পয়লা তারিখে খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল অনিমেষের। বালিশে মুখ রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে মাথাতেই মাথার ভেতর চিন্তাটা হঠাৎ নড়ে উঠল। আজ মাধবীলতা বাড়ি থেকে বেরিয়ে হোস্টেলে আসবে। কথা আছে, সকাল আটটার মধ্যে অনিমেষ বেলঘরিয়া ষ্টেশনে ওর জন্য অপেক্ষা করবে। নিমতা থেকে মাধবীলতা রিকশা নিয়ে সেখানে আসবে। তারপর ট্রেন ধরে শিয়ালদায় নেমে ওরা হোস্টেলে যাবে। প্রথম দিন অনিমেষ সঙ্গে গেলে মাধবীলতার সুবিধে হবে।
অনিমেষে চেয়েছিল নিমতার বাড়িতে যেতে। শেষবার সে নিজে মাধবীলতার বাবার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। ভদ্রলোক জেদ ধরে আছেন সত্যি কিন্তু ভাল করে বোঝালে হয়তো বুঝতেও পারেন। কিন্তু মাধবীলতা তাতে কিছুতেই রাজী হয়নি। বলেছিল, আমার বাবা তোমাকে অপনাম করবেন আমি সেটা দাঁড়িয়ে দেখতে পারবো না। যা কিছু শুনতে হয় তা আমিই শুনবো।
অনিমেষ একটু ইতস্তত করে বলেছিল, ঠিক আছে তবু একটা কথা বলি, জানি তুমি রেগে যাবে শুনলে, কোনভাবেই কি অ্যাডজাস্ট করা যায় না?
মাধবীলতা রাগল না। ওর ঠোঁটে হাসির আদল ফুটল শুধু। তারপর খুব নীচু গলায় বলল, আমি আর টেনসন সইতে পারছি না। প্রতিদিন এক কথা শুনতে শুনতে আমার নার্ভ সহ্যের শেষ সীমায় এসেছে। তারপর খানিক চুপ করে বলল, তুমি এত চিন্তা করছ কেন? আমি নিজে একজন মেয়ে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে আমাকে হাজারটা চিন্তা করতে হয়েছে।
মাধবীলতা তাই একাই বাড়ি থেকে বের হতে চেয়েছে। বাড়ির কাছাকাছি যাতে অনিমেষ না যায় তাই বেলঘরিয়া স্টেশনে ওকে অপেক্ষা করাতে চেয়েছে। ব্যাপারটা অনিমেষের ভাল লাগেনি। মাধবীলতা তার জীবনের এই ঝুঁকির সঙ্গে ওকে জড়াতে চাইছে না এটা ভাবলেই নিজেকে অক্ষম বলে হচ্ছিল। এ মেয়ে যা কিছু করবে তা নিজের দায়িত্বে করতে চায়। অনিমেষের অস্বস্তিটা এইখানেই।
অনিমেষ দ্রুত তৈরী হয়ে নিল। হাতিবাগান থেকে বেলঘরিয়াতে পৌঁছাতে মিনিট চল্লিশেক লাগবে। ভেতরে ভেতরে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ল অনিমেষ। একটি মেয়ে আজ তার জন্য জীবনের বাঁধা রাস্তার সব সুখ ত্যাগ করে বেরিয়ে আসছে এটুকু ভাবলেন নিজেকে সম্রাট বলে মনে হয়। জামাকাপড় পরতে পরতে অনিমেষ ভাবছিল যদি মাধবীলতা কোন কারণে বাড়ি থেকে না বেরুতে পারে তাহলে সে কি করবে? যদি বাড়ির লোকেরা জোরজবরদস্তি করে ওকে আটকে রাখে? অনিমেষ ঠিক করল যদি বেলা দশটার মধ্যেও মাধবীলতা স্টেশনে না আসে তাহলে সে কোন নিষেধ মানবে না। সোজা মাধবীলতার বাবার মুখোমুখি হবে। ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে নিজের অজান্তেই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল অনিমেষ। ঠিক এই সময়েই দরজায় শব্দ হল। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে অনিমেষ বলল, কে?
এইসময় কেউ এসে কথা বললে দেরী হয়ে যাবে বলে অনিমেষ বিরক্ত হচ্ছিল। বাইরে থেকে কেউ সাড়া না দেওয়ায় সে একেবারে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দুহাতে দরজা খুলতেই চমকে উঠল। বাইরে এখন ঝকঝকে রোদ্দুর। আর সেই রোদ্দুর পেছনে রেখে মাধবীলতা দুইচোখে হাসছে। বুকের ভেতরটা হঠাৎ শরতের আকাশ হয়ে গেল অনিমেষের। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। কোনরকমে বলল, তুমি!
মাধবীলতা তখনও হাসছিল। সেই হাসিতে একই সঙ্গে আনন্দ আর সঙ্কোচ। দুটো চোখের চাহনি নিঃশব্দে অনেক কথা বলে দিচ্ছে ওর। একটা হলুদ শাড়ি পরে আসায় সমস্ত চেহারায় মিষ্টি ঔজ্জ্বল্য এসেছে। বিব্রত, অবাক অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, রাগ করেছে?
কি আশ্চর্য! রাগ করব কেন? কিন্তু তুমি এখানে এলে কী করে? অনিমেষের বিস্ময় তখনও কাটছিল না। এই সকালবেলায় মাধবীলতা ওপরে উঠে এল কিভাবে? সাধারণত কেউ দেখা করতে এলে দারোয়ান এসে খবর দিয়ে যায়। অনিমেষ দেখল সুন্দরী একটি মেয়ে ভেতরে এসেছে, এ খবর ঘরে ঘরে জানাজানি হয়ে যাচ্ছে। কারণ এক একটা অজুহাত দেখিয়ে অন্যান্য বোর্ডার বাইরে বেরিয়ে মাধবীলতাকে দেখছে। অস্বস্তি হল ওর। সেইসময় মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, তোমার ঘরে যেতে বলবে না?
আমার ঘর? অনিমেষ ঘরটার দিকে তাকাল। ওর খুব ইচ্ছে করছিল মাধবীলতাকে ভেতরে নিয়ে যেতে। কিন্তু পরমুহূর্তেই সচেতন হয়ে গেল সে। খবরটা প্রচারিত হতে বেশী সময় লাগবে না। হোস্টেলের নিয়মকানুন তো আছেই, একটি অবিবাহিতা মেয়ে ছেলেদের হোস্টেলে একা বসে গল্প করছে এ খবর য়ুনিভার্সিটিতে দারুণ মুখরোচক হবে। সে কোন কথা না বলে দরজায় তালা লাগিয়ে বলল, চল, বের হব।
মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল, মানে?
আমাকে একটু বেরোতে হবে, কাজ আছে। অনিমেষ কপট গলায় বলল। ওকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অনিমেষ সিঁড়ির দিকে এগোল। হোস্টেলের এই ছাদের ঘরে আজ অবধি কোন মেয়ের পদার্পণ হয়নি। যতটা করলে অভদ্রতা না মনে হয় ঠিক ততটা আগ্রহ নিয়ে বারান্দায় বারান্দায় ছেলেরা তোয়ালে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাধবীলতা অনিমেষের পেছনে নীচে নেমে এসে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় কাজ আছে তোমার?
বেলঘরিয়া স্টেশনে। অনিমেষ গম্ভীর গলায় বলল।
ইয়ার্কি না? এতক্ষণে সহজ হল মাধবীলতা, এমন মুখের ভঙ্গি করেছিলে না যে মনে হচ্ছিল এসে খুব অন্যায় করেছি।
অন্যায় কিছুটা হয়েছে বইকি! ওইভাবে হুট করে ওপরে উঠে যাওয়া তোমার উচিত হয়নি। আফটার অল এটা ছেলেদের হোস্টেল। গেটে এসে অনিমেষ চারধারে নজর বুলিয়ে দারোয়ানকে দেখতে পেল না।
রাস্তায় নেমে মাধবীলতা বলল, বাঃ, সেটা আমি জানব কি করে। এখানে এসে দেখলাম কেউ নেই। একটু ভেতরে ঢুকে তোমার নাম জিজ্ঞাসা করতেই একজন ঘরটা বলে দিল। ডেকে দেবার কেউ না থাকলে আমি কি করব? কিন্তু তুমি আমাকে ভেতরে বসতে বললে না কেন?
নিজের ওপর বিশ্বাস নেই বলে।
অভদ্র! বলে মাধবীলতা মুখ ঘুরিয়ে নিল।
অনিমেষ ঘার ঘুরিয়ে ওর মুখখানা দেখল। আচমকা বেশ লাল দেখাচ্ছে। জরুরী কথা বলার ভঙ্গীতে সে বলল, এবার কাজের কথাটা বলো তো সাতসকালে কেন এখানে হাজির হলে? আর একটু দেরী হলেই তো আমি বেরিয়ে যেতাম।
মাধবীলতা তখনও স্বচ্ছন্দ নয়। অনিমেষের মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, বলছি, কিন্তু তার আগে সত্যি করে বল তুমি রাগ করনি আমি তোমার ঘরে উঠে গিয়েছিলাম বলে।
অনিমেষ হেসে ফেলল, আচ্ছা মেয়ে তো! বললাম না আমি রাগ করিনি।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে ট্রাম রাস্তায় চলে এসেছিল। সকালবেলায় কলকাতার চেহারাটা অনেক নরম থাকে। দোকানপাট এখনও খোলেনি, শুধু সিগারেট পানের দেকানগুলো ছাড়া। ফুটপাতে কলকাতাকে একদম অনুত্তেজিত দেখায়। মাধবীলতা বলল, চল, কোথাও বসে চা খেতে খেতে কথা বলি। সক্কাল থেকে স্থির হতে পারিনি।
ওরা পাশাপাশি হেঁটে হাতিবাগানে এল। এখন ভাল রেস্টুরেন্টগুলোর ধোওয়ামোছা চলছে। আটপৌরে চায়ের দোকানে খবরের কাগজ পড়তে আসা মানুষের ভিড়। অনিমেষ রাধা সিনেমার পাশে দোতলায় একটা রেস্টুরেন্টে উঠে জিজ্ঞাসা করল, চা পাওয়া যাবে?
ছোকরা মত একটা লোক, তখনও বেয়ারার পোশাক পরেনি, বলল, দেরী হবে।
কতক্ষণ?
ওদের দিকে তাকিয়ে লোকটা কি বুঝল কে জানে, জিজ্ঞাসা করল, শুধু চা?
অনিমেষ কিছু বলার আগেই মাধবীলতা বলল, টোস্ট পাওয়া যাবে? বোঝা যাচ্ছিল শুধু চা বললে লোকটা কাটিয়ে দিত।
বাঁ দিকে হাত তুলে বলল, বসুন দশ মিনিট।
রেস্টুরেন্টে সবে ঝাট পড়েছে। চেয়ারগুলো টেবিলের ওপর উলটে রাখা আছে। পেছনে থেকে লোকটা চেঁচিয়ে বলল, কেবিনে গিয়ে বসুন।
অনিমেষ রাস্তার ধারে কেবিনে ঢুকল। কেবিনটা ছোট। দেওয়াল ঘেঁষে টেবিল। পাশাপাশি দুজন বসতে পারে। ওরা বসতেই সামনের হাতিবাগান বাজারের ওপরটা চোখে পড়ল। পর্দাটা গোটানো থাকা সত্ত্বেও এখানে আলো কম। চেয়ারে বসে মাধবীলতা বলল, জানো, কাল রাত্তিরে এদকম ঘুমুতে পারিনি।
অনিমেষ তাকাল। মাধবীলতাকে প্রথম থেকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছিল। এখন কারণটা বুঝতে পারল। আজ অবধি কখনো সে ওকে ভোরে দ্যাখেনি তাই একটু আলস্য মাখানো অযত্ন মুখে চুলে। স্নানের পর মেয়েদের শরীরে যে টানটান তেজ থাকে তা ভোরবেলায় পাওয়া যায় না। ভোরবেলায় তাই মেয়েদের কাছের মানুষ মনে হয়। এতক্ষণ ওকে দেখার আনন্দে এবং উত্তেজনায় সমস্ত ব্যাপারটা গুলিয়ে গিয়েছিল। আজ সকালে মাধবীলতার বেরিয়ে আসার কথা। অথচ সে এখন তার সামনে বসে। এদিকে বলছে মত পালটেছে মাধবীলতা। গলা স্বাভাবিক রেখে সে জিজ্ঞাসা করল, ঘুম হয়নি কেন?
কোনদিন তো বাড়ির বাইরে থাকিনি। একা নতুন জায়গায় কিছুতেই ঘুম আসছিল না। নানান চিন্তা আসছিল আর ভেবেছি কখন সকাল হবে। মাধবীলতা হাসলো।
হকচকিয়ে গেল অনিমেষ, নতুন জায়গা মানে? তুমি কি গত কালই চলে এসেছ?
হ্যাঁ। মাধবীলতা একটা চাপা নিশ্বাস ফেলল।
কেন? কি হয়েছিল?
চলে আসতে হল। ভয় ছিল গতকাল থেকেই আমাকে থাকতে দেবে কিনা। কিন্তু সুপারকে বলতে দেখলাম রাজী হয়ে গেলেন। নইলে কি বিপদে পড়তে হতো!
কী হয়েছিল? আবার প্রশ্নটা করলো অনিমেষ।
বাড়িতে গিয়ে মাকে বললাম তোমরা যদি চাও তাহলে আমি হোস্টেলে চলে যেতে পারি। মা বলল, তোমার বাবার সঙ্গে বুঝে নাও, আমি এর মধ্যে নেই। বাবা আমাকে দেখা মাত্র জানতে চাইলেন আমি কারো প্রেমে পড়েছি কিনা। অস্বীকার করলাম না। তারপর যা হয়ে থাকে তাই হল। আমি নাকি ওঁর মুখ পুড়িয়ে দিয়েছি। দুধকলা খাইয়েছেন কালসাপকে। বললেন মত পরিবর্তন করতে। অসম্ভব শুনে জানিয়ে দিলেন আমার মুখ দর্শন করতে চান না। আমি যেন ওই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। আমারও খুব রাগ হয়ে গিয়েছিল। জিনিসপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ওরা জানতেও চাইল না কোথায় যাচ্ছি। তবু একটা কাগজে নিজের ঠিকানাটা লিখে রেখে এলাম। ভালো লাগছিল না একটুও।
মাধবীলতা মুখ নামালো।
অনিমেষের কষ্ট হচ্ছিল, গাঢ় গলায় বলল, দ্যাখো, পরে অনুশোচনা করার চেয়ে সময় থাকতেই শুধরে নেওয়া ভাল। হাজার হোক তারা তোমার মা বাবা।
মাধবীলতা দাঁতে ঠোঁট কামড়ালো, এই একটা কথা তুমি কতবার বললে! তুমি কিছুতেই বুঝছ না একটা মেয়ে বাড়ির প্রতিকূল মনোভাবের বিরুদ্ধে কতক্ষণ লড়তে পারে? অনবরত চাপ দিচ্ছে সবাই বিয়ের জন্যে। উঠতে বসতে খোটা খেতে হচ্ছে। হয় হ্যাঁ বল নয় না। আজ থেকে দুবছর আগে হলে হ্যাঁ বলতে কোন অসুবিধে হতো না। স্বচ্ছন্দে বিয়ে হয়ে যেত আমার। বাবা বলতেন বড় ভাল মেয়ে, আমি দায় থেকে উদ্ধার পেলাম। কিন্তু এখন আমি কি করে রাজী হই! যে সব মেয়ে মনে করে মনের কোন সতীত্ব নেই আমি সেই দলের নই। শরীরের চেয়ে মন আমার কাছে কম মূল্যবান নয়। যে চোখে আমি তোমাকে দেখেছি সেই চোখে আমি অন্য পুরুষকে দেখব কি করে? কথা বলতে বলতে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল মাধবীলতা।
অনিমেষ দেখল ওঁর মুখ কাঁপছে, আর তারপরেই চোখের দুটো কোণা চিক চিক করে উঠল। মাধবীলতার মুখে এখন ভাড়চুর। চোখ দুটো ভরা পুকুর। অনিমেষের বুকের মধ্যে পাথর গড়াতে লাগল। নিজের অজান্তেই ওই একটা হাত মাধবীলতার কাঁধে রাখল, কেঁদো না, তোমার চোখে জল একদম মানায় না। আমি সহ্য করতে পারব না।
সামলাতে সময় লাগল ওর। আঁচলে চোখ চেপে রাখল কিছুক্ষণ। তারপর ধরা গলায় বলল, আচ্ছা। বল তো, কোন বাবা-মা নিজের মেয়েকে এত সন্দেহ করে? কেন নিজের জেদ মেয়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে আনন্দ পায়? আমি কি ছেলেমানুষ? এতদিন যেমন ছিলাম তেমনি কি ওদের কাছে আরো কিছুকাল থাকেত পারতাম না? তবে কেন এত জোরজবরদস্তি!
অনিমেষ জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। আকাশ এখন পরিষ্কার। সান্তনা দেবার ভঙ্গিতে বলল, কিছুদিন যেতে দাও দেখবে ওঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন। নিশ্চয়ই জেদ করবেন না আর। তুমি যদি কোন অন্যায় না কর তাহলে কেউ তোমার দোষ দেবে না।
না, কথাটা ঠিক নয়। আমি বাড়ি থেকে চলে এসেছি এই খবরটা আত্মীয়রা জানা মাত্রই দুর্নাম রটাতে শুরু করবে। কিন্তু তাতে আমার কিছু এসে যায় না। মাধবীলতার কাঁধ থেকে দুহাত দুপ্লেট টোস্ট আর দুটো চায়ের কাপ হাতে নিয়ে লোকটা চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরটার চেহারা পালটে গেল। পর্দাটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষের একবার মনে হল উঠে সরিয়ে দেয় ওটাকে। সেইসময় মাধবীলতা বলল, তুমি আমাকে কখনো কষ্ট দিও না।
একথা বলছ কেন?
আমার যেন মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার কোথাও অস্বস্তি আছে।
কী রকম?
আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারটায় যেন তোমার কোথাও অস্বস্তি আছে। সত্যি করে বল তো আমি কি তোমার ওপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি?
লতা! অনিমেষ প্রতিবাদ করতে চাইল।
না অনি, আমি, যা করছি নিজের দায়িত্বেই করছি। তোমার যদি মনে হয় জড়িয়ে যাচ্ছ তাহলে স্বচ্ছন্দে সরে যেতে পরো। আমার খুব কষ্ট হবে, সারা জীবন হয়তো কাদব কিন্তু আমি তোমার গার কাঁটা হয়ে আছি এ আমার সহ্য হবে না। মাধবীলতার গলা বুজে এল।
অনিমেষ আর পারল না। চকিতে দুই হাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরল সে। বোধহয় একটা সুতোর আড়ালে নিজেকে ধরে রাখছিল মাধবীলতা, আর পারল না। অনিমেষের বুকে মুখ রেখে হু হু করে কেঁদে ফেলল। তার দুহাত এখন অনিমেষের পিঠ আঁকড়ে ধরেছে। থর থর করে কাঁপছে শরীর। অনিমেষের সমস্ত শরীর এখন অচৈতন্য, মনের কোন বাঁধা নেই, দুহাতে মাধবীলতার মুখ তুলে স্পষ্ট গলায় বলল, আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না।
মাধবীলতার দুই চোখে জলের ধারা গড়ালো, ঠোঁট কাপলো, আমিও না। এই প্রথম কোন যুবতী শরীরকে বুকের ওপর অনুভব করল অনিমেষ। চোখের সামনে মাধবীলতার ভেজা স্ফীত ঠোঁট চুম্বকের মত তাকে টানছিল। ধীরে ধীরে মুখ নামালো অনিমেষ। তারপর সেই উষ্ণ নরম সিক্ত ঠোঁট আকণ্ঠ চুম্বন করল। দুজনের চোখ এখন বন্ধ, সমস্ত বিশ্বচরাচর যেন এই পর্দা ঘেরা ছোট্ট কেবিন হয়ে গেছে। ঠোঁটের স্পর্শের মধ্যে দিয়ে অনিমেষ মাধবীলতার সব অন্ধকার মুছিয়ে দিল, মাধবীলতা সব না-বলা কথা জেনে নিল।
চেতনা ফিরতেই মুখ সরিয়ে নিল মাধবীলতা। আস্তে আস্তে তার হাত শিথিল হল। যেন একটু লজ্জা পেয়েই সে সরে বসতে চাইল। মুখে এখনও একটা মিষ্টি অথচ নোনতা সুখের স্বাদ, অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। আর তখনই সেই বন্ধ চোখের পাতায় আচমকা সেই দুপুরটা ছিটকে চলে এল। জলপাইগুড়ি শহরের বিরাম করের বাড়িতে সদ্য কিশোর অনিমেষ রম্ভার সামনে দাঁড়িয়ে। সামনের বিছানায় রম্ভা শুয়ে রয়েছে জ্বরতপ্ত শরীরে। মুখচোখ লাল, চুল উসকোখুসকো। অনিমেষ যখন তার অনুরোধে জ্বর দেখতে নীচু হয়েছিল তখনই করার আগেই দুটো জ্বরো ঠোঁট তাকে চুম্বন করেছিল। বিশ্রী, পোড়া বিড়ির স্বাদ পেয়েছিল যেন অনিমেষ। দাঁড়িয়ে উঠে নিজের ঠোঁট ঘিনঘিনে ভাব অনুভব করেছিল। জ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে সেই তার প্রথম চুম্বন। কিন্তু তার স্মৃতি অনেকদিন একটা অস্বস্তির চেহারা নিয়ে মনের ভেতর ছিল। আজ অনিমেষের মনে হল এতদিনে সেই বিশ্রী স্মৃতিটা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হয়ে গেল।
অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। শেষ পর্যন্ত অনিমেষ সামনে রাখা প্লেট টেনে নিয়ে বলল, খাও।
টোস্টে হাত না দিয়ে চায়ের কাপটা টেনে নিল মাধবীলতা। ধীরে ধীরে একবার চুমুক দিয়ে বলল, ভাল লাগছে না..
কেন, ঠান্ডা হয়ে গেছে? অনিমেষ হাত দিয়ে দেখল কাপটা গরম নেই।
মাধবীলতা তাই দেখে বলল, না, খাওয়া যাবে কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না।
বুঝল না অনিমেষ, কেন?
সে তুমি বুঝবে না।
বাঃ, তুমিই তো চা খেতে চাইলে।
চেয়েছিলাম।
অনিমেষ ওর চোখে চোখ রাখতে চাইল কিন্তু, মাধবীলতা মুখ ঘুরিয়ে নিলে। অনিমেষ ধমকের সুরে বলল, খেয়ে নাও তো, সকাল থেকে কিছু খাওনি আর আজে-বাজে বকা হচ্ছে। খাও বলছি। টোস্টের প্লেটটা মাধবীলতার সামনে এগিয়ে দিল সে।
খাওয়া হয়ে গেলে মাধবীলতা বলল, আমি কিন্তু তোমার ভরসায় পরীক্ষা দেব!
আমার ভরসায়! আমি তো পড়াশুনা শুরুই করিনি।
এবার কর।
তুমি স্কুলে পড়ানো আর পরীক্ষার জন্যে তৈরী–দুটো পারবে?
পারতে হবেই।
আচ্ছা লতা, আমি ভবিষ্যতে কি করব বলে তুমি ভাবছ?
মানে?
আমি কি রকম চাকরি-বাকরি করব বলে তুমি আশা কর?
মাধবীলতা একটু ভাবল। তারপর বলল, ওসব আমি কিছুই ভাবিনি। একটা কিছু নিশ্চয়ই তুমি করবে, আর যাই করো আমি সমর্থন করবো।
এ কোন কথা হল? বাংলায় এম. এ. পাস করে চাকরি পাওয়া যাবে না। অধ্যাপনা বা মাস্টারী করার মত ব্রাইট রেজাল্ট আমার হবে বলে মনে হচ্ছে না। তখন কি হবে তাই ভাবছি।
আমার চাকরি তো রয়েছে।
আশ্চর্য মেয়ে।
কেন, আমার তো দুটো হাত-পাই আছে।
ইয়ার্কি করো না। আমার ব্যাপারে তুমি একটুও সিরিয়াস নও।
খুব বেশী সিরিয়াস বলেই কিছু ভাবি না।
তাছাড়া আর একটা ব্যাপার আছে। আমার যা শুনেছি তাতে লোক তোমাকে কি ভাবে নেবে তা জানি না। যদি—
ওসব কথা থাক। তোমার দাদু পিসীমার কথা যা শুনেছি তাতে আমার বিশ্বাস ওঁরা আমাকে নিশ্চয়ই ভালবাসবেন।
হঠাৎ অনিমেষের হাসি পেল। ওর মনে হল মেয়েদের মন সত্যিই বিচিত্র। এতদিনের রক্তের সম্পর্ক যাদের সঙ্গে তারা যাকে বুঝতে পারল না, সে বিশ্বাস করছে দুজন অপরিচিত লোক তাকে গ্রহণ করবে। যুক্তি নয়, হৃদয়াবেগই মেয়েদের সাহসী করে তোলে। কথা ঘোরাল অনিমেষ, আমার ভয় হচ্ছে হয়তো তোমাকে আমি সুখী করতে পারব না। সেদিন সুবাসদার সঙ্গে কথা হবার পর থেকে আমার চিন্তা-ভাবনা সব পালটে যাচ্ছে। যদি এমন সময় আসে যখন আমি বাধা-ধরা জীবনে না থাকি তাহলে তুমি কি করবে?
কিচ্ছু না। এখন যা করছি তাই করব। মাধবীলতা অনিমেষের হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই মনে হয়েছেল তুমি সাধারণ নও। ঘরসংসারের বাধা জীবনে তোমাকে মানায় না। সেটা করতে গেলে তোমার ওপর অন্যায় করা হবে। তোমার পক্ষে যেটা স্বাভাবিক তাই তুমি করবে। আমি কোনদিন তোমার বাধা হয়ে দাঁড়াবো না।
আচ্ছা, এত ছেলে থাকতে তুমি আমাকে ভালবাসলে কেন?
কি মনে হয় তোমার?
জানি না। কেন, তুমি কেন ভালবাসলে?
অনিমেষ মাধবীলতার চোখের দিকে তাকাল। সেই চোখ হাসছে। মনে মনে সে বলল, তোমায় না ভালবাসলে আমি মরে যেতাম। কিন্তু মুখে মুখে কিছু বলল না সে। কারণ মাধবীলতার চোখে হাসি এখন ঠোঁটে ছাড়িয়েছে। অনিমেষ হেসে ফেলল, শব্দ করে। ওদের দশটা আঙুল এখন পরস্পরকে আঁকড়ে ধরেছে বিশ্বাসে।
Leave a Reply