সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। সেটা পেরোলেই শান্তিনিকেতন শীতের কোলে মুখ লুকোয়। আজ মেলার মাঠে সারা রাতের উৎসব। কিন্তু এই শ্রীনিকেতনের পথে অথৈ ঘুম। এরকম একটা কান্ড এই শহরে হচ্ছে তা বোঝা যাবে না এ পথে হাঁটলে। রাস্তায় একটাও মানুষ নেই, আশেপাশের বাড়ির জানলা দরজা বন্ধ। অনিমেষের হাঁটতে খুব ক্লান্তিবোধ হচ্ছিল।
পকেটে যা পয়সা আছে তাতে একটা রিকশা অনায়াসেই করা যেতে পারে। কিন্তু সন্ধ্যেবেলাতেই বোঝা গেছে শীতের রাত রিকশায় চাপা কি বোকামী হবে। ঠাণ্ডাটা জোরে জোরে হাঁটলে কমে যায়। কিন্তু জোরে হাঁটার মত মেজাজই আসছে না আজ। বার-বার ঘুরে ফিরে মাধবীলতার মুখ ওর সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। স্ফীত অধর, মুদিতচোখ–এ অন্য মাধবীলতা। সমস্ত শরীর এখন সেই মাধবীলতার স্পর্শে আচ্ছন্ন। জীবনে এই প্রথম বার একটি নারী শরীরের রহস্যে আচমকা ঢুকে পড়ল। এখন বেরিয়ে এসেও মনে হচ্ছে কিছুই জানা হল না কিন্তু প্রথম অভিযানে রহস্যটুকু আর রইল না।
শান্তিনিকেতনের রাস্তায় এই নির্জন রাতে হাঁটতে অনিমেষের মনে হল, আজ একটু আগে কোথায় যেন গিঁট পড়ল। দাদু পিসীমা বাবা কিংবা ছোটমা যে গিঁট দিতে পারেনি, রক্তের সম্পর্কে যে টান তাকে জড়াতে পারেনি এখন যেন সেই অনুভব তাকে আচ্ছন্ন করছে। মনে হচ্ছে সে আর একা নয়। মাধবীলতা যতই বলুক এ ব্যাপারে অনিমেষের কোন দায়িত্ব নেই কিন্তু অনিমেষ সে-কথা কিছুতেই মানতে পারবে না। না, কোন অপরাধবোধ নয়, পেছনে ছায়া রেখে হেঁটে যেতে ইচ্ছে হয় না, ছায়া থাকবে পায়ের তলায়।
বোলপুর কোঅপারেটিভ স্টোর্সের সামনে গিয়ে সে যখন পৌঁছাল তখন কুয়াশারা হিম হয়ে ঝরছে। অনুমানে বোঝা যায় গোয়াল পাড়ার রাস্তাটা বাঁদিকে। তবু কাউকে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া দরকার। সে দেখল, একটা খালি রিকশা বেশ কুঁড়েমি করে বাঁ-দিক থেকেই আসছে। ওকে দেখে লোকটা থামল, মেলায় যাবেন বাবু?
অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না। গোয়াল পাড়ায় যাবার রাস্তা এদিকে?
লোকটা নীরবে ঘাড় নাড়ল, তারপর প্যাডেল ঘুরিয়ে মেলার দিকে গেল। বোধহয় এত রাতে সে গোয়ালপাড়ায় যেতে রাজী নয়। দুপাশের বাড়িগুলো ঘুমুচ্ছে। সুন্দর রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে অনিমেষের মনে হল এখন যদি কেউ ওকে প্রশ্ন করে কি কারণে সে গোয়ালপাড়া যাচ্ছে, তাহলে উত্তর দেবার কিছু থাকবে না। সুবাসদার কথা মত যদি পুলিশ সতর্ক থাকে তাহলে এই পথেই তার ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। কারন সে ছাড়া যখন আর কোন মানুষকে দেখা যাচ্ছে না তখন…। অনিমেষ দাঁড়িয়ে পড়ল। অথচ চোখের সামনে অন্য কোন পথও দেখা যাচ্ছে না। সরাসরি হেঁটে যাওয়ার মধ্যে বেহিসেবী ঝুঁকি আছে, অন্তত রাস্তার এক ধার দিয়ে হাঁটতে লাগল। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর দুপাশের ঘরবাড়ি কমে এসে খোলা মাঠ দেখা দিল। পিচ ফুরিয়ে গিয়ে কাটা মাটির পথ এখন পায়ের তলায়। বাঁ দিকে দূরে কালো জঙ্গলের রেখা। একটা সাঁকো মত পেরিয়ে অনিমেষ থমকে দাঁড়াল। এবার পথটা দুভাগ হয়ে গেছে। একটা গেছে সোজা অন্যটা ডান দিকে নালার পাশ ধরে এঁকে বেঁকে ওপরে উঠে গেছে। তালগাছের মত নখ লম্বা একহারা গাছ ঝাপসা আকাশের পটভূমিকায় চোখে পড়ছে। এতক্ষণ আকাশে এক ধরনের ঘোলাটে আলো ছিল কিন্তু এখন কুয়াশারা যত ঘন হচ্ছে তত সেটা হারিয়ে যাচ্ছে। বেশীদূর তো বটেই, কাছের জিনিস ভাল করে নজরে পড়ে না। সব ঝাপসা। এবং এই ফাঁকা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে হঠাৎ সমস্ত শরীর ঠকঠক করে কাঁপতে লাগর অনিমেষের। নিজের দাঁতের ওর কর্তৃত্ব হারিয়ে গেল হঠাৎ।
দুটো পথের কোনটি গোয়াল পাড়ায় গেছে? নিজের ওপর তার খুব রাগ হচ্ছিল। বিকেলে স্থানিয় বাসিন্দাদের কাছে এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে রাখা উচিত ছিল। চারপাশে ফাঁকা, শীতের কামড় খুব, অনিমেষ একটা গরা শুনতে পেল। কেউ গান গাইতে গাইতে আসছে। চমৎকার গলায় শ্যামাসঙ্গীত গাইছে কেউ। অনিমেষ নিজেকে আড়াল করার কোন উপায় না দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। একটু বাদেই লোকটা সামনে এসে ওকে দেখে গান থামাল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, মানুষ মনে হচ্ছে।
অনিমেষ ওকে দেখে আশ্বস্ত হল। লোকটি ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত বারংবার দেখছে দেখে সে হেসে বলল, গোয়ালপাড়া কোন দিকে?
উদ্দেশ্যটা কি?
অনিমেষ বুঝল লোকটি মাতাল। পুলিশের চরও হতে পারে। কিন্তু এখন তো কিছু করার উপায় নেই। তবু রহস্য করে সে বলল, দুটো রাস্তা তো, কোনটা কোন দিকে তাই জানতে চাইছি।
সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে উঠল লোকটা, উহু বাবা, ফাঁকি দিয়ে পথ জেনে নেওয়া হচ্ছে! ঠিক রাস্তা জানতে পারে না বলেই তো মানুষ মরে। মেলা থেকে?
অনিমেষ ঘাড় নাড়ল।
খবর কে দিল?
কিসের খবর?
জ্ঞান দেখি টনটনে। মচকায় কিন্তু ভাঙ্গে না। আরে বাবা মায়েদের কাছে পোয়াতিদের লজ্জা করার কিছু নেই। চলুন, আমিও যাচ্ছি।
গোয়ালপাড়ায়?
আবার কথা! কিন্তু রাত হল কত? বেশী মার না নিলে তো আর শুঁড়ির ছেলে দোকান খুলবে না। দশটায় বন্ধ করে, আজ মেলা বলে যদি….। তা আপনি নতুন লোক, আপনাকে দেখিয়ে মন ভজানো যাবে।
লোকটা হাঁটা শুরু করল। পেছনে অনিমেষ। তবু সন্দেহ, তাই জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি গোয়ালপাড়ায় যাচ্ছেন?
আর কোথায় যাবা বাবা। আমার মক্কা বল আর কাশী বল তা হল ওই গোয়ালপাড়া। এত বড় দিশী মালের কারখানা বীরভূমে কটা আছে? না, ভেজাল পাবে না, কেউ মাল খেয়ে মরেনি আজ পর্যন্ত, না খেয়ে মরেছে।
না খেয়ে?
আমার বন্ধুরা কেউ মাল খায় না। বাপ মা ভাই কাকা কেউ না। কিন্তু অর্ধেক লোক চেষে গেছে এর মধ্যে। আমি শালা মাল খেয়ে চলে বেড়াচ্ছি।
আপনার বাড়ি ওখানেই? অনিমেষ এতক্ষণে লোকটাকে বুঝে নিয়েছে। সে ভাব জমাবার চেষ্টা করল।
লোকটা প্রথমে কোন উত্তর দিল না। গুম হয়ে জোরে জোরে হাঁটতে আরম্ভ করল। পরিবর্তনের কারণ অনিমেষ বুঝতে পারছিল না। দরকার নেই বেশী কথা বলে। একবার গ্রামটা চোখে পড়লেই সরে পড়বে সে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ হেঁটে লোকটা নিজের মনেই বলল, এ শালা আমার চেয়ে বড় মাতাল। মেলা থেকে ঠিক গন্ধে গন্ধে ছিটকে এসেছে। আবার বলে কিনা ওটা আমার বাড়ি কিনা! মালখানাকে যে বাড়ি বানায় সে শালার সঙ্গত করতে নেই।
অনিমেষের হাসি পাচ্ছিল কথাগুলো শুনে। সে চট করে জিজ্ঞাসা করল, কেন?
বড় মাতাল ছোট মাতালের মাথায় হাত বোলায়। আমার পয়সায় মাল খাওয়ার মতলব? লোকটা আরো জোরে পা চালাল।
অনিমেষ ইচ্ছে করে দূরত্ব বাড়িয়ে দিল। লোকটা পড়ি মরি করে ছুটছে। ক্রমশ একটা গ্রামের আদল নজরে এল। অন্ধকারে আবছা ঘর বাড়ি। গ্রামের গায়ে এসে অনিমেষের খেয়াল হল সেই মাতাল লোকটা উধাও হয়ে গেছে। কাছাকাছি তার অস্তিত্ব নেই। মাতালরা নাকি নেশার সময় খুব উদার হয়, এই লোকটি সেরেফ খাওয়াতে হবে ভেবে এমন করল। কাঁচা লাল মাটির পথ, মাটির ঘরদোর, গ্রামে ঢুকে অনিমেষ চমক খেল। সেই ছেলেবেলা থেকে বাংলাদেশের যে গ্রামের ছবি বইয়ে দেখে আসছে তাই এখন চোখের সামনে। এই ছবির সঙ্গে উত্তরবাংলার গ্রামের কোন মিল নেই। অবশ্য এখন এই রাতে ঘরে বাইরে কোন মানুষ নেই। যেন একটা পরিত্যক্ত গ্রামে সে একা হাঁটছে। নির্দেশ মিলিয়ে মিলিয়ে সে সঠিক বাড়ির সামনে গিয়ে উপস্থিত হতেই সিটি শুনতে পেল। অনিমেষ এই গোপন ইশারাইয় হদিস জানে; এইসময় যা করা উচিত তাই করল সে।
ভোর রাতে সভা ভাঙল। নির্বাচন সামনে। সেটা বয়কট করার জন্য সাময়িক প্রচার করতে হবে। দলনেতারা আশংকা করছেন কংগ্রেস নয়, সি পি এম থেকেই তাদের উৎখাত করার চেষ্টা করা হবে।
অর্থাৎ এখন ঘরে বাইরে যুদ্ধ। যতটা সম্ভব বেশী ক্যাডার বাড়াতে হবে। দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হল। জনসাধারণের ক্ষতিকর মানুষ, যেমন জোতদার, সুদখোর ইত্যাদিদের প্রয়োজনে শেষ করে দেওয়া হবে। সাধারণত এরা পুলিশ এবং সরকারের সমর্থনপুষ্ট। এইসব মানুসের হাত থেকে সাধারন মানুষ রেহাই পেলে দলের প্রতি সমর্থন বাড়বে আর দেশ জুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে খুব স্বভাবিকভাবেই শাসনব্যবস্থার ঠুনকো কাঠামোটা ভেঙ্গে পড়বে এবং বিপ্লবের প্রসন্ন সময় উপস্থিত হবে।
দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত, কতগুলো পুরোন বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট যা কিনা বুর্জোয়া মানসিকতাপ্রসুত, সেগুলো সমএর্ক জনসাধারণকে মোহমুক্ত করতে হবে। রেনেষার কাল যাকে বলা হয় সেই সময় এবং তার পর থেকে যাদের মহান বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, দেশের নানা জায়গায় ঘটা করে মুর্তি স্থাপন করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই সেই সম্মানের যোগ্য ছিলেন না। বুর্জোয়া শক্তি গুলো দেশের মানুষকে মোহগ্রস্ত করে রাখার জন্যে তাঁদের ব্যবহার করেছে তাই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সুচনা রাজনৈতিক বিপ্লবের পাশাপাশি শুরু জরা দরকার।
বাঙালীর ইতিহাস বড় জোর দেড়শ বছরের। খুব বেশি দূর নয় পলাশীর যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে একটি বাঙালীও উপস্থিত ছিলেন না। এমন কি সিপাহীযুদ্ধের সময় সারা দেশ যখন আলোড়িত তখন কোন বাঙালীর নাম মানা যায়নি। প্রথম বাঙালী যিনি আমাদের সামনে নিজের কৃতিত্বে উঠে এসছেন তিনি কি রামমোহন রায়! ইতিহাস প্রতাপাদিত্যের কথা বলে। কিন্তু ভদ্রলোক একজন লেঠেল সর্দার ছাড়া অন্য কিছু ছলেন না। এবং তার বায়ালী নিয়েও সন্দেহ আছে। এদেশের রাজারা, কুচবিহার বা বর্ধমান–এঁরা কেউ বাঙালী নন। কৃষ্ণচন্দ্র রায়
একজন বড় জমিদার ছাড়া কিছু নন। অর্থাৎ দেড়শ বছর আগে আমাদের চতুর্থ পূৰ্বপুরুষ মাথায় গামছা বেধে হয় চাষ করতেন কিংবা সেই চাষ তদারক করতেন। আমাদের যা কিছু বোলবোলা শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথ থেকে। অর্থাৎ বাঙালীর কোন ধারাবাহিক ইতিহাস নেই। একশ দেড়শো বছরের হঠাৎ উঠতি জাতির ফুটুনি তাই চোখে পড়ার মত। স্রেফ একদল নিরক্ষর চাষী, জেলে কিংবা বুচুটে ব্যাক্ষণ এতকাল নিজেদের মধ্যেই খেয়োখেয়ি করছিল। ইংরেজ আসার পর অব্ৰক্ষণরা তাদের চাটুকারিতা করার জন্যে ইংরেজী শেখে নিলেন চটপট। এই বিদ্যা চাকরি পেতেসুবিধে দিল। ব্রাক্ষণরা নিজেদের গোঁড়ামিতে কিছুদিন ইংরেজদের থেকে দুরে সরে থাকার পর দেখল এতকাল যাদের তারা ধর্মের ভয় দেখিয়ে দাবিয়ে রেখেছিল তারা অবস্থাপন্ন হয়ে যাচ্ছে চটপট ইংরেজী শিখে। শেষ পর্যন্ত তারাও লাইন ধরল। ফলে এতকালের মরে থাকা একটি জাত রাতারাতি চাকর হয়ে গেল। তা এইরকম একটা জাত তেকে যখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন কিংবা বিদ্যাসাগর উঠে এসেন তখন তাদের অস্বীকার করা কি যায়! হয়তো মাত্র দেড়শ বছর আমার মানুষ হয়েছি কিন্তু এই সময়ের মধ্যে শিল্প সংস্কৃতিতে আমরা অনেকের সঙ্গে পাল্লা দেবার মত উপযুক্ত হতে পেরেছি। এখন প্রশ্ন, যে শিল্প সংস্কৃতির কথা এতকাল আমরা জানি তার সম্যক চেহারাটা সাধারন মানুষের কতটা উপকারে লাগছে। অনিমেষ এ ব্যাপারে একমত যে বড় মানুষদের তৈরী এই সাংস্কৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কোন যোগ নেই। আকাদেমীতে যে সব কৃষিবিপ্লবের নাটক হয় তা যদি গ্রামে দেখানো হয়, সত্যিারের কৃষকরা ক্যারিকেচার দেখছে বলে হেসে গড়িয়ে পড়বে। তাই এই ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। হয়তো তার মন সব কিছুতেই সায় দিচ্ছে না কিন্তু বৃহয় কিছু ফললাভের জন্যে সামান্য ভুলগুলো সম্পর্কে অন্ধ হয়ে। থাকা ভাল।
ইতিহাস একটু অন্যরকম করে লেখা দরকার। ইংরেজরা আমাদের মানুষ করেছে এটা সূর্যের মত সত্য। ওরা আসার পর আমরা জীবনধারন ও যৌন কাজের বাইরে অন্য কিছু জগতের কথা ভাবতে শিখলাম। কিন্তু তার বদলে গোলামিটাও রক্তে ঢুকে গেল। প্রিন্স দ্বারকানাথ পাল্লা দিয়েছেন ওদের সঙ্গে। জয়েন্ট স্টক কোম্পানী খুলেছেন, ব্যাংক স্থাপন করেছেন ইংরেজদের কাছে জেনে। এবং মদ খেয়েছেন ও মেমসাহেবের কাছে প্রণয় জেনেছেন। ফলত তিনি প্রিন্স। বিদ্যাসাগর কিংবা রামমোহন যতই বাঙালীয়ানা চাপাই না কেন, তাদের চরিত্রে ইংরেজী শিক্ষা মেরুদন্ডের মত কাজ করেছে। ফলে ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর আমরা পিতৃমাতৃহীন হয়ে গেলাম। ভারতবর্ষের মানচিত্রে কোন স্থান রইল না বাঙালীর। ওদিকে উষর মরুভূমির মানুষ রাজস্থানী কিংবা পার্সি সিন্ধীরা ইংরেজের চাকর না হয়ে তাদের মন যুগিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল। ইংরেজ চলে যাওয়ার পর দেশটা তাই ওদের হাতেই চলে গেল।
রবীন্দ্রনাথ যদি এ-দেশে না জন্মাতেন তাহলে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতো। এই মানুষটি নিজে বীজ সৃষ্টি করে তা থেকে বিরাট মহীরুহ দাঁড় করিয়ে গেলেন একা। অবশ্যই বিবেকানন্দের নাম তার পাশে উচ্চারণ করা যায়। এবং এই দুজন ব্যতিরেকে বাকীটা সব অন্ধকার। শ্রীহট্টের মানুষকে চৈতন্যদেব যে ধর্মবিশ্বাসে বাঙালীকে উদ্বেলিত করেছিলেন তার ব্যবহারিক মূল্য কতটুকু? নদীয়া থেকে উড়িষ্যায় চলে যেতে হয়েছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উন্মাদনায়। তাহলে? তবে ওই ঈশ্বরমুখী মানুষটিকে নবজাগরনী প্রতীক বলে ঐতিহাসিকরা আমাদের আফিং খাইয়ে যাচ্ছেন।
অনিমেষ সভার শেষে সরাসরি কিছু নির্দেশ জেনে নিল। এখন আর কোন কুণ্ঠার সময় নয়। খুব শীগগীর একটা স্কোয়াড যাচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে গেরিলা ট্রেনিং-এর জন্যে। কিছু কিছু অস্ত্র যাতে ঠিক সময়ে পৌঁছে যায় তার আয়োজন হচ্ছে। এ-সবের জন্যে যে অর্থ প্রয়োজন তার ব্যবস্থা অনিমেষদেরই করতে হবে।
মিটিং-এর পর সুবাসদার সঙ্গে যখন কথা বলার জন্য অনিমেষ উঠে দাঁড়াল ঠিক তখনই লোকটার দিকে তার নজর পড়ল। এতক্ষণ এই বড় ঘরটায় এত লোকের মধ্যে সে খেয়াল করেনি। দেখে হতবাক হল সে। লোকটারও প্রায় সেই অবস্থা। তারপর চট করে নিজেকে সামলে লোকটা বলল, মাল-ফাল খাইনি বুঝতেই পারছেন!
আমিও সেটার সন্ধানে এখানে আসিনি তাও দেখছেন!
আরে বাপ, আমি তো মশাই আপনাকে দেখে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাবলাম এ শালা নিশ্চয়ই খেচড়া। কি করে কাটানো যায় তাই ছিল আমার ধান্দা। অনিমেষ হাসল, আপনি না এলে আমার এখানে আসতে একটু অসুবিধা হতো। তবে খুব চমকে দিয়েছেন কিন্তু।
এই সময় সুবাসদা ওদের কাছে এল, অনিমেষ, তুমি কি আজই ফিরে যাচ্ছ?
তাই তো ইচ্ছে আছে।
হ্যাঁ, তোমার কলকাতায় না যাওয়ায় ভাল। কিভাবে ফিরবে ঠিক করেছ?
দুপুরের ট্রেন ধরব।
এই সময় লোকটা বলল, যাবেন কোন দিকে?
সুবাসদা বলল, ও আপনিও তো নর্থ বেঙ্গলে যাবেন। এক সঙ্গে যেতে পারেন আপনারা।
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল আপনি নর্থ বেঙ্গলে কোথায় যাবেন?
রায়গঞ্জ। আপনি?
শিলিগুড়ি।
বাঃ গুড। লোকটা হাসল, কিন্তু ট্রেনে না যাওয়াই ভাল।
তাহলে কিসে ফিরবেন?
সে ব্যবস্থা করেছি। বোলপুরে একটা লরি এসেছে কুচবিহার থেকে। সেটা আজ সকালেই ফিরবে। ওটাতেই এলাম ওটাতেই যাব।
আপনার সঙ্গে গেলে জায়গা হবে?
সারা ভারতবর্ষকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইছি আর আপনি তো মশাই মোটে পঞ্চাশ কেজির লোক হবেন? লোকটা অনিমেষের সঙ্গে হাত মেলাল।
এখন বাইরে প্রচন্ড কুয়াশা। চারধার সাদা হয়ে গেছে। মাথার ওপর আকাশটা তাই ঘোলাটে, এমন কি শুকতারা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ওরা ছোট ছোট দলে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ল। সুবাস, অনিমেষ এবং সদ্য পরিচিত মানুষটি চুপচাপ গ্রামের বাকী পথটুকু পার হয়ে একটা ছোট্ট নদীর কাছে এল। এটা ওরা যে দিক দিয়ে গ্রামে ঢুকেছিল তার বিপরীত দিক। এ গ্রামে শীতকাল বলেই হয়তো কোন কুকুর এই ভোর রাতে ডাকছে না, কোন মানুষ পথে হাঁটছে না। লোকটা বলল, আমি কিন্তু গুল মারিনি। এখানকার দিশী মদের দোকান খুব বিখ্যাত।
আপনি জানলেন কি করে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।
জেনে নিয়েছি। এই যে নদী, এটা ডিঙ্গিয়ে আলপথ দিয়ে কিছুটা গেলে যে গ্রামটা পড়বে তার নাম তালতোড়। ওটা ছাড়িয়ে আর একটু হাটলেই কোপাই।
লোকটার পেছন পেছন নদী পার হল ওরা। প্রচন্ড ঠান্ডা জল।
সুবাস বলল, আপনি যখন সব জানেন তখন গাইড হয়ে আগে আগে হাঁটুন, আমরা পেছনে আসছি।
লোকটা মাথা নাড়ল, তা কেন, একসঙ্গে পা ফেলি আসুন।
সুবাস বিরক্ত হল, দুর মশাই, এতদিন পর এর সঙ্গে দেখা হল, দুটো ব্যক্তিগত কথাও থাকতে পারে। বুঝছেন না কেন?
লোকটা বলল, তা তো বটে। বলে একটু এগিয়ে হাঁটা শুরু করল।
অনিমেষ অনেক দূরে গ্রাম দেখতে পাচ্ছিল। এদিকটায় শুধু মাঠ আর মাঝে মাঝে ঝোঁপঝাড়। শীতের সময় বলেই বোধহয় এখনও অন্ধকার হালকা হয়নি। সুবাস কিন্তু অনিমেষের সঙ্গে কথা বলছিল না। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে অনিমেষ বলল, সেই প্যাকেটটা নিতে আমার সঙ্গে যেতে হবে তো?
সুবাস মাথা নাড়ল, না। ওটা ফিরিয়ে দিতে হবে না।
কি আছে ওতে? অনিমেষ বুঝতে পারছিল না।
রিভলভার। বলে সুবাস কাঁধের ঝুলি থেকে একটা ছোট অস্ত্র বের করে অনিমেষ কে দেখাল ঠিক এই রকম। তারপরই অনিমেষকে একদম পাথর করে দিয়ে সামনে গুলি ছুঁড়ল। অনিমেষ দেখল চলতে চলতে সেই মুহূর্তে লোকটা ওদের দিকে মুখ ঘুরিয়েছিল এবং গুলীটা সরাসরি তার বুকে বিদ্ধ হতেই সে যেন কিছুটা শুন্যে উঠে গিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ওর শরীরের কাছে ছুটে গেল সুবাস। লোকটার ডান পকেটে একটা ছোট অস্ত্র ছাড়া কিছু পাওয়া গেল না। তখনও গুলীর শব্দ সেই নির্জন রাতের ফাঁকা মাঠে ড়িয়ে গড়িয়ে আকাশের দিকে যেন এগিয়েই যাচ্ছে। অনিমেষ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে ধাতস্থ হবার আগেই সুবাস উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দৌড়ে চল।
ঠিক খেয়াল নেই কতটা পথ কিভাবে ওরা পেরিয়ে এসেছে। শান্তিনিকেতনে ঢোকার মুখে সুবাস পা থামাল। অনিমেসের চোখের সামনে তখনও যেন সেই শরীরটা মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। এভাবে আচমকা হত্যা করার কোন কারন সে খুঁজে পাচ্ছিল না। লোকটি তাদের দলের না হলে এই গোপন মিটিং-এ প্রবেশ করার সুযোগ পেল কি করে? তাহলে
সুবাস বলল, ভোর হয়ে আসছে। তুমি ফিরে যাও।
অনিমেষ সরাসরি প্রশ্ন করল, লোকটা কি অন্যায় করেছিল?
সুবাস বলল, কথাবলার বেশী সময় নেই। ও পুলিশের চর। আমাদের সঙ্গে কাজ করার ভান করে এসেছে। আমি জানি ও ট্রেনেই এসেছে ট্রেনে যাবে। লরির ব্যাপারটা স্রেফ বানানো। তোমাকে কিংবা আমাকে আজ শ্রীঘরে ঢুকতে হতো।
অনিমেষ বলল, আমি ভাবতে পারছি না।
সুবাস বলল, চোখ কান খোলা রাখ অনিমেষ। যখনই বুঝবে কেউ পথের বাধা হচ্ছে তখনই তাকে সরিয়ে দেবে। সেন্টিমেন্ট মানুষকে সব সময় দাম দিতে বাধ্য করে। লোকটার সম্পর্কে আজ বিকেলেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যা হোক, আমি এখান থেকেই চলে যাচ্ছি। তুমি পুল পেরিয়ে ডান দিকের রাস্তাটা ধরো।
কিন্তু প্যাকেটটা–।
বললাম তো, ওটা তোমার জন্যে। গুলী লোড করাই আছে। সঙ্গে একটা কাগজে ডেমনেস্ট্রেশন দেওয়া আছে। আবার দেখা হবে।
সেই ফিকে চাঁদের আলোয় অনিমেষ সুবাসকে উলটো পথে হাঁটতে দেখল। তারপর দ্রুত পা চালাল শ্রীনিকেতনের দিকে। কনকনে ঠান্ডাতেও এখন আর অনিমেষের শীতবোধ ছিল না।
হিমে স্নান করা বাড়িগুলোর কাছে এসে অনিমেষ একবার দাঁড়াল। হঠাৎ প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে। নাক মুখ বরফের মত ঠান্ডা। সমস্ত এনার্জি যেন শরীর থেকে নিংড়ে নিয়েছে রাতটা। পুবের আকাশ এখন ঈষৎলালচে। বাগান পেরিয়ে সে খিড়কি দরজার কাছে এসে দেখল সেটা বন্ধ। কয়েকবার আস্তে শব্দ করলেও ভেতরে কারো সাড়া পাওয়া গেল না। বাড়িটা যেন নিঝুম হয়ে আছে। হঠাৎ অনিমেষের মনে হল সে মাধবীলতার কাছে আর কখনই পৌঁছাতে পারবে না। অন্যের গড়া দুর্গে মাধবলিতাকে রেখে বেরিয়ে গেলে ফিরে এসে কখনই আর দরজাটা খোলা পাবে না। ব্যাপারটা ভাবতেই হিম যেন বুকে ছড়াল। সে খুব জোরে আঘাত করতে লাগল দরজায়। এখন এই কাকভোরে এই শব্দ চতুর্গুণ হলেও তার কোন প্রতিক্রিয়া বোঝা যাচ্ছে না। হতাশ অনিমেষ ভেতরে পায়ের আওয়াজ পেল এবার। দরজা খুলল মাধবীলতা। তার চোখে মুখে উদ্বেগ। নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?
অনিমেষ উত্তর না দিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মাধবীলতার হাত নিজের দুহাতে টেনে নিল। মাধবীলতা বলল, ওমা, তুমি একদম জমে গেছ। এসো তাড়াতাড়ি ভেতরে এসো।
চাতালের পাশে সব কটা দরজা বন্ধ। দারোয়ানটার ঘুম ভাঙ্গার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বন্ধ ঘরের উত্তাপ বড় আরামের। অনিমেষ সরাসরি খাটে গিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করল, তুমি ঘুমোওনি?
মাধবীলতা ঠোঁট টিপে মাথা নাড়ল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?
কিছু না। অনিমেষ সহজ হবার চেষ্টা করছিল।
তোমাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে। শুয়ে পড়।
শুয়ে আর কি হবে। একটু বাদেই তো বের হতে হবে।
তুমি কি আজই ফিরে যাবে?
হ্যাঁ।
ট্রেন কখন?
বোধহয় বারোটা।
তাহলে তো অনেক দেরী আছে।
অনিমেষ মাধবীলতাকে পূর্ণ চোখে দেখল। তারপর বলল, তোমার কিছু বলার নেই?
না। তুমি ভাল থেকো শুধু এইটুকু।
বালিশে মাথা রেখে অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। মাধবীলতা এসে ওর পাশে বসল। বসে বলল, তোমাকে কিন্তু আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে।
একটা লোককে চোখের ওপর মরে যেতে দেখলাম।
সেকি! কেন?
লোকটা বিশ্বাসঘাতকতা করছিল। লতা, জানি না তোমার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে কিনা। বোধহয় দেখা না হওয়াই ভাল।
কেন?
তোমায় দেখলে আমি ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ি।
জানতাম না তো।
আজ ফিরে এসে দরজা বন্ধ দেখে সেটা অনুভব করলাম। আমি দূরে থাকলে মনে হয় তুমি আমার জন্যেই আছে। কিন্তু কাছে এলেই ভয় হয় যদি হারিয়ে যাও।
মাধবীলতা ধীরে ধীরে ওর মুখ অনিমেষের গালের ওপর রাখল। দুহাত অনিমেষের মাথা আঁকড়ে ধরে নিজের শরীরের তাপে অনিমেষের শীতলতা ঢেকে দিয়ে বলল, আমি আছি, আমি থাকব।
দশটা নাগাদ ওরা টাকা পয়সা মিটিয়ে বেরিয়ে এল। রিকশা নিল না ওরা। জিনিসগুলো দুহাতে বয়ে বড় রাস্তায় চলে এল। বেরুবার আগে মাধবীলতা প্যাকেটটা বের করে জিজ্ঞাসা করল, সেই ভদ্রলোক তো এলো না?
অনিমেষ হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল, ওটা আমার জন্যে। কি আছে জানো এতে?
মাধবীলতা ঘাড় নাড়ল।
রিভলবার। অনিমেষ সযত্নে জিনিসটাকে লুকিয়ে রাখল। আর রাখতে গিয়ে ওর মনে পড়ে গেল। বড় রাস্তায় এসে সে জিজ্ঞাসা করল, আমার জিনিসপত্র ওরা হোস্টেল থেকে এসে তোমার কাছে পৌঁছে দিয়েছিল না?
হ্যাঁ।
সেগুলো ঠিক আছে?
কেন?
আমি একটা জিনিস একদম ভুলে গিয়েছিলাম। দুটো প্যাকেট আমার কাকা আমাকে দিয়েছিলেন দুজনকে দেবার জন্যে। মনেই পড়ছে না ওগুলো নিয়ে আমি কি করেছি। তুমি কি ছোট দুটো প্যাকেট ওগুলোর মধ্যে পেয়েছ?
না তো।
কি আশ্চর্য! তাহলে গেল কোথায় ওগুলো!
খুব দরকারী কিছু?
জানি না। আমাকে পৌঁছে দিতে দেওয়া হয়েছিল। যাঃ খুব খারাপ লাগছে।
তাহলে আমি ভাল করে খুঁজে দেখব।
দেখো তো।
ওরা খানিকটা এগোবার পর মাধবীলতা বলল, শোন আমার মনে হচ্ছে তোমার একা ট্রেনে ওঠা উচিত হবে না।
কিছু হবে না।
হলে কিছু করার থাকবে না। আজ কাকে মেরে ফেলা হয়েছে তার খবর পুলিশ পেলে নিশ্চয়ই হাওয়া খুব গরম হবে।
অনিমেষ দাঁড়াল, ঠিক বলেছ। তাহলে কি করা যায়?
আমি তোমার সঙ্গে যাব।
পাগল! তোমার স্কুল আছে না?
থাক।
কিন্তু তুমি সঙ্গে থাকলে কি লাভ হবে?
স্বামী-স্ত্রী দেখলে পুলিশ সন্দেহ করবে না।
অনিমেষ মাধবীলতাকে দেখল। একটা খালি রিকশা দেখতে পেয়ে মাধবীলতা ততক্ষনে সেটাকে থামিয়েছে। ওটাটে চেপে মাধবীলতা আঁচলটা মাথায় তুলে দিল। সামান্য একটু কাপড়ের আড়াল কিন্তু অনিমেষের মনে হর পৃথিবীর সব সৌন্দর্য এর কাছে মুহূর্তেই ম্লান হয়ে গেল। মাধবীলতা নিঃশব্দে অনিমেষের হাতে চিমটি কাটল, এই, কি দেখছ?
অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে নিল, কোন কথা বলল না।
মাধবীলতা কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। অনিমেষের বুকের ভেতর এটা লোহার বল গড়াচ্ছিল, অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রাখছিল সে।
বাস স্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে যেতে যেতে অনিমেষ রিকশাওয়ালাকে থামতে বলল। ঠিক সামনেই একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। ওপরে লেখা সাঁইথিয়া। রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে সময়টা জেনে নিল অনিমেষ। সাঁইথিয়া যেতে যে সময় লাগবে তাতে নিশ্চিতভাবেই সেখান থেকে ট্রেনটা ধরা যাবে। সাঁইথিয়া স্টেশনে নিশ্চয়ই কোন বিপদের ঝুঁকি নেই।
মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কি হল?
বাসে সাঁইথিয়া যাব। তুমি ঠিকই বলেছ, রিস্ক নিয়ে কোন লাভ নেই।
তুমি কি চাইছ আমি তোমার সঙ্গে না যাই?
হ্যাঁ।
কেন?
তুমি জানো লতা।
অনিমেষ আর কথা বাড়াল না। চট করে সাঁইথিয়ার বাসটায় উঠে জায়গা খুঁজতে লাগল। একদম পেছনের দিকে একট সিট পাওয়া গেল। ব্যাগটা সেখানে রেখে নেমে এসে দেখল মাধবীলতা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে, রিকশাটা তখনও চলে যায়নি। ঠিক সেই সময় আর একটা প্রাইভেট বাস এসে স্ট্যান্ডে দাঁড়াল। ওপরে সাদা কাগজে স্টেশন শব্দটা লেখা। তার নীচে শান্তিনিকেতন-কলকাতা। কন্ডাক্টর তার দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে বর্ধমান, কলকাতা।
অনিমেস বলল, চমৎকার। কি সুন্দর ব্যবস্থা হয়ে গেল। তোমার আর ট্রেনে করে ফিরে দরকার নেই। নিশ্চয়ই স্টেশনে লোক পিলপিল করছে। এই বাসটার খবর পেলে আর দেখতে হবে না। উঠে এসো চটপট। মাধবীলতার জিনিস নিয়ে অনিমেষ ভরতি হতে যাওয়া বাসটায় উঠে চড়ল। প্রথম দিকের লেডিস সিটে রেখে জানালা দিয়ে ডাকতে মাধবীলতা ভারী পায়ে উঠে এল।
অনিমেষ বলল, একদম টানা চলে যাবে। কষ্ট পাবে না।
কষ্ট! মাধবীলতা হাসল।
ওদিকে সাঁইথিয়ার বাস হর্ণ দিচ্ছে। অনিমেষ বাস থেকে নেমে পড়তেই মাধবীলতা পেছনে ডাকল। জানলার নিচে গিয়ে দাঁড়াল অনিমেষ। মাধবীলতা চট করে ব্যাগ খুলে একটা খাম বের করে হাতটা বাড়িয়ে দিল।
কি এটা?
তোমার জন্যে নিয়ে এসেছিলাম। দরকার হবে।
অনিমেষ খামটা খুলতে যাবে, এমন সময় বাসটা আবার সজোরে হর্ণ বাজাল। দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠল সে। ততক্ষণে প্রায় ভরতি হয়ে গেছে। লোকেরা এখন দাঁড়িয়ে আছে মাঝখানে। ভীড় সাঁতরে কোনরকমে নিজের সিটে গিয়ে বসতেই সে মাধবীলতাকে দেখতে পেল। কলকাতার বাসের জানালার ওর মুখ।
মাধবীলতা হাসবার চেষ্ট করছে, কবে দেখা হবে বললে না!
লিখব। চেঁচিয়ে বলল অনিমেষ।
মাধবীলতা কি বলল শুনতে পেল না অনিমেষ। কারণ, তখন সশব্দে বাসটা চলতে শুরু করেছে। একপলকেই মাধবীলতার উদগ্রীব মুখটা মুছে গেল সামনে থেকে। মাধবীলতার বিপরীতমুখী বাসে বসে খামটা খুলে শক্ত হয়ে গেল অনিমেষ। পাঁচটা একশ টাকার নতুন নোট খামের ভেতরে। সঙ্গে একটা সাদা কাগজে দুটো অক্ষর লেখা, ভালো থেকো।
Leave a Reply