই সংখ্যালঘুর দল নির্বিচারে বংশবৃদ্ধি করে, সন্তানের জন্ম দেয় বেপরোয়ার মতো। বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আনিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করে দেওয়া হচ্ছে(৭), এরই দরুন দেশের বুকে অভাব-অনটনের বন্যা না বয়ে পারে না। এ যে অর্থনীতির এক অমোঘ বিধান : খাইয়া মানুষের সংখ্যা বাড়লে খাবারে ঘাটতি পড়বেই। অথচ, কার্যকারণসম্পর্ক সম্বন্ধে অন্ধ ওই প্রাকৃতজনেরা একদিকে সেকালের বামাচারীদের মতোই প্রজনন-উৎসাহী এবং অপরদিকে লোকায়তিকদের মতোই অমৃত বদলে অন্নকেই পুরুষার্থ মনে করছে। ফলে, একালেও সন্তান-উৎপাদনের সঙ্গে খাদ্য-উৎপাদনের প্রসঙ্গ না উঠে পারছে না। দাবি উঠছে, দেশের উৎপাদন-পদ্ধতিকে উন্নততর করতে হবে—অনাবাসী জমিকে আবাদ-যোগ্য করে তুলতে হবে, আবাদী জমিতে চাষবাদের মামুলি আয়োজনটুক নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা চলবে না, দেশের বুকে গড়ে তুলতে হবে আধুনিক কলকারখানা। দেশের মানুষ যদি সংখ্যায় সত্যিই বাড়ে তাহলে সমাধানটা অনাহার নয়, খামারের আয়োজন বাড়ানোই।

কিন্তু, উৎপাদন-পদ্ধতির সঙ্গে শাসন-ব্যবস্থারও যোগাযোগ রয়েছে। ফলে, এ-জাতীয় দাবী শাসক-সম্প্রদায়ের সুনিশ্চিত শান্তিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। তাই দেখা দেয় বিরক্তিও। তুলনায় কিন্তু ঐশী বাসিন্দারা দলে যতোই বেশি হোন না কেন, এরকম বিরক্তিজনক পরিস্থিতি মোটেই সৃষ্টি করেন না। দেশের উৎপাদন-পদ্ধতিকে উন্নততর করবার বদলে বরং পিছিয়ে-পড়ে থিতোনো আবহাওয়াই তাঁদের পক্ষেও নিরাপদ। দেশের জনসাধারণ যাতে নিজেদের দুঃখদৈন্যকে নিজেদেরই কর্মফল বলে মেনে শুধুমাত্র নিজেদের কপালেই করাঘাত করতে শেখে এ-চেষ্টাতেও তাঁরা উদাসীন নন। ফলে, দেশের শাসক-সম্প্রদায়ও এঁদের সম্বন্ধে বিরক্তির বদলে শ্রদ্ধাভক্তিই প্রচার করতে চায়।

———————-
৪. Moreland IDA 22; R. P. Dutt IT 48.
৫. Census of 1871-2 cf. W. W. Hunter IGI 4:164-5.
৬. যথা, Queen’s Proclamation of 1858. See R. P. Dutt IT 286-7. cf. H. Maine VCEW 46.
৭. এ-জাতীয় প্রচারের চুড়ান্ত জবাব হিসেবে Castro GH দ্রষ্টব্য।