প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

২১. কামগান মানে কী?

কামগান মানে কী?    

আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি, ছান্দোগ্যের ঋষি বলছেন…‘সেইজন্য এইরূপ জ্ঞানসম্পন্ন উদ্গতা বলবেন, তোমার কোন কাম্যবস্তু লাভের জন্য গান করবো? যিনি এই প্রকার জেনে সামগান করেন তিনি গানের দ্বারা কাম্যবস্তু লাভ করতে সমর্থ হন।’

প্রাচীন পুঁথিতে লেখা রয়েছে, কামম্‌ আগায়ানি।

প্রাচীন পুঁথিতে লেখা রয়েছে, কামগানস্য।

প্রাচীন সমাজের কোন লক্ষণ থেকে এই কথাগুলির তাৎপর্য উদ্ধার করা সম্ভব? এই জাতীয় উক্তি সমাজ-বিকাশের প্রাচীন পর্যায়ের কোন ধরনের স্মৃতি বহন করছে?

আজো পৃথিবীর নানা জায়গায় যে-সব মানুষের দল সমাজ-বিকাশের প্রাচীন পর্যায়ে পড়ে রয়েছে তাদের লক্ষ্য করলে এ-প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেতে পারে। এবং তাদের দৃষ্টান্ত আলোচনা করে আধুনিক গবেষক বলছেন, প্রাচীন সমাজে নাচগানের মূলে ছিলো যাদুবিশ্বাস : মানুষ যে-কামনাকে সফল করতে চেয়েছে নাচের মধ্যে গানের ভাষায় তারই সফলতার ছবি ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা করেছে। মাওরি মেয়েদের আলু-নাচের সময় তাই পুবহাওয়ার আর ফুলফোটার আর ফসলফলার অনুকরণ; ফসল যাতে এলোচুলের মতো গোছাগোছা হয় সেই আশায় মেক্সিকোর মেয়েরা কোজাগর পূর্ণিমায় তাই এলোকেশী হয়। এই যাদুবিশ্বাসটির বর্ণনা হিসেবে অধ্যাপক জর্জ টমসন(১২৬) বলছেন :

The desired reality is described as though already present.
অর্থাৎ, এক কথায়, কামনা সফল হবার ছবিটি ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা।

প্রাচীন মানুষদের এই যাদুবিশ্বাসকেই মূলসূত্র হিসেবে গ্রহণ করে প্রাচীন সাহিত্যের ‘কামগান’ কথাটিকে বুঝতে হবে : প্রাচীন সমাজে কামনা ছাড়া গান হয় না, কেননা, ওই কামনাকে সফল করে তোলবার কল্পনাই হলো প্রাচীন সংগীতের প্রাণবস্তু।

ছান্দোগ্য-উপনিষদে কুকুরদের সামগান এই বিষয়টিরই মূর্ত উদাহরণ। তাদের ক্ষিদে পেয়েছিলো, তারা তাই অন্নের আশায় গান চেয়েছিলো। তাই, তাদের গানটিও হলো : ওম্‌ অদাম, ওম্‌ পিবাম…। আমরা ভোজন করি, আমরা পান করি…।

আজকালকার গানের মতো এ-গান একজনে গাইবে আর দশজনে শুনবে—তা নয়। দশজনে এক হয়ে একসঙ্গে গাইবে। কেননা, বাংলার প্রাচীন ব্রতগুলির মতোই এ-গানেরও মূল কথা হলো একটি কামনা এবং ‘একের কামনা দশের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে একটা অনুষ্ঠান হয়ে’ ওঠা।

———————-
১২৬. G. Thomas SAGS 453.