প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০৭. লোকায়ত, বৈষ্ণব, সহজিয়া

লোকায়ত, বৈষ্ণব, সহজিয়া

অবশ্যই, লোকায়ত নিয়ে সমস্যাটা শুধুমাত্র প্রাচীন ইতিহাসের সমস্যা নয়। কেননা, খুব পুরোনো কালের লেখায় লোকায়তিকদের উল্লেখ পাওয়া গেলেও, লোকায়ত বলতে শুধুমাত্র প্রাচীন কালের কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ বোঝা উচিত নয়।

এ-বিষয়ে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মন্তব্য উল্লেখ করেছি। তিনি দেখাচ্ছেন, আজো ভারতবর্ষের নানান জায়গায় নানান রকম নামের আড়ালে ওই লোকায়ত আর কাপালিক মতবাদ টিকে রয়েছে। বিশেষ করে তিনি দুটি সম্প্রদায়ের কথা তুলছেন, বৈষ্ণব আর সহজিয়া। এই যে বৈষ্ণব সম্প্রদায়, এ-হলো নামেই বৈষ্ণব—কেননা, বিষ্ণু কিংবা কৃষ্ণ অবতারের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কই নেই। তার বদলে, এ-জাতীয় সম্প্রদায়গুলির কাছে দেহতত্ত্বই হলো চরমতত্ত্ব, সাধনা বলতে সবটুকুই কামসাধনা।

অতএব, মহামহোপাধ্যায় বলছেন, এ-জাতীয় সম্প্রদায়গুলিকে লোকায়তিক আখ্যাই দিতে হবে।

কিন্তু যে-লোকায়ত চিন্তাধারা দেহতত্ত্বের গানে, সহজিয়া, তন্ত্র বা ওই ধরনের অজস্র নামের আড়ালে, দেশের পিছিয়ে-পড়া অঞ্চলে এবং সামাজিক মর্যাদাহীন নিচু স্তরের মানুষদের মধ্যে আজো এ-ভাবে টিক রয়েছে তার সঙ্গে মাধবাচার্য বর্ণিত ওই ধারালো, মার্জিত দার্শনিক মতবাদটির সম্পর্ক ঠিক কী?

সম্পর্কের একটা নমুনা দেখুন :

এ ব্রাহ্মণ বুঝি নদীতে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি ভরে জল নিয়ে তর্পণ করছিলো। তাই দেখে সহজিয়ারা গান(৩৯) গেয়ে বলছে : ওগো বামুন, এতো সহজেই যদি সুদূর পরলোক পর্যন্ত জল পাঠাতে পারো তাহলে কাছে পিঠে ওই যে চাষের ক্ষেত সেখানে জল পৌঁছে দেবার জন্যে আর হাঙ্গামা করা কেন?

যাগযজ্ঞ সম্বন্ধে লোকায়তিকদের যে-সব তীব্র বিদ্রুপের বর্ণনা মাধবাচার্য দিয়েছেন সহজিয়াদের এই গান প্রায় হুবহু সেই রকমের নয় কি? মাধবাচার্য(৪০) লিখেছেন, লোকায়তিকেরা বলে শ্রাদ্ধপিণ্ড যদি পরলোকে কারুর ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করতে পারে তাহলে গ্রামান্তরে যাবার সময় চিঁড়েমুড়ির পোঁটলাটাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার দরকার কি?

কিন্তু শুধু সহজিয়াই নয়। দেহবাদী নানান সম্প্রদায় আজো আমাদের দেশে বেঁচে রয়েছে। লোকায়ত-দর্শন বুঝতে হলে এগুলিকেও ঠিকমতো বুঝতে হবে।

—————-
৩৯. H. P. Shastri op. cit, 4.
৪০. সর্বদর্শনসংগ্রহ ৫।