১. বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়

বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় – শ্রী অতুল সুর

উৎসর্গ

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁদের কাছে নৃতত্ত্ব বিষয় অধ্যয়ন করেছিলাম সেই দুই মনীষী অধ্যাপক হারাণচন্দ্র চাকলাদার ও ড. বিরজাশঙ্কর গুহ মহোদয়গণের স্মরণে নিবেদন

‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু মহাসভা-কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল। বোধহয় নৃতত্ত্ব সম্বন্ধে বাঙলা ভাষায় এইটাই প্রথম বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা। পরবর্তীকালের কর্মব্যস্ততা ও পারিবারিক বিপর্যয়ের মধ্যে এই রচনাটির কথা আমি একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। মাত্র দুই মাস পূর্বে আমার সহকর্মী শ্রীকানাইলাল বসু তাঁর কাছে সংরক্ষিত এই গ্রন্থের একখানা কপি আমাকে প্রত্যর্পণ করেন। তারপর ‘জিজ্ঞাসা’ প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী শ্রীশীশকুমার কুণ্ড মহাশয় এর পুনমুদ্রণের ব্যবস্থা করেন। কালের তিমির গহ্বর থেকে উৎখনিত এই রচনাটির পুনর্মুদ্রণের ব্যবস্থা করে তিনি বিশেষভাবে আমার ধন্যবাদাহ হয়েছেন। বইখানির দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রদত্ত জনসংখ্যাসমূহ আদম শুমারির শেষ অধিগত বিবরণী অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে এবং বইয়ের পঞ্চম অধ্যায়টি নতুনভাবে লিখিত হয়েছে। তা ছাড়া, বইখানি যেমন ছিল তেমনই আছে।

অতুল সুর
২০ কার্তিক, ১৩৮৩

পুনশ্চ

‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ যে পাঠকসমাজের কাছে বিশেষ সমাদর লভে করেছে তা বইখানি অল্পদিনের মধ্যে নিঃশেষিত হয়ে যাওয়া থেকে প্রকাশ পাচ্ছে। এই সংস্করণে মানুষের দৈহিক গঠনে জীবকণা। (Genes) ও প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural selection)-এর প্রভাব ও নৃতাত্ত্বিক পর্যায় নির্ণয়ে শোণিত-বর্গ (Blood groups) সম্পর্কে পরীক্ষার ভূমিকার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া, এখানে- সেখানে নতুন তথ্যও যোগ করা হয়েছে।

অতুল সুর
১২ ফাল্গুন ১৩৫৮

.

প্রথম অধ্যায় – বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়

এক.

অতি প্রাচীনকাল থেকেই নানা জাতির লোক নানা দিগ্‌দেশ হতে এসে ভারতের মহাক্ষেত্রে মিলিত ও মিশ্রিত হয়েছে। এই মিশ্রণ ও মিলনের ফলে ভারতের বিভিন্ন অংশের অধিবাসীদের নৃতাত্ত্বিক জ্ঞাতিত্ব নিরূপণ করা বর্তমানে সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তা হলেও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের নৃতাত্ত্বিক জ্ঞাতিত্ব নিরূপণের একটা চেষ্টা আমরা এখানে করব।

নৃতাত্ত্বিক জ্ঞাতিত্ব নিরূপণের জন্য প্রধানতঃ তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করতে হয়—

১. প্রাচীনতম মানবের কঙ্কালাস্থি।

২. জাতি ও উপজাতি সম্পর্কে প্রাচীন সাহিত্য ও ঐতিহাসিক নজির।

৩. বর্তমানে দৃষ্ট জাতিগুলোর নৃতত্ত্বমূলক বৈজ্ঞানিক পরিমাপ

দুই.

স্যর আর্থার কীথ তাঁর সুপ্রসিদ্ধ Antiquity of Man নামক গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে বলেছিলেন- ‘ India is a pat of the world from which the student of early man has expected so much and so far has obtained so little.’ (‘প্রাচীন মানুষের সম্বন্ধে যাঁরা অনুসন্ধান করেন, তাঁরা ভারতের দিকেই আশার দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন, কিন্তু এ পর্যন্ত তাঁদের নিরাশ হতে হয়েছে।’) স্যর আর্থারের এই উক্তি এখন আর সম্পূর্ণ সত্য নয়। কারণ, এ বিষয়ে অনুসন্ধান এখন অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। এবং ভারতের কোথাও কোথাও প্রাচীন উপমানব ও মানবের কঙ্কালাস্থি পাওয়া গেছে। বাঙলার নৃতাত্ত্বিক আলোচনার পূর্বে আমরা সে বিষয়ে পাঠকবর্গের কাছে সংক্ষেপে আলোচনা করব।

ভারতে যাঁরা প্রাচীন কঙ্কালাস্থির অনুসন্ধান করেছেন, তাঁদের মধ্যে বহির্ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুসন্ধান-প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য। আমেরিকার ইয়েলের ন্যাচারাল মিউজিয়ামের অধ্যাপক ডক্টর টেরের এ- বিষয়ে অনুসন্ধান-প্রচেষ্টা সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। যদিও তাঁর প্রথম অভিযানে প্রাচীন যুগের প্রকৃত মানবের কঙ্কালাস্থি পাওয়া যায়নি, তথাপি মানবের বিবর্তনের কতগুলো মূল্যবান সূত্র তিনি এখানে আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। এক কথায় বলতে গেলে মানবাস্থির সন্ধান না পেলেও, মানবের পূর্ববর্তী পুরুষদের অস্থির সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন। উত্তর-পশ্চিম ভারতের পর্বতমালায় তিনি রামপিথেকাস, সুগ্রীবপিথেকাস, ব্রহ্মপিথেকাস প্রভৃতি নামধেয় নরাকার জীবগণের জীবাশ্মের সন্ধান পেয়েছিলেন। তাঁর এই আবিষ্কারগুলো নৃতত্ত্বের উপর নতুন আলোকপাত করে; কারণ ইতিপূর্বে এই পর্যায়ের জীবগণের তথ্য অজ্ঞাত ছিল। ইয়েল অভিযানের সদস্য লুইস সাহেবের মতে এই জাতীয় জীবগুলো (Higher primates) জগতের এই অঞ্চলেই প্রথম প্রাদুর্ভূত হয়েছিল। এদের চিবুকাস্থি ও দান্তিক সংস্থান ভগতের এই অঞ্চলেই প্রথম প্রাদুর্ভূত হয়েছিল। এদের চিবুকাস্থি ও দান্তিক সংস্থান অনেকটা মানবেরই কাছাকাছি। এ থেকে মনে হয় যে, মানবের বিবর্তন এই অঞ্চলেই ঘটেছিল।

কেম্বিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডক্টর টেরা ভারতে তাঁর দ্বিতীয় অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু এই দ্বিতীয় অভিযানেও তিনি আদিম যুগের মানবের জীবাশ্ম পাননি। তথাপি এই পথম ও দ্বিতীয় অভিযানের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, এই অভিযানদ্বয়ে এক লক্ষ থেকে পাঁচ লক্ষ বৎসরের পুরাতন ভূ-স্তর হতে তৎকালীন ভারতে মানব-বাসের প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে। এ থেকে মনে হয় যে ভারতে আদিম মানবের জীবাশ্মের সন্ধান নিতান্ত বৃথা স্বপ্নবিলাসমাত্র নয়। জগতের অপরাপর অংশে ক্রমশ সে সন্ধান যেমন মিলছে, একদিন ভারতেও সেরূপ সন্ধান সফল হবে। দ্বিতীয় ইয়েল-কেম্বিজ অভিযানের অন্যতম সদস্য ড্রামন্ড সাহেব বলেন, প্রাগৈতিহাসিক মানব মধ্য-এশিয়ায় উদ্ভূত হয়েছে। এরূপ ধারণা করা হলেও, প্রাগৈতিহাসিক মানবের বিষয় আলোচনা করতে হলে, ভারতেও গবেষণা চালান আবশ্যক। সুদূর প্রাচীনতম যুগ হতে আদিম মানবের সন্ধান ভারতে পাওয়া আদৌ বিচিত্র নয়।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে অনুরূপ নরাকার জীবের কঙ্কাল, আমরা এশিয়ার তিন জায়গা থেকে পেয়েছি। ভারতের উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্রস্থ গিরিমালা ছাড়া, জাভা ও চীনদেশের চুংকিঙ-এ। এই তিনটি বিন্দু সরলরেখা দ্বারা সংবদ্ধ করলে যে ত্রিভুজের সৃষ্টি হয়, বাঙলাদেশ তার কেন্দ্রস্থলে পড়ে। সুতরাং এরূপ জীবসমূহ যে বাঙলাদেশের উপর দিয়েও যাতায়াত করত, সেরূপ অনুমান করা যেতে পারে।

জগতের অন্যত্র আদিম মানবের জীবাশ্মের সঙ্গে তার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের নিদর্শন (Cultural relics) আবিষ্কৃত হয়েছে। ভারতে আদিম মানবের জীবাশ্ম পাওয়া না গেলেও তার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের নিদর্শন বহুল পরিমাণে পাওয়া গেছে এবং এখনও পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং আদিম মানব যে ভারতে বহু বিস্তৃতভাবে বাস করত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বস্তুতঃ প্রত্ন-প্রস্তর যুগের নানা স্তরের আয়ুধ ও ব্যবহার্য বস্তুর নিদর্শন যেমন পশ্চিম-ইউরোপ খণ্ডে পাওয়া যায়, তেমনই বঙ্গদেশ, মাদ্রাজ গোদাবরী, নর্মদা ও কৃষ্ণার অববাহিকায়, মধ্য-ভারতে, বর্তমান কর্ণাটক, ছোটনাগপুরে, বিহারের কোনো কোনো স্থানে, আসাম, পাঞ্জাবে ও সীমান্তপ্রদেশে পাওয়া গেছে। নবপলীয় যুগেরও নিদর্শন ভারতের নানা অঞ্চলে পাওয়া গেছে। মাত্র নবপলীয় যুগের ও তৎপরবর্তী যুগের (Chalcolithic and megalithic ages) মানব-জীবাশ্মই ভারতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সকল জীবাশ্মের পরিচয় দেবার পূর্বে, আমাদের এখানে বিজ্ঞানসম্মত নৃতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য যেসকল পরিমাপ বা মাপজোকের প্রয়োজন হয়, তার একটা পরিচয় দেওয়া দরকার।

তিন.

এটা প্রায়ই সকলে লক্ষ করে থাকবেন যে, দুজন মানুষকে কখনো একরকম দেখতে পাওয়া যায় না। দুজনের মধ্যে এমন একটা চেহারা ও অবয়বগত পার্থক্য থাকে, যার দ্বারা পরস্পরের মধ্যে বৈষম্য সবসময়েই নজরে পড়ে। এই ব্যক্তিগত বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও, কোনো এক বিশেষ জনসমষ্টির মধ্যে এমন কতগুলো চেহারা ও অবয়বগত সাদৃশ্য থাকে, যার দ্বারা তাদের এক বিশেষ পর্যায়গত করা চলে এবং কোনো বিশেষ জনশ্রেণির মধ্যে অবয়বগত সাদৃশ্য নিরূপণ করে তাদের নৃতাত্ত্বিক পর্যায়গত করাই নৃতত্ত্ববিদ্‌গণের কাজ।

কিন্তু এখানে ‘নৃতাত্ত্বিক-পর্যায়’ (Race) এই শব্দটির সংজ্ঞা বিশেষভাবে উপলব্ধি করা আবশ্যক। সাধারণতঃ সম-সাদৃশ্যবিশিষ্ট কোনো বিশেষ শ্রেণিকে আমরা ‘জাতি’ আখ্যা দিয়ে থাকি। যেমন আমরা বলে থাকি—আর্য জাতি, হিন্দু জাতি, ব্রাহ্মণ জাতি, বাঙালি জাতি ইত্যাদি। আর্য জাতি বলতে আমরা সেই জনসমষ্টিকে বুঝি যাঁরা আর্য ধর্ম, ভাষা ও সংস্কার অনুসরণ করেন। সেইরূপ হিন্দু জাতি বলতে আমরা সেই জনসমষ্টিকে বুঝি যাঁরা হিন্দুর আচার-ব্যবহার পালন করেন। ব্রাহ্মণ জাতি বলতে আমরা তাঁদের বুঝি যাঁরা ব্রাহ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করে ব্রাহ্মণোচিত ক্রিয়া-কলাপ করে থাকেন এবং বাঙালি জাতি বলতে আমরা তাঁদের বুঝি, যাঁরা বাঙলাদেশে জন্মগ্রহণ করে একটা বিশিষ্ট জীবনযাত্রা-প্রণালি, ভাষা ও সংস্কৃতি অনুসরণ করেন। এ থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হচ্ছে যে ‘জাতি শব্দের কোনো একটা বিশিষ্ট সংজ্ঞা নেই। কিন্তু ‘নৃতাত্ত্বিক পর্যায়’ বলতে আমরা এমন এক জনসমষ্টিকে বুঝি যাঁদের সকলের মধ্যেই জীন-কণা (Genes) ও ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ ভিত্তিক কতগুলো বিশিষ্ট অবয়বগত সাদৃশ্য আছে। অবয়বগত কোনো কোন সাদৃশ্য থাকলে, আমরা কোনো এক বিশেষ শ্রেণির জনসমষ্টিকে নৃতাত্ত্বিক-পর্যায়গত করব, সে সম্বন্ধে সুধীজনের মধ্যে মতভেদ আছে। কিন্তু এ সম্বন্ধে যেসকল লক্ষণ সুধীজন একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন, সেগুলো হচ্ছে—

১. মাথার চুলের বৈশিষ্ট্য ও রঙ।

২. গায়ের রঙ।

৩. চোখের রঙ ও বৈশিষ্ট্য।

৪. দেহের দীর্ঘতা।

৫. মাথার আকার।

৬. মুখের গঠন

৭. নাকের আকার।

৮. শোণিত বর্গ বা Blood groups.

এই লক্ষণগুলোর মধ্যে মাথার চুলের বৈশিষ্ট্য প্রধানতম। চুলের বিশিষ্টতার দিক থেকে মানুষের চুলগুলোকে সাধারণতঃ তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। প্রথম, ঋজু বা সোজা চুল (Straight hair)। এটা মঙ্গোলিয়ান জাতিসমূহের লক্ষণ। দ্বিতীয়, কুঞ্চিত বা কোঁকড়া চুল (Woolly hair) এটা নিগ্রোজাতির লক্ষণ। তৃতীয়, তরঙ্গায়িত বা ঢেউখেলান চুল (Smooth, wavy or curly hair)। এটা জগতের অবশিষ্ট জাতিসমূহের লক্ষণ। অনেক সময় অনেক পুরুষের (Generation) রক্তের সংমিশ্রণে চুলের এই বাহ্য বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু খণ্ডিত চুলকে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করলে, তার মৌলিক নৃতাত্ত্বিক-পর্যায়গত বৈশিষ্ট্য পুনরায় প্রকাশ হয়ে পড়ে। খণ্ডিত চুলকে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে কীভাবে পরীক্ষা করা হয়, এবং তার কি কি লক্ষণ প্রকাশ পেলে তাকে কোন বিশেষ নৃতাত্ত্বিক পর্যায়গত করা হয়, সে সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করা এ স্থলে সম্ভবপর নয়। তবে যাঁরা উৎসাহী তাঁরা এ সম্বন্ধে সাঁ-মার্তার (St. Martin) বই পড়ে নিতে পারেন।

চুলের এবং চোখের রঙ অপেক্ষা নৃতত্ত্ববিদগণ গায়ের রঙের উপর বেশি জোর দিয়ে থাকেন। যদিও এটা দেখা গেছে যে কালো গায়ের রঙের সঙ্গে কালো চুলের একটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু কালো চুলের সঙ্গে কালো চোখের এরূপ কোনো পারস্পরিক সাহচর্য সর্বত্র পরিলক্ষিত হয় না। সাধারণতঃ গায়ের রঙ অনুযায়ী মানুষকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়— ফরসা বা সাদা রং, ময়লা বা কালো রঙ ও পীত রং। অবশ্য এই তিন শ্রেণির আবার বহু উপবিভাগ আছে।

দেহের দীর্ঘতা অনুযায়ী মানুষকে পাঁচ শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। যেমন-

১. বামন (Pygmy)— উচ্চতা ১৪৮০ মিলিমিটারের কম।

২. খর্বাকৃতি বা বেঁটে (Short)— উচ্চতা ১৪৮০ মিলিমিটার থেকে ১৫৮১ মিলিমিটার

৩. মধ্যমাকৃতি বা মাঝারি (Medium) – উচ্চতা ১৫৮২ মিলিমিটার থেকে ১৬৭৬ মিলিমিটার।

৪. দীর্ঘ (Tall)— ১৬৭৭ মিলিমিটার হতে ১৭২০ মিলিমিটার।

৫. অতিদীর্ঘ (Very tall)—১৭২১ মিলিমিটারের উপর।

নৃতাত্ত্বিক আলোচনার জন্য মানুষের মাথার আকার এক সূচক-সংখ্যা দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এই সূচক-সংখ্যাকে Cephalic index বা শির-সূচকসংখ্যা বলা হয়। মাথার দীর্ঘতার (সম্মুখভাগ Nasion হতে পশ্চাদ্‌ভাগ Occiput পর্যন্ত) তুলনায় মাথার চওড়ার দিকের মাপের শততমাংশিক অনুপাতকেই cephalic index বলা হয়। এই অনুপাত অনুযায়ী মানুষের মাথাকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যেমন—

১. লম্বা মাথা বা দীর্ঘশিরস্ক ( Dolicho cephalic) – অনুপাত ৭৫ শতাংশের কম।

২. মাঝারি মাথা বা নাতিদীর্ঘশিরস্ক (Mesaticephalic) – অনুপাত ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের কম।

৩. গোল মাথা বা বিস্তৃতশিরস্ক (Brachy-cephalic) অনুপাত ৮০ শতাংশ বা ততোধিক।

নাকের আকারের পরিমাপও ঠিক মাথার আকারের পরিমাপ-প্রথার অনুরূপ। নাকের দীর্ঘতার (নাকের মাথা থেকে তলা পর্যন্ত) তুলনায় নাকের চওড়ার (তলদেশ) দিকের মাপের শততমাংশিক অনুপাতকে Nasal index বা নাসিকা-সূচক সংখ্যা বলা হয়। এই অনুপাত অনুযায়ী মানুষের নাককে তিন শ্রেণিতে পর্যায়ভুক্ত করা হয়। যেমন-

১. লম্বা সরু নাক (Leptorrhine) – অনুপাত ৫৫ শতাংশ হতে ৭৭ শতাংশ।

২. মাঝারি নাক (Mesorthine)— অনুপাত ৭৮ শতাংশ হতে ৮৫ শতাংশ।

৩. চওড়া নাক (Platyrrhine)— অনুপাত ৮৬ শতাংশ হতে ১০০ শতাংশ। নৃতাত্ত্বিক পর্যায় নির্ণয়ের জন্য রক্তের চারিত্রিক গুণও পরীক্ষা করা হয়। দানা বাঁধা (Agglutination), গুণের দিক থেকে রক্তকে ‘O’, ‘A’, ‘B’, ‘A-B’ ‘M’, ‘N’, Rh positive ও Negative, ও বীজাণু- প্রতিরোধক শক্তি উৎপাদনের দিক থেকে ‘A’-বর্গের রক্তকে A1, ও A2 শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যখন দুই নরগোষ্ঠীর মধ্যে রক্তের চারিত্রিক মিল থাকে, তখন তাদের মধ্যে নৃতাত্ত্বিক জ্ঞাতিত্ব আছে বলে সিদ্ধান্ত করা হয়। বর্তমানে, আঙুলের রেখা বিন্যাসের মিল দ্বারাও নৃতাত্ত্বিক সম্পর্কের নৈকট্য নির্দেশ করা হচ্ছে।

তবে, একথা এখানে বলা আবশ্যক যে নৃতত্ত্ববিদগণ নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ভুক্ত করবার জন্য অবয়বের কোনো এক বিশেষ লক্ষণের উপর নির্ভর করেন না। উপরি-উক্ত সমস্ত অবয়ব-লক্ষণের সমষ্টিগত ফলের উপর নির্ভর করেই তাঁরা নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ভুক্ত করবার জন্য কোনো এক বিশষ সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এরূপ সিদ্ধান্তে উপীত হবার জন্য তাঁরা একই জাতির অনুর্ভূক্ত বহুসংখ্যক লোকের পরিমাপ গ্রহণ করেন।

চার.

আমরা পূর্ববর্তী আলোচনায় প্রাচীন মানবের কঙ্কালাস্থি প্রাপ্তির বিবরণ দেওয়া স্থগিত রেখেছিলাম। ভারতের যে যে স্থান থেক প্রাচীন মানবের কঙ্কালাস্থি পাওয়া। গেছে তার বিবরণ এখন দেওয়া হচ্ছে—

১. ১৯২৮-২৯ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তানের মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত ৪১টি কঙ্কাল।

২. ১৯৩৮-৩৯ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তানের হরপ্পায় প্রাপ্ত ২৬০টি কঙ্কাল।

৩. ১৯৩০-৩১ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তানের তক্ষশীলার ধর্মরাজিকা মঠে প্রাপ্ত ৬টি কঙ্কাল।

৪. ১৯৩৫-৩৬ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তানের চানু-ধারোয় প্রাপ্ত একটি কঙ্গাল।

৫. ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মধ্য প্রদেশের উজ্জয়িনীর নিকট কুমহার-টেকরিতে প্রাপ্ত ৪২টি কঙ্কাল।

৬. ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে তামিলনাড়ুর কোদাইকানালে প্রাপ্ত পাঁচটি সমাধিপাত্রপূর্ণ কঙ্কাল।

৭. ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে কর্ণাটকের ব্রহ্মগিরিতে প্রাপ্ত ১৪টি কঙ্কাল।

৮. ১৯৫১-৫২ খ্রিষ্টাব্দে কর্ণাটকের পিকলিহাল নামক স্থানে প্রাপ্ত তিনটি সম্পূর্ণ কঙ্কাল ও একটি চিবুকাস্থি।

৯. ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে কর্ণাটকের মাসকী নামক স্থানে প্রাপ্ত কঙ্কাল।

১০. ১৯৫৪-৫৬ খ্রিষ্টাব্দে মহারাষ্ট্রের নেভাসায় প্রাপ্ত ৩০টি কঙ্কাল।

১১. ১৯৫৬-৬০ খ্রিষ্টাব্দে অন্ধ্রপ্রদেশের নাগাজু নাকুণ্ডুর উপত্যকায় প্রাপ্ত ১৩টি নবপলীয় যুগের কঙ্কাল ও ১৪টি মেগালিথিক যুগের সমাধি।

১২. ১৯৫৪-৫৫ খ্রিষ্টাব্দে পাঞ্জাবের রূপার নামকস্থানের ২১টি সমাধিতে প্রাপ্ত কঙ্কাল।

১৩. ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তামিলনাড়ুর অমিরথমঙ্গলম নামক স্থানে প্রাপ্ত ১০টি সমাধিপাত্র।

১৪. ১৯৫৭-৫৯ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর প্রদেশের কৌশাম্বীতে প্রাপ্ত ৮টি পুরুষ ও ৪টি নারীর কঙ্কাল।

১৫. ১৯৫৮-৬০ খ্রিষ্টাব্দে গুজরাটের লোথালে প্রাপ্ত ২১টি কঙ্কাল।

১৬. ১৯৫৮-৫৯ খ্রিষ্টাব্দে অন্ধ্রপ্রদেশের নাগার্জুনাকুণ্ডর ঠিক বিপরীত দিকে কৃষ্ণা নদীর উপর ইল্পেশ্বরম নামক স্থানে প্রাপ্ত ৬টি কঙ্কাল।

১৭. ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে মহারাষ্ট্রের পুনে শহরের নিকট চণ্ডোলী গ্রাম হতে প্রাপ্ত ২৪টি কঙ্কাল।

১৮. ১৯৬২-৬৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজস্থানের কালিবঙ্গন হতে প্রাপ্ত কয়েকটি কঙ্কাল। ১৯. ১৯৬৩-৬৪ খ্রিষ্টাব্দে কর্ণাটকের টেককলকোটা স্থানে প্রাপ্ত ৯টি কঙ্কাল।

২০. ১৯৬৩-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিম বাঙলার পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে প্রাপ্ত ১৪টি সমাধি কঙ্কাল।

২১. ১৯৬০-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে কাশ্মীরের শ্রীনগরের নিকটে এক গ্রামে নবপলীয় যুগের সমাধিতে প্রাপ্ত কঙ্কাল।

২২. ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর প্রদেশের প্রতাপগড়ে প্রাপ্ত কঙ্কাল।

২৩. মেদিনীপুর জেলার রামগড়ের অদূরে সিজুয়ায় প্রাপ্ত প্রাক্-হরপ্পীয় যুগের জীবাশ্মীভূত এক ভগ্ন চোয়াল।

উপরি-উক্ত স্থানসমূহে প্রাপ্ত কঙ্কালাস্থিগুলো অধিকাংশই অসম্পূর্ণ ও ভগ্ন অবস্থায় পাওয়া গেছে। সুতরাং সেগুলো নৃতাত্ত্বিক পরিমাপের পক্ষে অনুপযুক্ত। আমরা পূর্ব পরিচ্ছেদে নৃতাত্ত্বিক পরিমাপ সম্বন্ধে যে আলোচনা করেছি, তা থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে নৃতাত্ত্বিক পর্যায় নিরূপণের জন্য বহুসংখ্যক ও সম্পূর্ণ নরকঙ্কালের অভাবে আমরা ভারতের প্রাচীন কালের মানুষের পরিযান (এক অঞ্চল থেকে অপর অঞ্চলে গমন), সংমিশ্রণ ও অভিযান সম্বন্ধে অভ্রান্তভাবে কিছুই বলতে পারি না। যেহেতু এই সকল নরকঙ্কালসমূহ নানা যুগের, সেজন্য সভ্যতামূলক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এগুলোকে আমরা পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত করতে পারি—ক. নবপলীয় যুগের, খ. হরপ্পা যুগের, গ. দাক্ষিণাত্যের তাম্রাক্ষ্মযুগের, ঘ. মেগালিথিক যুগের, ও ঙ. আদি- ঐতিহাসিক যুগের।

পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে এই কঙ্কালাস্থিসমূহ সম্পর্কে নৃতত্ত্ববিদগণ যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, এখানে তা সংক্ষেপে বিবৃত করা যেতে পারে—১. হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো ও লোথালের লোকেরা অধিকাংশই দীর্ঘশিরস্ক ও বিস্তৃতনাসা ছিল, তবে মহেঞ্জোদারোর লোকদের নাক হরপ্পা ও লোথালের লোকেদের মতো অত বিস্তৃত ছিল না; ২. হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর লোকেদের তুলনায় লোথালের লোকেদের মাথা চওড়া ছিল; ৩. তবে এইসকল পার্থক্য থাকলেও মাথার খুলির আকার, নাকের গঠন, ও আকারের দিক থেকে তারা একই নরপর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল; ৪. তার মানে তারা দীর্ঘশিরস্ক, প্রশস্ত নাসা ও আকারে লম্বা ছিল। ৫. কিন্তু হরপ্পা-যুগে গুজরাটে ও সিন্ধু প্রদেশে বিস্তৃত-শিরস্ক জাতির বিদ্যমানতাও লক্ষিত হয়। ৬. ব্রহ্মগিরি, নাগাজু নাকুণ্ড, পিথলিহাল, মাসকী ও ইয়েলেশ্বরম্ প্রভৃতি স্থান থেকে মেগালিথিক যুগের প্রাপ্ত কঙ্কালসমূহ থেকে বুঝতে পারা যায় যে, মেগালিথ (সমাধিস্তূপের উপর স্মৃতিস্তম্ভ) নির্মাণকারীরা অধিকাংশই বিস্তৃতশিরস্ক, আকারে লম্বা, ও দৃঢ়দেহবিশিষ্ট লোক ছিল। কিন্তু অন্ধ্র প্রদেশের আদিতান্নালুরের ও দক্ষিণ ভারতের সমাধিস্তূপগুলোতে যেসকল নরঙ্কাল পাওয়া গেছে তারা দীর্ঘশিরস্ক ও নাতি-দীর্ঘশিরস্ক ছিল। মেগালিথ নির্মাণকারীরাই বোধহয় ভারতে লৌহের ব্যবহারের সূচনা করেছিল। কেন না, নাগার্জু নাকুণ্ড, তেক্কলকোটা ও মাসকী হতে প্রাপ্ত নবপলীয় যুগের লোকেদের মধ্যে দীর্ঘ শরস্কতারই প্রাচুর্য ছিল। উজ্জয়িনী, কৌশাম্বী ও তক্ষশিলা হতে প্রাপ্ত কঙ্কালসমূহ থেকে বুঝতে পারা যায় যে ওই সকল স্থানে দীর্ঘশিরস্ক জাতির লোকেরাই প্রথমে বাস করত, পরে সেখানে বিস্তৃতশিরস্ক জাতির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল।

সুতরাং এই সকল সিদ্ধান্ত থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে ক, নবপলীয় যুগের লোকেরা দীর্ঘশিরস্ক ছিল, খ. হরপ্পা এবং অন্যান্য তাম্ৰাশ্ম যুগের লোকেরা দীর্ঘশিরস্ক ও নাতিদীর্ঘ-শিরস্ক ছিল, কিন্তু গুজরাটে ও সিন্ধুপ্রদেশে বিস্তৃতশিরস্ক জাতিরও অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, ও গ. মেগালিথ যুগের লোকেরা বিস্তৃতশিরস্ক ছিল। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে বিস্তৃতশিরস্ক জাতিসমূহের আগমন পরে ঘটেছিল। এখানে বক্তব্য যে পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে যে কঙ্কাল পাওয়া গেছে তা দীর্ঘশিরস্ক। তারা যে ভূমধাগোষ্ঠীর লোক সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে প্রাপ্ত ক্রীট দেশিয় একটি সীলমোহরও তা সমর্থন করে। এদেরই অনুসরণে বিস্তৃতশিরস্ক জাতি বাঙালাদেশে এসেছিল।

পাঁচ.

একমাত্র যে দৃষ্টিভঙ্গীর সাহায্যে আলোচনা করলে, আমরা বাঙলাদেশের নৃতাত্ত্বিক স্বরূপ সম্যকভাবে বুঝতে পারব সেই দৃষ্টিভঙ্গী আয়ত্ত করতে হলে, আমাদের সমগ্র ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিস্থিতির জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। সেজন্য বাঙালির নৃতাত্ত্বিক-স্বরূপ বিশদভাবে আলোচনা করবার আগে আমরা সমগ্র ভারতের একটা মোটামুটি নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দিচ্ছি।

ভারতীয় জাতিসমূহের পরিমাপ প্রথম গ্রহণ করা হয়েছিল ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে লোক-গণনার সময় ভারতীয় নৃতত্ত্ব-বিভাগ (Indian Ethnographic Survey) কর্তৃক। ওই পরিমাপ গ্রহণের জন্য তৎকালীন সমগ্র ভারতের লোক-গণনা সম্পর্কিত চিফ কমিশনার ও নৃতত্ত্ব- বিভাগের সর্বময় কর্তা স্যর হারবার্ট রীজলি কয়েকজন এদেশিয় সাধারণ সরকারি কর্মচারিকে নিযুক্ত করেছিলেন। একথা বলা প্রয়োজন যে, নৃতাত্ত্বিক পরিমাপ গ্রহণের জন্য স্যর হারবার্ট রীজলি নৃতত্ত্ব বিভাগের তরফ থেকে যে সকল কর্মচারিকে নিযুক্ত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে কেউই নৃতত্ত্ব-বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। কেবল নৃতাত্ত্বিক পরিমাপ গ্রহণের প্রণালি- মাত্রেই দীক্ষা দিয়ে তাঁদের স্কন্ধে নৃতত্ত্ব সম্বন্ধে অনুসন্ধান করবার এক গুরু দায়িত্বপূর্ণ ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং তাঁদের পরিমাপের বৈজ্ঞানিক সঠিকতা সম্বন্ধে সন্ধিহান হবার যথেষ্ট কারণ আছে। সেজন্য ভারতের নৃতত্ত্ব সম্বন্ধে আলোচনা করবার সময় যেখানে পরবর্তীকালের অন্য কোনো নৃতত্ত্ববিদ্ কর্তৃক স্বাধীনভাবে গৃহীত পরিমাপ পাওয়া যায়, তার সঙ্গে রীজলির পরিমাপ সব সময় তুলনা করা উচিত নয়। পরন্তু রীজলির সময় এশিয়াবাসিগণের নৃতাত্তিক-স্বরূপ সম্বন্ধে আমাদের যতটুকু জ্ঞান ছিল, বর্তমানে তা অপেক্ষা যথেষ্ট জ্ঞান বৃদ্ধি ঘটেছে। এ সব কারণে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের লোকগণনার সময় উক্ত গণনা সম্পর্কিত চিফ কমিশনার মি. হাটন (Hutton) ভারতীয় প্রাণিতত্ত্ব বিভাগের (Indian Zoological Survey) নৃতত্ত্ববিদ্ ড. বিরজাশঙ্কর গুহ মহাশয়ের উপর রীজলির এবং তৎপরবর্তীকালের নৃতত্ত্ববিদ্‌গণ কর্তৃক গৃহীত পরিমাপগুলোর তুলনামূলক মূল্যের উপর নির্ভর করে ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে পুনরায় আলোচনা করে পরিশোধিত সিদ্ধান্তে উপনীত হবার ভার অর্পণ করেন।

সেই পরিশোধিত সিদ্ধান্তসমূহ ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিস্থিতির উপর যে নতুন আলোকপাত করেছে, তার ফলে আমরা জানতে পারি যে ভারতের সীমান্তবর্তী হিমালয়ের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশসমূহের অধিবাসিগণের মধ্যে কয়েকটি বিশিষ্ট নৃতাত্ত্বিক পর্যায় বিদ্যমান আছে। অন্তঃ-স্রোতার মতো যে নৃতাত্ত্বিক পর্যায়টি জনবাসিগণের মধ্যে সর্বত্রই ব্যাপ্তিলাভ করেছে, সেই পর্যায়ের লোকদের বৈশিষ্ট্য—লম্বা মাথা, দীর্ঘ দেহ, ফিকে রঙের চুল ও চোখ, ও ফরসা চেহারা। পাঠান ও কাফির জাতিরা এই পর্যায়েরই অন্তর্ভুক্ত, এবং পাকিস্তানের অন্তর্গত চিত্রল ও মাস্তাজের খস্ ও কাশ্মীরের পণ্ডিত জাতিগণের মধ্যে এই পর্যায়ের লক্ষণগুলো বিশেষভাবে বর্তমান। এরূপ অনুমান করবার সপক্ষে যথেষ্ট কারণ আছে যে, এই পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত লোকেরা আর্যজাতির ভারতে আগমনের সমসাময়িক কালে এই সমস্ত স্থানে এসে বসবাস শুরু কয়েছিল বা সেই আর্য জনস্রোতেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর একটি পর্যায় যা এই সমস্ত প্রদেশে লক্ষিত হয়, তার অন্তর্ভুক্ত লোকেদের মাথা গোল, নাসিকা উন্নত, গায়ের রঙ ফরসা, কিন্তু চোখ ও চুলের রঙ মাঝামাঝি। এই গোষ্ঠী ইউরোপের ডিনারিক (Dinaric Race ) পর্যায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং ইউজেন ফিশার (Fisher) এর নামকরণ করেছেন ‘নিকট-প্রাচ্য জাতি’ (Near Eastern Race)। এই পর্যায়ের লক্ষণগুলো আংশিকভাবে দেখতে পাওয়া যায় কাফির ও পাঠানগণের মধ্যে, এবং খুব বেশি পরিমাণে পরিলক্ষিত হয় পাকিস্তানের চিত্রলের খস্, পাকিস্তানের গিলগিট উপত্যকার বুরিশ, দরদী এবং সারিকল, পাকিস্তানের মাস্তাজ ও কাশ্মীরের হুনজা উপত্যকার ওয়াখিস জাতিসমূহের মধ্যে। কাশ্মীরের সাধারণ অধিবাসিবৃন্দের মধ্যে যে নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ের সন্ধান পাওয়া যায়, তার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে— লম্বা মাথা, উন্নত নাসিকা, গোলাপি আভাৱিশিষ্ট ফরসা গায়ের রঙ ও বাদামি (brown) রঙের চোখ ও চুল। উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানের বাদাকশানের বাদাকশিরাও এই পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত এবং ইউজেন ফিশার এই লক্ষণবিশিষ্ট জাতিসমূহের নামকরণ করেছেন—’প্ৰাচ্য জাতি’ (Oriental Race)। এ ছাড়া, কাশ্মীরের লাডাক উপত্যকা ও দক্ষিণের পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসিবৃন্দের মধ্যে আমরা একটি মঙ্গোলীয় স্তরও লক্ষ্য করি। চিয়াংপা-রা এই জাতির অন্তর্ভুক্ত এবং পশ্চিম নেপালের লাডাকী, লাহুলী, গুরুং ও অন্যান্য কয়েকটি জাতির মধ্যে এই স্তরের বৈশিষ্ট্যগুলো যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান। সামান্য পরিমাণে এই বৈশিষ্ট্য লাডাকের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের পুরিগি ও মাচনোপা জাতিগণের মধ্যেও বোধহয় বর্তমান আছে।

উপরিউক্ত নৃতাত্ত্বিক পর্যায়গুলো পর্যালোচনা করে নৃতত্ত্ববিদগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে হিমালয়ের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে এগুলো সমস্তই অতীতকালের আগন্তুক পর্যায়। এই অঞ্চলসমূহের আদিম বা মৌলিক অধিবাসিগণের বৈশিষ্ট্য—খাটো দেহ, লম্বা মাথা, মাঝারি নাক, চওড়া মুখ ও বাদামি রঙের গা। বিশুদ্ধ অবস্থায় এই পর্যায়ের লক্ষণগুলো পরিলক্ষিত হয় কুলুর কানেট জাতিসমূহের মধ্যে। প্রসিদ্ধ জার্মান নৃতত্ত্ববিদ আইকষ্টেট (Eickstet) এই পর্যায়টির নামকরণ করেছেন ‘গাড়ওয়ালি’ এবং ড. বিরজাশঙ্কর গুহ এর নাম দিয়েছেন ‘হিমালয়ান’।

হিমালয়ের উত্তর-পশ্চিম পার্বত্য অঞ্চল পরিত্যাগ করে পঞ্চনদে উপনীত হয়ে আমরা দেখতে পাই যে, পাঞ্জাবের অধিবাসিবৃন্দের মধ্যে একটা নৃতাত্ত্বিক ঐক্য আছে। এখানকার অধিবাসিবৃন্দ হিমালয়ের উত্তর- পশ্চিম পার্বত্য অঞ্চলের পাঠান ও অন্যান্য দীর্ঘশিরস্ক জাতিসমূহের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। যদিও আইকৃষ্টেট পাঞ্জাবের অধিবাসিবৃন্দের মধ্যে দুটি নৃতাত্ত্বিক উপশ্রেণি নির্দেশ করেছেন তথাপি তিনি এই মন্তব্য প্ৰকাশ করেছেন যে, পাঞ্জাবের পূর্বাঞ্চলের শিখগণ ও পশ্চিমাংশের মুসলমানগণের মধ্যে অবয়বগত নৃতাত্ত্বিক কোনো পার্থক্য নেই। উভয়ের মধ্যে যে বৈষম্য সাধারণত বাইরে থেকে পরিলক্ষিত হয়, তা কেবলমাত্র বেশভূষা ও কেশধারণের স্বতন্ত্রতার জন্য।

ঠিক পাশাপাশি অবস্থিত সিন্ধুপ্রদেশের অধিবাসিবৃন্দ কিন্তু ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। এই পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত লোকেদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে— অল্পবিস্তর গোল মাথা, পাঞ্জাবীগণ অপেক্ষা খর্বতর দৈহিক দৈৰ্ঘ্য, গোলাকার মুখ ও প্রসারিত নাক। এ থেকে মনে হয় যে, সিন্ধুপ্রদেশের আদিম অধিবাসীরা উত্তরাঞ্চলের লম্বা মাথা-বিশিষ্ট জাতিসমূহের অন্তর্গত ছিল এবং পরে কোনো এক গোল মাথা-বিশিষ্ট জাতির আক্রমণ ও সংমিশ্রণের ফলে বর্তমান ‘সিন্ধি’ জাতির উদ্ভব হয়েছে।

পাঞ্জাব ও হিমালয়ের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের অংশ-বিশেষে আমরা যে লম্বা মাথা-বিশিষ্ট জাতি লক্ষ্য করেছি সেই নৃতাত্ত্বিক পর্যায়েরই আধিপত্য আমরা দেখতে পাই উত্তর-প্রদশে। বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের ব্রাহ্মণরা এই পর্যায়ের অন্তর্গত, তবে তাদের সঙ্গে পাঞ্জাবের অধিবাসিবৃন্দের মধ্যে যে সামান্য পার্থক্য আছে তা লক্ষিত হয় পাঞ্জাবীদের দীর্ঘতর দৈহিক উচ্চতায়, বৃহত্তর মাথায়, দীর্ঘতর নাকে ও অধিকতর প্রসারিত মুখে। এই দুই প্রদেশের অধিবাসিবৃন্দের মধ্যে গায়ের রঙের কিন্তু বিশেষ বৈষম্য নেই, কেবলমাত্র উত্তরপ্রদেশের শ্রেণিবিশেষের মধ্যে অধিকতর ফরসা লোক পাওয়া যায়।

উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণগণের সঙ্গে রাজপুতানা ও মধ্যপ্রদেশের অনেকগুলো জাতি নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ের দিক থেকে বিশেষভাবে সম্পর্কিত যদিও বাঘেল রাজপুতগণের মধ্যে গোল মাথাও পরিদৃষ্ট হয়, তথাপি রাজপুতানার সাধারণ নৃতাত্ত্বিক স্তরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লম্বা মাথা ও সুন্দর উন্নত নাক। মধ্যভারতের অধিবাসিবৃন্দও এই একই নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ের অন্তুর্ভুক্ত। তবে এই পর্যায়ের জাতিসমূহের নাসিকা সম্বন্ধে একথা এখানে বলা প্রয়োজন যে, শতকরা ১৩ থেকে ১৪ জনের নাসিকার উপরের ভাগ গোলাকার (Convex) বা কুব্জ এবং যথেষ্টসংখ্যক লোকের মধ্যে নাসিকার মূলদেশ সামান্য পরিমাণে অবনত দেখা যায়। এই সমস্ত জাতিসমূহের সাধারণ গায়ের রঙ বাদামি (brown) ও চুলের রঙ কালো খুব ফিকে রঙের চোখ, চুল ও চেহারা খুব কমসংখ্যক লোকের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু একটি বিশিষ্টসংখ্যক লোকের মধ্যে গোলাপি আভাবিশিষ্ট গায়ের রঙ ও গোর বর্ণের চুলও চোখ দেখা যায়।

কাথিয়াবার ও গুজরাটের অধিবাসিবৃন্দের কিন্তু প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গোল মাথা। যদিও নাগর এবং বেনিয়া জৈন, ও ব্রহ্মক্ষত্রিয় এবং ঔদিব ব্রাহ্মণদের মধ্যে একটি পারস্পরিক নৃতাত্ত্বিক সাদৃশ্য আছে, কুম্বী ব্রাহ্মণদের কিন্তু ঔদিব ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য কোনো জাতির সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক নৈকট্য সূচিত হয় না। খ্রিষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে কুন্বীরা গুজরাটে এসেছিলেন এই জনশ্রুতিও তাদের উপরি-উক্ত নৃতাত্ত্বিক স্বতন্ত্রতাকে সমর্থন করে।

যদিও গুজরাটের জাতিসমূহের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে তথাপি তাদের পরস্পরের গায়ের রঙের কিছু পার্থক্য লক্ষিত হয়; নাগর ব্রাহ্মণরা দেখতে সর্বাপেক্ষা ফরসা এবং তাদের প্রায় কাছাকাছি রঙ হচ্ছে ব্রহ্মক্ষত্রিয়দের। বেনিয়া-জৈনদের গায়ের রঙ ময়লা, এবং কাথিদের গায়ের রঙ আরও ময়লা।

ভারতের উপদ্বীপাংশকে (Peninsular India) মোটামুটি দুই ভৌগোলিক বিভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমাংশ বিন্ধ্য-পর্বত থেকে শুরু করে নীলগিরি শৈলমালা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এর নাম দাক্ষিণাত্য। দ্বিতীয়াংশ ১৪ ডিগ্রি উত্তর-অক্ষাংশের দক্ষিণে অবস্থিত ভারতের অবশিষ্ট দক্ষিণাঞ্চল। দাক্ষিণাত্যের পশ্চিমাংশকেই বলা হয় দাক্ষিণাত্য এবং এই প্রদেশের প্রধান জাতিসমূহ হচ্ছে দশস্থ ব্রাহ্মণ, করহাদ ব্রাহ্মণ, কুম্বী ও মারাঠা। চিৎপাবন, সারম্বত, প্রভুকায়স্থ প্রভৃতি মহারাষ্ট্র-দেশবাসী অন্যান্য জাতিসমূহ অন্য অঞ্চল হতে এসে এই অঞ্চলে বসবাস করেছে বলে মনে হয়। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে অধ্যাপক জারম্যানো ডি সিলভা-র (Germano-de Silva) এক শিষ্য প্রমাণ করতে প্রয়াস পেয়েছিলেন যে, গোয়া-অধিবাসী সারস্বত জাতির সঙ্গে প্রাচীন বাঙলার গৌড়দেশের ব্রাহ্মণগণের নৃতাত্ত্বিক সাদৃশ্য আছে।

মোটামুটিভাবে মহারাষ্ট্র দেশের জাতিসমূহ বিস্তৃতশিরস্ক (Brachycephalic), এবং দীর্ঘ (Leptorrhine) হতে নাতিদীর্ঘ (Mesorthine) নাসা।

চিৎপাবনরা সর্বাপেক্ষা গৌরবর্ণ। অন্যান্য জাতিসমূহ ওদের চেয়ে ময়লা। দশস্থ, মারাঠা ও সারস্বতগণের মধ্যে অল্পসংখ্যক পিঙ্গলবর্ণ (Tawny) ত্বও পরিলক্ষিত হয়। পরস্পরের মধ্যে চোখ ও চুলের রঙের ও যথেষ্ট পার্থক্য আছে, তবে এ বিষয়ে চিৎপাবন, প্রভুকায়স্থ ও সারস্বতগণের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ Blonde Elementও দেখতে পাওয়া যায় এবং ভারতবাসিগণের মধ্যে তারাই সর্বাপেক্ষা গৌরবর্ণ ও তাদের মধ্যেই সর্বাপেক্ষা অধিক পরিমাণ ফিকা মাথার চুল ও চোখ পরিদৃষ্ট হয়।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ড. বিরজাশঙ্কর গুহমহাশয় বোম্বাইয়ের পারসীজাতির যে নৃতাত্ত্বিক পরিমাপ গ্রহণ করেছিলেন, তা থেকে দেখা যায় যে, তারা অতিমাত্রায় বিস্তৃতশিরস্ক (Brachycephalic), তাদের নাসিকা দীর্ঘ, উন্নত ও প্রায়ই কুব্জ (Aquiline) এবং তাদের মুখ বিস্তৃত, কিন্তু অল্প- বিস্তর ছোট। যদিও পারসীরা নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ের দিক থেকে ভারতের অন্যান্য জাতিসমূহ হতে পৃথক শ্রেণিভুক্ত, তথাপি তাদের সঙ্গে জোসায়াফস্ট্রয়ান ধর্মাবলম্বী প্রাচীন পারসিক জাতির কোনো নৃতাত্ত্বিক সাদৃশ্য নেই। প্রাচীন পারসিক জাতিরা দীর্ঘশিরস্ক (dolichocephalic) ও দীর্ঘনাসা (Leptorrhine) এবং তাদের মুখ লম্বা। এ বিষয়ে উত্তর- পশ্চিম এশিয়ার আর্য-ভাষাভাষী জাতিগণের সঙ্গে তাদের নৃতাত্ত্বিক নৈকট্য খুব বেশি পরিমাণে লক্ষিত হয়।

গুজরাট ও মহারাষ্ট্র প্রদেশের অধিবাসিগণের মধ্যে খুব নিকটতম ঘনিষ্ঠতা আছে। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য কেবলমাত্র এই যে গুজরাট রাজ্যের অধিবাসিগণের মধ্যে বিস্তৃতশিরস্কতা (Brachycephaly) খুব বেশি পরিমাণে লক্ষিত হয় এবং তাদের নাকও বেশি পরিমাণে দীর্ঘ ও সুন্দর। ড. বিরজাশঙ্কর গুহ মহাশয় অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে মধ্যভারত হতে মহারাষ্ট্র দেশে একটি সাধারণ নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ের আগমন ঘটেছিল, এবং পশ্চিম ভারতে ওই পর্যায়ের উপর কোনো এক বিস্তৃতশিরস্ক জাতি এসে নৃতাত্ত্বিক আধিপত্য বিস্তার করেছিল।

দাক্ষিণাত্যে মারাঠী ছাড়া আরও অনেক জাতি আছে। যেমন কৰ্ণাটক, দক্ষিণ-পশ্চিম অন্ধ্র প্রদেশ ও দক্ষিণাপথের সম-মালভূমির পশ্চিমাংশের কন্নড় জাতিসমূহ, উত্তর ও পূর্বাংশের তেলেগু ভাষাভাষী জাতিসমূহ ও মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের মধ্যবর্তী দক্ষিণ কানাড়ার কানাড়া বা কন্নড় ভাষারসহিত সম্পর্কিত তুলুভাষী জাতিসমূহ। শিরাকার জ্ঞাপক সূচক- সংখ্যা (Cephalic index ) ৭৮.০ থেকে ৮০.৪ পর্যন্ত এবং নাসিকার জ্ঞাপক সূচক-সংখ্যা (Nasal index ) ৭২.২ থেকে ৭১.৪ পর্যন্ত। তার মানে তুলুরা অনুবিস্তৃত-শিরস্ক ও দীর্ঘনাসা। তুলুভাষী জাতিসমূহের মধ্যে কন্যাগত উত্তরাধিকার প্রথা প্রচলিত আছে এবং যদিও তারা মৃতের শবদাহ করে, তবুও সমাধিস্থ করার প্রথাও তাদের মধ্যে অজ্ঞাত নয়। মৃতকে যখন তারা সমাধিস্থ করে, তখন তারা ওই স্থানের উপর কোণাকার সমাধিস্তূপ নির্মাণ করে।

কর্ণাটকের কানাড়া-ভাষী জাতিসমূহের শিরাকার জ্ঞাপক ও নাসিকাকার জ্ঞাপক সূচক-সংখ্যা যথাক্রমে ৭৯.৩ ও ৭৩.৫। বেলারী ও কুর্নুল জেলার কানাড়া-ভাষী জাতিসমূহের মাথা কিন্তু কিছু বেশি দীর্ঘও নাকও কিছু বেশি বিস্তৃত। তাদের শিরাকারজ্ঞাপক ও নাসিকাকার জ্ঞাপক সূচক-সংখ্যা যথাক্রমে ৭৮.৮ ও ৭৫.৩। ড. বিরজাশঙ্কর গুহ কানাড়া- ভাষী ব্রাহ্মণদের যে নৃতাত্ত্বিক পরিমাপ গ্রহণ করেছিলেন তা থেকে দেখা যায় যে তাদের মাথা গোল (শিরাকার জ্ঞাপক সূচক-সংখ্যা ৭৯.৩৪) এবং তাদের নাক লম্বা (নাসিকাকার জ্ঞাপক সূচক সংখ্যা ৭১.২০)। কয়েক ক্ষেত্রে কুব্জ নাসিকাও (Aquiline) দেখা গিয়েছে। ব্রাহ্মণদের দেহদৈর্ঘ্য (Stature) অব্রাহ্মণ জাতিসমূহ অপেক্ষা কম, কিন্তু অব্রাহ্মণদের গায়ের রঙ ব্রাহ্মণদের চেয়ে ময়লা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে কালো বা পিঙ্গলযুক্ত বাদামি। চোখের রঙ ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণ উভয়েরই ঘার বাদামি বা কালো—যদিও খুব অল্প সংখ্যকের মধ্যে ফিকা রঙও দেখতে পাওয়া যায়।

দাক্ষিণাত্যের উত্তর-পূর্বাংশে ও গঞ্জাম থেকে সংযুক্ত জেলাসমূহের উপকূলভাগে যেসমস্ত জাতি বাস করে, তাদের নাম অন্ধ্র। অন্ধ্রদের শিরাকার জ্ঞাপক ও নাসিকাকার জ্ঞাপক সূচক-সংখ্যা যথাক্রমে ৭৭.৬ এবং ৭৫.৪। তার মানে তারা নাতিদীর্ঘশিরস্ক ও নাতি-দীর্ঘসাসা। মধ্য এবং পূর্বাঞ্চলের অন্ধ্রদের মধ্যে দুটি প্রধান জাতি, যথা ব্রাহ্মণ ও বৈশ্য কুমটিদের দেহ-দৈর্ঘ্য মাঝামাঝি। মুখ লম্বা এবং নাক অল্পবিস্তর লম্বা ও উন্নত। ব্রাহ্মণদের গায়ের রঙ অন্যান্য জাতির চেয়ে ফিকে। কিন্তু চোখের রঙ সকলেরই কালো থেকে ঘোর বাদামি। চুলের রঙ খুব বিশিষ্টভাবে কালো, এবং নিম্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে নাক খুব বিস্তৃত।

ভারতীয় উপদ্বীপের ১৪ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশের তলভাগস্থ ভূভাগের অধিবাসি-বৃন্দকে আমরা দুই শ্রেণিতে ভাগ করতে পারি। প্রথম, কেরালা ও পশ্চিম উপকূলের মালয়ালীভাষী জাতিসমূহ ও দ্বিতীয়, পূর্ব-উপকুলের তামিল-ভাষাভাষী জাতিসমূহ। কেরালার মালয়ালী ভাষাভাষী জাতিসমূহ দীর্ঘশিরস্ক ও দীর্ঘনাসা। তাদের মধ্যে নামুদ্রী, নায়ার ও ইলুবার জাতিসমূহ যথাক্রমে উচ্চ, মধ্যম ও নিম্নশ্রেণির প্রতিভূ-স্বরূপ। নামুদ্রীরা সর্বাপেক্ষা দীর্ঘকায়, নায়াররা মধ্যকায় ও ইলুবারা খর্বকায়। নামুদ্রীরা সর্বাপেক্ষা ফরসা, নায়ারদের গায়ের রঙ বাদামি থেকে পিঙ্গলযুক্ত বাদামি, ও ইলুবার সর্বাপেক্ষা মলিন। চোখের রঙ সকলেরই কালো থেকে ঘোর বাদামি এবং চুলের রঙ কালো, অল্পসংখ্যকের মধ্যে ফিকে রঙও পরিদৃষ্ট হয়। নামুদ্রীদের মুখের আকার নায়ারদের অপেক্ষা লম্বা এবং তাদের নাকের গঠনও বেশ উন্নত। মনে হয় নামুদ্রীরা বহির্দেশ থেকে কেরালায় এসে বাস করছে, কিন্তু নায়ারদের সঙ্গে ‘সম্বন্ধম্’ নামক বিবাহপ্রথা প্রচলিত থাকার জন্য উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট সংমিশ্রণ ঘটেছে।

তামিলনাড়ুর তামিলভাষাভাষী জাতিসমূহও দীর্ঘশিরস্ক, কিন্তু তাদের নাক ঠিক মালয়ালী ভাষাভাষীদের মতো দীর্ঘ নয়। তামিল ব্রাহ্মণদের গায়ের রঙ বিশেষভাবে ঘোর বাদামি, এবং চেট্টি ও কাল্লাদের যথাক্রমে পিঙ্গলযুক্ত বাদামি থেকে গভীর পিঙ্গলুযুক্ত বাদামি। চোখ ও চুলের রঙ সকলেরই কালো।

তবে তামিলভাষাভাষী জাতিসূহের যে পরিমাপ প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে দেখা যায় যে, তাদের মধ্যে দুটি বিভিন্ন পর্যায় বর্তমান—একটি দীর্ঘশিরস্ক ও আরেকটি বিস্তৃত-শিরস্ক পর্যায়। এ দুটি পর্যায় যথাক্রম নিম্ন ও উচ্চবর্ণের তামিলভাষাভাষীদের মধ্যে পরিদৃষ্ট হয়। ড. বিরজাশঙ্কর গুহ বলেন যে, যদিও তামিলভাষাভাষী জাতিসমূহের মধ্যে একটি দীর্ঘশিরস্ক অন্তস্তর খুব প্রবলভাবে বর্তমান, তবুও বিস্তৃতশিরস্ক পর্যায়ের সঙ্গে তাদের যথেষ্ট সংমিশ্রণ ঘটেছে। নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ের দিক দিয়ে তাদের স্থান কানাড়াভাষাভাষী জাতিসমূহের ঠিক মাঝামাঝি এবং এ বিষয়ে দ্রাবিড় ভাষাভাষী জাতিসমূহের মধ্যে তেলেগু-ভাষাভাষিগণের সঙ্গে মালয়ালী- ভাষাভাষিগণের সর্বাপেক্ষা নিকটতম সম্বন্ধ আছে। পশ্চিম ও প্রাচ্য ভারতে আমরা যে বিস্তৃতশিরস্ক পর্যায় দেখি, সেই একই পর্যায়ের সংমিশ্রণে দ্রাবিড় জাতিসমূহের মধ্যে যে বিস্তৃতশিরস্কতার উদ্ভব হয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

ছয়.

নৃতত্ত্বের দিক দিয়ে প্রাচ্য ভারত তিনভাগে বিভক্ত–বিহার, বাঙলা ও ওড়িশা। এই তিন প্রদেশের অধিবাসিবৃন্দের প্রধান নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের বিস্তৃতশিরস্কতা। পশ্চিমে এই পর্যায়ের অস্তিত্ব আমরা বারাণসীর পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত লক্ষ্য করি। বিহার প্রদেশে এই পর্যায় বেশ ব্যাপকভাবে বর্তমান; কিন্তু বাঙলাদেশেই এই পর্যায় বিশেষভাবে ঘনীভূত হয়েছে। ওড়িশার অধিবাসিবৃন্দ এই পর্যায়েরই দক্ষিণতম: প্রতিনিধিস্বরূপ।

এই পর্যায়ের উৎপত্তি নিরূপণ করতে গিয়ে স্যার হারবার্ট রীজলি বাঙলার অধিবাসিবৃন্দকে মঙ্গোলীয় ও দ্রাবিড় জাতিদ্বয়ের সংমিশ্রণে উদ্ভূত বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বাঙালি ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ, চট্টগ্রামের রাজবংশী মগ, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের মাল এবং জলপাইগুড়িও রংপুরের কোচ জাতিগণকে একই পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরে নিয়েছিলেন, এবং যেহেতু বিস্তৃতশিরস্কতা ও বিস্তৃতনাসিকা যথাক্রমে মঙ্গোলীয় ও দ্রাবিড় জাতিদ্বয়ের বৈশিষ্ট্য, এবং এই দুই লক্ষণ উচ্চশ্রেণির বাঙালি ব্যতীত উপরি-উক্ত অন্যান্য জাতিসমূহের মধ্যে বিশেষভাবে পরিদৃষ্ট হয়, সেই হেতু তিনি অনুমান করে নিয়েছিলেন যে, তাদের এই দুই নৃতাত্ত্বিক লক্ষণ মঙ্গোলীয় ও দ্রাবিড় জাতিদ্বয়ের নিকট হতে প্রাপ্ত। কিন্তু রীজলি বাঙলার যেসকল জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিমাপে সমষ্টিগত ফলের উপর ভিত্তি করে উপরি উক্ত মত প্রকাশ করেছিলেন, সেইসকল জাতি যদিও বাঙলার রাষ্ট্রীয় গণ্ডীর মধ্যে বাঙালির সঙ্গে বাস করে, তথাপি তারা সকলে বাঙালি বলতে যা বুঝায়, তা নয়। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, বাঙলার উচ্চশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ব্রাহ্মণ, কায়স্থ প্রভৃতি জাতিসমূহ চট্টগ্রাম ইত্যাদি অঞ্চলের পার্বত্য উপজাতিগণের সঙ্গে এক নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের রাজবংশী মগগণ (যাদের পরিমাপ রীজলি নিজের মত পোষণের জন্য বাঙালি ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ইত্যাদি জাতিগণের পরিমাপের সঙ্গে সংমিশ্রিত করেছিলেন), মোটেই বাঙলাদেশের মৌলিক অধিবাসী নয়। তারা ইন্দোচীন নামক মঙ্গোলীয় পর্যায়ের অন্তর্গত এবং মাত্র কয়েক শত বর্ষ পূর্বে আরাকান দেশ থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেছে। তাদের বিচিত্র সামাজিক সংগঠন, ও আহং, সেপোটাং, পাংড়ুং, থাফাসু, থিয়াংগা প্রভৃতি অবাঙালি নাম থেকে সেটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয়। ঠিক এইভাবে, রংপুর ও জলপাইগড়ি অঞ্চলের কোচগণ ঐতিহাসিককালে উত্তরবঙ্গবিজেতা মঙ্গোলীয় পর্যায়সম্ভূত কোচজাতির বংশধর মাত্র। পাইয়া, লেথরু, লবু, অলিঙ্গ, এন্না, তানডু লোবাই প্রভৃতি এদের নামগুলোও সম্পূর্ণ অবাঙালির নাম। বাঁকুড়া, বীরভূম ও মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলের মালজাতিগণ রাজমহলের পার্বত্য অঞ্চল হতে বাঙলাদেশে এসে বসবাস করেছে এবং তারা সাঁওতালপরগণার মাল-পাহাড়িয়া, মাল প্রভৃতি জাতি থেকে অভিন্ন। বাঙলার সীমান্তাংশবাসী এই সমস্ত অবাঙালি উপজাতিসমূহের নৃতাত্ত্বিক লক্ষণগুলোর উপর ভিত্তি করে সমগ্র বাঙলাদেশের জনসংখ্যার নৃতাত্ত্বিক পর্যায় নিরূপণ করা যে সম্পূর্ণ অসমীচীন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয় প্রথম প্রমাণ করতে প্রয়াস পান যে বাঙালি-জাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে রীজলির মতবাদ সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক। পরে ড. বিরজাশঙ্কর গুহ কর্তৃক গৃহীত পরিমাপ চন্দের মতবাদকে যে সমর্থন করে, মাত্র তা নয়, বাঙলাদেশের নৃতাত্ত্বিক পরিস্থিতির উপর নতুন আলোকপাত করে।

গুহ মহাশয় বাঙলার রাঢ়া ব্রাহ্মণ, দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থ এবং চব্বিশপরগণার পোদ-জাতির যে নৃতাত্ত্বিক পরিমাপ নিয়েছিলেন, তা থেকে প্রকাশ পায় যে বাঙালি ব্রাহ্মণদের মাথা গোলাকার (শিরাকার-জ্ঞাপক সূচক-সংখ্যা ৭৮.৯৩) নাসিকা দীর্ঘ ও উন্নত এবং দেহ-দৈর্ঘ্যের গড় ১৬৮০ মিলিমিটার। কায়স্থদের মাথা ব্রাহ্মণদের চেয়ে কিছু বেশি গোল (শিরাকার-জ্ঞাপক সূচক-সংখ্যা ৮০.৮৪), নাসিকা প্রায় সমানভাবেই উন্নত ও দীর্ঘ এবং দেহ-দৈর্ঘ্য সামান্য পরিমাণেক ম (১৬৭০ মি. মি.)। পোদদের দেহ-দৈর্ঘ্য সর্বাপেক্ষা কম (১৬২৮ মি. মি.), মাথা কম গোল (শিরাকার-জ্ঞাপক সূচক-সংখ্যা ৭৭.১৩), মুখ ছোট ও অপ্রসারিত এবং নাক ছোট ও কম উন্নত। কায়স্থ ও ব্রাহ্মণদের গায়ের রঙ বাদামি, কিন্ত পোদদের গায়ের রঙ গভীর বাদামি। ব্রাহ্মণ ও কায়স্থগণের মধ্যে গরিষ্ঠসংখ্যকের চোখ ঘোর বাদামি, কিন্তু পোদদের চোখ অধিক পরিমাণে কালো। চুলের রঙ সকলেরই কালো।

আগেই বলা হয়েছে যে, বাঙালি জাতির বিস্তৃত-শির ও প্রসারিত- নাসিকা দেখে, তারা দ্রাবিড়-মঙ্গোলীয় জাতিসম্ভূত বলে রীজলি সিদ্ধান্ত করেছিলেন। কিন্তু রীজলির এই মতবাদের সপক্ষে কোনো বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ নেই। মঙ্গোলীয় জাতির আদিম অধিবাস ভারতবর্ষ নয়—ভারতবর্ষে তারা আগন্তুক মাত্র। সুতরাং পূর্বভারতের জাতিসমূহের বিস্তৃত-শিরস্কতা যদি মঙ্গোলীয় জাতির সংমিশ্রণে ঘটেছে বলে ধরে নিতে হয়, তা হলে এটা নিশ্চিত যে, মঙ্গোলীয় জাতি কর্তৃক বাঙলা দেশে কোনো বৃহৎ আক্রমণ সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু এরূপ কোনো আক্রমণ সম্বন্ধে ইতিহাস কোনো সাক্ষ্য দেয় না। অধিকন্তু বাঙালি জাতির আকৃতির মধ্যে এমন কোনো নৃতাত্ত্বিক লক্ষণ বা তাদের মধ্যে প্রচলিত এমন কোনো জনশ্রুতি বা কাহিনি নেই, যা দ্বারা তাদের মঙ্গোলীয় উৎপত্তি সমর্থিত হয়। পরন্তু, নেপাল ও আসামে এরূপ অনেক জনশ্রুতি প্রচলিত আছে, এবং এটাও আমরা জানি যে, এসকল দেশের অধিবাসিবৃন্দ মঙ্গোলীয় নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।

বাঙালি জাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে হরিবংশে (১১ অধ্যায়) যে কাহিনি আছে, সেই কাহিনি থেকে আমরা জানতে পারি যে পুরু (যযাতিপূত্র)- বংশে বলি নামে এক রাজা ছিলেন। উক্ত রাজার পাঁচ পুত্র ছিল, তাদের নাম যথাক্রমে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুহ্ম ও পুশু। মহাভারতের আদিপর্বেও অসুর-রাজ বলির এই পাঁচ পুত্রের উল্লেখ আছে। বলিরাজার এই পাঁচ সন্তান যে পাঁচটি রাজ্য শাসন করতেন, তাঁদের নাম থেকেই এই পাঁচটি রাজ্যের নামকরণ হয়েছিল। বলিরাজার এই পাঁচটি পুত্র বালেয় ক্ষত্রিয় নামে অভিহিত হয়েছেন, এবং তাঁরাই চারি বর্ণের সৃস্টি করেছেন। মৎস্য (৪৮।২৪।২৮) ও বায়ু পুরাণেও (৯৯।২৭) উক্ত হয়েছে যে, বলিরাজার পুত্রগণই জগতে চারি বর্ণের সৃষ্টি করেছেন।

এখন কথা হচ্ছে এই যে, এইসকল শাস্ত্রীয় প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও রীজলি কেন বাঙালি জাতিকে মঙ্গোলীয় জাতির সংমিশ্রণে উদ্ভূত, এই সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছিলেন? আগেই বলা হয়েছে—তার প্রধান কারণ বাঙালি জাতির বিস্তৃত-শিরস্কতা। কিন্তু বিস্তৃত-শিরস্কতা এক মাত্ৰ মঙ্গোলীয় জাতির বৈশিষ্ট্য নয়। বস্তুত বিস্তৃত-শিরস্কতাব্যতীত মঙ্গোলীয় জাতির নিজস্ব কতকগুলো বৈশিষ্ট্যও আছে, যা মঙ্গোলীয় জাতি ছাড়া অন্য জাতিসমূহের মধ্যে কখনো দেখা যায় না। যেমন, তাদের ঋজু সরল চুল, চোখের খাঁজ (Epicanthic fold), গুণ্ডাস্থির প্রাধান্য, পীতাভ গায়ের রঙ ইত্যাদি। বলা বাহুল্য এইসমস্ত মঙ্গোলীয় লক্ষণ বাঙালিদের মধ্যে নেই। উপরন্তু, দার্ঘশিরস্ক মঙ্গোলীয় জাতিও যথেষ্ট পরিমাণে ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তপ্রদেশে দেখতে পাওয়া যায়।

এটা সত্য যে বাঙলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তপ্রদেশের অধিবাসিবৃন্দ মঙ্গোলীয় জাতি-সম্ভূত। কিন্তু এই সম্পর্কে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যদিও বাঙলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তপ্রদেশের ভুটিয়া, ল্যাপচা প্রভৃতি জাতিসমূহ বিস্তৃত-শিরস্ক, তথাপি উত্তরবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে দীর্ঘশিরস্কতারই প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। ঠিক তদ্রূপ, যদিও পূর্ব- সীমান্তের মঙ্গোলীয় জাতিসমূহ দীর্ঘশিরস্ক, পূর্ববাঙলার বাঙালিরা কিন্তু বিস্তৃত-শিরস্ক। কগিন ব্রাউন ও এস. ডব্লিউ, কেম্প পূর্ব-সীমান্তের আবরজাতির যে নৃতাত্ত্বিক পরিমাপ গ্রহণ করেছিলেন, তা থেকে দেখা যায় যে তাদের মধ্যে শতকরা গড়ে ৩২ জন দীর্ঘশিরস্ক ও মাত্র ৬ জন বিস্তৃত- শিরস্ক। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে পরস্পর সান্নিধ্য-হেতু বাঙলার অধিবাসিবৃন্দের সঙ্গে যদি সীমান্ত প্রদেশস্থ মঙ্গোলীয় জাতিসমূহের সংমিশ্রণ ঘটে থাকত, তা হলে উত্তরবিভাগে এটা বাঙালির বিস্তৃত- শিরস্কতায় ও পূর্ববিভাগে দীর্ঘশিরস্কতায় প্রতিফলিত হতো। কিন্তু আমরা দেখছি যে প্রকৃত নৃতাত্ত্বিক পরিস্থিতি এর বিপরীত সাক্ষ্য বহন করে।

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে পশ্চিম ও প্রাচ্য ভারতের বিস্তৃত- শিরস্ক জাতিসমূহ একই নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ের অন্তর্গত এবং তারা উত্তরভারতের দীর্ঘশিরস্ক নৃতাত্ত্বিক পর্যায় থেকে পৃথক। পশ্চিম ও প্রাচ্য ভারতের এবং উত্তরপ্রদেশের জাতিসমূহের যে নৃতাত্ত্বিক পরিমাপ নিচে দেওয়া হচ্ছে, তা থেকে এটা স্পষ্টই প্ৰকাশ পায়—

জাতিশির-সূ:নাসিকা-সূ:দেহ দৈৰ্ঘ্য মি. মি.
নাগর ব্রাহ্মণ৭৯.৭৭৩.১১৬৪৩
গুজরাটী বেনিয়া৭৯.৩৭৫.৭১৬১২
প্ৰভুকায়স্থ৭৯.৯৭৫.৮১৬২৭
বাঙালা ব্ৰাহ্মণ (১)৭৮.৮৭০.৮১৬৭৬
বাঙালি কায়স্থ (২)৭৮.৪৭০.৭১৬৩৬
উত্তর প্রদেশের ব্রাহ্মণ৭৩.১৭৪.৬১৬৫৯
উত্তর প্রদেশের কায়স্থ৭২.৬৭৪.৮১৬৪৮
বিহারী ব্রাহ্মণ৭৪.৯৭৩.২১৬৬১
ড. বিরজাশঙ্কর গুহ কর্তৃত পরিমাণ হচ্ছে-
(১) বাঙালি বাহ্মণ – ৭৮.৯ – ৬৭.৯ – ১৬৮০
(২) বাঙালি কায়স্থ – ৮০.৮ – ৬৮.৯ – ১৬৭০

পশ্চিম ও প্রাচ্য-ভারতের অধিবাসিবৃন্দের মধ্যে নৃতাত্ত্বিক পর্যায়গত সাদৃশ্য থাকা হেতু এরূপ সিদ্ধান্ত করা ব্যতীত উপায় নেই যে, অতি প্ৰাচীন কালে কোনো বিস্তৃত-শিরস্ক জাতির লোকেরা বহু সংখ্যায় গুজরাট প্রভৃতি প্রদেশের ন্যায় বাঙলা দেশেও এসে বসবাস করতে আরম্ভ করেছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে–এরা কারা? এর জবাব দেওয়া খুবই সহজ।

এই বিস্তৃত-শিরস্ক জাতির অধিম অধিবাস সম্বন্ধে রমাপ্রসাদ চন্দ প্রথম সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পঞ্চনদের পশ্চিমে বালুচিস্তান ও আফগানিস্থানের বালুচ ও পাঠান জাতীয় লোকগণ আর্যভাষাভাষী এবং নাতিদীর্ঘশিরস্ক (Mesaticephalic); এদের মধ্যে দীর্ঘশিরস্কতা ও বিস্তৃত-শিরস্কতা যথাক্রমে ইরানীয় ও তুরানীয় জাতিসমূহ হতে প্রাপ্ত, এই সিদ্ধান্ত করে স্যর হারবার্ট রীজলি এদের ‘তুর্ক-ইরানীয়’ পর্যায়ভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু মধ্য-এশিয়ার পামির ও চৈনিক তুর্কীস্থানের জাতিসমূহের সম্পর্কে উজফালভী (Ujfalvy) ও স্যর অরেল ষ্টাইন (Sir Aurel Stein) যে নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করেছিলেন তার ফলে আমরা জানতে পারি যে, বালুচ ও পাঠান, গুজরাটী, মারাঠী, কুর্গ এবং বাঙালি ও ওড়িয়া জাতিসমূহের বিস্তৃত-শিরস্কতার জন্য আমাদের তুর্ক, শক, মঙ্গোলীয় প্রভৃতি জাতিসমূহকে টেনে আনবার কোনো প্রয়োজন নেই। আগেই বলা হয়েছে যে তুর্ক, শক ও মঙ্গোলীয় জাতিসমূহের নিজেদের যেসকল নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য আছে, তা এ সকল জাতিগণের মধ্যে মোটেই নেই। পরন্তু, পামির ও চৈনিক তুর্কীস্থানের জাতিসমূহের সঙ্গে এদের নৃতাত্ত্বিক লক্ষণগুলো সম্পূর্ণভাবে মিলে যায়।

পামির ও চৈনিক তুর্কীস্থানের নৃতাত্ত্বিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে টি. এ. জয়েস (T. A. Joyce) যে সংক্ষিপ্ত বিবরণী প্রকাশ করেছেন তা থেকে আমরা জানতে পারি যে, তাকলামাকান মরুদেশের চতুষ্পার্শ্বস্থ দেশসমূহের জাতিগণের মধ্যে একটা মোটামুটি নৃতাত্ত্বিক ঐক্য আছে। এই নৃতাত্ত্বিক পর্যায়টি আমরা বিশুদ্ধ অবস্থায় লক্ষ্য করি ওয়াখিগণের (Wakhis) মধ্যে। এই অঞ্চলের অধিবাসিবৃন্দের যে নৃতাত্ত্বিক পরিমাপ গ্রহণ করা হয়েছে তার জটিলতার মধ্য দিয়ে লক্ষ্য করবার মতো বস্তু এই যে পামির ও তাকলামাকান মরুদেশের আদিম অধিবাসিরা আলপাইন (Alpine) পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত, কেবলমাত্র পশ্চিমে ইন্দো-আফগান পর্যায়ের সঙ্গে এদের কিছু সংমিশ্রণ ঘটেছে। কিন্তু এটা সুনিশ্চিত যে এই সকল অঞ্চলের সাধারণ অধিবাসিবৃন্দের ওপর মঙ্গোলীয় জাতির প্রভাব নেই বললেই হয়। এই অঞ্চলের পর্যায়গুলোর নৃতাত্ত্বিক লক্ষণগুলো এরূপ

প্রথম পর্যায়—বিস্তৃত-শিরস্ক, গোলাপি আভাবিশিষ্ট গৌরবর্ণত্বক, দেহ- দৈর্ঘ্য গড়ের ওপর, পাতলা উন্নত দীর্ঘনাসিকা- তা সরল থেকে কুজ, লম্বা ডিম্বাকৃতি মুখ, বাদামি রঙের চুল—সাধারণত খুব ঘোর এবং তা প্রচুর ও ঢেউখেলান, ও চোখ প্রধানত মধ্যম শ্রেণির। এরা লা পুজের (La Pouge) আলপাইন পর্যায়ভুক্ত।

দ্বিতীয় পর্যায়—বিস্তৃত-শিরস্ক, গায়ের রঙ ফরসা, কিন্তু সামান্য বাদামি আভাবিশিষ্ট; দেহ-দৈর্ঘ্য গড়ের ঊর্ধ্বে; নাক সরল, কিন্তু প্রথম পর্যায় অপেক্ষা বিস্তৃত; গণ্ডাস্থি চওড়া চুল প্রথম পর্যায় অপেক্ষা সরল— তা ঘোর বর্ণ ও অপ্রচুর, চোখ কালো। এরা তুর্কী পর্যায়ভুক্ত।

তৃতীয় পর্যায়-নাতিদীর্ঘ-শিরস্ক, দীর্ঘ দেহ, পাতলা উন্নত কুজ নাসিকা, লম্বা ডিম্বাকৃতি মুখ, কালো ঢেউখেলান চুল ও কালো চোখ। এরা ইন্দো-আফগান পর্যায়ভুক্ত।

পামির ও চৈনিক তুর্কীস্থানের নৃতাত্ত্বিক পরিস্থিতি থেকে এটা স্পষ্টই প্রমাণ হচ্ছে যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে পামির ও তাকলামাকান মরু অঞ্চলে বিস্তৃত-শিরস্ক এক জাতি বাস করত। এরা পাশ্চাত্য ইউরোপে প্রচলিত ইটালোসেলটিক ভাষার অনুরূপ এক আর্য-ভাষাভাষী ছিল এবং পশ্চিম ইউরোপের অধিবাসিবৃন্দ ওই একই বিস্তৃত-শিরস্ক পর্যায় -সম্ভূত বলে এদের নামকরণ করা হয়েছে ‘অ্যালপাইন’ পর্যায়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশে এবং বালুচিস্তানে এই পর্যায় বৈদিক আর্য ও দ্রাবিড় জাতির সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়ে, তথায় নাতিদীর্ঘ-শিরস্ক ইন্দো-আফগান’ পর্যায়ের সৃষ্টি করেছে। এই একই পর্যায় ভারতের অন্যত্রও আদিম অধিবাসিগণ (Proto-Australoid), বৈদিক আর্য এবং দ্রাবিড় জাতির সহিত সংমিশ্রিত হয়ে নাতিদীর্ঘ পর্যায়ের সৃষ্টি করেছে। অনেকে মনে করেন যে ‘অ্যালপাইন’ পর্যায়ভুক্ত, বিস্তৃত-শিরস্ক জাতিসমূহ বৈদিক আর্যদের অব্যবহিত পরে ভারতবর্ষে এসে আর্যাবর্তের দেশসমূহ বৈদিক আর্যগণ কর্তৃক অধিকৃত দেখে পশ্চিম উপকূল ধরে নেমে এসে মধ্যভারতের মালভূমির ভিতর দিয়ে গঙ্গানদীর নিম্ন উপত্যকায় গিয়ে বসাবাস শুরু করে। তাদেরই অপর এক শাখা কাথিয়াবাড়, গুজরাট ও পশ্চিম ভারতে বসবাস শুরু করে। কিন্তু অপর পক্ষে, এরূপ সিদ্ধান্ত করবার সপক্ষেও যথেষ্ট কারণ আছে যে অ্যালপাইন পর্যায়ভূক্ত একদল এশিয়া মাইনর বা বালুচিস্তান থেকে পশ্চিম সাগরের উপকূল ধরে অগ্রসর হয়ে ক্রমশ সিন্ধু, কাথিয়াবাড়, গুজরাট, মহারাষ্ট্রকুর্গ, কন্নাদ ও তামিলনাড়ু প্রদেশে পৌঁছায় এবং আর একদল পূর্ব-উপকূল ধরে বাংলা ও ওড়িশায় আসে। আরও মনে হয়, তারা দ্রাবিড়দের অনুসরণে সমুদ্রপথে আর্যদের পূর্বেই ভারতে এসে পৌঁছেছিল।

বাঙালি যে মঙ্গোলীয় জাতিসম্ভূত নয়, তার যথেষ্ট প্রমাণ আমরা দিয়েছি। দ্রাবিড় জাতির সঙ্গেও তাদের খুব বেশি রক্ত-সম্বন্ধ নেই। রীজলির সময়ে দ্রাবিড় জাতিগণকেই ভারতের আদিম অধিবাসী বলে মনে করা হতো। এবং সেজন্যই তিনি বাঙালির নৃতাত্ত্বিক গঠনে দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণ আছে, এরূপ অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রমাণ হয়েছে যে আর্য-ভাষিগণের ন্যায় দ্রাবিড় জাতিগণও ভারতে আগন্তুক মাত্র। তাদের পূর্বে ভারতে প্রাক্ -দ্রাবিড় (Pre-Dravidians) বা আদি-অস্ত্রাল (Proto-Australoid) জাতিসমূহ বাস করত এবং তারাই ভারতের আদিম অধিবাসী। তাদের বংশধরগণকেই আজ আমরা ভারতের বনে, জঙ্গলে ও পার্বত্য অঞ্চলসমূহে দেখতে পাই। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, নিম্ন সম্প্রদায়ের বাঙালির মধ্যে বেশ কিছু পরিমান প্রাক্-দ্রাবিড় রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছে।

তবে উচ্চশ্রেণির বাঙালি যে অ্যালপাইন পর্যায়ভুক্ত, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জগতের সমস্ত নৃতত্ত্ববিদগণ এটা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে নিয়েছেন। একথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে আজ কায়স্থ প্রভৃতি উচ্চশ্রেণির বাঙালির মধ্যে যে সকল পদবি প্রচলিত আছে (যেমন ঘোষ, বসু, মিথ্য, দত্ত, দেব, বর, গুপ্ত, নাগ, পাল, সেন, চন্দ্র, প্রভৃতি) এগুলো এক সময় ব্রাহ্মণগণের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। ড. দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকার দেখিয়েছেন যে, পশ্চিম-ভারতে ওই একই নৃতাত্ত্বিক পর্যায়ের অন্তর্গত নাগর-ব্রাহ্মণগণের মধ্যেও ঠিক অনুরূপ পদবির প্রচলন আছে। বোধ হয় এক সময়ে এগুলো অ্যালপানি পর্যায়ের উপশ্রেণির (Tribes) নাম মাত্র ছিল, এবং পরে বর্ণসৃষ্টির সময়ে সেগুলো জাতিবাচক পদবি হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। সে যাই হোক, বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়- সম্পর্কিত এই আলোচনার ফলে এটা পরিষ্কার প্রমাণিত হচ্ছে যে, বাঙালি রীজলির তথাকথিত মঙ্গোলীয়-দ্রাবিড়-গোষ্ঠী সম্ভূত নয়।

Leave a Reply to Suboron Surjo Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *