প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০৩. লোকায়ত ও কাপালিক

লোকায়ত ও কাপালিক

যোগীর কথা ছেড়ে দিলেও কাপালিক নামটিকেই দেখুন না। প্রাচীনেরা বলছেন, লোকায়ত আর কাপালিক একই কথা। কিন্তু আমাদের মনে কাপালিক ও লোকায়ত সম্বন্ধে যেটুকু সাধারণ ধারণা তার সঙ্গে এ-কথার কোনো রকম সঙ্গতি কি খুঁজে পাওয়া যায়?

লোকায়তিকদের সম্বন্ধে আমাদের যেটুকু সাধারণ ধারণা তার প্রায় চোদ্দ আনাই মাধবাচার্যের লেখা সর্ব্বদর্শনসংগ্রহ থেকে সংগৃহীত। এই বইতে লেখা আছে, লোকায়তিকেরা অনুমান মানে না, আত্মা মানে না, পরলোক মানে না, ঈশ্বর মানে না। তার বদলে তারা মনে করে প্রত্যক্ষই হলো একমাত্র প্রমাণ, দেহই আত্ময়া, ইহলোকই সব, সুখভোগ ছাড়া কোনো পুরুষার্থ নেই। মাধবাচার্যের এই লেখা থেকে লোকায়তিকদের সম্বন্ধে একটা ধারণা হয়। কিন্তু তার সঙ্গে কাপালিক-সংক্রান্ত ধারণার যোগাযোগ কোথায়? অবশ্যই, কাপালিক সম্বন্ধে আমাদের ধারণাটুকু সত্যিই খুব স্পষ্ট নয়—যেটুক স্পষ্ট তা শুধুমাত্র ভয়াবহ বীভৎসতার একটা ছবি। চীন পর্যটক হুয়েন্‌সাঙ(১২) ভারতবর্ষে বহু কাপালিক দেখেছিলেন—তাদের গলায় মড়ার খুলির মালা, মড়ার খুলি ভরে তারা মদ খায়। হুয়েন্‌সাঙ-এর ঢের আগেই বরাহমিহির(১৩) (ষষ্ঠ শতাব্দীতে) তাঁর বৃহৎসংহিতায় কাপালিকদের কথা যেটুকু উল্লেখ করেছেন তার থেকে এর চেয়ে স্পষ্ট আর কোনো ছবি পাওয়া যায় না। অবশ্যই, কাপালিক সম্বন্ধে আমাদের চলতি ধারণাটা প্রধানতই নাটক-নভেল থেকে পাওয়া। বঙ্কিমচন্ত্রের কপালকুণ্ডলা(১৩) মনে আছে? মনে আছে, কাপালিকদের সেই নিষ্ঠুর বীভৎসতার চিত্র? কাপালিকদের সম্বন্ধে এই রকম ঘৃণার ভাব শুধুই বঙ্কিমচন্দ্রের নভেল-এ নয়; তাঁর ঢের আগেকার যুগের নাটকেও। একাদশ শতাব্দীতে লেখা কৃষ্ণমিশ্রের(১৫) প্রবোধচন্দ্রোদয়-এ দেখতে পাই একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ও একজন দিগম্বর জৈন সাধুর সংযম পরীক্ষা করবার জন্যে এক কাপালিক আর এক কাপালিকার চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে; অবশ্যই, তাদের স্বভাবচরিত্রের কোনো বালাই নেই—তাই মঞ্চের উপরেই তারা কামসাধনা শুরু করে দিলো! তারও আগে, সম্ভবট খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে লেখা ভবভূতির মালতীমাধব(১৬) নাটকে দেখা যায় নায়িকা মালতীকে প্রলুব্ধ করার, এবং শেষ পর্যন্ত তার সর্বনাশ সাধন করার, দায়িত্ব এক কাপালিকার উপরই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই জাতীয় নাটক-নভেল পড়েশুনে কাপালিকদের সম্বন্ধে আমাদের মনে কোনো রকম স্পষ্ট ধারণা হোক আর নাই হোক অন্তত একটা তীব্র ঘৃণা বিদ্বেষের ভাব যে জন্মায় সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্যই, লোকায়তিকদের সম্বন্ধেও যেটুকু খাপছাড়া খবর পাওয়া যায় তার মধ্যেও বিদ্বেষের ভাবটা খুবই প্রকট। দার্শনিক পুঁথিপত্রের কথা ছাড়াও এমনকি দেশের খোদ আইনকার্তা বিধান দিয়েছেন, সাধু-সমাজ থেকে লোকায়তিকদের দূর করে দিতে হবে। কিন্তু শুধু সেই কারণেই,—দুই-এর বিরুদ্ধেই বিদ্বেষের ভাব রয়েছে বলেই,—লোকায়ত ও কাপালিক যে এক এ-কথা বলাও বুদ্ধিমানের লক্ষণ হবে না।

————————
১২. A. Barth RI 214.
১৩. Ibid.
১৪. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : কপালকুণ্ডলা।
১৫. প্রবোধচন্দ্রোদয়।
১৬. R. G. Bhandarkar VS 128.