প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০৬. সন্তান উৎপাদন আর ধন-উৎপাদন

সন্তান উৎপাদন আর ধন-উৎপাদন

লোকায়তিকদের কথায় ফিরে আসা যাক। কাপালিকদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে যে সমস্যা উঠেছিলো বৈদিক সাহিত্যের নজির থেকেই তার যেন একটা কিনারা পাওয়া যাচ্ছে। বৃহস্পতি বলছেন, লোকায়ত আর কাপালিক দু’-এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। শুধু বৃহস্পতিই নন, গুণরত্নের লেখা বইতেও এই কথাই। এদিকে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দেখছেন, লোকায়ত হলো অর্থসাধনশাস্ত্র—আধুনিক ভাষায় ধনউৎপাদনের শাস্ত্র, সায়েন্স অব ইকনোমিক্স। অপর পক্ষে, কাপালিক হলো কামসাধনশাস্ত্র, মহামহোপাধ্যায়ের ভাষায় সায়েন্স অব ইরোটিক্স।

অবশ্যই, আমাদের আধুনিক ধারণা অনুসারে ইকনোমিক্স-এর সঙ্গে ইরোটিক্স-এর—ধনউৎপাদনের সঙ্গে কামসাধনের—কোনো সম্পর্ক নেই। আর যদি তা না থাকে তাহলে সেকালের পুঁথিপত্রে লোকায়তিকদের সঙ্গে কাপালিকদের অভেদ-সূচক যে-সব কথাবার্তা সেগুলির তাৎপর্য খোঁজবার কোনো মানে হয় না। মহামহোপাধ্যায়ের নিজের লেখার মধ্যে এই রকমেরই একটা পরাজয় স্বীকার করার ইঙ্গিত থেকে গিয়েছে। এক জায়গায় তিনি বলেছেন, প্রাচীনদের মত অনুসারে লোকায়ত ও কাপালিক আলাদা নয়। আর এক জায়গায় তিনি বলছেন, লোকায়তিকেরা ছিলেন অর্থনীতি বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা, কাপালিকেরা কামশাস্ত্রের : কিন্তু দু’-এর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে তিনি কোনো কথাই তুললেন না। অথচ তা যদি না তোলা হয় তাহলে লোকায়ত আর কাপালিক যে কী করে এক হলো সে-সমস্যার সমাধান চেবার চেষ্টাই করা হলো না।

অথচ, আমরা দেখলাম বৈদিক সাহিত্যের আলোচনা এ-সমস্যার উপর কিছুটা আলোকপাত করতে পারে। কেননা, বৈদিক সাহিত্য থেকে অন্তত এটুকু বোঝা গেলো যে আজকালকার দিনে ধনউৎপাদন ও সন্তানউৎপাদনকে আমরা যতোখানিই সম্পর্কহীন ও বিচ্ছিন্ন চেষ্টা মনে করি না কেন প্রাচীনকালের কোনো একটা যুগের মানুষ তা মনে করতো না। আর তাহলে কি এমনটা হতে পারে না যে, যে-কালের বা যে-স্তরের ধ্যানধারণার স্মারক বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে টিকে রয়েছে সেই-স্তরের চেতনা থেকেই লোকায়ত ও কাপালিক মতের উৎপত্তি? সকলেই বলছেন, লোকায়তিকদের মতে অর্থ ও কামই হলো পরম-পুরুষার্থ; কিন্তু এমন কথা তো কেউই বলছেন না যে মানব-চেতনার একটি পুরানো স্তরে যেহেতু অর্থসাধন ও কামসাধন স্বতন্ত্র প্রচেষ্টা নয় সেই হেতু এমনটা হওয়া নিশ্চয়ই অসম্ভব নয় যে, সেই স্তরের চেতনাই লোকায়তিকদের মধ্যে প্রতিফলিত—তাদের কাছে হয়তো অর্থ ও কাম স্বতন্ত্র পুরুষার্থ নয়, একই পুরুষার্থের যেন এপিঠ-ওপিঠ।

অবশ্যই মানি, বৈদিক সাহিত্যে বামাচারের বা কামাচারের স্মারককে সূত্র হিসেবে অবলম্বন করে লোকায়তিকদের কথা বোঝবার চেষ্টা করলে রাশি রাশি প্রশ্ন উঠবে। কেননা, বেদনিন্দুক বা নাস্তিক বলেই যাদের প্রধান পরিচয় বেদমন্ত্রের সাহায্যে তাদের কথা বুঝতে পারবার দাবিটা সরাসরি অসম্ভব মনে হবারই কথা। বিশেষত, আর্য-অনার্য মতবাদ রয়েছে—পণ্ডিত মহলে অনেকেরই ধারণা বৈদিক সাহিত্যে যে রকম বিশুদ্ধ আর্য-সাহিত্য বামাচারাদি তেমনিই বিশুদ্ধ অনার্য-ব্যাপার। তাই, এই সাহায্যে ওকে বোঝবার চেষ্টা একান্তই অসম্ভব।

আমরা কিন্তু বলতে চাই, তা নয়। শুধুই যে কিছুকিছু বেদমন্ত্রের সাহায্যে বেদনিন্দুকদের কথা বুঝতে পারা যায় তাই নয়, বেদনিন্দুকদের কিছুকিছু কথা বিচার করেও বৈদিক সাহিত্যকে বোঝবার অবকাশ রয়েছে। তার কারণ আমরা প্রথম পরিচ্ছেদেই আলোচনা করেছি : বৈদিক বা অ-বৈদিক যে-কোনো ধ্যানধারণাই হোক না কেন, প্রত্যেকটিরই উৎসে রয়েছে সমাজ-বিকাশের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের কথা। এবং সমাজ-বিকাশের যে পর্যায়টির মধ্যে লোকায়তিক চেতনার উৎস বৈদিক মানুষেরাও এককালে সেই পর্যায়েই বাস করতেন, ফলে তাঁদের রচনায় সেই পর্যায়ের স্মারক টিকে থাকা নিশ্চয়ই অসম্ভব নয়। তাই, উত্তরকালে বেদপন্থী ও বেদনিন্দুকদের মতাদর্শে যতোই প্রভেদ দেখা দিক না কেন, বৈদিক সাহিত্যের স্মারকের সাহায্যেই ওই বেদনিন্দুকদের কিছুকিছু কথা বুঝতে পারার সম্ভাবনা সত্যিই রয়েছে। অবশ্যই এ-কথা বলতে গেলে বিদগ্ধ সমাজে যে-মতবাদ প্রায় স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে—অর্থাৎ আর্য-অনার্য বা আর্য-দ্রাবিড় মতবাদ—তার সংঙ্কীর্ণতা ঠিক কোথায় সে-প্রশ্ন নিয়েও আলোচনা তোলা দরকার। কিন্তু শুরুতেই যদি এতো রকম সমস্যার জোটে জড়িয়ে পড়তে হয় তাহলে আর অগ্রসর হবার সম্ভাবনা থাকে না। তাই, আপাতত শুধু বামাচার বা কামাচারের কথাটা আরো একটু তলিয়ে দেখা যাক।

কথা হলো, কোনো এক যুগে,—কিংবা আরো সাবধানে বললে বলা উচিত মানব সমাজের ক্রমোন্নতির কোনো এক পর্যায়ে,–সন্তান উৎপাদন ও ধন-উৎপাদনকে মানুষ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দুটি ক্রিয়া বলে চিনতে শেখে নি। সে-যুগটা যাই হোক না কেন, সে-পর্যায়টা যাই হোক না কেন, বৈদিক সাহিত্যের সাক্ষ্যকে যদি আপনি গুরুত্ব দিতে রাজী হন তাহলে আপনাকে মানতেই হবে যে, বৈদিক মানুষেরাই এককালে ক্রমোন্নতির এ-রকম একটা পর্যায়ে বেঁচে ছিলো। তারই রাশি রাশি স্মারক রয়েছে বৈদিক সাহিত্যে। এ-কথা যদি আপনি না মানেন তাহলে আপনাকে বলতে হবে মৈথুন নিয়ে অমন প্রচণ্ড উৎসাহটা বৈদিক ঋষিদের পক্ষে অতি কদর্য কামবিকারেরই পরিচয়। আমরা আপনার কথায় সায় দিতে পারবো না। কেননা, আমরা দেখছি বৈদিক রচনায় যেখানে কামাচারের কথা সেখানে রসালো অশ্লীলতা উপভোগ করবার কোনো রকম লক্ষণই নেই। বরং এই বামাচার যে তাঁদের কাছে কতোখানি গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্দেশ্যমূলক ব্যাপার তার পরিচয় তাঁরা দিয়েছেন একে যজ্ঞের সঙ্গে তুলনা করে, সামগানের সঙ্গে তুলনা করে। যজ্ঞ ও সামগানের সঙ্গে তুলনা করে। যজ্ঞ ও সামগান সম্বন্ধে আজকের দিনে আমরা যতো হালকা কথাবার্তাই বলতে শিখি না কেন, তাঁদের কাছে এগুলিই ছিলো জীবনের সর্বস্ব।

বেদে লেখা আছে,–কথাটা তাই মানতেই হবে। মানতেই হবে, ক্রমোনতির কোনো এক পর্যায়ে মানুষ সত্যিই মনে করেছিলো, মিথুনের দরুন শুধু সন্তান উৎপাদনই নয়, ধন উৎপাদনও সম্ভবপর। তাই, সমস্যা হলো : এ-পর্যায় সম্বন্ধে সংবাদ সংগ্রহ করা যাবে কোথা থেকে?

একবার উল্টো দিক থেকে চেষ্টা করা যাক। বেদনিন্দুকদের কথা বোঝবার আশায় বৈদিক সাহিত্যের সাহায্য নেওয়া গিয়েছে। এবার দেখা যাক বৈদিক সাহিত্যে বামাচারে ওই স্মারকগুলি মানব চেতনার ঠিক কোন স্তরের পরিচায়ক সে-কথা বোঝবার ব্যাপারে বেদনিন্দুকদের দিক থেকে এগোলে কি কোনো সুবিধে হতে পারে?

গুণরত্নের কথা বলেছি। লোকায়ত-সংক্রান্ত তাঁর কিছুকিছু মন্তব্যের উল্লেখ করেছেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী : লোকায়তিকেরা যোগী, তারা গায়ে ভস্ম মাখে, তারা বামাচারী, তারা কাপালিক। গুণরত্ন কিন্তু লোকায়তিকদের সম্বন্ধেই আরো কিছু কথা বলেছেন, মহামহোপাধ্যায় তার উল্লেখ করেন নি।

গুণরত্ন বলেছেন, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে লোকায়তিকেরা একত্র সমবেত হয়। তারা একত্রে মিলিত হয় এবং প্রমত্ত হয় নির্বিচার মৈথুনে।

বর্ষে বর্ষে কস্মিন যপি দিবসে সর্ব্বে সংভূত যথানাম নির্গমম্‌ স্ত্রীতিঃ অভিরম্যস্তে(২৭)…

বলাই বাহুল্য, লোকায়তিকদের সম্বন্ধে এই সংবাদটি দেবার পিছনেও গুণরত্নের আসল উদ্দেশ্যটা হলো তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচার করা। কিন্তু তা হোক। তবুও গুণরত্ন লোকায়তিকদের সম্বন্ধে এই যে খবরটি দিলেন এর জন্যে ভারতীয় দর্শনের প্রত্যেক ছাত্রই তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে। কেননা, এটুকু সংবাদের মধ্যে শুধুই যে লোকায়তিক দৃষ্টিভঙ্গির উৎস সম্বন্ধে মূল্যবান ইঙ্গিত পাওয়া গেলো তাই নয়, বামাচাঈ ক্রিয়াকাণ্ডগুলি মানব সমাজের ঠিক কোন স্তরের পরিচায়ক সে-কথা অনুমান করবারও একটি সুযোগ পাওয়া গেলো।

গুণরত্নের দেওয়া এই তথ্যটি সম্বন্ধে ভালো করে ভেবে দেখুন। ব্যাপারটা কী? মানুষগুলো এক জায়গায় জড়ো হচ্ছে, একত্রে পানাহার করছে, প্রমত্ত হয়ে উঠছে অবারিত মৈথুনে! একে কি কোন একরকম দলগত কামবিকার বলতে হবে নাকি? এখানেও সেই একই কথা। শুধুমাত্র একালের লাম্পট্য-ব্যবহারকে সম্বল করলে সেকালের আচরণকে বুঝতে পারা যাবে না।

তাহলে? বুঝতে পারবার আশায় কোন পথ ধরে এগোবো?

ভেবে দেখতে হবে, পৃথিবীর আনাচে-কানাচে আজ যে-সব পেছিয়ে-পড়া মানুষের দল টিকে রয়েছে তাদের মধ্যে এ-ধরনের আচরণ সত্যিই দেখতে পাওয়া যায় কি না। যদি সত্যিই দেখতে পাওয়া যায় তাহলে প্রশ্ন তুলতে হবে, ঠিক কী ভেবে তারা এ-ধরনের আচরণ করছে? তাদের চেতনাতেও কি এ-আচরণ শুধু লাম্পট্য, না, এরই সাহায্যে তারা কোনো রকম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য সাধন করবার চেষ্টা করছে? হয়তো তাদের সে-চেষ্টাটা শুধুই কল্পনা, বাস্তব তথ্যের দিক থেকে হয়তো তার পুরোটাই ভুল। তবুও আসল প্রশ্ন তা নয়। প্রশ্ন হলো, তাদের ধারণাটা ঠিক কী? সে-ধারণার সঙ্গে আমাদের ধারণার মিল আছে কি?

প্রাচীন পুঁথিপত্রগুলির যে-সব কথার কোনো রকম মানে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এইদিক থেকে এগোলে হয়তো তার মানে পাওয়া যেতে পারে। তার কারণ, পুঁথিগুলি প্রাচীন বলেই সেগুলির মধ্যে ওই পিছিয়ে-পড়া সমাজের মানুষদের চেতনার রেশ থেকে যাওয়া অসম্ভব নয়।

তাহলে প্রাচীন পুঁথির অর্থ অম্বেষণ করবার সময় শুধুমাত্র পুঁথির রাজ্যে আবদ্ধ থাকলেই চলবে না। পুঁথির রাজ্য ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে এই বাস্তব পৃথিবীতে—যে-পৃথিবীতে সব মানুষের সমান উন্নতি হয় নি, কেউ বা এগিয়ে গিয়েছে, উঠে এসেছে সভ্যতার হিমাদ্রিশিখরে, তাদের চেতনা থেকে অনেকাংশেই বিলুপ্ত হয়েছে নিজেদের অসভ্য অতীতের স্মৃতি; আর তাই, যারা পিছিয়ে পড়ে রয়েছে তাদের দিকে নজর করলে—ভালো করে নজর করলে—সভ্য মানুষদের এই ভুলে যাওয়া অতীতকে খুঁজে পাওয়া হয়তো অসম্ভব হবে না। আর এইদিক থেকে আলো পেয়েই আমরা হয়তো দেখতে পাবো আমাদের সুদূর পূর্বপুরুষেরা ঠিক কী ভেবে, কোন ধারণায় বিশ্বাস করে ওই জাতীয় কথাবার্তা লিখে গিয়েছেন।

কথাটা বিশেশ করে তুললাম, বৈদিক সাহিত্যে বামাচারের চিহ্নগুলি বোঝবার প্রসঙ্গে। কিন্তু, বৈদিক সাহত্যে আদিম চিন্তার স্বাক্ষর বলতে শুধু ওই বামাচার নয়। আরো নানা রকম চিহ্ন আছে। সেগুলিকেও বুঝতে হবে। তাই, কোন পদ্ধতিতে বোঝা সম্ভব এ-বিষয়েও একটা স্পষ্ট ধারণা পেতে হবে। আপাতত বামাচারী চেতনার উৎস নিয়েই অনুসন্ধান চালানো যাক। এ-অনুসন্ধান যদি সফল হয় তাহলে নিশ্চয়ই আশা করা ভুল হবে না যে, যে-পদ্ধতির অনুসরণে তা সফল হলো তারই সাহায্যে বৈদিক সাহিত্যে টিকে থাকা আদিম ধ্যানধারণার অন্যান্য চিহ্নই বুঝতে পারা যাবে। শুধু তাই নয়, মানবজাতির ক্রমোন্নতি-পথের ঠিক কোন স্তরের চেতনায় লোকায়তিক-বামাচারের উৎস সে-কথা নির্ণয় করা যদি সম্ভব হয় তাহলে হয়তো তারই সাহায্যে অনুমান করা যাবে, বৈদিক সাহিত্যের বামাচারের স্মারকগুলিও ঠিক কোন ধরনের সমাজবিকাশের পরিচায়ক। অর্থাৎ কিনা, বামাচারের ওই স্মারকগুলিই হয়ে দাঁড়াতে পারে একটি নির্দিষ্ট সমাজ-সংগঠনের সাক্ষ্য। তার মানে অবশ্যই এই নয় যে, বৈদিক বামাচার ও লোকায়তিক বামাচার হুবহু একই রকমের। দু’-এর মধ্যে তফাত আছে : বৈদিক বামাচার মূলতই পুরুষপ্রধান—ঝোঁকটা শুধুই পুরুষের উপর, যা কিছু ভাবা হচ্ছে বা বলা হচ্ছে তা পুরুষের তরফ থেকে। যেমন ধরুন, ছান্দোগ্যের ঋষি বলছেন : কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না। বৃহদারণ্যকের ঋষি আরো এক-পা এগিয়ে যাচ্ছেন; বলছেন, নারী যদি মৈথুনে রাজী না হয় তাহলে কিলঘুঁষি এমনকি লাঠি মেরে তাকে রাজী করাতে হবে। উপনিষদ থেকেই এই পুরুষ-প্রাধান্যের আরো অনেক নজির তোলা যায়। এর তুলনায়, লোকায়তিক বামাচার মূলতই স্ত্রী-প্রধান। স্ত্রীই শক্তি, শক্তিই সব। এই তফাতের কারণ কী?—সে বিষয়ে পরে দীর্ঘতর আলোচনা তুলতে হবে।

আপাতত, বামাচারী চেতনার উৎস-সন্ধানেই অগ্রসর হওয়া যাক। অগ্রসর হবার একটা সূত্র পাওয়া গিয়েছে : গুণরত্ন-বর্ণিত লোকায়তিকদের রতি-উৎসব(২৮)।

সে-বর্ণনাকে ঠিকমতো বুঝতে হলে, নিছক পুঁথিপত্রের বেড়াজালের মধ্যে আবদ্ধ থাকা চলবে না। তাহলে, পুঁথির গণ্ডি পিছনে ফেলে বাস্তব পৃথিবীতেই বেরিয়ে পড়া যাক। দেখা যাক, গুণরত্ন-বর্ণিত ওই লোকায়তিক আচরণের সঙ্গে হুবহু মিল আছে—এমন কোনো দৃশ্য সত্যিই চোখে পড়ে কি না।

পড়ে। আপনি যদি সত্যিই বেরিয়ে পড়তে রাজী হন তাহলে স্বচক্ষে দেখতে আসতে পারবেন। খুব বেশি দূরও যেতে হবে না। বাংলা দেশের সাঁওতাল-অঞ্চল পর্যন্ত গেলেই হবে। পৌষ মাসে যাবেন। ওই সময়টাতেই সাঁওতালদের ওই রকমের উৎসব। কিন্তু মজা হলো, উৎসবটার নামের সঙ্গে আষাঢ় মাসের যোগাযোগ রয়েছে। তার কারণ, উৎসবটা বুঝি আগেকার কালে আষাঢ় মাসেই হতো। সাঁওতালদের স্মৃতিতে আজো সে-কথা টিকে রয়েছে। এই সময়-বদলটা অবশ্যই অহেতুক নয়। আধুনিক গবেষক অনুমান করছেন, এর সঙ্গে চাষবাসের উন্নতির সম্পর্ক আছে(২৯)। অর্থাৎ কিনা, আগেকার কালে তাদের কাছে আউশই ছিলো একমাত্র ফসল। বর্ষার সেই ফলস উপলক্ষেই তাদের উৎসবটা ছিলো বর্ষাকালে। তারপর, আমন বা হৈমন্তিক ফসল ফলাতে শেখবার পরে উৎসবের সময়টা বর্ষা বদলে হেমন্ত হলো।

ছোটোনাগপুরের(৩০) দিকেও যেতে পারেন। এ-ধরনের উৎসব শুধুমাত্র সাঁওতালদের মধ্যেই টিকে নেই। ছোটোনাগপুরের দিকে দেখবেন মুণ্ডা, হো প্রভৃতিদের মধ্যেও এ-উৎসব আজো কী ভাবে বর্তমান। তবে, ওদের উৎসবটা যদি দেখতে চান তাহলে আষাঢ় মাসে বরাবরই যেতে হবে। তার কারণ কি এই যে ওরা এখনো আমন-ফসলটাকে বড়ো ফসল মনে করতে শেখে নি?

আরো নানান দিকে যাওয়া যায়। জয়পুরের দিকে গেলে পাঞ্জাবের মধ্যে এই উৎসব দেখা যায়, নিলগিরির দিকে গেলে দেখা যায় কোটারদের মধ্যে(৩১)। বিদেশ যেতে যদি রাজী হন তাহলে মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া বা ওই রকম আরো নানা জায়গায় এই উৎসবটাই আপনার চোখে পড়বে(৩২)। কিন্তু স্বদেশেই দেখুন আর বিদেশেই দেখুন, একটা ব্যাপার দেখে অবাক হতেই হবে : নির্বিচার মৈথুনের এই যে উৎসব, এর সঙ্গে ফসলের সম্পর্কটা সর্বত্রই ঘনিষ্ঠ।

সাঁওতালরাই সবচেয়ে কাছাকাছি রয়েছে। সাঁওতালদের মধ্যে এ-উৎসব কী ভাবে টিকে আছে তাই দেখা যাক :

Five days are spent in dancing, drinking and debauching. It is significant that at the commencement the village-headman gives a talk to the village people, in which he says that they may act as they like sexually, only being careful not to touch certain women : otherwise they may amuse themselves. The village people reply that they are putting twelve balls of cotton in their ears and will not pay any heed to, nor hear or see, anything. This festival is in many ways a disgrace to this people(৩৬).
অর্থাৎ নাচ, মদ্যপান ও ব্যাভিচারে কাটে পাঁচ দিন। লক্ষ্য করা দরকার যে, শুরুতে গ্রামের মোড়ল গ্রামের সবাইকে ডেকে একটি বক্তৃতায় বলে, মৈথুন ব্যাপারে যা খুসি তাই করতে পারো, কেবল নির্দিষ্ট কয়েকটি নারীকে স্পর্শ করা চলবে না, তাছাড়া মনের সুখে মজা করো। উত্তরে গ্রামের সবাই বলে যে, তারা কানের মধ্যে বারো গোলা তুলো পুরছে,–কোনো দিকে নজর দেবে না, কিছুই শুনবে না, কিছুই দেখবে না—কিছুই নয়। এ-উৎসব ওদের পক্ষে এক কলঙ্ক!

উদ্বৃতির শেষ কথাটি নজর করবেন : আধুনিক কালের লাম্পট্য-ব্যবহারের কাছ থেকে আলো পেয়ে ওদের আচরণটাকে বুঝতে গেলে এ-ধরনের একটা মন্তব্য করা ছাড়া উপায় নেই। ওদের শুধোন, একেবারে অন্য জবাব পাবেন। ডাল্টন(৩৪) সাহেব অনেককাল আগেই সে-জবাব সংগ্রহ করে গিয়েছেন : ফসলের এই সময়টায় ওরা অনুভব করে নিজেদের মধ্যে বীজের ভার। ক্ষেত্রে বীজ ছড়ানো আর নারীর মধ্যে সন্তানের বীজ স্থাপন করা—ওদের চেতনায় দুটো কথা সম্বন্ধহীন নয়।

বাজসনেয়ী সংহিতার মন্ত্রগুলিতেও কি সেই ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়? উদ্গাতা বাবাতাকে অভিমেথন করবার সময় ওই বীজবপনের কথাটাই ভাবছে : যেমন কৃষক বায়ুতে ধান্য শুষ্ক করিতে করিতে অকস্মাৎ গ্রহণ এবং বপন করে!

তাহলে সমাজ-বিকাশের প্রাচীন স্তরে আটকে পড়ে-থাকা মানুষদের দিকে চেয়ে দেখলে প্রাচীন সাহিত্যের বামাচারকে বোঝবার সূত্র খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়।

এ-বিষয়ে রাশি রাশি তথ্য সংগ্রহ করেছেন স্যর জেম্‌স্‌ ফ্রেসার এবং তারই ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্ত করছেন :

…the profligacy which notoriously attended these ceremonies was at one time not an accidental excess but an essential part of the rites, and that in the opinion of those who performed them the marriage of trees and plants could not be fertile without the real union of the human sexes. At the present day it might perhaps be vain to look in civilised Europe for customs of this sort observed for the explicit purpose of promoting the growth of vegetation. But ruder races in other parts of the world have consciously employed the intercourse of the sexes as a means to ensure the fruitfulness of the earth; and some rites which are still, or were till lately, kept up in Europe can be reasonably explained only as stunted relics of a similar practice(৩৫).
মোদ্দা কথায়, পিছিয়ে-পড়া মানুষদের কল্পনা অনুসারে প্রকৃতিকে ফলপ্রসূ করবার কৌশল হলো নরনারীর মৈথুন : মানুষ যদি ফলপ্রসূ হয় তাহলে প্রকৃতিও তাকে অনুকরণ করতে বাধ্য হবে।

বলাই বাহুল্য, আমাদের আজকালকার জ্ঞানের দিক থেকে পিছিয়ে-পড়া মানুষদের ওই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। আমরা আজ অনেক বেশি জেনেছি, অনেক ভালো করে বুঝতে পেরেছি প্রকৃতিকে বাস্তবিকই ফলপ্রসূ করবার প্রকৃত কৌশল কী। কিন্তু যারা পিছিয়ে পড়ে রয়েছে তাদের বেলায় একেবারে আলাদা কথা। আমাদের তুলনায় প্রকৃতির উপর তাদের দখলটা নেহাতই নগণ্য—বাস্তবভাবে তারা আর প্রকৃতিকে কতটুকুই বা জয় করতে শিখেছে? তাই বাস্তব জয়ের দিক থেকে প্রকাণ্ড অভাবটাকে একরকমের কাল্পনিক উপায়ে তারা মেটাতে চায়।

আকাশে বৃষ্টি চাইতে হলে তারা দলবেঁধে নাচতে নাচতে আকাশের দিকে জলের ছিটে ছোঁড়ে। কেন ছোঁড়ে? ওরা ভাবে, এইভাবে আকাশে বৃষ্টির একটা নকল তুললেই আসল বৃষ্টি ডেকে আনা যাবে।

আদিম মানুষের এ-জাতীয় বিশ্বাসকেই বলে ‘ম্যাজিক’ বা যাদুবিশ্বাস। মৈথুন সম্বন্ধে তার ধারণাটাও বুঝতে হবে এই যাদুবিশ্বাসের দিক থেকেই। স্যর জেম্‌স্‌ ফ্রেসার যেমন বলছেন : যে-পদ্ধতি অনুসারে মানুষ সন্তান উৎপাদন করে, আর, যে-পদ্ধতি অনুসারে গাছপালারাও ওই একই কাজ করে—আদিম মানুষ যেন এই দু’রকম পদ্ধতিকে গুলিয়ে ফেলছে, আর ভাবছে প্রথমটিকে যে নিজে সম্পাদন করে দ্বিতীয়টিকেও সম্পাদিত হবার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে(৩৬)।
স্যর জেম্‌স্‌ ফ্রেসারকে অনুসরণ করেই(৩৭) কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেখা যাক :
মধ্য-আমেরিকার পিপিলে বলে আদিবাসীদের কথা : বীজ বোনবার আগের রাতটিতে কামনাকে প্রচণ্ড ভাবে চরিতার্থ করা যায়। এমনকি, যে-মুহূর্তে জমিতে প্রথম বীজ বোনা হবে সেই মুহূর্তে মৈথুন করবার জন্যে কয়েকজনকে বিশেষ করে নিযুক্ত রাখা হয়। পুরোহিতদের নির্দেশ অনুসারে প্রত্যেকেই এই উপলক্ষে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতে বাধ্য; এমনকি, উক্ত অনুশাসন না মেনে বীজ বুনতে যাওয়াটাকে আইন-গর্হিত মনে করা হয়।
জাভা-দ্বীপের কোনো কোনো গ্রামে ধান পাকবার সময়টিতে কৃষাণ-কৃষাণীরা রাত্রিবেলায় ক্ষেতে যায় ও ক্ষেতের উপরই সহবাস করে।
অস্ট্রেলিয়া আর নিউগিনির মাঝামাঝি দ্বীপপুঞ্জগুলিতে এই জাতীয় বিশ্বাসের সামান্য রকমফের দেখা যায়। ওখানের মানুষদের বিশ্বাস, সূর্য হলো পুরুষ, ধরিত্রী নারী। বছরে একবার করে, বর্ষার মুখে, সূর্য নাকি আকাশ থেকে নেমে আসে ধরণীকে গর্ভবতী করবার জন্যে। আর পুরো পৃথিবী জুড়ে উৎপাদনের যখন এ-রকম মহোৎসব তখন মানুষেরাও মেতে ওঠে ওই একই উৎসবে : নরনারীর মধ্যে অবাধ মিলন চলতে থাকে। ওদের ধারণায়, উৎসবটির উদ্দেশ্য হলো পিতামহ সূর্যের কাছ থেকে বহুল পরিমাণে বৃষ্টি, অন্ন, পশু ও প্রজা পাওয়া। ফ্রেসার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, এই ধরনের অবারিত যৌন-মিলনকে অসংযত যৌনক্ষুধার বিকাশমাত্র মনে করলে ভুল করা হবে। এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে পুরো উৎসবটিকে তারা সযত্নে ও রীতিমতো ভক্তিভরেই সম্পাদন করে, কেননা, তাদের ধারণায় এরই উপর নির্ভর করছে জমির উর্বরতা আর মানুষের মঙ্গল।

স্যার জেম্‌স্‌ ফ্রেসার আরো অজস্র দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আরো দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না—জায়গায় কুলোবে না। উদ্ধৃত করতে পারলে দেখা যেতো এ-জাতীয় বিশ্বাস পৃথিবীর শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি জায়গায় আবদ্ধ নয়; যেখানেই আজো মানুষ পিছিয়ে-পড়া দশায় আটকে রয়েছে সেখানেই টিকে আছে এই ধরনের বিশ্বাস। অর্থাৎ, আদিম মানুষের পক্ষে এ-বিশ্বাস সার্বভৌম : কিংবা, যা হয়তো একই কথা, মানুষের আদিম অবস্থার কোনো এক স্তরে এ-বিশ্বাস অনিবার্যও। কেন, তা পরের পরিচ্ছেদে আলোচনা করবো।

আর যদি তাই হয় তাহলে নিশ্চয়ই অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে, আমাদের পূর্বপুরুষেরাও যখন সবেমাত্র ওই রকম কোনো অবস্থা পিছনে ফেলে এগিয়ে এসেছেন তখন তাঁদের ধ্যানধারণা থেকে এ-জাতীয় বিশ্বাসের চিহ্ন সম্পূর্ণ ভাবে মুছে যায় নি। আর যেহেতু তাঁরা নিজেদের ধ্যানধারণাগুলিকে অমর করে রেখে গিয়েছেন পুঁথির পাতায় বা মন্দিরের ভাস্কর্যে সেইহেতুই আমরা আজো সেগুলির স্পষ্ট স্বাক্ষর স্বচক্ষে দেখতে পাই। কেবল ভুলে যাই, তাঁদের উদ্দেশ্য আর আমাদের উদ্দেশ্য এক হবার কথা নয়।

তাই, বেদের মন্ত্র শুনলে পরের যুগে প্রায়শ্চিত্ত করবার কথা ওঠে।

তাই, মন্দিরের গায়ে ভাস্কর্য(৩৮) দেখতে গিয়ে আজ চোখ নামিয়ে নিতে হয়।

একাল আর সেকালের তফাতটা তো সত্যিই বড়ো কম নয়! বলাই বাহুল্য, প্রাচীন বলেই সেকালের ধারণাকে নির্বিচারে শ্রদ্ধা করবার কথা উঠছে না। কিন্তু এ-কথাও মনে রাখা উচিত যে, একালের মনোভাব নিয়ে সেকালকে বিচার করলে প্রাচীনদের প্রতি অবিচার করা হবে।

বাজসনেয়ী সংহিতার বা উপনিষদের ঋষিরা যা বলেছেন তা ঠিক না ভুল সে-আলোচনা স্বতন্ত্র। আমরা শুধু এইটুকুই বলতে চাই যে, তাঁরা যা ভাবেন নি, সে-ভাবনাটা তাঁদের রচনায় আরোপ করাটা ভুল।

তাঁরা অশ্লীল সাহিত্য রচনা করেন নি। তাঁরা লাম্পট্য বর্ণনা করেন নি। তাঁরা নিজেদের জ্ঞান অনুসারে যা উদ্দেশ্যমূলক মনে করেছেন তাই লিখে গিয়েছেন। মৈথুন তাঁদের ধারণায় যজ্ঞের সমান, সামগানের সমান, একমাত্র ব্রতের সমান। কেননা, তাঁদের ধারণায় এরই উপর নির্ভর করছে শুধুমাত্র সন্তান পাবার সম্ভাবনা নয়, সব কিছুই : মিথুনাম্মিথুনাৎ প্রজায়তে সর্ব্বমায়ুরেতি জ্যোগ্‌ জীবতি মহান্‌ প্রজয়া পশুভির্ভিবতি মহান্‌ কীর্ত্ত্যা…

———————-
২৭. এই গ্রন্থের তৃতীয় পরিচ্ছেদের “লোকায়ত-প্রসঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত” শিরোনামের পর্ব।
২৮. ঐ।
২৯. JAS (s) XIX-1953 No. 1, Page 7.
৩০. E. T. Dalton DEB 196.
৩১. E. Westermarck HHM 30.
৩২. Ibid cf. J. Frazer GB ch. Xi.
৩৩. JAS (s) XIX-1953 No. 1, Page 7.
৩৪. E. T. Dalton op. cit. 196.
৩৫. J. Frazer GB 135-6.
৩৬. Ibid. cb. Xi.
৩৭. Ibid.
৩৮. এই গ্রন্থের তৃতীয় পরিচ্ছেদের “তন্ত্রের দেহতত্ত্ব” শিরোনামের পর্ব।