কার্ডটা হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল অনিমেষ। প্রিয়তোষ মিটার যে ছোট কাকা তো বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু এ রকম আচমকা ছোট কাকা এই হোস্টেলে এলেন কোত্থেকে? ওঁর তো এখানে থাকার কথাই নয়। সেই কবে বাইরে চলে গেছেন, মস্কো বোধ হয়। দাদু তো সে রকমই বলেছিলেন, কবে ফিরে এলেন? কার্ডটায় আর কিছু লেখা নেই কিন্তু কাগজটা খুব দামী, ছুঁলেই বিদেশী বলে মনে হয়। ওর ইচ্ছে করছিল তমালকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করে কিন্তু তমাল ততক্ষণে নীচে নেমে গেছে। অনিমেষ নিজের ঘরে ঢুকল।
মিত্রকে মিটার বলা দুচক্ষে দেখতে পারে না অনিমেষ। বাঙালী পদবীগুলোকে এভাবে বিকৃত করলেই সাহেব হওয়া যায়? দারোয়ান অবশ্য ওকে সাহেব বলেছে। তার মানে ছোট কাকার চেহারাটা পালটে গেছে। সেই রোগাটে পাজামা পাঞ্জাবি। ভাবতে গিয়েই সচকিত হল। এই চেহারাটা তো সেই সময়ের যখন পুলিশ তাদের বাড়ি সার্চ করতে এসেছিল। কিন্তু তারপর যখন ছোট কাকা কলকাতা থেকে প্লেনে জলপাইগুড়িতে এসেছিলেন তখন তো রীতিমতই সাহেব। মন্ত্রীর পেছন পেছন প্লেন থেকে নেমে এসেছিলেন ছোট কাকা। চোখ বন্ধ করতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল অনিমেষ, অ্যাশ কালারের স্যুট লম্বা সুরু নীল টাই, চোখে চশমা, হাতে বড় অ্যাটাচি ব্যাগ। তাহলে তো ছোট কাকা এতদিনে আরো কড়া সাহেব হয়ে গেছেন। আট নয় বছর তো হয়ে গেল। অনিমেষের মনে পড়ল পুলিশ আসার আগে যে রাতে ছোট কাকা নিঃশব্দে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সেই রাতে সে প্রথম একটা কাগজে মার্কসবাদী শব্দটা দেখেছিল। ছোট কাকা তখন কট্টর কমুনিস্ট ছিলেন। তারপর যখন ফিরে এলেন তখন তিনি কী, বুঝতে পারেনি অনিমেষ। কংগ্রেসী বিরাম করের সঙ্গে যেমন দোস্তি তেমনি কম্যুনিস্ট নেতাদের সঙ্গেও ভাব করার চেষ্টা ছিল তখন। দালাল বলে টাকা বিক্ষোভও হয়েছিল তখন। আর এখন ছোট কাকা কোন ভূমিকায়? যে ভূমিকাতেই হোক সরিৎশেখর যখন প্রচণ্ড অর্থকষ্টে জর্জরিত তখন তিনি সাহেবী করে বেড়াছে, এটাকে ক্ষমা করা অসম্ভব। অনিমেষ ঠিক করল সে গ্র্যাণ্ড হোটেলে যাবে না। যে মানুষ অবহেলায় নিজের স্বার্থের জন্য বাবা দিদিকে ছেড়ে এতকাল বাইরে ডুব দিয়ে বসেছিলেন তার সম্পর্কে আজ আর কোন দুর্বলতা তার নেই।
সকাল বেলায় একজন দাড়িকাটা পাঞ্জাবী তার কাছে এল। অনিমেষ তখন এই পত্র নাড়াচাড়া করছে, দেখে অবাক হল।
নমস্কার করে লোকটা বলল, সাব গাড়ি লেকে আয়া।
ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কিসের গাড়ি?
সাব ভেজ দিয়া গ্র্যাণ্ড হোটেলসে।
ছোট কাকা তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছেন। অনিমেষের আর অবাক হওয়ার মত নার্ভ ছিল না। তাকে এত খাতির কেউ করতে পারে সামনে দাঁড়ানো লোকটার নিতী ভড়িঙ্গ দেখে ও দ্বিতীয় চিন্তা করল। যে কোন কারণেই হোক ছোট কাকার তাকে দরকার। সে যতই এড়াতে চাইবে তিনি ছাড়বেন না। এই লোকটিকে ফিরিয়ে দেবার পর তিনি যদি নিজে আসেন তাহলে খামোকা বিব্ৰত হতে হবে। মুখের ওপর তাকে কালকের ভাবনাগুলো বলা যাবে না। সম্পর্কটাকে তিক্ত না করে মানসিক সম্পর্কহীন একটা সাক্ষাৎকার সেরে আসাই ভাল।
ইচ্ছে করেই পাজামা পাঞ্জাবী পরল অনিমেষ। গ্র্যাণ্ড হোটেলে যেতে হলে যেসব পোশাকের কথা মনে পড়ে তা অবশ্য ওর নেই। না থাকলে মানুষ যেমন একটা বোহেমিয়ান ভাব দেখিয়ে উপেক্ষা করতে চায় সেও তেমনি ইস্ত্রি না করা পাঞ্জাবী গায়ে চাপালো। গাড়িতে বসে অনিমেষ বুঝতে পারল, এগুলোকে লাক্সারী ট্যাক্সি বলে। খুব যত্ন করে রাখা বলে বেশ আরামদায়ক। জিজ্ঞাসা করে জানল হোটেলের বড় সাহেবরা কলকাতায় থাকাকালীন দিন রাতের জন্য এ রকম গাড়ি ভাড়া করেন। সাধারণ মানুষের ক্ষমতার বাইরে এ গাড়ির ভাড়া।
গ্র্যাণ্ড হোটেলে সে কখনও আসেনি কিংবা সে সুযোগই হয়নি। চৌরঙ্গী দিয়ে যেতে যেতে অনেক দিন সে ওদিকে তাকিয়েছে। একজন দীর্ঘদেহী পাঞ্জাবী দারোয়ান দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে তার পাশের গালচে বিছানো আলো ঝলমল প্যাসেজ দিয়ে।
সুবেশ মানুষরা যাতায়াত করেন। মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীদের মতন ওরও মনে হতো ভেতরটা নিশ্চয়ই রহস্যময়। আজ সেই প্যাসেজ দিয়ে হাটবার সময় সে অকারণেই স্মার্ট হতে চাইল। ড্রাইভারই তাকে বলে দিয়েছে ছোট কাকার স্যুট নম্বর। কয়েকজন বিদেশী নারী পুরুষ হাসতে হাসতে তার পাশ দিয়ে চলে গেল। রিসেপসনে হদিস নিয়ে অনিমেষ ওপরে উঠে এল।
এই কলকাতা শহরের বুকেই এমন টিপটপ সাহেবী পরিবেশ অনিমেষের জানা ছিল না। মিছিল শ্লোগান অভাব দৈন্যতার বাইরে ইংরেজী ছবির মত ছিমছাম আবহাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ নির্দিষ্ট নম্বরের সামনে এসে কপালের ঘাম মুছল। ঘর নয়, একটা পুরো স্যুট নিয়ে আছেন ছোট কাকা। নিশ্চয়ই প্রচুর অর্থ লাগছে এ জন্যে। অথচ দাদু জলপাইগুড়িতে, ব্যাপারটা মনে পড়তেই শক্ত হয়ে গেল অনিমেষ। না, আজকে এসব চিন্তা করবে না সে। দেখা করতে এসেছে দেখা করেই চলে যাবে।
বেল টিপতেই দরজা খুলে গেল। খুব সামান্য সময়, কিন্তু ছোট কাকাকে চিনতে পারল অনিমেষ। প্রচুর পরিবর্তন হয়ে গেছে চেহারার। একটু রোগাটে অথচ ছিমছাম শরীর। ঠোঁটের ওপর বেশ ঝোলা গোঁফ, মাথার চুল পাতলা কিন্তু যথেষ্ট লম্বাটে। চিনতে দেরী হওয়ার কারণ গোঁফ এবং চুলের রঙ লালচে আর গায়ের রঙ এত ফরসা যে চট করে বিদেশী বলে ভুল হতে পারে। সুন্দর একটা গন্ধ আসছে ওর শরীর থেকে। অনিমেষ প্রণাম করবে কিনা বুঝতে না পেরে বলল, কেমন আছেন?
ছোট কাকার মুখ এতক্ষণ অপরিচয়ের আড়াল সরাবার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর শোনা মাত্রই দু হাতে ওর কাধ ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন আরিব্বাস অনি, তুই কত বড় হয়ে গেছিস। একদম অ্যাডালটা? আরে রাস্তায় দেখলে তো আমি চিনতেই পারতাম না। আয় আয় ভেতরে আয়। দুহাতে জড়িয়ে ধরে তাকে ঘরে ঢোকালেন ছোট কাকা।
ওঁর স্পর্শে অনিমেষ একটু আড়ষ্ট হল; এভাবে অনেকদিন তাকে কেউ জড়িয়ে ধরেনি এবং ছোট কাকার শরীর থেকে এমন মূল্যবান গন্ধ বের হচ্ছে যাতে সে অভ্যস্ত নয়।
ঘরটা বেশ বড়। সুন্দর করে সাজানো। একটি মানুষ যত রকমের আরামের উপকরণ না পেলে বিরক্ত হবে তার সবগুলিই আছে। অনিমেষ ঘরে আর তিনজন মানুষকে দেখতে পেল। একবার তাকানোতেই মনে হচ্ছিল তাদের মধ্যে একজনকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কিন্তু ছোট কাকার উচ্ছাস তাকে এত বিব্রত করছিল যে কিছু ভাবার সুযোগই পাচ্ছিল না। ছোট কাকা এখন ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন, আরে অনি তুই আমাকে ছাড়িয়ে গেছিস লম্বায়? এই সেদিন জন্মালি, আঃ সময়টা এত দ্রুত চলে যাচ্ছে যে তাল রাখা মুশকিল। দেখি তোর চেহারাটা কেমন হয়েছে। হুম, গুড, দাড়ি রেখেছিস কেন? কারণ শুধু রাখলেই হল না, ওটার একটু যত্ন আত্তিও দরকার। এখন কি পড়ছিস যেন!
এবার এম. এ. দেব। অনিমেষ কথাটা বলতেই প্রিয়তোষের চোখ কপালে উঠে গেল যেন এ্যা এম.এ.? নো দেন য়ু আর কোয়াইট এ্যাডালট। নাঃ তোকে দেখে মনে হচ্ছে আমি এবার বুড়ো হয়ে যাবো।
ছোট কাকা শিশুর মত ওর হাত ধরে কথা বলছিলেন। অনিমেষ ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ওর সম্পর্কে নরম হতে লাগল। এই আচরণ, যদি আন্তরিক না হয় তাহলে মানুষ সম্পর্কে কখনোই কারো বিশ্বাস করার কারণ নেই। হঠাৎ ছোট কাকা অপেক্ষারত তিনজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাকে ক্ষমা করবেন। এ হল আমার ভাইপো। দীর্ঘকাল বাদে ওকে আমি দেখলাম। ন্যাচারালি।
সঙ্গে সঙ্গে তিনজন মানুষ প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলেন, ঠিক আছে ঠিক আছে। ছোট কাকা বললেন, আপনারা আমাকে মিনিট দশকে সময় দেবেন? আমি ওর সঙ্গে কয়েকটা কথা সেরে নিচ্ছি।
না, আপনাদের উঠতে হবে না, আমরা পাশের ঘরে যাচ্ছি। ততক্ষণ কিছু ড্রিংক বলছি আপনাদের জন্যে। টেলিফোন তুলে রুমসার্ভিসকে নির্দেশ দিয়ে ছোট কাকা ওকে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলেন। ওকে এখন খুব স্বচ্ছন্দ দেখাচ্ছে।
এটি শোওয়ার ঘর। অমন লোভনীয় বিছানা অনিমেষ কখনো দ্যাখেনি। এক পাশে সুন্দর বেঁটে খাটো সোফাসেট। ছোট কাকার সঙ্গে সেখানে বসল অনিমেষ। অনিমেষ দেখল ছোট কাকা ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। চোখাচোখি হতেই বললেন, একদিন আমি তোর মতন ছিলাম!
খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলা কিন্তু অনিমেষের অস্বস্তি হল। সে বলল, আপনি কবে এসেছেন কলকাতায়?
গতকাল। তোর হোস্টেলে গিয়েছিলাম। কত রাতে ফিরিস?
কাল একটু দেরী হয়েছিল।
নো নো আমি কিছু মনে করছি না এ জন্যে, দেরী করে ফেরার বয়স তো এটাই। এবার কলকাতায় এসে আমার একটাই অভিজ্ঞতা হল তুই বড় হয়ে গেছিস। প্রেম করছিস?
আচমকা প্রশ্নটা শুনে অনিমেষ লাল হয়ে গেল কোন রকমে বলল, কি যে বলেন! ছোট কাকা তখনও হাসছেন দেখে কথা ঘোরাতে জিজ্ঞাসা করল, আমার ঠিকানা কোত্থেকে পেলেন?
ছোট কাকা হাত নাড়লেন সেটাও বেশ কাকতালীয়। অনেকদিন আগে জলপাইগুড়ি থেকে বাবার চিঠি পেয়েছিলাম। দ্যাট ওয়াজ লাস্ট ওয়ান। তাতে জেনেছিলাম তুই কলকাতায় স্কটিশে ভরতি হয়েছিস। এখানে এসে সে কথা মনে পড়তেই স্কটিশ কলেজে ফোন করলাম। ওরা কিছুই বলতে পারল না। তখন খেয়াল হল তুই কলকাতায় এলে নিশ্চয়ই হোষ্টেলে উঠবি। কলেজ থেকে নাম্বার নিয়ে পর পর হোস্টেলগুলোতে রিং করতে লাগলাম। আলটিমেটলি তোকে পেয়ে গেলাম। আমার যদি খেয়াল হতো তুই কলেজ ছেড়ে দিয়েছিস অনেক আগেই তাহলে এ বুদ্ধি মাথায় আসত না এবং দেখাও হতো না।
আপনি কি মস্কোয় আছেন?
হ্যাঁ। এখন ওখানেই সেটলড। তারপর গলা পালটে জিজ্ঞাসা করলেন। বাবার খবর কি? কেমন আছেন?
সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। এই বিলাসবহুল হোটেলে বসে দাদুর কথা জিজ্ঞাসা না করে ছোট কাকা তো সরাসরি জলপাইগুড়িতে চলে যেতে পারেন। কি উত্তর দেবে ঠিক করার আগেই ছোট কাকা একটা হাত বাড়িয়ে ওর কাধ ধরলেন, বুঝতে পারছি প্রশ্নটা শুনে তুই ডিস্টাবড তাই তো?
অনিমেষ খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিল, না, তা কেন হবে! আপনি নিশ্চয়ই প্রশ্নটা করতে পারেন। দাদুর শরীর ভাল নেই। উত্তরটা দিতে পেরে অনিমেষ স্বস্তি পেল। এখানে এই হোটেলে বসে ছোট কাকাকে রূঢ় কথা বলে সে দাদুর সমস্যার কোন সমাধান যখন করতে পারবে না তখন বলে লাভ কি।
তুই সত্যিই বুদ্ধিমান। ছোট কাকা উঠে টেবিলের কাছে গিয়ে একটা সাদা বোতল থেকে গ্লাসে পানীয় ঢেলে জিজ্ঞাসা করলেন, তুই ভদকা খাবি?
ভদকা? না, না।
ঠিক আছে। গ্লাসে ঠোঁট ঠেকিয়ে ছোট কাকা বিছানার ওপর বসলেন এবার, তুই জানিস কিনা জানি না জলপাইগুড়ি ছাড়ার পর আমি বাবার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছিলাম। লাস্ট যেবার ওখানে যাই সে খবর তো তুই জানিস। তারপর নানান ঝামেলায় আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। ওই সময় বড়দার চিঠি পাই বাবা চলে গেছেন। তখন আমার বাইরে যাওয়া ঠিকঠাক। সেদিনই দিল্লি যাব। ভাবলাম বাবা যখন নেই তখন আর জলপাইগুড়িতে ফিরে কি হবে। বড়দা টাকা চেয়েছিল তাই পাঠিয়ে দিলাম। মস্কোতে গিয়ে তোর বাবাকে চিঠি দিলাম। মেজদা যে আমার ওপর চটেছে তা উত্তর পেয়ে বুঝলাম আর সেই সঙ্গে জানলাম বড়দা আমাকে ব্লাফ দিয়েছে, বাবা বেঁচে আছেন। তুই বোঝ ব্যাপারটা। বাবাকে চিঠি দিয়েছি তারপর উত্তর পাইনি। দিল্লী থেকে এক বন্ধুকে দিয়ে টাকা পাঠিয়েছিলাম উনি রিফুজ করেছেন। নাউ আই হ্যাভ নাথিং টু সে। কেউ যদি আমাকে এ জন্য দোষী করতে চায় করতে পারে এবং তাতে আমার কিছু এসে যায় না। বাবা ভাল নেই বললি, কি হয়েছে? অনিমেষ বুঝতে পারছিল ছোট কাকা নিজেও জানেন তার কথাগুলোর পেছনে খুব জোরালো যুক্তি নেই। তাই স্রেফ জেদের বশে কথাগুলো বলে যাওয়া এবং ঘুরে ফিরে দাদুর কথা জানতে চাওয়ার মধ্যেই সেই দুর্বলতা প্রকাশিত।
অনিমেষ বলল, বয়স হয়েছে টাকা পয়সা হাতে নেই, খুব কষ্টে চলতে হচ্ছে।
ছোট কাকা বললেন, খুলে বল, ইন ডিটেইলস।
অনিমেষ তাকাল, আপনার ভাল লাগবে না। এখন ওই বাড়িটুকু ছাড়া দাদুর কোন সম্বল নেই। তাই পাবার জন্য আত্মীয়রা যাওয়া আসা করছে বলে দাদু সবাইকে বলেছেন ওঁর লেপ্রসি হয়েছে।
হয়নি। কিন্তু হয়েছে বলে বেড়ালে ভীড় এড়ানো হয় তা জানেন দাদু। আমি এবার গিয়ে দাদুকে চিনতে পারিনি। খুব বেশিদিন মনে হয় বাঁচবেন না।
বড়দি?
শরীর ভাল নেই। এক বেলা খান। শুকিয়ে গেছেন।
ছোট কাকা হাতের গ্লাসটটা একচুমুকে শেষ করলেন। তারপর আচমকা প্রশ্ন করলেন, শুনলাম তুই রাজনীতি করিস। এস. এফ.?
বিস্মিত অনিমেষ কাকার মুখে হাসি দেখতে পেল, হ্যাঁ।
তুই সি. পি. এম.-এর কাজকারবারে বিশ্বাস করিস?
খানিকটা।
হোয়াই?
ভারতবর্ষে কমুনিস্ট পার্টি বলতে তো সি. পি. এম-ই। কিন্তু এই দলের কাজকর্ম আমার ভাল লাগে না, অথচ উপায় নেই।
ও। তা ভাল না লাগলে রাজনীতি করতে কে বলেছে! এম. এ. পাস করে চাকরি যোগাড় করে সংসার কর।
এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ছোট কাকা ওর মুখের দিকে সকৌতুকে তাকালেন, তারপর হো হো করে হাসতে লাগলেন। শেষে খুব ধীর গলায় বললেন, অনি এই রাজনীতি করতে এসে কোন আদর্শ বা ফর্মুলা সামনে রেখে এগোয় বোকারা। যখন যা তখন তা যে হতে পারে সেই ভাল পলিটিসিয়ান। গতকাল তোর হোস্টেলের একটি ছেলের সঙ্গে গল্প করতে করতে তোর সম্পর্কে জানতে পারলাম। তোকে দেখে আমি আমার অতীতকে দেখতে পাচ্ছি। পার্টি যখন নিষিদ্ধ হল তখন ওই একই আদর্শ নিয়ে আমরা বেঁচেছিলাম। কিন্তু তাই যদি আঁকড়ে থাকতাম তাহলে আমাকে আজ খুঁজে পাওয়া যেত না। রাজনীতি করবি একটা মজবুত সিঁড়ির কাছে পৌঁছাবার জন্য। যেই সেই সিঁড়িটা পেয়ে যাবি আর পেছন দিকে তাকাবি না। তোদের এখানে যারা বড় নেতা তাদের অনেকের ব্যক্তিগত চরিত্র আমি জানি। সেসব জানলে তুই শিউরে উঠবি। যারা বাইরের ঘরে বসে আছে তাদের তুই চিনিস?
অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না।
এরা এসেছে আমার মন গলাতে মস্কো যাওয়ার প্রবেশ পত্র পাওয়া ওদের উদ্দেশ্য, না এরা সিপিআই নয়। আজ সারাদিন আমি দফায় দফায় মিটিং করব তোদের নানা নেতাদের সঙ্গে। তুই যেমন করেই হোক একটু সামনের সারিতে চলে আয় তারপর তোর ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দে।
অনিমেষ আর পারছিল না। ছোট কাকা যেসব কথা বলে যাচ্ছে তা হয়তো সত্যি কিন্তু এ কি রকম চিন্তা ভাবনা। চোখের সামনে জলপাইগুড়ির বাড়ির সামনে সেই বিক্ষোভটার ছবি ভেসে উঠল। ছোট কাকা যেটা এড়াতে বিরাম করের বাড়িতে গিয়ে বসেছিলেন। সে স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি কেজিবির এজেন্ট?
এ্যা, গুড! এখন কি সি. আই এ-র সঙ্গে কে.জি. বির এজেন্ট বলা আপ টু ডেট গালাগালি? আরে বোকা সি.আই.এ.কিংবা কে.জি.বি. অনেক বুদ্ধিমান সংগঠন। তারা এমন লোককে কাজ করতে পাঠায় না যাকে দেখে তুইও বুঝতে পারবি। তোর উদ্দেশ্য কি?
কি ব্যাপার?
কেন রাজনীতি করছিস?
এদেশের মানুষ যাতে শোষিত না হয় কোন ধাপ্পায় না ভোলো।
ওর কথা থামিয়ে ছোট কাকা জিঞ্জাসা করল, এটা তো সি.পি. এম.ও বলছে।
বলছে। কিন্তু এই সংবিধানের মধ্যে সেটা করা সম্ভব নয় তা ওরা জানে।
দেন ইউ আর থিংকিং, সাম আদার ওয়ে। সেটা কি?
জানি না।
পাগলামি করিস না। এদেশের মানুষের মনে লোভের পোকা থিকথিক করছে। এদের নিয়ে কোন কাজ করা সম্ভব নয়। আমি যা বললাম তাই কর।
অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, আপনি ওদের দশ মিনিট অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।
হাসল ছোট কাকা, দরকার হলে ওরা দশ ঘন্টা অপেক্ষা করবে।
আমি চলি।
যাবি?
হ্যাঁ।
ছোট কাকা একটা ব্যাগ থেকে নিজের কার্ড বের করে ওর হাতে দিলেন। আমি আজ রাত্রেই ফিরে যাব। তোর যদি কখনো দরকার হয় এই ঠিকানায় আমাকে চিঠি দিবি। এটা অন্য ধরনের কার্ড, গতকালের মত নয়। এক সঙ্গে ইংরেজী এবং সম্ভবত রাশিয়ান, যা অনিমেষ বুঝতে পারল না, লেখা আছে। অনিমেষ ওটা পকেটে রেখে বেরিয়ে আসছে, ছোট কাকা আবার ডাকলেন, অনি, আমার একটা উপকার করবি?
বলুন।
তোকে প্রমিস করতে হবে।
এক মুহূর্ত দ্বিধা করে অনিমেষ সেটাকে ঝেড়ে ফেলল, বলুন।
আমি তোকে দুটো প্যাকেট দেব তুই দুজনকে ওদুটো পৌঁছে দিবি?
কাদের?
ছোট কাকা একটা স্যুটকেস খুলে দুটো সুদৃশ্য প্যাকেট বের করে অনিমেষের সামনে ধরে বললেন, উপরে নাম লেখা আছে।
খুব বেশী ওজন নয়, অনিমেষ প্যাকেট দুটোর নাম পড়তে গিয়ে খুব কষ্টে নিজেকে সংযত করল। একটাতে সরিৎশেখর মিত্র, অন্যটায় ছোট করে লেখা তপু মানে তপু পিসী। অনিমেষ বিহ্বলচোখে ছোট কাকাকে দেখল। এতগুলো বছর চলে গেছে অথচ ছোট কাকা এখনও তপুপিসীকে মনে রেখেছেন? এক সময় ছোট কাকার ওপর সে রেগে গিয়েছিল তপুপিসীকে অবহেলা করার জন্য অথচ একটা মানুষ যে গোপনে গোপনে আর একজনকে মনে রেখে দেয় চিরকাল, এটা জেনে সব গোলমাল হয়ে গেল তার। রুপশ্রী সিনেমার সামনে বচ্চাদের নিয়ে তপুপিসীকে যেদিন পথের পাঁচালী দেখাতে যাচ্ছিল সেদিনই বোধ হয় ছোট কাকার সঙ্গে তার শেষ দেখা। কি নির্লিপ্ত হয়ে তপুপিসী ছোট কাকাকে এড়িয়ে গিয়েছিল। আর নীল কাগজে ছোট কাকাকে লেখা তপুপিসীর সেই চিঠিটা যেটাকে সে বাড়ি সার্চ করার আগে পুলিশের চোখ থেকে সরিয়ে রেখেছিল, যা কিনা পরে ছোট কাকার হাতেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল তার কথা মনে পড়ল। সেই লাইন দুটো কখনোই ভুলবে না অনিমেষ, তোমার রাজনীতিই এখন সব, আমি আর কেউ নই। তাই তুমি যত ইচ্ছে রাজনীতি কর, আমি দায় তুলে নিলাম।
তপুর সঙ্গে তোর যোগাযোগ আছে?
প্রশ্নটা শুনেই ঘাড় নেড়ে না বলল অনিমেষ।
তপুপিসী কি এখনও জলপাইগুড়ি গার্লস স্কুলে আছে?
কি জানি।
ওর কোন খবর জানিস না তুই?
না।
তাহলে।
যদি দায়িত্ব দেন তাহলে খুঁজে বের করে দিয়ে দিতে পারি।
এটুকু অন্তত কর।
হঠাৎ অনিমেষের মাথায় চিন্তাটা চলকে উঠল, কিন্তু তপুপিসী যদি না নেয়?
ছোট কাকা স্থির হয়ে গেলেন। এতক্ষণ যে মানুষটা প্রচন্ড প্রতাপে নানান কথা বলছিল এই সময় তাকে কি নিঃসহায় দেখাচ্ছে। মৃদু গলায় বললেন, যদি না নিতে চায় তাহলে তিস্তায় ফেলে দিস। তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, আমার ভাগ্যটাই এমন। কোন সম্পর্ককেই আমি সহজ স্বাভাবিক রাখতে পারলাম না অনি, তোকে দেখে আমার এই ভয়টাই হচ্ছে। আমি যে ভুল করেছি। তুই তা করিস না।
অনিমেষ প্যাকেট দুটো হাতে নিয়ে বলল, যাচ্ছি।
তুই কি আজকে আবার আসবি?
কখন?
কখন বলি! সারাদিন ঝামেলা লেগেই থাকবে। এয়ারপোর্টে আসতে পারবি ছটা নাগাদ?
এয়ারপোর্ট?
তখন কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে।
দেখি।
তুই সিগারেট খাস অনি?
দ্বিধা না করে উত্তর দিল অনিমেষ, মাঝে মাঝে।
দেন ওয়েট। ছোট কাকা ঘরের কোণায় ফিরে গিয়ে একটা সুদৃশ্য প্যাকেট আর ছোট্ট অথচ সুন্দর লাইটার এনে ওর হাতে গুঁজে দিলেন। অনিমেষ প্যাকেটটা দেখল। রাশিয়ান সিগারেট। বিদেশী সিগারেট সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই। বন্ধুদের দেখেছে খুব লালায়িত হতে। লাইটারের বোতামে চাপ দিতেই একটা নীল হলকা বেরিয়ে এল। খুব দামী নিশ্চয়ই এটা। ছোট কাকা বললেন, গ্যাসের, ফুরিয়ে গেলে কিনে নিস।
আমার অত পয়সা নেই। এটা রেখে দিন। আমার কাজে লাগবে না।
কেনার দরকার নেই। ওটার গ্যাস শেষ হয়ে গেলে কাউকে দিয়ে দিস।
বাইরের ঘরে বেরিয়ে আসতেই লোক তিনটে উঠে দাঁড়াল। তাদের মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এতক্ষণ বসিয়ে রাখার জন্য তারা একটুও অসন্তুষ্ট হয়নি। বরং বেশ নেশা হয়ে গেছে এরই মধ্যে। একজন অকারণেই হাসছিল। লোকটাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে অথচ ছোট কাকা বললেন, সরি দেরী করিয়ে দিলাম আপনাদের। বসুন বসুন। কি খাচ্ছেন? সিভাস রিগ্যাল? আমার আবার ভদকা না হলে চলে না। অনিমেষ বেরিয়ে যাচ্ছিল, ছোট কাকা ওকে দাঁড়াতে বললেন, আমার ভাইপো অনিমেষ মিত্র; খুব ইনটেলিজেন্ট ছেলে, লোক তিনটে তাকে নমস্কার করছে দেখে অনিমেষ প্যাকেট হাতেই সেটা ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করল। ছোট কাকা তখন বলছেন, এম. এ. পড়েছে ছাত্র ফেডারেশন করে। খুব অ্যাকটিভ।
আচ্ছা। সেই চেনা চেনা লোকটি বলল, বিমানকে চেন?
হ্যাঁ। অনিমেষ জবাব দিল।
কি নাম যেন? অনিমেষ মিত্র।
ঠিক আছে মিত্র সাহেব, মনে থাকবে। লোকটি ছোট কাকার দিকে তাকিয়ে হাসল তবে ওকে মানে, বুঝতেই পারছেন?
অফ কোর্স। ছোট কাকা অনিমেষকে দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে বললেন, এদের যে তুই এখানে দেখলি কাউকে বলার দরকার নেই।
কেন? চাপা গলায় বলল অনিমেষ।
রাজনীতিতে সাফল্য পাওয়ার সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি হল চোখ খোলা আর মুখ বন্ধ রাখা। এটার সঙ্গে যে মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে পারে তাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। ছোট কাকা হাসলেন।
অনিমেষ খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, আর হৃদয়।
ওটার ব্যবহার নির্বোধরাই করে। ইমোশনাল ফুলদের জায়গা রাজনীতিতে নেই। ওকে চেষ্টা করিস এয়ারপোর্ট আসতে আর ইন কেশ অফ অনি ডেঞ্জার চিঠি লিখবি। এই ভারতবর্ষের যে কোন অসাধ্য সাধন মস্কোয় বসে করা যায়। দরজা বন্ধ করলেন ছোট কাকা।
সেদিন দুপুরে ইয়ুনিয়ন অফিসে গেল অনিমেষ। ইদানিং এই ঘরটাকে সে এড়িয়ে যাচ্ছে। বিমান, সুদীপ এবং অনেকে কথা বলছিল। ওকে দেখে সুদীপ বলল, তোমার কি হয়েছে? আজকাল অন্য রকম লাগছে।
কি হবে। অনিমেষ হাসল, খুব ব্যস্ত ছিলাম।
কি ব্যাপার? বিমান জিজ্ঞাসা করল।
আমার কাকা এসেছেন মস্কো থেকে। এখানে পলিটিক্যাল কনফারেন্স আছে। ওঁর সঙ্গে থাকতে হয়েছিল। অনিমেষ বলল।
বিমান বিজ্ঞাসা করল কি নাম বল তো?
প্রিয়তোষ মিত্র।
আচ্ছা। আমি ঠিক জানি না। তুমিও তো কখনো বলনি।
এমন কি ব্যাপার যে বলব! তবে দেখলাম নেতারা জানেন। অনিমেষ দেখল ওদের খুব পাজলড দেখাচ্ছে। সে পকেট থেকে সিগারেটর প্যাকেট বের করে সুদীপের সামনে রাখল, কাকা দিয়েছেন তোমাদের খেতে।
নির্লিপ্তের মত প্যাকেটটা তুলেই চেঁচিয়ে উঠল সুদীপ, আরে রাশিয়ান সিগারেট! এ প্যাকেট ফ্রম দ্য ল্যান্ড অফ কন্যুনিজম। সবাই হুমড়ি খেয়ে প্যাকেটটাকে দেখতে লাগল। সুদীপ সন্তর্পণে প্যকেটটা খুলে সিগারেট বের করে ঠোঁটে গুঁজে বলল, থ্যাংকু অনিমেষ আমি যেন মস্কোর গন্ধ পাচ্ছি। চারপাশ থেকে আরো কতগুলো আগ্রহী হাত এগিয়ে এল সিগারেটের জন্য।
প্রচণ্ড একটা জ্বলুনি অনিমেষকে এয়ারপোর্টে নিয়ে এল। তিরিশের বি বাসে চেপে এই প্রথম দমদমে যেতে যেতে অনিমেষ আজ সকাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যত ভাবছিল ততই জ্বলুনিটা বাড়ছিল। ছোট কাকা হঠাৎ মস্কো থেকে উড়ে এলেন কেন? ওঁর ঘরে যারা বসেছিলেন কিংবা যাদের সঙ্গে মিটিং করেছেন তাদের সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক? সকাল বেলায় তার মস্তিষ্ক ঠিক কাজ না করায় ছোট কাকা একতরফা কতগুলো কথা বলে গেছেন। হয়তো তিনিই সঠিক, আজকাল যে সুবিধেবাদী রাজনীতির শিকার সবাই তাতে ওই পথে চলাই লোভনীয়। কিন্তু অনিমেষের মনে হল ছোট কাকাকে কিছু কথা স্পষ্ট বলা দরকার।
এয়ারপোর্টে এসে চোখ ধাধিয়ে গেল অনিমেষের। স্টেশনের যাত্রীদের থেকে এখনকার মানুষগুলোর হাবভাব আলাদা। কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর সে ছোট কাকাকে দেখতে পেল। সেই তিনটে লোক এখনও সঙ্গে আছে।
ওকে দেখে ছোট কাকা এগিয়ে এলেন, এসেছিস।
হ্যাঁ।
খুব দেরী হয়ে গেছে আমার। তোকে যা বললাম তা করিস।
কি ব্যাপারে?
ওঃ ওই প্যাকেট দুটোর কথা বলছি।
আচ্ছা।
আর, হা, এদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখিস, আখেরে কাজ দেবে। ইঙ্গিতে পেছনে দাঁড়ানো লোকগুলোকে দেখিয়ে দিলেন উনি, মনে রাখিস, প্রত্যেকটা স্টেপ সামনে এগিয়ে যাবার জন্যেই ফেলতে হয়। কথাটা বলে ছোট কাকা ঘুরে স্যুটকেস হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, অনিমেষ পেছন থেকে ডাকল।
কি হল?
এই লোকগুলোকে কি আপনি লোভ দেখিয়ে গেলেন?
কথাটা শোনামাত্র ছোট কাকার মুখ বিস্ময়ে চুরমার। অবাক চোখে দেখছেন তিনি অনিমেষকে। তারপর কয়েক পা ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করলেন,
কি বলছিস?
আপনি যে রাশিয়ান সিগারেটের প্যাকেটটা দিয়েছিলেন সেটা খাওয়ার জন্যে আমার কমরেড বন্ধুরা লালায়িত হয়েছে। এরা নিশ্চয়ই আরো বড় কিছু প্রাপ্তির আশায় আপনার পেছনে ছুটছে। এঁদের নষ্ট করে আপনার কি লাভ হচ্ছে? অনিমেষ খুব স্পষ্ট গলায় জিজ্ঞাসা করল।
উত্তরটা তোকে দেব না। তোকে অন্য রকম দেখাচ্ছে। তোরা কি চাস?
এই করাপসন থেকে দেশটাকে বাঁচাতে চাই। শুনুন যে সব লোকদের আপনি দেখে এসেছেন কিংবা নিজের মত মনে করেন তার বাইরেও কেউ কেউ আছে। অনিমেষ দৃঢ় প্রত্যয়ে জানাল।
গুড। একই ভ্রান্ত আবেগ। অনি, ভারতবর্ষের এই সিস্টেমে তোর ওই কেউ কেউ লোকগুলো হয় না খেয়ে মরবে নয় একদিন দালাল হয়ে যাবে। অতএব ভেবে দ্যাখ। আই ফিল পিটি ফর য়ু।
ছোট কাকা আর দাঁড়ালেন না। সঙ্গীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। অনিমেষের প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু হঠাৎ সে টের পেয়ে গেল তার কোন জোর নেই। কিসের ওপর ভিত্তি করে এই সব লোভী মানুষগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলবে? সামনে যে কোন পথ খোলা নেই। চুপচাপ রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া সেও তো এক রকম এসকেপিজম। তাহলে এই ঘোলাজলে পাক খাওয়া যেখানে অবধারিত সেখানে ছোট কাকাকে মুখের উপর জবাব দেবার কোন উপায় নেই। এয়ার পোর্ট থেকে বাস স্ট্যান্ড অনেকটা দুর। অনিমেষ হেঁটে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় পেছনে গাড়ির শব্দ হওয়ায় সে ঘাড় ঘোরাল। গাড়িটা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেল। সেই তিনজন। ছোট কাকাকে সি অফ করে ফিরছেন। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, কলকাতায় যাবেতো? অনিমেষ ঘাড় নাড়ল। উঠে এসো। কথার মধ্যে একটা নকল ভালবাসা টের পাওয়া যাচ্ছে। অনিমেষ একমুহূর্ত চিন্তা করল।
তারপরই হাসল, না। আপনারা যান। আমার এখানে একটু দরকার আছে। দেরী হবে। তিনটে লোক স্বাভাবিক হয়ে গেল। চলে যাওয়ার আগে সেই ভদ্র লোক বললেন, তোমার কাকার সঙ্গে কথা হয়েছে। একদিন সকালে আমার সঙ্গে দেখা করো। কোন চিন্তা নেই। ছুটন্ত গাড়ির পশ্চাদ্দেশ দেখতে দেখতে অনিমেষ দাঁতে দাঁত চাপল, শালা।
অনেক রাত্রে হোস্টেলে ফিরল অনিমেষ। উলটোডাঙ্গা থেকে সোজা হেঁটে এসেছে। ভীষণ ক্লান্তি শরীরে। আশেপাশের দোকান বন্ধ এখন। হোস্টেলের গেট আধভেজানো। হঠাৎ পাশের ল্যামপোস্টের ছায়া থেকে কেউ দ্রুত সরে এল ওর কাছে। চমকে অনিমেষ তাকাতে হতভম্ব হয়ে গেল। সুবাসদা। ঝড়ো কাকের মত চেহারা। চাপা গলায় ডাকল সুবাসদা, অনিমেষ।
সুবাসদা! আপনি? যতটা না দেখে তার চেয়ে ওর হাবভাবে অবাক হল সে।
অনিমেষ তুমি কি আমাকে একটা রাত থাকতে দিতে পার?
অনিমেষ একটু দ্বিধা না করে বলল, নিশ্চয়ই, আসুন।
Leave a Reply