প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১৩. প্রাচীন ভারতীয় পুঁথিতে টোটেম-বিশ্বাসের চিহ্ন

প্রাচীন ভারতীয় পুঁথিতে টোটেম-বিশ্বাসের চিহ্ন

বেদাদি প্রাচীন ভারতীয় পুঁথিপত্রে টোটেম-বিশ্বাসের চিহ্ন যে স্পষ্টভাবেই টিকে রয়েছে এ-কথা বোধ হয় হপকিন্স ছাড়া আর কোনো আধুনিক পণ্ডিত খুব জোর গলায় অস্বীকার করেন না। তাই, বিশেষ করে হপকিন্স-এর যুক্তিটাই এখানে বিচার করা দরকার। ওল্ডেনবার্গ-এর গ্রন্থ সমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলছেন(৮৩) :

Our learned author, who is perhaps too well read in modern anthropology, seems to gibe the absolute dictum that animal names of persons and clans imply totemism. This is no longer a new theory. On the contrary, taken in so universal an application it is a theory already on the wane, and it seems to us injudicious to apply it at random to the Rigveda, As a means of explanation it requires great circumspection, as is evinced by the practice of American Indians, among whom it is a well known fact that animal names not of totemic origin are given, although many of the tribes do have totem-names. For example, in the Rigveda, Cucumber and Tortoise certainly appear to indicate totemism. But when we hear that Mr. Cucumber was so called because of his numerous family we must remain in doubt whether this was not the real reason. Such family events are apt to receive the mocking admiration of contemporaries. Again, Mr. Tortoise is the son of Gritsamada, a name smacking strongly of the sacrifice, a thoroughly priestly name, and it is not his ancestor but his son who is called Tortoise, very likely because he was slow. The descendents of his son will be called “sons of the tortoise”, but there is no proof of totemism; on the contrary, there is here direct evidence that totemistic appearance may be found without totemism. We can scarcely believe that Gritsamada’s ritualistic educated son ever worshipped the tortoise.

Clearly enough, it is in the later literature that one is brought into closest rapport with the anthropological data of the other peoples. This is due to the fact that the more the Hindus penetrated into India the more they absorbed the cult of the un-Aryan nations, and it is from this rather than the refined priestliness of the Rigvedic Aryans that one may get parallels to the conceptions of Cis-Indic Barbarism.

পুরো উদ্ধৃতিটির তর্জমা করবার দরকার নেই, উদ্ধৃতির প্রতিটি যুক্তি খুঁটিয়ে বিচার করবারও নয়। তার বদলে বিশেষ করে নজর করা যাক, বৈদিক সাহিত্যে টোটেম-বিশ্বাসের চিহ্ন অস্বীকার করবার আশায় হপকিন্স কোন ধরনের পাল্টা মতবাদ দাঁড় করবার চেষ্টা করছেন।

উদ্ধৃতির মধ্যেই দু’রকম চেষ্টার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে।

এক : বৈদিক সাহিত্যের যেখানে যেখানে জন্তু-জানোয়ারের নাম থেকে মানুষের নামকরণ করবার ব্যবস্থা দেখা যায় সেখানেই আসল উদ্দেশ্যটা হলো ঠাট্টা-তামাসা। জন্তুটার কোনো একটা লক্ষণের সঙ্গে মানুষটির কোনো লক্ষণ মিলে গেলে মানুষটিকে সেই জন্তুর নাম দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন ধরুন, আজকালকার দিনে কেউ খুব লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটলে তাকে ঠাট্টা করে আমি-আপনি হয়তো বক বলবো, কিংবা প্রচণ্ড গলায় চিৎকার করবার স্বভাব থাকলে বলবো ষাঁড়! তেমনই, হপকিন্স বলছেন, গৃৎসমদের পুত্রটি নিশ্চয়ই গুটিগুটি নড়তেন, আর সম্ভবত সেই কারণেই তাঁকে কাছিম বলা হয়েছে।

কিন্তু, এই মতবাদ মানা সত্যিই মুস্কিল। বৈদিক ঋষিদের রসিকতার উৎসাহটা হপকিন্স-এর মতো প্রবল ছিলো কি না সে-বিষয়ে নিঃসন্দেহ না হলেও হপকিন্স-এর মত অনুসারে অন্তত এটুকু মানতেই হবে যে রসিকতার উদ্দেশ্যে তাঁরা একেবারেই পাত্রাপাত্রজ্ঞানহীন হয়ে পড়তেন এবং বহু ক্ষেত্রেই তাঁরা রসিকতা করতেন জানোয়ারটির সঙ্গে কোনো রকম আপাত-সাদৃশ্যের পরোয়া না করেই। গোতম ঋষির সঙ্গে গোরুর মিল কোথায়, বৎস-র সঙ্গে বাছুরের মিল কোথায়, শুনক ঋষির সঙ্গে কুকুরের মিল কোথায়, মাণ্ডক্যেয় ও কৌশিকের সঙ্গে বাঙাচি আর প্যাঁচার মিল কতটুকু—এ-সব প্রসঙ্গ অবশ্যই প্রাচীন পুঁথিপত্রের কোথাও আলোচনাই হয় নি। না হয় ধরেই নিলাম, উক্ত ঋষিদের সঙ্গে উক্ত জন্তু-জানোয়ারের লক্ষণগত সাদৃশ্য ছিলো এবং তারই প্রচ্ছন্ন উল্লেখ ঋষিদের সম্বন্ধে ওই রকম বিদ্রুপমূলক নামের আড়ালে। কিন্তু তাহলেও ঠিক কোন ধরনের পরিহাস-প্রিয়তায় মেতে সেকালের ঋষিরা বৈদিক শাখাগুলিকে সাপ, ব্যাঙ নাম দিয়েছিলেন, তা বোঝবার মতো কল্পনার দৌড় আমাদের সত্যিই নেই।

দুই : হপকিন্স যেন কিছুটা স্বস্তিবোধ করছেন পরবর্তী যুগের পুঁথিপরে পৌঁছে। কেননা, এখানে টোটেম-বিশ্বাসের চিহ্ন পাওয়া গেলেও তার কলঙ্ক থেকে বৈদিক আর্যদের বাঁচাবার একটা সহজ উপায়ও তিনি পাচ্ছেন : বৈদিক আর্যরা যতোই ভারতবর্ষের গভীরে প্রবেশ করেছিলেন ততোই স্থানীয় অনার্যদের অনেক রকম স্থূল ও প্রাকৃত বিশ্বাস তাদের সাহিত্যেও প্রবেশ লাভ করেছিলো। অর্থাৎ কিনা, টোটেম-বিশ্বাসটির জন্যে দায়ি করে দেওয়া গেলো শুধু ওই ছাই-ফেলতে-ভাঙা-কুলো স্থানীয় অনার্য জাতিগুলোকে।

আর ঠিক এইটেই হলো আর্য-অনার্য মতবাদের আসল ফাঁদ। ঐতিহাসিক ভাবে এ-মতবাদ যে শেষ পর্যন্ত কতোখানি দাঁড়াবে সে-বিষয়ে নিশ্চয়ই সন্দেহের অবকাশ আছে। কিন্তু এই মতবাদই যে বৈদিক মানুষগুলির ইতিহাসকে বুঝতে দারুণ বাধার সৃষ্টি করে সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা, বৈদিক সাহিত্যে এই বৈদিক মানুষগুলিকে সমাজ-বিকাশের যে-পর্যায়েই দেখা যাক না কেন, বৈজ্ঞানিক ভাবে এ-কথা মনে করা অসম্ভব যে তাদের কোনো অতীত ছিলো না—বুঝি শুরু থেকেই তারা সমাজ-বিকাশের ওই পর্যায়ের জীবনযাপন করতো। কেননা, মানবজাতির যে-কোনো শাখার কথাই ভাবা যাক না কেন, পশুর রাজ্য পিছনে ফেলে সভ্যতার পর্যায়ে উঠে আসবার পথে প্রত্যেককেই সমাজ-বিকাশের কয়েকটি নির্দিষ্ট ধাপ পার হতে হয়েছে। কিন্তু আর্য-অনার্য মতবাদ অনেক সময় বৈদিক মানুষদের ওই পিছনে-পড়ে-থাকা পর্যায়গুলিকে অস্বীকার করবার আয়োজন করে। কেননা, বৈদিক সাহিত্যে সে-পর্যায়ের কোনো চিহ্ন দেখলে উক্ত মতবাদের প্রভাবে এগুলিকে অনার্যদের কাছ থেকে গ্রহণ করা বিশ্বাস বলে ব্যাখা করবার প্রলোভন হয়। বৈদিকসাহিত্যে টোটেম-বিশ্বাসের চিহ্নগুলিকে ব্যাখ্যা করবার আশায় হপকিন্স যা বলেছেন তা এই প্রলোভনেরই প্রকৃষ্টতম উদাহরণ। যদিও, বৈদিক সাহিত্যের তুলনায় উত্তর যুগের সাহিত্যে টোটেম-বিশ্বাসের পরিচয় সত্যিই বেশি প্রকট, এ-কথা স্বতঃসিদ্ধ সত্য নয়—হপকিন্স-এর প্রতিজ্ঞাটিও খুব সম্ভব ভ্রান্ত।

কিন্তু হপকিন্স-এর সবচেয়ে হাস্যকর যুক্তি হলো : ঋষি গৃৎসমদের যাগযজ্ঞবিদ পুত্রটি কোনোদিন সত্যিই কাছিম পুজো করেছেন কিনা তা খুবই সন্দেহের কথা। বৈদিক সাহিত্যে টোটেম-বিশ্বাসের চিহ্ন অপ্রমাণ করবার আশায় হপকিন্স এটিকেও একটি মূল্যবান যুক্তি মনে করছেন! অথচ এ-কথা সত্যিই হাস্যকর; কেননা, টোটেম-বিশ্বাসকে ভুল বোঝবার—বা একেবারেই না-বোঝবার—এ হল প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এবং দুঃখের বিষয় যে-সব বিদ্বানেরা বৈদিক সাহিত্যে টোটেম-বিশ্বাসের চিহ্ন স্বীকার করেন তাঁরাও(৮৪) এ-বিশ্বাসের স্বরূপ সম্বন্ধে, এবং বৈদিক সাহিত্যে এ-বিশ্বাসের চিহ্ন খুঁজে পাবার তাৎপর্য সম্বন্ধে, খুব সুস্পষ্ট কোনো ধারণা পাবার চেষ্টা করেন নি।

———————
৮৩. E. W. Hopkins in PAOS-1894. CLIV.
৮৪. Oldenberg ইত্যাদি। A. B. Keith RPVU 46, 47, 49, 54, 74 ইত্যাদি দ্রষ্টব্য।