প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

২০. গান আর নাচ

গান আর নাচ

সমাজের পুরোনো পর্যায়ে গান কিন্তু শুধু গান নয়। আর সঙ্গে নাচেরও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ : কামনা সফল হবার ছবিটা মানুষ শুধু কথায় নয়, কাজের মধ্যেও ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছে। মাওরি মেয়েদের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছি : গান ছাড়াও ওরা নাচের মধ্যেই পুব-হাওয়ার আর ফুল ফোটার আর ফসল ফলার অনুকরণ করছে, আর ভাবছে এরই দরুন পাওয়া যাবে ফসল। শস্‌পাতার ব্রতের বেলাতেও একই কথা : ভাঁজোকে কলকলিয়ে তোলবার কামনায় মেয়েদের গান, কিন্তু শুধু গানই নয়—ইন্দ্রদ্বাদশীতে তোলবার কামনায় মেয়েদের গান, কিন্তু শুধু গানই নয়—ইন্দ্রদ্বাদশীতে রাতভোর চাঁচের আলোয় তাদের নাচও। বস্তুত, আজো পৃথিবীর আনাচে-কানাচে যে-সব মানুষের দল সমাজ-বিকাশের পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ে পড়ে রয়েছে তাদের মধ্যে নিছক গান বলে কিছুই চোখে পড়ে না। তার বদলে দেখা যায় গানে-নাচে মেশা এক অনুষ্ঠান, যার প্রেরণা যাদুবিশ্বাসে, যার উদ্দেশ্য কাজ। নাচের সঙ্গে গানের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়েছে সমাজ-বিকাশের অনেক পরের পর্যায়ে, আরো পরের পর্যায়ে গানের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়েছে সুর—তখন থেকেই আজকালকার অর্থে কবিতার জন্ম। এ-বিষয়ে অধ্যাপক জর্জ টমসনের সিদ্ধান্তগুলি(১১৬) নিদিধ্যাসিতব্য। মনে রাখা দরকার, ভূয়োদর্শনের ভিত্তিতেই তাঁর ওই সিদ্ধান্তগুলি প্রতিষ্ঠিত।

কিন্তু ছান্দোগ্যের সামগান-রত কুকুরগুলির বেলায় কী রকম? সমাজ-বিকাশের যে-পর্যায়ের মানুষ বলে ওদের সনাক্ত করতে হলো সে-পর্যায়ে গান নিছক গান হবার কথা নয়। নিছক গান অবশ্য নয়; তার সঙ্গে কামনার যোগ রয়েছে, কাজের যোগ রয়েছে। কিন্তু নাচের যোগ? সে-বিষয়ে উপনিষদের লেখায় কি কোনোরকম ইঙ্গিত পাওয়া যায়?

উপনিষদে লেখা আছে, গান শুরু করবার ঠিক আগেই ওরা বহিষ্পবমানের অনুকরণে পরস্পরের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে সর্পিল গতিতে ঘুরেছিলো : তে হ যথৈবেদং বহিষ্পবমানেন স্তোষ্যমাণাঃ সংরব্ধাঃ সর্পিন্তীত্যেবম্‌আসসৃপুস্তে। এর মধ্যে ওই সংরব্ধা শব্দটিকে আশ্রয় করেই আধুনিক টীকাকারেরা খোদ মানুষগুলিকে কেমনভাবে একেবারে কুকুর বানিয়ে দেবার উপক্রম করেছিলেন সে-কথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। এবং অর্থবিপর্যয়ের এই আশঙ্কা দেখেই আমরা সিদ্ধান্ত করেছি, আধুনিক ধ্যানধারণাকে অবলম্বন করে প্রাচীন সাহিত্যের অর্থ নির্ণয় করতে অগ্রসর হবো না।

সে-অভিজ্ঞতার কথা মনে রাখলে কিন্তু ‘যথৈবেদং বহিষ্পবমানেন স্তোষ্যমাণাঃ’ শব্দগুলির অর্থবিচার করবার সময়েও আধুনিক কালের ধারণার উপর একান্তভাবে নির্ভর করতে যাওয়া ভুল হবে। অর্থাৎ, পরবর্তীকালে বহিষ্পবমানেন স্তোষ্যমাণাঃ বলতে কী বুঝিয়েছে তা জানা থাকলেই ছান্দোগ্যের আলোচ্য অংশে শব্দগুলি কী বোঝাচ্ছে সে-বিষয়ে নিঃসন্দেহে কোনো কথা বলবার জোর থাকবে না। কেননা, এমন তো হতেই পারে যে, আদিকালের অর্থটা অন্যরকম ছিলো এবং আলোচ্য চিত্রটিতে আদিকালের পরিস্থিতিই প্রতিবিম্বিত হয়েছে।

অবশ্যই, এ-বিষয়ে দীর্ঘতর আলোচনা তোলবার অবকাশ আমরা এখানে পাবো না। কেননা, তাহলে বৈদিক সাহিত্যে যজ্ঞ, ছন্দ ইত্যাদি কথাগুলির আদি তাৎপর্য অনুসন্ধানে অগ্রসর হতে হয়। ‘দ্বিজ’ নামের পরিচ্ছেদে সে-চেষ্টা করবার আগ্রহ রইলো। এখানে সামান্য কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা যায়।

প্রথমত, পরের যুগে বহিষ্পবমান স্তোত্রের মানে যাই দাঁড়াক না কেন, আদিযুগে তা পার্থিব সম্পদের কামনার গান ছাড়া আর কিছুই নয়। “যাহা গান করা যায়, তাহার নাম স্তোত্র”। বহিষ্পবমান স্তোত্র কোন গান? সামগায়ী ঋত্বিকেরা ঋগ্বেদের নবম মণ্ডলের একাদশ সূক্ত গান করেন; ওই সূক্তটি যখন গীত হয় তখন তার নাম বহিষ্পবমান স্তোত্র। এখন ঋগ্বেদের ওই সূক্তটি যখন গীত হয় তখন তার নাম বহিষ্পবমান স্তোত্র। এখন ঋগ্বেদের ওই সূক্তটি যদি পড়ে দেখেন তাহলে দেখবেন তার মধ্যে অধ্যাত্মবাদের ছিটেফোঁটাও নেই। এই সূক্তে নয়টি মন্ত্র রয়েছে, এবং নবম মন্ত্রটিতেই সূক্তের চরম কামনা প্রকাশ করে বলা হচ্ছে :

হে ক্লেদবিশিষ্ট পবমান সোম! তুমি ইন্দ্রের সহিত আমাদিগকে সুন্দর বীর্যযুক্ত ধন দান কর।

সূক্তটির আগাগোড়াই এই রকম পার্থিব কামনা।

অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে, এ-গান তো আর শুধু গলা ছেড়ে গাইবার গান নয়; সোমযজ্ঞের এক নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে গাইবার গান এবং যজ্ঞ মানেই পরলোকতত্ত্ব, অধ্যাত্মবাদ। কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে, প্রাচীনেরাই এ-ধরনের কথা জোর গলায় বলতে বারণ করে গিয়েছে। কেননা, যদিও উত্তরযুগে যজ্ঞ    বলতে স্বর্গাদির কামনামূলক ক্রিয়াকাণ্ডকেই বুঝিয়েছে তবুও যজ্ঞের আদি-অর্থ নিশ্চয়ই তা ছিলো না। একটি প্রমাণ উদ্ধৃতি করা যাক। ঐতরেয়-ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে,—এবং এক-আধবার নয়, বারবার বলা হয়েছে,—

যজ্ঞ দেবগণের নিকট হইতে, আমি তোমাদের অন্ন হইব না, ইহা বলিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন। দেবতারা বলিলেন,—না, তুমি আমাদের অন্নই হইবে। দেবতারা তাঁহাকে (যজ্ঞকে) হিংসা করিয়াছিলেন…(১১৭)

কিংবা,—

একদা যজ্ঞ ভক্ষ্য অন্ন সমেত দেবগণের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন। দেবগণ বলিলেন, যজ্ঞ ভক্ষ্য অন্ন সমেত আমাদের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছেন এই যজ্ঞের অনুসরণ করিয়া আমরা অন্নেরও অনুসরণ করিব। তাঁহারা বলিলেন, কিরূপে অম্বেষণ করিব? ব্রাহ্মণদ্বারা ও ছন্দোদ্বারা (অম্বেষণ) করিব।…

ঐতরেয় ব্রাহ্মণেই দেখা যায় কী ভাবে ব্রহ্ম ও ক্ষত্র পলায়মান যজ্ঞের অনুসরণ করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মই (ব্রাহ্মণ-ই?) যজ্ঞকে ধরে ফেলেন।(১১৮)

এই উপাখ্যান এবং ব্রাহ্মণ-সাহিত্যের এই জাতীয় উক্তিগুলির তাৎপর্য অবশ্যই বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা দরকার। কেননা, এই ব্রাহ্মণ-সাহিত্যের যুগ থেকেই আদিম প্রাগ-বিভক্ত সমাজ বদলে শ্রেণীসমাজ ফুটে অঠবার লক্ষণ স্পষ্ট হতে দেখা যায়—এ-যুগে অনাহারের তাড়নায় মানুষ নিজের ছেলে বেচতে শুরু করেছে(১১৯)। আমরা এ-আলোচনায় পরে ফিরবো। আপাতত দেখা যাক উদ্ধৃত অংশগুলিতে কী কী কথা বলা হয়েছে :

এক : প্রাচীনেরাই লিখছেন, ব্রাহ্মণের পরবর্তী যুগে যজ্ঞ বলতে যা বুঝিয়েছে তা যজ্ঞের আদি-অর্থ নয়। পরবর্তী যুগের যজ্ঞ হলো আদি-যজ্ঞের নবাবিষ্কৃত সংস্করণ এবং এ-আবিষ্কার ব্রাহ্মণ-বর্ণের কীর্তি।

দুই : প্রাচীনেরাই লিখছেন, যজ্ঞের আদি-তাৎপর্য ছিলো দেবগণের পক্ষে অন্নের যোগান দেওয়া। তাই যজ্ঞের সঙ্গে পরলোকাদির যে-সংশ্রব তা নিশ্চয়ই পরবর্তী যুগের অবদান। আদি-যুগে যজ্ঞের তাৎপর্যটুকু নেহাতই পার্থিব। কেননা, ব্রাহ্মণগ্রন্থটিতে স্পষ্টই বলা হচ্ছে, দেবতাদের কাছে যজ্ঞই ছিলো ভক্ষ্য অন্ন লাভের উপায়। ‘ভক্ষ্য অন্নে’র অর্থ নিশ্চয়ই অস্পষ্ট নয়; প্রশ্ন হলো : যজ্ঞের আদি-অর্থ কী? যার সাহায্যে ভক্ষ্য অন্ন পাওয়া যায়, যা চলে গেলে ভক্ষ্য অন্নও চলে যায়, যাকে ফিরে পাবার চেষ্টার মধ্যেই ভক্ষ্য অন্নকেও ফিরে পাবার আশা, তারই নাম যজ্ঞ হয় তাহলে এই যজ্ঞকে অন্ন-উৎপাদনের বা অন্ন-আহরণের কৌশল ছাড়া আর কী হলা যেতে পারে? তাই, পরের যুগে যজ্ঞ শব্দের অর্থ যাই দাঁড়াক না কেন অন্তত ঐতরেয় ব্রাহ্মণের সাক্ষ্য থেকে প্রমাণ হয়, কোনো এককালে যজ্ঞ বলতে উৎপাদন-পদ্ধতিই বোঝাতো। যজ্ঞ শব্দের এই আদি-তাৎপর্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি সর্বপ্রথম আকর্ষণ করেন এস. এ. দাঙ্গে : ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্রেণীবিভাগ ও রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত আর্যদের আদিম অবস্থায় যে যৌথ উৎপাদন-পদ্ধতি তারই নাম ছিলো যজ্ঞ(১২০)।

এই সিদ্ধান্তের পক্ষে অন্যান্য প্রমাণের আলোচনায় পরে ফেরা যাবে। আপাতত আমাদের যুক্তির পক্ষে যেটুকু কথা প্রাসঙ্গিক শুধু সেইটুকুই প্রতিই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখা যাক। আমরা বলতে চাই, বহিষ্পবমান স্তোত্র সংযোগে আসর্পণ-ক্রিয়া যজ্ঞে-বিশেষের অঙ্গ,—শুধুমাত্র এই বিষয়ের নজির দেখালেই প্রমাণ হবে না ছান্দোগ্য-উপনিষদের আলোচ্য দৃশ্যে সামগাননিরত কুকুরগুলি অন্ন-উৎপাদন বা অন্ন-আহরণ ক্রিয়া ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে লিপ্ত ছিলো। বরং, আদিম পর্যায়ের এই দৃশ্যটিতে যজ্ঞ-ক্রিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের উল্লেখ থেকেই আরো অবধারিতভাবেই প্রমাণ হয় যে, এখানে আদিম সমাজের উৎপাদন-প্রক্রিয়ারই—বা আরো নিখুঁতভাবে বললে বলা উচিত, অন্ন-আহরণ-ক্রিয়ারই—বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। কেননা, যজ্ঞের আদি-অর্থ উৎপাদন-পদ্ধতি ব্যঞ্জক।

ঐতরেয় ব্রাহ্মণের উদ্ধৃত অংশ থেকে আরো কিছুকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। দেবতারা বললেন, যজ্ঞকে অনুসরণ করেই ভক্ষ্য অন্নেরও অন্বেষণ করতে হবে। কিন্তু কী ভাবে তা করা যায়? ব্রাহ্মণদ্বারা ছন্দোদ্বারা। এই বলে তাঁরা ব্রাহ্মণকে ছন্দোদ্বারা দীক্ষিত করেছিলেন।

এখানে, ব্রাহ্মণ শব্দের আদি-অর্থ সন্ধানে এগোবার অবকাশ নেই।

কিন্তু যজ্ঞের সঙ্গে ছন্দের সম্পর্কমূলক ইঙ্গিতকেও অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। কেননা, আধুনিক নৃতত্ত্ববিদেরা বলছেন, সমাজ-বিকাশের আদিম পর্যায়ে,—যৌথজীবনের আবহাওয়ায়,—ছন্দ ছাড়া উৎপাদন-পদ্ধতি সম্ভবই নয়(১২১)।

চলতি বাংলাতেই তার স্মৃতি নানান ভাবে থেকে গিয়েছে। ছন্নছাড়া বা ছন্দ-ছাড়া কথাটি কোথা থেকে এলো তা ভাষাতত্ত্ববিদেরা ভেবে দেখবেন। তাছাড়াও আমরা বলি : কাজের ছিরি-ছাঁদ। ছিরি হলো শ্রী, সৌন্দর্য। ছাঁদ হলো ছন্দ। তাই, সৌন্দর্য ও ছন্দ কী ভাবে ‘কাজ’-এর বিশেষণ হতে পারে তাও ভেবে দেখা দরকার : “ছিরি-ছাঁদ জিনিসটা আকাশ থেকে পড়েনি। এখানে সমাজের দরকারে। মানুষই তৈরী করেছে এই ছিরি-ছাঁদ। শ্রীর মধ্যে আছে সুন্দর আর মঙ্গল, বাহার আর ব্যবহার। ছন্দের দরুনই এসেছে শ্রী। ছন্দ হলো কাজ। কাজ থেকেই এসেছে সৌন্দর্য আর মঙ্গল”(১২২)।

এখানেও, লোকায়ত-ব্যবহারের সাহায্যে বৈদিক ঐতিহ্যকে বোঝবার সম্ভাবনা থেকে গিয়েছে : “বৈদিক সাতটি ছন্দে তারই পরিচয় পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি ছন্দের নাম থেকেই বাঁচবার আয়োজন আর সেই সঙ্গে সকলে মিলে হাতে হাত লাগিয়ে বাঁচবার ভাবটা আন্দাজ করা শক্ত নয়। বৈদিক ছন্দ আছে সাতটি : গায়ত্রী, বৃহতী, জগতী, উষ্ণিক, পঙতি, ত্রিষ্টুপ, অনুষ্টুপ। এই নামগুলোর পিছনে উৎপাদন-সংক্রান্ত অর্থাৎ মানুষের বাঁচা-সংক্রান্ত কোনো-না-কোনো কাজ না থেকে পারে না!… ‘উষ্ণিক’ কি উড়কিধান না রবিফসল? ‘ত্রিষ্টুপ’ কি ধানকাটা? ‘জগতী’ মানে তো গোরু। ‘গায়ত্রী’ তো বাঁচাবার উপায়। ‘অনুষ্টুপ’ এসেছে সকলের পরে”…(১২৩)।

এই প্রসঙ্গেই আরো মনে রাখা দরকার, বৈদিক ছন্দ শুধুই কাজের ঢঙ নয়, নাচের তালও। মকাঁল্‌ তাঁর “চিন্তা ও ভাষার উৎপত্তি” নামের গ্রন্থে(১২৪) এ-বিষয়ে অজস্র প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। তার আলোচনায় পরে ফিরতে হবে। আপাতত আমাদের যুক্তি হলো, ছান্দোগ্য-উপনিষদের আলোচ্য অংশে “যথৈবেদং বহিষ্পবমানেন স্তোষ্যমাণাঃ সংরব্ধাঃ সর্পন্তীত্যেবম্‌ আসসৃপুন্তে”—প্রাচীন-সমাজ সম্বন্ধে সাধারণভাবে জানতে-পারা তথ্যের আলোয় এই বর্ণনাটুকু অনুসরণ করে কোনো দক্ষ সংস্কৃতজ্ঞ যদি বৈদিক সাহিত্যের আদি-তাৎপর্য সন্ধানে অগ্রসর হন তাহলে তাঁর পক্ষে এর মূলে কোনো নাচের স্মৃতি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব না হতেও পারে। কেননা, আধুনিক নৃতত্ত্বের বহুল তথ্য পর্যালোচনা করে অধ্যাপক জর্জ টমসন(১২৫) নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, যাকে মানব সংস্কৃতির আদি-পর্যায় সংক্রান্ত এক সাধারণ সত্য বলা যায়।

The three arts of dancing, music and poetry began as one. Their source was the rhythmical movement of the human bodies engaged in collective labour.
অর্থাৎ, নাচ গান আর কবিতা—এই তিন রকম চারুশিল্পই শুরুতে এক ছিলো। এ গুলির উৎসে ছিলো যৌথশ্রমে নিযুক্ত মানবদেহের ছন্দ-যুক্ত ক্রিয়া।

এই সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করেই অধ্যাপক জর্জ টমসন প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যের নানান দুর্বোধ্য সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর পদ্ধতি অনুসরন করেই প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের অনেক অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। দক্ষ ভারততত্ত্ববিদেরা যেদিন সে-কাজে হাত দেবেন সেদিন ভারততত্ত্বের ক্ষেত্রে যুগান্তর আসবে। পদ্ধতিটির প্রতি তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার আশাতেই আমরা একটি সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে এ-পদ্ধতির উপযোগিতা দেখাবার চেষ্টা করেছি : দেখা যাচ্ছে ছান্দোগ্য-উপনিষদের ওই আপাত-অর্থহীন অংশটির অনেকখানিই স্পষ্টভাবে বোঝবার পথ পাওয়া যাচ্ছে। এই প্রসংগে বিশেষ করে আরো দুটি বিষয়ের আলোচনা তোলা দরকার : এক, কামগানের তাৎপর্য। দুই, বৈদিক দেবতাদের আদি-রূপ।

—————
১১৬. G. Thomas SAGS ch. 14.
১১৭. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ (রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী) ৫৬।
১১৮. ঐ ২৩৮-৪০ এবং ৪৫০-৫১।
১১৯. ঐ শুনঃশেপের উপাখ্যান। এই গ্রন্থের চতুর্থ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
১২০. S. A. Dange IPCS ch. 2.
১২১. G. Thomas SAGS ch. 14
১২২. সুভাষ মুখোপাধ্যায় : জানবার কথা ৮:৫৮
১২৩. ঐ : ৮:৬৩-৬৪।
১২৪. Moncalm OTS.
১২৫. G. Thomas SAGS 451.