হাসিমারায় বসে কলকাতার খবর পাওয়া মুশকিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও দলের খবর আসতে লাগল। সমস্ত দেশ একটু একটু করে নকশালবাড়ি হয়ে উঠছে। বীরভূম মেদিনীপুর চব্বিশ পরগণা তো বটেই, খোদ কলকাতায় এখন পুলিশের সঙ্গে সংগ্রাম চলছে। বেলঘরিয়া যাদবপুর বেলেঘাটার কিছু কিছু জায়গা প্রায় মুক্ত অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে। রেডিও শুনলে অবশ্য মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এই সব ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে সমাজবিরোধীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। যে খবরটা সবচেয়ে আনন্দের তা হল সাধারণ মানুষ নকশালপন্থীদের জন্যে মৌন সমর্থন রাখছে। ঘর ছাড়া ছেলেগুলোকে আশ্রয় বা খাবার দেওয়ার ব্যাপারে অনেকেই প্রশ্রয়ের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
সাধারণ মানুষ এখনও সক্রিয়ভাবে বিপ্লবে যোগ দেয়নি। কিন্তু এভাবে যদি এগিয়ে যায় তাহলে তাদের দরজা খুলবেই। স্বৰ্গছেঁড়ায় এর মধ্যে কতকগুলো মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে বলে খবর এসেছে। পুলিশ নাকি পানিরামের হত্যার বদলা নিতে ওই অঞ্চলে চিরুনি অপারেশন চালিয়েছে। ব্যাপক ধরপাকড় হয়েছে। কিন্তু ওদের কাউকে পুলিশ ধরতে পারেনি। তবে খুঁটিমারীর জঙ্গলের ডেরাও পুলিশ আবষ্কিার করেছে। এই মুহূর্তে অনিমেষ সিরিল এবং জুলিয়েনকে পুলিশ গরুখোঁজা খুঁজছে। স্বৰ্গছেঁড়ার ব্যবসায়ীরা ভয় পেয়ে গেছে খুব কিন্তু সাধারণ মানুষ যে স্বস্তি পেয়েছে তা হাটে বাজারে গেলেই বোঝা যায়।
দ্বিতীয় ঘটনাটি হল অনিমেষের অস্তিত্ব আবিষ্কার করার পর পুলিশ চা বাগানে গিয়ে ছিল। মহীতোষকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে কি কথাবার্তা হয়েছে অনিমেষ খবর পায়নি তবে থানা থেকে ফিরে এসে মহীতোষ লম্বা ছুটি নিয়ে ছোটমাকে সঙ্গে করে জলপাইগুড়িতে চলে গেছেন। কথাটা শুনে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল অনিমেষ। এত কাছাকাছি দীর্ঘকাল থেকেও সে বাবার সঙ্গে দেখা করেনি। করেনি যাতে ওরা না জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাই হল। অনিমেষ এখানেই ছিল এবং পানিরাম হত্যার সঙ্গে জড়িত জেনে বাবার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে? খুবই সামান্য সময় অনিমেষ তারপর ব্যাপারটাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করল।
নদীর ওপর তাঁবু পেতে বিরাট কর্মযজ্ঞ চলছে। অনিমেষের আপাতত আশ্রয় এখানেই। ওর বয়সী যে ছেলেটি কন্ট্রাক্টরের অধীনে কাজ করছে তার সঙ্গে দলের মাধ্যমেই যোগাযোগ হয়েছিল কিছুদিন আগে। আশ্রয় চাইতে সে একটুও আপত্তি করেনি। শুধু বলেছিল, সহজ হয়ে ঘোরাফেরা করুন। নদীর বেডে পুলিশ আসবে না। আমি বলব আপনি আমার মাসতুতো ভাই। সিরিলকে সেই কাজে লাগিয়েছিল। কুলিরা মাথায় করে যে পথ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার তদারকির কাজ। ফলে এখানে এসে আর সবার সামনে সিরিলের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। যা কিছু খবর ওই ছেলেটির মাধ্যমেই পাচ্ছে অনিমেষ। একদম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এই ছেলেটির বুকে উত্তাপ আছে, নাম করুণাসিন্ধু। তবু এর মধ্যে একদিন শিলিগুড়িতে গেল অনিমেষ। করুণাসিন্ধু নিষেধ করেছিল, আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে যখন তখন যাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু এভাবে হাত পা গুটিয়ে নদীর উপর তাঁবুর ভেতরে ইঁদুরের মত লুকিয়ে বসে থাকতে আর ভাল লাগছিল না। পরবর্তী কাজকর্মের ব্যাপারে কথা বলা দরকার। সমচিন্তাযুক্ত দলগুলো এখন একত্রিত হয়েছে কিনা। আন্দোলনের নেতৃত্ব এখন কোন যোগ্য হাতে গিয়েছে কিনা পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তা নিয়ে একটা সুষ্ঠু ধারণায় আসা হয়েছে কিনা–এইসব জানতে আগ্রহ হচ্ছিল তার। একজন পানিরামকে হত্যা করে সেই তল্লাটের কিছু মানুষের আশীর্বাদ পাওয়া যেতে পারে কিন্তু সেখানেই শেষ কথা নয়। আশেপাশে তাকালে মনে হয় না, সাধারণ মানুষ তাদের বিপ্লব নিয়ে তেমন ভাবছে। একথা ঠিক, একদিনে সেটা সম্ভবও নয় কিন্তু তার আয়োজন করা দরকার।
আকাশে মেঘ করেছিল। তাঁবুতে বসে চিঠি লেখা শেষ করল অনিমেষ। নাম সই করল না, কেউ চিঠিটা পড়লে রাজনীতির গন্ধ পাবে না। কিন্তু যাকে চিঠি লিখছে সে বুঝবে। মাধবীলতাকে লেখা এটি তার চতুর্থ চিঠি। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে আসার পর সে একতরফা চিঠি লিখে যাচ্ছে। মাধবীলতার কাছ থেকে উত্তর পাওয়ার উপায় নেই। মাধবীলতাকে নিজের আস্তানার ঠিকানা দেওয়ারও উপায় নেই। অনিমেষ চিঠিটা ভাঁজ করে ফেলার আগে আর একবার পড়ে নিল। এবার সে সম্বোধন করেনি, সরাসরি শুরু, ‘তুমি কেমন আছ জানি না, তবে আমার জন্য তুমি ভাল থাকবেই এটা জানি। কেমন স্বার্থপরের মত শোনাচ্ছে কথাটা তবু তোমার কাছেই তো আমি স্বার্থপর হতে পারি?
ছটফট করছি কাজ শুরু করতে কিন্তু কিছুদিন হল চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া কোন উপায় দেখছি না। এ যে কি যন্ত্রণা তা তুমি বুঝবে না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমরা যা করত চাইছি ত হবেই। পৃথিবীটা পালটে যাবেই। আমাদের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে তা করতে হবেই।
শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার পর বেশি করে তোমার কথা মনে পড়ছে। চোখ বন্ধ করলেই তোমার মুখের প্রতিটি টান দেখতে পাই। আইন কিংবা ধর্ম কি বলবে জানি না কিন্তু আমি চিৎকার করে বলতে পারি তুমি আমার স্ত্রী।
কিন্তু আমি তোমাকে আমার সঙ্গে কাজ করতে বললাম না কেন? কেন তোমাকে দুরে সরিয়ে রাখলাম? যে কেউ এই প্রশ্ন করতে পারে। হয়তো একজন প্রকৃত কমুনিস্টের একটা অপরাধ। যে কম্যুনিজমে বিশ্বাস করে তার কর্তব্য আর একজনকে সেই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু আমি যখন বুঝলাম তুমি আমার এই আমি টাকেই গ্রহণ করেছ আমার আর সব কাজকর্মে তুমি বাধাও দেবে না, মুখ ফুটেও কিছু বলবে না তখন তোমার উপর কিছু চাপিয়ে দিতে চাইনি। শুনেছি বিখ্যাত গুরুদেবদের শিষ্যরা নাকি বন্ধু বান্ধবীদের গুরু ভাই করতে ব্যগ্র হয়। সে রকম করতে চাইনি আমি। কিন্তু তোমার সমস্ত ভাল মন্দের জন্যে আমি নিজের কাছে দায়বদ্ধ অথচ এই মুহূর্তে যদি তুমি অসুস্থ হও তবু আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে পারব না। এ যে কি যন্ত্রণা তা কি করে বোঝাই।
কবে দেখা হবে জানি না, আদৌ দেখা হবে কিনা তাও জানি না, কিন্তু আমি প্রতি মুহূর্তে তোমার স্পর্শ পাচ্ছি।‘
ইনল্যান্ড লেটারের ওপর গোটা গোটা অক্ষরে মাধবীলতার নাম ঠিকানা লিখে তাঁবুর বাইরে এসে দেখল করুণাসিন্ধু আসছে। এখন সকাল। চারদিকে ফিনফিনে রোদের ছড়াছড়ি। নদীর ওপর শুকনো নুড়িতে অবশ্য এখনও দুপাশের পাহাড়ের ছায়া মাখামাখি। কিন্তু মুখ তুললেই সোনাগলা রোদ্র। জায়গাটা সত্যি সুন্দর। চওড়া নদীর দুধারে গাছে মোড়া বড় পাহাড়। নদীর জল এখন এক পাশ দিয়ে ছোট্ট শরীর নিয়ে ছুটে যাচ্ছে। কুলিরা এখনও কাজে নামেনি।
করুণা সিন্ধু কাছে এসে বলল, কপাল ভাল বলতে হবে।
কেন?
আপনি শিলিগুড়িতে যাবেনই?
হ্যাঁ।
তাহলে তৈরি হয়ে নিন। আধ ঘন্টার মধ্যে আমাদের একটা জীপ ছাড়ছে। সন্ধ্যে নাগাদ শিলিগুড়ি থেকে ঘুরে আসবে। আমি একটু গায়ে পড়ে কাজটার দায়িত্ব নিলাম। অতএব আপনি সঙ্গে যেতে পারেন।
কথাটা শুনে অনিমেষ স্বস্তি পেল। বারোয়ারী ট্রেন কিংবা বাসে যাওয়ার চেয়ে প্রাইভেট জিপে যাওয়া অনেক নিরাপদ এবং সময়ও কম লাগবে। তাবুর ভেতরে ঢুকে করুণাসিন্ধু বলল, আপনাকে একটা অনুরোধ করব।
বলুন।
দাড়িটা কেটে ফেলুন।
চমকে নিজের গালে হাত দিল অনিমেষ, সেকি?
করুণাসিন্ধু হাসল, লোকে নিজেকে লুকোতে দাড়ি রাখে। তাই দাড়ি দেখলেই অনেকে সন্দেহের চোখে তাকায় আজকাল। তাছাড়া আপনাকে যারা চেনে তারা দাড়ি দেখেই অভ্যস্ত। ওটা কেটে ফেললে কেউ চিনতেই পারবে না। শিলিগুড়িতে যখন যাচ্ছেনই তখন একটু সতর্ক হয়ে থাকা ভাল।
অনিমেষ ইতস্তত করছিল, এ কত বছরের দাড়ি জানেন? আমি জীবনে কখনো গালে খুর লাগাইনি।
করুণাসিন্ধু ঠাট্টার গলায় বলল, এত হাজার বছরের জঞ্জাল যখন সরাতে নেমেছেন তখন আর সামান্য দাড়িতে মায়া করছেন কেন?
কথাটা শুনে অনিমেষের ভ্রূ কুঁচকে গেল দেখে গলা পালটিয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না। আমি কিছু মিন করতে চাইনি।
করুণাসিন্ধুর দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম ব্যবহার করতে অনিমেষকে বেশ পরিশ্রম করতে হল। গালের কয়েক জায়গায় কেটে কুটে গেল। কিন্তু মুখ মোছার পর সে নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই চিনতে পারছিল না। মসৃণ গাল একটি সুশ্রী মোলায়েম তরুণকে হাজির করছিল। সিমেনার পোস্টারে এ রকম মুখ দেখা যায়। করুণা সিন্ধু ক্যাম্পখাটে বসে ওর পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল, এবার বলল, অ্যাদ্দিন আপনি দাড়ির আড়ালে বয়সটাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন, এবার এখন ধরা পড়ে গেলেন।
অনিমেষ হাসল কিন্তু প্রতিবাদ করল না। তার চেয়ে বয়সে বড় অনেকই তাকে দাদা এবং আপনি বলে থাকে। এটা যে দাড়ির জন্যেই তা বোঝা যেত। কিন্তু কারুর ভুল ভাঙ্গিয়ে দিত না সে। যে যা বলে খুশি হয় তাই হতে দেওয়া উচিত। করুণাসিন্ধুর দিকে তাকিয়ে সে বলল, চলুন।
জিপে ওরা চারজন। বাড়তি দুজনের একজন করুণাসিন্ধুর মালিকের ছেলে অন্যজন ড্রাইভার। গাড়িতে ওঠার পর থেকেই ছেলেটিকে লক্ষ্য করছিল অনিমেষ। বছর কুড়ি বয়স হবে বেশ মোটাসোটা। করুণাসিন্ধু ওর কথা বলে রেখেছিল তাই কোন প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয়নি। হাসিমারা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর ছেলেটি বলল, বাবা কি আজই ফিরতে বললেন?
করুণাসিন্ধু মাথা নাড়লো, হ্যাঁ।
ধ্যুৎ এতদিন বাদে শিলিগুড়ি গিয়ে রাত না কাটিয়ে ফিরে আসা যায়?
আপনি আজ ফিরবেন না?
আমি মানে আমরা সবাই। বাবাকে বলব, গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
কেন? কোন কাজ আছে ওখানে?
কাজ? ধ্যুৎ আপনি একদম বেরসিক। আপনি এর আগে শিলিগুড়িতে গিয়েছেন? প্রশ্নটা অনিমেষকে উদ্দেশ্য করে।
সঠিক উত্তর দিল সে, না। মানে থাকার জন্যে যাইনি।
নীচু হয়ে ছেলেটি একটা ব্যাগ খুলে বোতল বের করল। ভুটানের সামচিতে তৈরি সস্তা দামের রাম। তারপর করুণাসিন্ধুকে বলল, আপনি তো মাল খান না?
না স্যার। করুণাসিন্ধু দ্রুত ঘাড় নাড়ল।
আপনি?
গোড়ামি নেই কিছু, তবে এখন খাবো না। অনিমেষ জানাল।
কেন? সকাল বেলায় চা-ই ভাল লাগে।
ছেলেটি আর কথা বলল না। ব্যাগ থেকেই গেলাস আর জল বের হল। প্রথমটা এক চুমুকে শেষ করে হাসল, আজ মশাই অনেকদিন বাদে স্বাধীনতার আলো দেখেছি। শালা বুড়ো শকুনটা মদ ছুঁতে দেয় না আমাকে। অথচ সতের বচর বয়স থেকে মালাবৃত হয়ে আছি। তখন থেকে সাইটগুলোতে আমি যেতাম একা একা। তা একবার রাত্তিরে শকুনটা গিয়ে হাজির। আমরা মাল খেয়ে বোতলগুলো একটা কুয়োর মধ্যে ফেলে দিতাম। শকুন সেটায় বুকে দেখল প্রায় বুজে গেছে বোতলে। ব্যাস, আমার স্বাধীনতা চৌপাট হয়ে গেল। আজ অনেকদিন পর ফিফটিনথ আগস্ট হল।
করুণাসিন্ধু বলল, কিন্তু কাজটা যদি না হয়।
সে জন্যেই আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি। মন দিয়ে কাজ করবেন।
এ রকম একটি বাচ্চা ছেলের মুখে এমন পাকা পাকা কথা শুনতে শুনতে অনিমেষের মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছি। তবে ছেলে বেশ তৈরি এখন গেলাস হাতে ধরে রেখেছে, বেশ সময়ের ব্যবধানে চুমুক দিচ্ছে। অনিমেষ বাইরে তাকাল। চা বাগান সবুজ গালচের মত দিগন্তে ছড়ানো। মাঝখানের শেড ট্রিগুলোয় পাখির ঝাক। খুব স্পীডে গাড়ি ছুটছে, রাস্তা ফাঁকা। এক সময় নীরসাড়া ছাড়ির স্বৰ্গছেঁড়ার কাছে এসে গেল ওরা। করুণাসিন্ধু ওর দিকে তাকাতেই সে একটু পেছনে সরে বসল। বলা যায় না কিছু, যদি কারো নজর খুব তীক্ষ্ণ হয় তাহলে মুশকিল।
হঠাৎ ছেলেটি বলল, আপনি কি করেন মশাই।
করুণাসিন্ধু বলল, পড়াশুনা করে। কলকাতায়। এখানে বেড়াতে এসেছে।
ছেলেটি বলল, কি হবে পড়াশুনা করে? শালা পরের গোলামী করে করে জাতটা ডুবে গেল। ব্যবসা করুণ মাল কামান। শকুনকে দেখছেন না? ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছিল বলে শুনেছি।
অনিমেষ বলল, শকুন কে?
যার গাড়িতে আপনি চড়েছেন মাই ফাদার। সব সময় ভাগাড়ে নজর। যতদূরেই থাক কিছুতেই অ্যাভয়েড করতে পারি না। দাঁড়ান দাঁড়ান এ গাড়ি থামা তো। ছেলেটি ব্যগ্র হয়ে বাইরে তাকাল। অনিমেষ গুটিয়ে গেল। ওরা এখন স্বৰ্গছেঁড়ার চৌমাথায় এসে দাঁড়িয়েছে। পকেট থেকে টাকা বের করে ছেলেটি ড্রাইভারকে দিল, নায়ারের হোটেলে যা, পাঁচটা রামের বোতল আনবি।
ড্রাইভার ওর বাপের বয়সী কিন্তু স্বচ্ছন্দে তুইতোকারি করছে সে। টাকা নিয়ে চলে গেলে ছেলেটি বলল, যান, আপনারা চটপট চা খেয়ে নিন। সকাল হলে বাঙালী ছাগলের মত চা চা করে ডাকে, হ্যাঁ হ্যাঁ।
অনিমেষের ইচ্ছা করছিল ঠাস করে একটা চড় মারে ছেলেটার গালে। ওর শরীর শক্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু করুণাসিন্ধু ওর হাত ধরল, না একেবারে শিলিগুড়িতে গিয়েই খাবো। ছেলেটি সামনে বসে থাকায় ওদের দেখতে পাচ্ছিল না। করুণাসিন্ধু হাত ছেড়ে দেবার আগে চোখ টিপল তাকে।
অনিমেষ দেখল চৌমাথা একদম নির্জন। দোকানপাট কিছু কিছু খুলেছে বটে কিন্তু রোজ সকালকার স্বাভাবিক ভিড় নেই। একটু বাদেই ড্রাইভার ফিরে এল শূন্য হাতে, নেই মিলা ছোটাসাব।
নেই মিলা? কিউ? খিঁচিয়ে উঠল ছেলেটা।
নায়ার বোলতা থা পুলিশ বহুৎ ঝামেলা কিয়া। ইহা এক আদমী খুন হুয়া আউর উসি বারে মে পুলিশ বহুৎ ঝমেলা কিয়া। তিন চার আদমীকো আরেস্ট কিয়া। নায়ারকো বহুৎ তংক কিয়া।
দুটো কাঁধ নাচালো ছেলেটি বিরক্তিতে। তারপর বলল, নায়ারকে আমার নাম বলেছিলি?
হাঁ সাব।
ঠিক তখনি নায়ারকে দেখতে পেল অনিমেষ। নিরীহ মুখ করে বিরাট শরীর নিয়ে এদিকে হেঁটে আসছে। অনিমেষ আর একটু মুখ ঘুরিয়ে বসল। ছেলেটার গলা শোনা গেল, কি মশাই মেরে ফেলবেন নাকি?
আর বলবেন না স্যার, পুলিশ আমাদের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। পানিরাম খুন হয়ে গেছে জানেন তো?
পানিরাম বাবু?
হ্যাঁ। কদিন আগে রাতে ডাকাতি হয়। সাধারণ ডাকাতি নয়। নায়ারের গলা নীচে নেমে এল, নকশাল। মাল লুট করেছে আর পুলিশ তার বদলা নিচ্ছে আমাদের উপর। এখানকার কটা নিরীহ ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে।
নকশাল। সে তো কলকাতায় হচ্ছে শুনেছি, এখানে এলো কোত্থেকে?
তলে তলে ছড়িয়ে পড়েছে। দু-একজনের নাম শোনা যাচ্ছে। এখানকার চা বাগানের এক বাবুর ছেলে নাকি ওদের মধ্যে আছে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না স্যার, ছেলেটাকে আমি চিনি খুব শান্ত ছিল।
নকশাল ফকশাল না, সব মাল কামানোর ধান্দা।
স্যার। ব্যাপারটা লাইট না, একটু সাবধানে থাকবেন।
সাবধানে থাকব কেন?
ওরা লিখে গেছে বড় ব্যবসায়ীদের খুন করবে।
কিন্তু এখনই তো আপনি আমাকে খুন করছেন। একটা পাঁইট হবে না?
কোন রকমে একটাই ম্যানেজ করে এনেছি স্যার।
বেঁচে থাকুন বেঁচে থাকুন। ছেলেটির গলায় হাসি গলছে, এতদিন বাদে স্বাধীনতা পেলাম আর শুকনো থাকব এতটা পথ?
টাকা দিয়ে জিপ চলা শুরু করল। চোখের ওপর স্বৰ্গছেঁড়া মিলিয়ে যাচ্ছে। ডানদিকে চা বাগানের কোয়ার্টারগুলো দেখা যাচ্ছে। অনিমেষ ওর বাড়িটার দিকে তাকাল। দরজা বন্ধ, বারান্দায় একটা নেড়ি কুকুর শুয়ে আছে। কেমন খাঁ খাঁ করছে জায়গাটা।
বোতল খুলতে খুলতে ছেলেটা বলল, এই আর এক নকশা শুরু হয়েছে মশাই নকশাল। এলো গেল কতশাল এখন দেখি নকশাল। মাল গোটানোর ধান্দা। সব শালা সিআইএ-র কারবার।
করুণাসিন্ধু অনিমেষের হাত ধরল, সিআইএ
আমেরিকার চর মশাই। এই সব করে দেশে একটা ঝামেলা ক্রিয়ে করে ওরা। পৃথিবীর সব দেশেই নাকি এই রকম করে। কাল রাত্রে শকুনকে বলছিল হাসিমারার ওসে। ছেলেটি বলল।
ওসি এসেছিল নাকি?
হ্যাঁ। শকুনকে বলতে এসেছিল কোন উটকো লোককে যেন কাজে নেওয়া না হয়। শকুনের বন্দুকটা থানায় জমা দিতে বলছিল।
কেন?
তেনারা নাকি বন্দুক ছিনতাই করে দেশে বিপ্লব করবেন। পেছনে বিছুটি পাতা ঘষে দিতে হয় হারামীদের। শেষের কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল।
অনিমেষ খুব কষ্টে নিজেকে সামলে রাখল। এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা শুনলে মাথা ঠিক রাখা মুশকিল হয়। কিন্তু এখানে কিছু করতে গেলে পুরো ঝক্কিটা করুণাসিন্ধুর ঘাড়ে পড়বে। বেচারা নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে তাদের সাহায্য করছে ওকে বিপদে ফেলে লাভ নেই।
জলপাইগুড়ি শহর বাঁ পাশে রেখে ওরা শিলিগুড়ির পথ ধরল। যেতে যেতে অনিমেষের চোখে লেখাগুলো পড়ছিল। খুবই অযত্নে কিন্তু যেখানেই জায়গা পাওয়া গেছে সেখানেই এদিকের ছেলেরা লিখেছে, নকশালবাড়ি লাল সেলাম। নকশালবাড়ির লাল আগুন দিকে দিকে ছড়িয়ে দাও।
অর্থাৎ এদিকে সংগঠন খুবই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এটা খুব ভাল কথা, বেশ আশার কথা।
শিলিগুড়ি শহরে পৌঁছে অনিমেষ করুণাসিন্ধুর কাছে বিদায় নিল। ঠিক হল বিকেল চারটের সময় স্টেট বাসের টার্মিনালের সামনে সে ওদের জন্য অপেক্ষা করবে। সামনের সিটে ছেলেটা তখন প্রায় আউট কিন্তু তবু তার তাল ঠিক আছে। বলল, আজ বিকেলে নয়, কাল সকাল আটটায় দেখা হবে। আজ আমরা ফিরছি না।
করুণাসিন্ধু পেছন থেকে চোখ টিপল। ছেলেটার কথায় গুরুত্ব দিতে নিষেধ করল সে। অর্থাৎ আজই ফিরে যেতে হবে। জিপ চলে গেলে অনিমেষ হাঁটা শুরু করল। সঙ্গে কোন মালপত্র নেই, কেমন হালকা লাগছে তাই। শিলিগুড়ির সব রাস্তাঘাট সে চেনে না। কিন্তু মোটামুটি একটি আন্দাজ রেখে সে এগোচ্ছিল। দুপাশের বাড়ির দেওয়ালগুলোয় আন্দোলনের নানা শ্লোগান লেখা। অথচ লোকজন যে সেগুলো খুব আগ্রহের সঙ্গে পড়ছে এমন দৃশ্য তার চোখে পড়ল না। হয়তো দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে সবাই। কিন্তু কিছুদর যেতে যেতে আর এক ধরনের পোস্টার চোখে পড়ল অনিমেষের। হঠকারী দূর হঠো, সিআইএ-র দালাল নকশাল নিপাত যাক, দেওয়ালে লিখে বিপ্লব হয় না হবে না। যারা এই শ্লোগান লিখেছে তারা নিজেদের অস্তিত্ব লুকোয়নি। চোয়াল শক্ত হল অনিমেষের। কংগ্রেস থেকে এই সব কথা লিখলে তার একটা মানে বোঝা যেত কিন্তু সংশোধনবাদের শীর্ষবিন্দুতে না পৌঁছালে এই রকম বিরোধিতা করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ বিরোধ শুরু হচ্ছে এবং তা হচ্ছে আর একটি মার্কসবাদীদের সঙ্গেই। চমৎকার!
রাস্তার পাশে পাশে ডাকবক্সে মাধবীলতাকে লেখা চিঠি ফেলে বারীনদার দোকানের কাছাকাছি এসে অনিমেষ দাঁড়াল। মার্কেটের ভেতরে চট করে ঢুকতে রাজী নয়। ওখানে পরিস্থিতিটা কেমন তা না জানলে মুশকিলে পড়তে হতে পারে। সে রাস্তার দুপাশে তাকাল। খুবই স্বাভাবিক জীবন। তবু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল অনিমেষ। যদি কোন পরিচিত মুখ চোখে পড়ে তাহলে ভাল হয়। তারপর যেন দোকান খুঁজছে এমন ভঙ্গীতে মার্কেটের ভেতরে ঢুকে পড়ল একটু এগোতেই বারীনদার দোকান নজরে এল। বন্ধ। ভাল করে চোখ বুলিয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে অনিমেষ বাইরে বেরিয়ে এল। কি ব্যাপার? এত বেলা পর্যন্ত তো বারীনদার দোকান বন্ধ থাকার থাকার কথা নয়। কিছু হয়ে গেল নাকি? পুলিশ এখানে হানা দিয়েছিল কিনা বোঝা যাচ্ছে না। যাই হোক বারীনদার বাড়িতে যাওয়া উচিত হবে না। ওদের যে আড্ডায় খবরাখবর পাওয়ার জন্য দেখা করতে যাওয়ার কথা সেখানে এখন কি অবস্থা কে জানে। আগে যতবার সে এসেছে এই বারীনদার মাধ্যমেই কাজ হয়েছে।
ভেতরে ভেতরে একটু নার্ভাস হয়ে পড়ল অনিমেষ। কি করবে বুঝে ওঠার আগেই সে ছেলেটাকে দেখতে পেল। রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে। যেন একটু আলো দেখা গেল এই ভঙ্গীতে অনিমেষ পা চালালো। ছেলেটি বোধহয় অনেক আগে থেকেই তাকে লক্ষ্য করছিল কারণ অনিমেষ এগোন মাত্রই সে অলস ভঙ্গীতে হাঁটতে লাগল। দূরত্বটা কমতে দিচ্ছে না অথচ হাঁটাচলায় ব্যস্ততাও দেখাচ্ছে না। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অনিমেষও আর ব্যস্ত হল না।
শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনের কাছে এসে ছেলেটা দাঁড়াল। লেবেল ক্রসিং বন্ধ। সার দিয়ে দুপাশে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, ভীড়-ভাট্টায় একাকার। অনিমেষ কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার।
খুব খারাপ। বিজনেসের বারোটা বেজে যাবে।
সে তো বুঝলাম কিন্তু হয়েছে কি?
দাদাকে শুইয়ে দিয়েছে ওরা।
খুলে বল।
বারীনদা মার খেয়েছে জানতে পেরে মাথা গরম হয়ে গেল অনিমেষের। সে ছেলেটিকে নিয়ে প্রায় বাতিল হয়ে যাওয়া প্ল্যাটফর্মের ওপর গিয়ে দাঁড়াল। জায়গাটা এককালে রমরমা ছিল। এখন স্টেশন হিসেবে এর কোন গুরুত্ব নেই। ফলে লোকজন চোখে পড়ে না।
ছেলেটি বললো, পার্টির বাবুরা খুব শাসিয়ে গিয়েছিল দাদাকে। নকশালদের সঙ্গে নাকি দাদা যোগাযোগ রাখে। দাদা অস্বীকার করেছিল কিন্তু ওরা বিশ্বাস করেনি। তারপর পুলিশ এসে একদিন খুব জেরাটেরা করে গেল। আমি ভাবলাম আর দোকানে আড্ডা বসবে না। কিন্তু কোথায় কি, ওই ছেলেগুলোর আসা বন্ধ হল না। শেষে এই গতরাতে ওরা এসে হামলা করল, বোমা মারল আর দাদাকে দোকান থেকে বের করে প্রায় মেরেই ফেলেছিল, অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে। বলে গেছে দোকান যেন খোলা না হয় আর।
ওদের চেনো?
হ্যাঁ, পার্টির বাবুরা।
বারীনদা এখন কোথায়?
বাড়িতেই। সকালে আমাকে পাঠাল হালচাল দেখতে। আমি এসে আপনাকে দেখতে পেলাম। এখন যে কি হবে বুঝতে পারছি না।
অনিমেষ আর সময় নষ্ট করল না। ছেলেটিকে সেখানেই ছেড়ে দিয়ে একটা রিকশা নিয়ে সটান বারীনদার বাড়ির দিকে রওয়ানা হল। বারীনদার সঙ্গে অবিলম্বে দেখা করা দরকার। ওখানে গেলে বিপদ হবে কিনা সে ভাবনা এখন মাথা থেকে উড়ে গেছে।
এক ডাকেই সাড়া পাওয়া গেল। জানলা দিয়ে শব্দ এল, কে
আমি অনিমেষ।
কয়েক মুহূর্ত, বারীনদার মা দরজা খুললেন। একটু অচেনার ভাব কিন্তু সেটা খুব দ্রুত কেটে গেল, ছেলেকে মারল কেন ওরা?
আমি জানি না। অনিমেষ মাথা নীচু করল।
আমি ওকে জানি। ও তো কোন দোষ করেনি, তবে মারল কেন? বৃদ্ধার গলা এখন থমথম করছে। ঠিক সেইসময় অনিমেষ বারীনদার গলা শুনতে পেল, ওকে ভেতরে আসতে দাও মা।
খুব অনিচ্ছার সঙ্গেই বৃদ্ধা একপাশে সড়ে দাঁড়ালেন। অনিমেষ বারীনদার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে চমকে উঠল! সর্বাঙ্গে ব্যান্ডেজ, বারীনদা শুয়ে আছেন। চোখ নাক এবং ঠোঁট ছাড়া মুখ দেখা যাচ্ছে না। ওকে দেখা মাত্র বললেন, অনেক দিন পর রেস্ট নিচ্ছি ভাই। এভাবে শুয়ে থাকা তো হয় না।
বারীনদাকে যারা আঘাত করেছে তাদের অনিমেষ চেনে না কিন্তু এই মুহূর্তে তার নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। সে এগিয়ে যেতে বারীনদা বিছানার একটা পাশ দেখিয়ে বললেন, বসো ভাই।
অনিমেষ বুজতে পারল বারীনদার নড়াচড়া করতেই অসুবিধে হচ্ছে! সে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছিল?
ইংরেজরা বলে না এসবই খেলার একটা অঙ্গ তাই। জলে নাম কিন্তু বেণী ভেজাবো না, তা আর কদিন চলে। কিন্তু তুমি খবর পেলে কি করে! তোমার তো এখন হাসিমারায় থাকার কথা।
অনিমেষ অবাক হল, হাসিমারার কথা আপনি জানেন?
জেনেছি।
অনিমেষের কপালে ভাঁজ পড়েছিল। সে প্রসঙ্গে ফিরে এল, আপনার দোকানে গিয়ে দেখলাম সেটা বন্ধ। বেরিয়ে এসে আপনার অ্যাসিস্টেন্টের দেখা পেলাম।
তুমি দোকান ঘুরে এসেছ? হঠাৎ বারীনদা উত্তেজিত হলেন।
হ্যাঁ, কেন?
খুব অন্যায় করেছ, তোমার এখানে আসা উচিত হয়নি।
আমি বুঝতে পারছি না।
আঃ, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। আমার দোকানের ওপর ওদের নজর আছে। এ বাড়ির মুখে গলিতেও ওরা আছে। তুমি এখান থেকে যখন বেরোবে তখন সতর্ক হয়ে বেরিও। বারীনদা যেন হাল ছেড়ে দিলেন।
আপনি কি আমাকে খুলে বলতে চাইছেন না?
অনিমেষ, এসব নিয়ে কম চিন্তা করাই ভাল। তবু যখন জানতে চাইছ বলছি। কিছুদিন হল সি পি এম নকশালপন্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে নেমেছে। এরা সি আই এর চর, বিদেশী টাকায় গোলমাল করতে চাইছে, এইসব প্রচার ছিলই। এখন পাড়া দখল নিয়ে বোমাবাজি শুরু হয়েছে। এমন কি কোথায় নকশাল অ্যাকশন করবে তাও আগেভাবে পুলিশের কাছে খবর পৌঁছে যাচ্ছে। তুমি জানো আমার দোকানে এখনকার গল্পলিখিয়েরা আড্ডা মারে। তারা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয়। তোমাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা বাইরের কেউ জানে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওরা এসে আমাকে শাসিয়ে গেল। পরদিনই এল পুলিশ। ওরা কি করে খবর পেল তা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু দল থেকেই খবর বেরিয়ে যাচ্ছে। পুলিশকে উলটোপাল্টা বোঝাতে পারলেও ওদের বোঝাতে পারছিলাম না। কারণ ওরা বুঝতে পারছে যে এ্যাদ্দিন জনসাধারণের সামনে ওদের যে চেহারাটা ছিল তা তোমরা কাগুজে বাঘে পরিণত করে দিয়েছ। নিজের অস্তিত্ব বাঁচাবার জন্যে ওরা তাই মরিয়া হয়ে পড়েছে। বারীনদা নিঃশ্বাস ফেলল। সামান্য সময় নিল দম নেবার জন্যে। অনিমেষ চুপচাপ মানুষটিকে দেখছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, ওরাই আপনাকে মেরেছে?
বারীনদা মাথা নাড়লেন, না।
তাহলে? কে মারল?
তোমরা।
অনিমেষ সোজা হয়ে বসল। মনুমেন্টের ওপর থেকে পড়ে গেলেও ধাক্কা খেত না। বারীনদা বললেন, ওই ইংরেজদের কথাটা, এসবই খেলার অঙ্গ। এইভাবেই মেনে নিয়েছি। তুমি কি জানো আন্দোলন এখন দ্বিমুখী হিয়ে গেছে। দুটো দল পাশাপাশি কাজ করছে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। এখন মেইন লাইন যাদের হাতে তাদের বক্তব্য হল, খতম অভিযান চালিয়েই আমরা সমস্ত সমস্যার সমাধান করব ভারতবর্ষের প্রতিটি গ্রামে খতম অভিযানের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ চালানো যায়, এই খতমের সগ্রামের প্রশ্নে যারা আমাদের বিরোধিতা করতে তাদের আমরা পার্টিতে থাকতে দেব না। কিন্তু এসব করতে গিয়ে আমরা জনসাধারণের কাছ থেকে সরে আসছি। সাধারণ মানুষ এখন আমাদের ভয় পাচ্ছে। একজন কনস্টেবলকে খুন করে কতটা বিপ্লব করা যায়? পুলিশের যে কর্তারা নকশাল হত্যার মদত দিচ্ছে তাদের গায়ে হাত পড়ছে না কেন? কলকাতায় যে সব এলাকায় সংঘর্ষ চলছে সেগুলো গরীব মদ্যবিত্তদের জায়গা। পার্কস্ট্রীট বড়বাজার এলাকায় কেন অ্যাকশন হচ্ছে না? আমি এসব প্রশ্ন তুলেছিলাম।
তারপর?
সি পি এম থেকে শাসিয়ে গেল, পুলিশ জেরা করল, আর সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম আমি ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে যাচ্ছি। তোমার বন্ধুরা সন্দেহ করলেন আমি গোপনে ওদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছি। শুধু সন্দেহের বশে ওরা আমাকে মেরে গেল। যাচাই করার প্রয়োজন কেউ বোধ করছে না আজকাল।
অনিমেষ স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। শুরুতেই যদি পার্টির মধ্যে ভাঙ্গন দেখা যায় তাহলে কাজ হবে কি করে? পার্টির মূল উদ্দেশ্য, ব্যাপক গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করা, গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের মুক্তাঞ্চলের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মঘট সংঘটিত করে শাসনযন্ত্রকে চলৎশক্তিহীন করে দেওয়া, বিচ্ছিন্ন গেরিলা স্কোয়াডগুলোকে সংখ্যায় বৃদ্ধি করে গণমুক্তি ফৌজে পরিণত করা। কিন্তু বিভেদ যদি গোড়াতেই আসে তাহলে এসব হবে কি করে?
বারীনদা বললেন, অনিমেষ, এখন পার্টির মধ্যে হু হু করে বেনোজল ঢুকছে। গুন্ডামি করার এমন সুযোগ কজনে ছাড়ে! ঝাড়াই বাছাই করার সুযোগ আর নেই। আমার খুব ভয় হচ্ছে অনিমেষ।
আপনাকে মারার সিদ্ধান্ত কি পার্টি থেকে নেওয়া হয়েছিল?
আমার তো মনে হয় না আসলে এখন দু-তিন চারজন মানুষ যা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তাই ঠিক। আবার দুটো ভাগ হয়ে যাওয়ায় দুদলের দুইরকম সিদ্ধান্ত। কলকাতায় বিদ্যাসাগর বা সুরেন ব্যানার্জীর মূর্তি ভেঙে কি লাভ হচ্ছে অনিমেষ, আমার মনে হচ্ছে কেউ কিংবা কারা অত্যন্ত চতুরভাবে আমাদের আন্দোলনকে হত্যা করার জন্যে এইসব কাজ করাচ্ছে। আমরা তাদের হাতের পুতুল হয়ে যাচ্ছি।
কারা?
আমি জানি না।
আপনাকে মারল তার বিচার হবে না?
ছেড়ে দাও। আজ সকালে মহাদেববাবু খবর পাঠিয়েছিলেন, আমি তাকেও বলে দিয়েছি এ নিয়ে কোন ঝামেলা না করতে।
মহাদেবদা এখানে এসেছেন?
হা, ওহো তুমি জানো না। খুব মুশকিলে আছেন ভদ্রলোক। এখুনি ওঁর একটা শেলটার দরকার। আমি খাড়া থাকলে…
কোথায় আছেন উনি?
ঠিকানাটা জেনে নিয়ে অনিমেষ উঠল, বারীনদা, আমি খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে ফিরছি আপনার গায়ে হাত তুলল কেন ওরা! এভাবে ভাঙ্গন শুরু হলো, কেন এই ভাঙ্গন?
নেতৃত্ব নিয়ে। বাঙালী কাউকে বেশিদিন সহ্য করতে পারে না।
গলির মুখে এসে অনিমেষ দুপাশে তাকাল। দুটি ছেলে নিরীহ মুখ করে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। অনিমেষ বিপদের গন্ধ পেল। এই ধরনের মুখগুলো অনেক কথা বলে দেয়। তার একটা হাত জামার মধ্যে ঢুকে রিভলভারের স্পর্শ নিল।
কোথায় এসেছেন?
একটি ছেলে জিজ্ঞাসা করল।
বারীনদাকে দেখতে।
কি নাম?
কেন?
ঝামেলা না করে নাম বলুন। নামে কি দরকার, নিয়ে চল। দ্বিতীয় জন অসহিষ্ণু গলায় বলল।
অনিমেষ চোয়াল শক্ত করল, কেটে পড়, সুবিধে হবে না।
যাবে ফোট! কথাটা শেষ করার আগেই ছেলেটার হাতে চকচকে ছুরি ঝলসে উঠল। অনিমেষ আর দ্বিধা করল না। দ্রুত সরে গিয়ে রিভলভার বের করে চিৎকার করল, নড়লেই শেষ করে দেব। ছুরি ফেল।
ছেলে দুটো আচমকা রিভলভার দেখে এত ঘাবড়ে গিয়েছিল যে ওদের মুখ হাঁ হয়ে গেল। ছুরিটা মাটিতে পড়ল ঠক করে। অনিমেষের কানে দ্রুত জানলা দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ এল। আশেপাশের বাড়ির লোক শামুকের খোলে মুখ লুকোচ্ছে। অনিমেষ আর সময় নষ্ট করল না। সে দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে একটা রিকশায় উঠে চালাতে বলল। লোকটা তার হাতে রিভলভার দেখে জোরে জোরে প্যাডেল ঘুরোতে লাগল! অনিমেষ পেছনে তাকিয়ে দেখল ছেলে দুটো তখনও নড়ছে না। ওরা যেন কি করবে বুঝতে পারছে না। রিভলভারটা লুকিয়ে রাখল অনিমেষ। কিন্তু এতক্ষণে অনেকেই এটার অস্তিত্ব জেনেছে। জানুক, আর লুকোচুরি করে কি হবে মাইল দুয়েক এলোমেলো ঘুরে রিকশাওয়ালা মাথা নেড়ে প্রায় ছুটে চলে গেল খালি রিকশা নিয়ে। লোকটা ওর কাছে থেকে পয়সা নিল না কেন? ভালবেসে নিশ্চয়ই না। রিভলভারটা দেখতে পেয়ে লোকটা ওকে ভয় পেয়েছে। অনিমেষের খুব খারাপ লাগল। কিন্তু এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় না। সে বেশ কিছুটা এগিয়ে একটা পাঞ্জাবীর দোকানে ঢুকে কিছু খেয়ে নিল।
এখন ভর দুপুর। অনিমেষ নির্দিষ্ট ঠিকানায় মহাদেবদাকে খুঁজে পেল। একমুখ দাড়ি, মহাদেবদাকে খুব অসুস্থ দেখাচ্ছে। ওকে দেখে বললেন, কিছুতেই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। তোমার খবর যারা জানে তারা তো এখন আমার শত্রু।
মানে?
আমরা এখন বিরোধীপক্ষ অনিমেষ। যা হোক, তুমি কেমন আছ?
চলছে।
তুমি কোন দলে অনিমেষ খতমপন্থী না বিরোধী?
ঠিক করিনি।
আমার একটা থাকার জায়গা দরকার কদিনের জন্যে। তুমি সেরকম কোন জায়গার সন্ধান জানো?
অনিমেষ একটুও দ্বিধা করল না, মাথা নাড়ল সম্মতির।
আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি?
নিশ্চয়ই।
মহাদেবদা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর চোখ বন্ধ করে বললেন, গত সপ্তাহে বরানগরে পুলিশ সুবাসকে মেরে ফেলেছে।
Leave a Reply