দাসপাড়ার উপনির্বাচনের কংগ্রেসপ্রার্থী বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেন। কলকাতার মানুষ খবরের কাগজের এই সংবাদটাকে তেমন গুরুত্বই দিল না, যেন একটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, জেতাটাই ছিল আশ্চর্যের। ভোটের ফলাফল বের হলে অনিমেষরা হিসেব করেছিল মোট ভোটের সত্তর শতাংশ বাক্সে পড়েছে। বাকী ত্রিশভাগ যারা ভোট দেয়নি তাদের সমর্থন পেলে কি কাণ্ড হতো বলা যায় না। দেখা গেল আগের বার বিরোধী প্রার্থী যত ভোট পেয়েছিল এবার তা থেকে হাজার খানেক বেড়েছে। বিমান বা সুদীপ এই নির্বাচন নিয়ে কোন কথা বলছে না। যা গিয়েছে তার সম্পর্কে ভেবে কিছু লাভ নেই। পার্টির নেতারা নিশ্চয়ই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ত্রুটিগুলো সামলে নেবেন সামনের বার। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করতে বিমান জবাব দিয়েছিল, পর্যালোচনা চলছে।
সুবিমলবাবুর ব্যাপারটার পর থেকে অনিমেষ নিজের ভেতরে যেন আর উৎসাহ খুঁজে পাচ্ছিল না। এই মানুষটি দ্বৈতসত্তার কথা জেনেও পার্টি তাকে মূল্যবান বলে মনে করে, কমরেডের সম্মান দেয়, কথা শোনে কিন্তু আলোচনায় উৎসাহ পায় না।
এই সময় ভারতবর্ষ আর পাকিস্তান একটা যুদ্ধে লিপ্ত হল। সন্ধ্যের পরই কলকাতা শহর অন্ধকারে ডুবে যায়, তড়িঘড়ি মানুষ ঘরে ফিরে যাচ্ছে। যে কোন মুহূর্তেই পাকিস্তানের বোমারু বিমান কলকাতার আকাশে দু-একটা বোমা টুক করে ছেড়ে দিয়ে যেতে পারে। তাবে চীনের সঙ্গে যখন গোলমালটা লেগেছিল তখন কার মত দিশেহারা অবস্থা এখন নয়। মানুষ জানে পাকিস্তান যতই গর্জাক ভারত দখল করার হিম্মত নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে ভারতবাসী কংগ্রেস সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে, বহুমুখী বিরোধীরা মুখ হয়ে আছে। তবু যুদ্ধটা ঠিক জমছে না।
এই যুদ্ধ অনেকটাই সাজানো, ফলাফল জানাই আছে৷ এইরকম বোধ পার্টির নেতাদের থেকে শুরু করে ক্যাডার পর্যন্ত সঞ্চারিত। সাধারণ মানুষও বেশ মজা পেয়ে গেছে। সিনেমা দেখবার ভঙ্গিতে কাগজে যুদ্ধের খবর পড়ে কারণ তারা সবাই জানে পাকিস্তানীরা কখনোই তাদের গায়ে হাত দিতে পারবে না। কিন্তু যুদ্ধের কারণেই কংগ্রেস সম্পর্কে তিক্ততা ক্ষীণ হয়ে গেল।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের আঁচ গায়ে লাগল। হু হু করে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে। ভারতবাসীর মত সব-সইয়ে জাত পৃথিবীতে বিরল। কোথাও কোন প্রতিবাদ নেই, যেন যুদ্ধ হলে দাম বাড়াটাই স্বাভাবিক কথা। চোখে সামনে মানুষ মানুষকে ঠকাচ্ছে এবং সেটাকে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই গ্রহণ করে সবাই। অনিমেষের মনে হয় সাতচল্লিশ সালের পনেরই আগস্টেই এদেশের মানুষের মেরুদণ্ডটিকে খুলে নিয়ে মাউন্টব্যাটেন–সাহেব দেশে চলে গেছেন।
যুদ্ধ যখন থেকে গেল খুব আফসোস হচ্ছিল ওর। পাকিস্তান কেন পূর্ববঙ্গকে ব্যবহার করল না? কেন ঢাকা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমান উড়ে এসে কলকাতার ওপর বোমা ফেলল না? যদি কোন যাদুমন্ত্রে পাকিস্তানী সেনা পশ্চিমবাংলায় ঢুকে পড়ত তাহলে উত্তেজনার আগুন পোয়ানোর বিলাসিতা ছাড়তে হতো এদেরম মানুষকেইনজস্ব সুবিধেরে ছকে সাজানো রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা তখন হারিয়ে যেতে বাধ্য হতো। প্রতিরোধ শক্তি জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লেই ওই সব নেতাদের ছুঁড়ে ফেলতে একটুও সময় লাগত না। এই দেশে কমুনিজম প্রতিষ্ঠা করতে হলে সশস্ত্র যুদ্ধ চাই। ঘরে আগুন না লাগলে ঘরের প্রতি ভালবাসা টের পাওয়া যায় না। স্বার্থের পৃথক খোলসগুলোকে চূর্ণ করতে যুদ্ধ চাই, নইলে এই নিরাসক্তির ভান কখনোই ঘুচবে না।
অনিমেষ এখন বিশ্বাস করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন করার ক্ষমতা কমুনিস্ট পার্টির নেই। শুধু প্রতিপক্ষকে গালিগালাজ করলে হয়তো একট সাময়িক সমর্থন পাওয়া যায় কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হলে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, সেটিই করা হচ্ছে না। যা কিছু চটজলদি আবেগকে পরিচালিত করে সাধারণ মানুষ তাকেই গ্রহণ করে। এদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির তাবড় তাবড় নেতাদের চালচলন কথাবার্তার সঙ্গে বেশিভাগেরই ব্যক্তিগত জীবনের কোন মিল নেই। তাদের দেখে কোনরকম অনুপ্রেরণা যদি সাধারণ মানুষ না পায় তাহরে তাদের আদর্শে শ্রদ্ধাশীল হবে কি করে? সবচেয়ে বিস্ময়ের কথা কম্যুনিস্ট পার্টির মত সুশৃঙ্খল সংস্থা কংগ্রেস নয়। কম্যুনিস্ট ক্যাডাররা নিঃস্বার্থ হয়ে নেতাদের হুকুম মেনে নেয়। এরকম শক্তিশালী একনিষ্ঠ কর্মী পেয়ে নেতারা কি করতে চান বোঝা যাচ্ছে না। দলের নীচের তলার কর্মীরা কাজ করে ভাবাবেগে, নেতাদের পদক্ষেপ হিসেব করে। তারা আবেগ আনেন বক্তৃতার সময়, ব্যক্তিগত স্বার্থ হারাতে কেউ বিন্দুমাত্র রাজী নন।
মোটামুটি এই যখন দেশের রাজনৈতিক চেহারা তখন ঘোলাজলে পাক খেয়ে কি লাভ? অদ্ভুত হতাশাজনিত ক্লান্তি ক্রমশ অনিমেষকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। এই সময় ছাত্র ইউনিয়নগুলো দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশব্যাপী আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিল। আন্দোলন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল করে মনুমেন্ট পর্যন্ত গিয়ে নেতাদের বক্তৃতা শোনা এই হল আন্দোলনে চেহারা। অনিমেষ দুদিন কংগ্রেস সরকার নিপাত যাও, খাদ্য চাই, বস্ত্র চাই, বাঁচার মত বাঁচতে চাই, দুনিয়ার ভুখা মানুষ হক হও, এক হও শ্লোগান দিতে গিদে গিয়েছে মিছিলের সঙ্গে। মাধবীলতাও চিল সঙ্গে। মিছিল মনুমেন্টের নীচে পৌঁছালে জায়গাটা এসময় সমুদ্রের চেহারা নিল। বাঁশের খুঁটির ওপর লাল কাপড়ের মঞ্জে নেতারা বসে সেই সমুদ্র দেখছিলেন। মাধবীলতা এই প্রথম এতসব নেতাদের একসঙ্গে দেখতে পেয়ে বেশ উত্তেজিত। এরা বিধানসভায় প্রায় সোরগোল তোলেন। কিন্তু এই গান্ধিজীমার্কা আন্দোলনে কি ফল ফলবে অনিমেষ বুঝতে পারছিল না। দেশের মানুষ বিক্ষুদ্ধ এই কথাটুকু বোঝানোর জন্যেই যদি এতো আয়োজন তাহরে সেটা কি কংগ্রেসী নেতাদের আজ অজানা আছে? তারা যদি সেই তথ্যটিকে উপেক্ষা করতে পারে তাহলে এই মিছিলের বিক্ষোভে কি এসে যায় তাদের। জনসাধারণের প্রাণশক্তির হাস্যকর অপব্যবহার ছাড়া ব্যাপারটা অন্য কিছু মনে হচ্ছে না অনিমেষের কাছে।
পর পর দুজন নেতা একই ভাষা এবং ভঙ্গিতে বক্তৃতা দিলেন। দেশে আজ বিপন্ন, কংগ্রেসী সরকারের শোষণে মানুষ দিশেহারা। এই সরকারকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলো বলার সময় গলা কাঁপিয়ে অনেকটা যাত্রার ঢংয়ে হাত নেড়ে একটা নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করে ফেললেন ওরা দুজনেই। কথা বলার সময় আবেগে মাঝে মাঝে কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ওঁদের চিৎকৃত ভাষণ যখন শেষ হল তখন বঙ্গে বর্গী পালার শেষে যে হাততালি পড়ে তারই অনুরণন মনুমেন্টের তলায় ছড়িয়ে পড়ল। বক্তৃতায় ক্লান্ত নেতাদের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল তারা এই মাত্র ঘরে ঘরে অন্ন বিলিয়ে ফিরে এলেন। সবশেষে যিনি উঠলেন তার জন্যই জনতা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল। এর আগেও দেখেছে সে, আজও দেখল। গানের অনুষ্ঠানে ছোট বড় শিল্পীরা একে একে গেয়ে যান, কোন চাঞ্চল্য দেখা যায় না, শ্রোতাদের মধ্যে। কিন্তু শেষ নামটি যেই ঘোষিত হয় এবং বিখ্যাত শিল্পী যখন মঞ্চে এসে দাঁড়ান তখন হাততালি পড়ে, যেন এতক্ষণে অনুষ্ঠানটি সার্থক হল।
এখন যিনি বলতে এলেন তারও সেই ইমেজ। উনি যখন বলেন তখন যুক্তি দিয়ে বলবেন এটাই সবার ধারণা। এর আগের মিটিং-এ উনি প্রথমে বলেছিলেন বলে বাকী বক্তারা অসন্তুষ্ট হয়েছিল। কারণ তাদের কথা শোনার জন্য কেউ অপেক্ষা করেনি।
জনতাকে নড়েচড়ে বসতে দেখে অনিমেষ মাধবীলতাকে বলল, চিনতে পারছ ওঁকে?
মাধবলীতা বড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ। বেশ ব্যক্তিত্ব আছে না?
অনিমেষ বলল, অন্তত যাত্রা করবেন না এটা বলা যায়।
মাধবীলতা বলল, তুমি অমন বেঁকা কথা বলছ কেন? তোমাদের পার্টির নেতা না?
অনিমেষ তর্ক বাড়ালো না। শুধু মাধবীলতার দিকে একবার তাকিয়ে বক্তৃতায় মন দিল। খুব শান্ত ভঙ্গি, প্রতিটি শব্দ আলাদা উচ্চারণ করেন। আবেগের বাড়াবাড়ি নেই। যেটা বলছেন তা কেন বছেন তা ওর জানা আছে। স্বভাবতই কংগ্রেসী সরকারকে আক্রমণ করে উনি কথা বলছিলেন। কিন্তু এসময় অনিমেষের মনে হল উনি খুব ভাল কথাশিল্পী। সুন্দর সাজানো কথা বিশ্বাসযোগ্য করে বলেন, কিন্তু কোন ধরাছোঁয়ার মধ্যে যান না। তার কথায় এমন একটা জাঁকজমক আছে যে লোকে সেইটে বুঝতেই পারে না। আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায় কারাবরণ এবং তারপরে বাংলা বন্ধ।
ধর্মতলা থেকে ফেরার সময় অনিমেষ সিদ্ধান্ত নিল এই রাজনীতি থেকে সে কিছুদিন সরে থাকবে। দশ হাজার লোককে পুলিশ এসপ্লানেড ইষ্ট থেকে ধরে বাসে করে খিদিরপুরে নামিয়ে দিলে কি ধরনের রাজনৈতিক লাভ হয় তা ওর মাথায় ঢুকবে না। এই কি কারাবরণ? অথবা সারাদেশ একদিনের জন্য অচল করে মোক্ষ লাভ হবে? এতে কি মনে হবে দেশের মানুষ তাদের পাশে আছে। এখনও যখন সাধারণ মানুষ মনে করে কম্যুনিস্টদের ভোট দিলে তারা দেশটাকে রাশিয়া কিংবা চীনের হাতে তুলে দেবে। পার্টির মধ্যে ইতিমধ্যেই বিরোধ শুরু হয়েছে। বেশি কিছু সক্রিয় কর্মী নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে বিরাগের পাত্র হয়েছেন। পার্টির মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা চলছে এ সংবাদ বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসছিল। অনিমেষ হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল এম এ পরীক্ষাটা দিয়ে দেওয়া যাক মন দিয়ে কিছুদিন পড়াশুনা করে।
মৌলালির মোড়ে হেঁটে এসে মাধবীলতা বলল, ভীষণ টায়ার্ড লাগছে কোথাও বসি চল।
অনিমেষ দেখল মেয়েটার মুখটা কালো হয়ে গেছে, চোখের তলায় বেশ কালি। ওর হঠাৎ মনে হল মাধবীলতার এই চেহারা সে কোনদিন দ্যাখেনি। মুখের মধ্যে একটা খসখসে ভাব এসে গেছে, চাহনিতে ক্লান্তি বোঝা যায়।
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে তোমার?
মাধবীলতা ভ্রূ কুঁচকে সেই চাহনিটা ব্যবহার করল, আমার! কী হবে?
অনিমেষ বুঝতে পারল মাধবীলতা যদি নিজে থেকে কিছু না বলে তাহলে শত চেষ্টা করেও ওর কাছ থেকে ব্যাপারটা জানা যাবে না।
মাধবীলতা হাসল, কি থেকে কি বলা। বললাম কোথাও চল বসি, না তোমার কি হয়েছে। বসতে চাইলে কিছু হতে হয় বুঝি।
অনিমেষ একটা ছোট খাটো চায়ের দোকান দেকতে পেয়ে বলল, চল এখানে বসি। তবে শুধু চা খেতে হবে।
মাধবীলতা বলল, সেটা আমি বুঝব।
দোকানটা নীচু ধরনের। অবস্থা যে ভাল নয় তা চেহারা দেখেই মালুম হয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যারা আড্ডা মারছিল তারা বেশ উৎসুক চোখে ওদের দিকে তাকাল। অনিমেষ সেটা দেখেও গা করল না। একটা ছোঁড়া এলে মাধবীলতা তাকে দুটো করে টোস্ট আর চা দিতে বলল। তারপর অনিমেষের দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কিন্তু আজকাল সব কথা আমার কাছে বলো না।
কি কথা?
বিমানদের সঙ্গে তোমার ঠিক মিলছে না, না?
কি করে বুঝলে? অনিমেষ অবাক হল। এসব কথা ও কখনো মাধবীলতার সঙ্গে আলোচনা করেনি।
আমি কি ঠিক বলছি?
মোটামুটি।
যাক। তাহলে তোমাকে বুঝতে আমার ভুল হয় না।
অনিমেষ মাধবীলতার চোখে চোখ রাখতেই সে মুখ নামিয়ে নিল। কথাটায় এমন সুখ জড়ানো যে তা অনিমষেকেও স্পর্শ করল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, আসলে আমি এই দলের কাজকর্ম মানতে পারছি না। এরা যেভাবে চলছে এদের কোনদিনই কম্যুনিজম আসবে না। বুঝে সুঝে অন্ধ হয়।
মাধবীলতা বলল, তুমি কি অন্য কোন দলে যাবে?
অনিমেষ বলল, অন্য দল? ধ্যুৎ। সেগুলো তো আরো খারাপ। না কোন দলফল নয়, ভাবছি এখন মন দিয়ে পড়ব।
মাধবীলতা বলল, আমি তোমার রাজনৈতিক ব্যাপারে কোন কথা বলতে চাই না। তবে একটা অনুরোধ করব। হুট করে কিছু করে ফেল না। তুমি যদি বিমানদের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখতে চাও তবে ঝগড়া করে নয়, চুপচাপ কোন সংঘর্ষ ছাড়াই সরে দাঁড়াও। একদিনে করলে সেটা ধরা পড়ে যাবে তাই কয়েকদিন সময় নাও। তারপর হেসে বলল, কিন্তু এম এর রেজাল্টটা যেন ভাল হয়।
অনিমেষ বলল, তোমার চেয়ে নিশ্চয়ই ভাল হবে না।
মাধবীলতা দিয়ে যাওয়া টোস্টের ওপর গোলমরিচ ছড়াতে ছড়াতে বলল, আমার বোধ হয় পরীক্ষা দেওয়াই হবে না।
চমকে উঠল অনিমেষ সেকি! কেন?
মুখ না তুলে মাধবীলতা বলল, ওসব ছেড়ে দাও। বাড়িতে চিঠি দিয়েছ?
চোয়াল শক্ত হল অনিমেষের। কিছুক্ষণ ধরেই ও বুঝতে পারছিল মাধবীলতার কিছু হয়েছে যার জন্যে ওকে চিন্তা করতে হচ্ছে খুব এবং তার ছাপ পড়েছে চোখ মুখে। এতদিন ব্যাপারটা লক্ষ্য করেনি বলে সে নিজের ওপরই বিরক্ত হল। খুব গম্ভীর গলায় বলল, তুমি যদি কিছু না বলতে চাও তাহলে আমার পক্ষে এসব খাওয়া অসম্ভব।
হেসে ফেলল মাধবীলতা, ওমা কি ছেলে মানুষ! এখন কি আর রাগ করে খাবার নষ্ট করার বয়স আছে! খোকা কোথাকার!
ইয়ার্কিং মেরো না। তুমি যদি না চাও তাহলে অবশ্যই তোমার ব্যাপারে আমি কথা বলব না। কিন্তু সেটা জানা দরকার। অনিমেষ বলল।
মাধবীলতা বলল, অমনি রাগ হয়ে গেল।
অনিমেষ বলল, আমাকে কি এতই অপদার্থ ভাবো যে রাগ করবার যোগ্যতাও নেই! টেবিলের ওপর দুই কনুই, হাতের ওপর চিবুক, মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে সামলাতে পারল না। বুকের মেঘ কখন যে টুক করে জল হয়ে চোখে গড়ায় তা যদি বোঝা যেত আগে ভাগে। অনিমেষ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারপর চাপা গলায় বলল, এটা চায়ের দোকান।
দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে চট করে দুচোখ সামলে নিলে মাধবীলতা। কিন্তু তার ভেতরটা ঠাণ্ডা হতে সময় লাগল আরো কিছুক্ষণ। ওরা নীরবে টোস্ট খেয়ে চায়ের কাপে হাত দিল। অনিমেষ কোন কথা বলছিল না। মাঝে মাঝে তার মাধবীলতাকে এত গভীর মনে হয় যে সে হাজার চেষ্টা করেও ডুব দিয়ে তল দেখতে পাবে না। চটুল হালকা টাইপের মেয়েদের সহজেই উপেক্ষা করা যায় কিন্তু মাধবীলতাকে নয়।
চা খেয়ে দাম দিল মাধবীলতা। তারপর রাস্তায় নেমে শিয়ালদা স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, বাবার জন্যেই বোধ হয় আমার এম এ পরীক্ষা দেওয়া হবে না।
মানে?
উনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি ওঁকে বলেছি এসব চিন্তা ছাড়তে। আমার মুখে এ রকম কথা উনি আশা করেননি। ফলে অগ্নিকাণ্ড আরম্ভ হয়ে গেছে। যা ইচ্ছে তাই বলছেন। আমাকে এখান থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেবার পরিকল্পনা করছেন। যে পাত্রটিকে ওঁরা নির্বাচিত করেছেন সে বোধ হয় আমার কথা শুনে হাতছাড়া হয়ে গেছে, ফলে আরো দিশেহারা অবস্থা। আমি বলেছি পরীক্ষা অবধি অপেক্ষা করতে কিন্তু ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে তা করবে না। মাধবীলতা মাথা সোজা করে হাঁটছিল। যেন কথাগুলোর মধ্যে নিজের অবস্থাটাকে জরিপ করছিল।
অনিমেষের বুকের বেতরটা হু হু করে উঠল। সে মাধবীলতার জন্যে কিছু করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। না যে কোন ভাবেই ওর এম. এ. পরীক্ষা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
কিন্তু কেন ওরা এমন করছেন?
ওঁরা আমার ভাবগতিক দেখে ভাল বুঝছেন না তাই। হাসল মাধবীলতা, বোধ হয় বুঝতে পেরেছেন আমি মনের দিক থেকে একা নই।
তাতে কি হয়েছে?
কোন পিতামাতাই মেয়েদের নির্বাচনের ওপর আস্থা রাখতে পারে না। সব সময় ভাবে এই বুঝি বোকামি করল।
তুমি আমার কথা ওঁদের বলেছ?
হ্যাঁ।
কি বললেন, ওঁরা?
নাই বা শুনলে। শোন, আমি গত রবিবার একটা স্কুলে ইন্টারভিউ দিয়েছি। আমার এক বন্ধুর দিদি ওই স্কুলে কাজ করে। যদি চাকরিটা হয়ে যায় তাহলে বেঁচে যাব।
তুমি চাকরি করবে? পড়াশুনা করবে না?
সে পরে দেখা যাবে প্রাইভেটেও পরীক্ষা দেওয়া যায়। হয়তো চাকরিটার জন্যেই দিতে হবে সেসব এখনই ভাবছিনা। এখন যেটা সমস্যা হল সেটা একটা ভাল হোষ্টেল। তোমার জানা শোনা কোন হোষ্টেল আছে? মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল।
অনিমেষ মাথা নাড়ল, না। তবে হোষ্টেলের খোঁজ নিতে পারি। কিন্তু তুমি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসবে?
মাধবীলতা দাঁড়িয়ে পড়ল। দু পাশে বাড়ি ফেরা মানুষের ভিড়, হকারের চিৎকার। তারই মধ্যে স্পষ্ট গলায় জিঞ্জাসা করল, তুমি কি চাইছনা বাড়ি থেকে আমি বেরিয়ে আসি।
তুমি কি যথেষ্ট ভেবেছ?
আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি।
অনিমেষ একটুও ভাবলনা। বলল ওঁরা তোমাকে জোর করে অন্য কোথায় পাঠিয়ে বিয়ে দেবেন এটা আমি মানতে পারি? কিন্তু এতদিনের পরিচিত পরিবেশ আর আত্নীয় স্বজন ছেড়ে তুমি একা হোষ্টেলে এসে উঠবে এ ব্যাপারে তোমার কোন দ্বিধা আছে কিনা তাই জানতে চাইছিলাম। নিজের কাছে পরিষ্কার হলে পৃথিবীতে কে কি মনে করল তাতে কিছু আসে যায় না।
আমার সব কিছু পরিষ্কার যদি তুমি পাশে থাক। আমি কোন অন্যায় করিনি। বাবা যদি না মানতে পারেন তাহলে সেটা দুঃখের। আমি তো হোষ্টেলে একা থাকছিনা। তুমি তো আছ। তুমি কখনো আমায় ফেলে না গেলেই হল। মাধবীলতা হাসল। আত্নবিশ্বাস এবং লজ্জা একসঙ্গে চমকে উঠল যেন।
অনিমেষ বলল বড় আফসোস হচ্ছে।
মাধবীলতা ঘার বেকাল। কেন?
নিজেকে খুব অপদার্থ মনে হচ্ছে। তুমি যখন এত বড় ঝুঁকি নিচ্ছ তখন আমার হাতে একফোঁটা জোর নেই। এখনো বাবার পাঠানো টাকার ভরসায় থাকি। আমার উচিত তোমাকে বিপদ থেকে বাঁচানো কিন্তু দ্যাখো শুধু কথা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারছি না। দেখি কি করতে পারি।
শেষের কথাটা একটু চিন্তা জরানো গলায় বলল অনিমেষ। মাধবীলতা বলল, এই তুমি কি চাও আমি এখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদি।
মানে?
আর একবার ওইসব কথা বললে আমি এমন সিন করব যে তুমি মজা বুজবে।
কিন্তু
কোন কিন্তু নয়। আমার কথা তোমার ভাবতে হবেনা। তুমি এম, এ, পাস করে…। না ভেবে কথাটা শুরু করে হঠাৎ থেমে গেল মাধবীলতা।
থামলে কেন? হাসল অনিমেষ। বাংলায় এম, এ, পাস করে কেউ চাকরি পায়না। আমি পরীক্ষা দেব দু তিন জন মানুষের ইচ্ছা পুরণ করতে। কিন্তু চাকরি যদি করতে হয় তাহলে বি, এ, পাসের ডিগ্রীটাই যথেষ্ট। তাছাড়া যদি বলি রাজনীতি করতে চাই লোকে আমাকে হাম্বাক ভাববে। যেন ওটা করার জিনিষ নয়। এককালে যারা সিরিয়াসলি কম্যুনিষ্ট পার্টি করত গণনাট্য করত এমন কয়েকজনকে আমি জানি তারা কি দুরবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। তাঁরা সারাজীবন চাকরি পাননি। অবস্থা যদি না পাল্টায় তাহলে এদেশে যারা রাজনীতি করতে চায় তারা না খেয়ে মরবে কিংবা চোরাপথে টাকা নিয়ে বিত্তশালী হবে। দ্বিতীয়টা আমার দ্বারা হবে না। অতএব আমার সঙ্গে ভাগ্যে হয়তো তুমি সারাজীবনের জন্যে পাকাপাকি অশান্তি ডেকে আনলে।
মাধবীলতা খুব মনযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল। শেষ হলে বলল আমি এখন কোন কথা বলব না। যদি চাকরিটা পাই তাহলে এর জবাব পাবে। আমি যা করব তা করেই দেখাতে চাই। আগে থেকে লম্বা চওড়া কথা বলে কোন লাভ নেই। শুধু তুমি আমার একটাই কাজ করে দাও, এ মাসের মধ্যেই একটা ভদ্ৰ হোষ্টেল খুঁজে দাও। চাকরিটা যেহেতু দক্ষিণেশ্বরের দিকে নর্থে হোষ্টেল হলে ভাল হয়।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে শিয়লদা ষ্টেশনের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। আজ হঠাৎ মাধবীলতাকে ওর ভীষন আপন মনে হচ্ছে। এই মেয়েটা শুধু অনিমেষের জন্যেই তার সব রকম নিরাপদ জীবনের মায়া ত্যাগ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে এর চেয়ে বড় অহংকার তার কি আছে। কিন্তু একথাটা ভাবলেই নিজেকে ভিষন অসহায় মনে হয়। তার সামনে কত কি করার আছে অথচ সে কিছুই পারছে না। একজন প্রেমিক হিসেবে যেমন একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তেমনি কোন ফারাক নেই। দুটো হাত আছে কিন্তু তাতে একটাও আঙ্গুল নেই। ক্রমশ একটা অপদার্থ ছাড়া নিজেকে কিছুই মনে হচ্ছে না।
ট্রেনে উঠে মাধবীলতা বলল, শোন একদম মাথা গরম করবে না। সব কিছু আমার উপর ছেড়ে দাও।
সব কিছু মানে আমি সুদ্ধু?
আমার সবতো তুমিই।
ট্রেন চলে গেলে অনিমেষ যখন স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসছিল তখন তার পা ভারী, ভীষন ক্লান্ত লাগছে হঠাৎ। মাধবীলতার শেষ কথাটা অন্য সময় শুনলে সম্রাট মনে হত। আনন্দে বুকের ভেতরটা আশ্বিনের সকাল হয়ে যেত। কিন্তু এখন, এখন সে খুশি হতে পারছে না কেন। সেই যে দুপুরটা যার শরীরে রোদ নেই মরা আলো ন্যাতানো, মাথায় মেঘের জলজ ছাতা, সময়টা যেন কাটতেই চায়না, ঠিক সেই রকম লাগছে।
হোস্টেলে ফিরেই শুনল তাকে কে একজন ডাকতে এসেছিল। দারোয়ান নাম বলতে পারল না। বলল, সাহেব ওপরে গিয়েছিলেন। সাহেব? অনিমেষ এদিক-ওদিক দেখল। কে এসেছিল না জানলে খুব অস্বস্তি হচ্ছে। হঠাৎ ওর মনে হল মাধবীলতার বাড়ি থেকে কেউ আসেনি তো? ওর বাবা? অনিমেষ ঠোঁট কামড়ালো। যদি তিনি আসেন তাহলে সে কি তর্ক করবে না ভদ্রলোককে বোঝাবে যে তিনি মেয়ের উপর ভুল করছেন?
ঠিক সেইসময় তমাল ঘর থেকে বেরিয়ে ওকে দেখে বলে উঠল, কখন ফিরলে?
এই তো।
তোমার কাকা এসেছিলেন।
কাকা?
তমাল আবার ঘরে ফিরে গিয়ে একটা কার্ড বের করে এনে ওর হাতে দিল, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন। বলেছিলেন আগামী কাল সকালে যেন তুমি অবশ্যই যাও। গ্র্যাণ্ড হোটেলে আছেন।
অনিমেষ চকচকে কার্ডটায় দেখল, প্রিয়তোষ মিটার লেখা, আর কিছুই নেই।
Leave a Reply