অনিমেষের মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকল বিমান। ঘরে সুদীপ ছাড়া আর কেউ নেই। এতক্ষণ গড়গড় করে কিছুটা মিথ্যে বলার পর অনিমেষ এখন ভেতরে ভেতরে নার্ভাস বোধ করছিল। এই সময়টার জন্যে সে মনে মনে অনেক রিহার্সাল দিয়ে আসা সত্ত্বেও বুঝতে পারছিল তার দেখানো কারণ খুব জোরালো নয়। বিমান সুদীপের দিকে তাকিয়ে বলল কি মনে হচ্ছে?
নেভা চুরুট দেশলাই কাঠি দিয়ে ঠিক করতে করতে সুদীপ বল, চট করে মনে হবে ও মিথ্যে কথা বলছে কিন্তু মফস্বলের ছেলেদের মানসিকতা বড় ঘোলাটে। দেশের কাছাকাছি গেলে সব রকম দায়িত্ব বিস্মৃত হতে ওদের বেশী সময় লাগে না।
বিমান বলল, অনিমেষ, আমি তোমার কথায় কোন লজিক খুঁজে পাচ্ছি না। দাসপাড়ায় বসে তুমি খবর পেলে তোমার দাদুর অসুখ হয়েছে এবং কাউকে কিছু না জানিয়েই জলপাইগুড়ি চলে গেলে। সেখানে এতদিন থাকলে অথচ আমাদের কাউকে একটা চিঠি দিয়ে ব্যাপারটা জানাতে পারলে না। প্রথম কথা, দাসপাড়ায় তোমাকে ওই খবর দেবার জন্যে কে বসে থাকবে? দ্বিতীয়ত, খবর পেলে তোমার টিমকে জানানোর সময় ছিল না এটা অবিস্বাস্য। তৃতীয়ত, জলপাইগুড়ি থেকে তুমি দাসপাড়ায় ব্যাক করতে পারতে কিংবা আমাকে চিঠি দিতে পারতে।
অনিমেষ নীচু গলায় বলল, আপনাকে তো বললাম, খবরটা শুনে আমি এমন আপসেট হয়ে গেলাম যে কারো সঙ্গে দেখা করার জন্যে অপেক্ষা করতে পারিনি। চিঠি দেবার কথা ভেবেছিলাম কিন্তু কোন ঠিকানায় দেব বুঝতে পারিনি।
সুদীপ বলল, তোমাকে তো এতটা নির্বেধ বলে মনে হয় না! তুমি এই কথাটা স্পষ্ট বলতে পারছ না কেন অত কাছাকাছি গিয়ে তোমার খুব মন কেমন করছিল দেশে যাওয়ার জন্য এবং তুমি জানতে যে পারমিশন পাবে না তাই কেটে পড়েছিলে চুপচাপ।
অনিমেষ মাথা নাড়ল, না একথা ঠিক নয়।
বিমান বলল, আমি তোমার ব্যবহারে মর্মাহত। তোমার এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের জন্য আমাকে অনেক কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে। তুমি উধাও হয়ে গেলে, তুমি তো খুনও হয়ে যেতে পারতে। সেক্ষেত্রে পার্টি কি জবাব দিত? মোদ্দা কথা তুমি পার্টির কাছে আমাকে অপদস্ত করেছ।
হঠাৎ সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, তোমার দাদুর খবরটা যদি আমরা যাচাই করি?
স্বচ্ছন্দে। অনিমেষ নড়েচড়ে বসল, শহরের অনেকেই জানে এখন।
কি হয়েছিল ওঁর?
লেপ্রসি।
অনিমেষ দেখল দুজনেই একসঙ্গে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। দুজনের মুখের অবস্থা দেখে খুব কষ্টে হাসি চাপল সে। আমরা যতই মুখে প্রগতির কথা বলি না কেন, এইসব অকারণ আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু ব্যাপারটাকে সে কাজে লাগালো, ওই খবর পাওয়ার পর আমার মাথা ঠাণ্ডা থাকতে পারে? আমার ছেলেবেলায় দাদুর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।
গলার স্বর বদলে গেল বিমানের, দুঃখিত। কথাটা যদি য়ুনিয়নের ঠিকানায় জানিয়ে দিতে তাহলে এই ভুল বোঝাবুঝি হতো না। যাহোক, উনি কেমন আছেন?
চিকিৎসা চলছে। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুব শকিং।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আমি চেষ্টা করব যাতে পার্টি তোমার সম্পর্কে কোন ভূল সিদ্ধান্ত না নেয়। কিন্তু এটাই শেষ সুযোগ। আমাদের মনে রাখা উচিত পৃথিবীর যেকোন ব্যক্তিগত সমস্যার চাইতে দলের কাজ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিমান খুব দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করল।
মাথা নাড়ল অনিমেষ, আমার মনে থাকবে। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি চুকে যাবে বুঝতে পারেনি অনিমেষ। সে নিশ্চিত ছিল ছাত্র ফেডারেশন তাকে বাতিল করে দেবে। সেটা হলে তার আপাতত কিছুই করার থাকছে না! দেশের জন্যে কেউ যদি কিছু করতে চায় তাহলে তাকে একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতেই হবে। পশ্চিম বাংলায় কংগ্রেসের বিকল্প দল এখন একটাই। যদিও ঘোলাজলের মত একই জায়গায় পাক খাচ্ছে তবু যা কিছু নাড়াচাড়া এই দলেই। বামপন্থী কমুনিস্ট দলের কাজকর্ম, মতবাদ এবং নেতৃত্ব সম্পর্কে কোন রকম আশা করার কিছু না থাকলেও খুব সামান্য কাজ এই দলে থাকলেই করা যাবে। সেই দুপা এগোন এবং এক পা পিছিয়ে যাওয়া ব্যাপার আর কি।
কলকাতায় ফিরে এসে তার মনে হয়েছিল কেউ তাকে মাথার দিব্য দেয়নি যে রাজনীতি করতে হবে। তার সহপাঠীরা, কলকাতায় লক্ষ লক্ষ মানুষেরা এসব না করে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে। এম.এ. পাশ করে একটা যেকোন চাকরি জুটিয়ে নিয়ে হাজারটা সমস্যার মধ্যে ওইরকম কাটিয়ে দেওয়া যায়। আজকের ভারতবর্ষে কেউ কি দেশের কথা ভেবে রাজনীতি করে? ব্রিটিশ আমলে যারা দেশের কথা ভাবতেন তাদের স্বদেশী বলা হতো। এখন বলা হয় না কেন? ব্রিটিশের বিকল্প যদি প্রক্রিয়াশীল শোষ করা হয় তো তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করাও তো স্বদেশী করা হতে পারে। মুশকিল হল স্বপাদেশিতাকে এমন সংকীর্ণ মনোভাবের প্রকাশ বলা হয়। অথচ বৃহত্তর ব্যাপারটার কোন মাথামুণ্ডু নেই একথা জানলেও কেউ মানতে চাইবে না।
কেন তার মনে হয় আমাদের দেমের মানুষগুলো স্বাধীন নয়? কেন মনে হয় লক্ষটা সংস্কার এবং অর্থনৈতিক দুর্দশা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যা থেকে লাভবান হয় একটিমাত্র শ্রেণী। যদি এই দেশের মানুষের আথর্থিক কাঠামোটা এক করা যেত তাহলে দেশের চেহারাটাই পালটে যেত। এটা ঠিক, আমাদের বর্তমান ব্যবস্থায় কোন দলেরই সেই কাজ করা সম্ভব নয়। সুদীপরা বলবে সীমাবদ্ধ সুযোগের মধ্যে যেটুকু কাজ করা যায় তাই করা উচিত। অনিমেষের মনে হয় এ এক ধরনের ফাঁকিবাজি। বিরোধীদল হিসাবে কংগ্রেসের সমালোচনা বা বিক্ষোভ দেখানোর মধ্যে একধরনের বাহাদুরি আছে কিন্তু গঠনমূলক কাজকর্ম যাতে দেশের সমগ্র মানুষ সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারবে তা করা সম্পূর্ণ আলাদা। কম্যুনিজমের থিওরি বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। কারণ প্রতিটি দেশের মাটি এবং মানুষের মনের চেহারা এক না। কিন্তু এসব চিন্তা তার মাথায় আসে কেন? অনেক ভেবেছে অনিমেষ, কিন্তু নিজেকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার সপক্ষে কোন কারণ খুঁজে পায়নি। চারপাশে এতরকম অসাধুতা যে নিজের মনের কাছেই দোষী হয়ে থাকতে হয়।
এই এবার জলপাইগুড়ি থেকে ফেরার সময় চোখের সামনে টিকিট চেকারকে ঘুষ দেবার জন্য যাত্রীদের হুড়োহুড়ি করতে দেখল। যারা দিচ্ছে এবং যে নিচ্ছে তাদের কেউ তথাকথিত প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীতে পড়ে না। এসব দেখে তার মধ্যে কেন ছটফটানি শুরু হয়? সেই কোন শৈশবে বন্দেমাতরম শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে সমস্ত শরীরে এক ধরনের আবেগের কাটা উঠতো তাই বা কেন হতো? সেই সময়ে রক্তে রোপিত স্বদেশী চিন্তাটা এতকাল নানান তাপে চেহারা পালটে কি তাকে এই ছটফটানি দিয়ে গেছে? তাই যদি হয় তবে সুদীপ বিমানদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকাই উচিত। ওরা কিছু করুক না করুক কথাবার্তায় অনেক কিছু করার একটা পরিমন্ডল সুষ্টী করে। এটুকুই লাভ। অনিমেষের খেয়াল হল আজ বিমানদের আস্থা ফিরিয়ে আনবার জন্য দাদু তাকে পরোক্ষভাবে সাহায্যে করলেন। এই একটি মানুষের কাছে তার ঋন ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে এবং পৃথিবীর কোন দামে তা শোধ করা যাবে না।
কংগ্রেসের অবস্থা এখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আসছে। নেতৃত্ব চিরকালই বৃদ্ধদের হাতে থাকে। পশ্চিম বাংলার কংগ্রেসীরা বিধান রায়ের পর নিজেরা কে কতখানি স্থবির প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর হয়ে পড়েছেন। তাদের অন্ধ বিশ্বাস গান্ধীজির নামের মধ্যে একটা জাদুমন্ত্র আছে যার দ্বারা দেশের মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায়। এই দেশ মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছাড়া কিছু নয়। বিরোধেরা শুধু চিকারেই নিজেদের অস্তিত্ব বজায় বাখে, তাই ওদের কাছ থেকে কোন ভয় নেই, মাঝে মাঝে দু–এক টুকরো রুটি ছুঁড়ে দিলেই যথেষ্ট। তারা যে মেহনত করে দেশের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন তার দাবীতে চিরকাল তাদের গদিতে বসিয়ে রাখা দেশবাসীর পুত্র কর্তব্য। এইসব ধারণা থেকেই ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের সৃষ্টি। যে গণতন্ত্রকে ধনিক–গণতন্ত্র বলা যায়। এই বুর্জোয়া ডেমোক্রেসি দিয়ে সমাজতন্ত্র হয় না। জংগ্রেস সেটি আমদানি করেছে। বামপন্থী দলগুলো যদি নির্বাচনে জেতে তাহলে ওই বুর্জোয়া ডেমোক্রেসির মধ্যে দিয়েই তাদের যেতে হবে।
বামপন্থী দলগুলো নির্বাচনের মাধ্যমে কংগ্রেসকে সরাতে চাইছেন। ধনিক শ্রেণীর ব্যাকিং যদি না থাকে তাহলে ফললাভ কষ্টকর। আর সত্যিই যদি ফল পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে এতকালে দেশের মানুষ নিপীড়নের বিরুদ্ধে মাতা তুলে দাঁড়িয়েছে। তারা বামপন্থীদের ভোট দিচ্ছে এই ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্যে। কিন্তু একটা সাইকেলকে প্যাডেল ঘোরালে সামনের দিকেই নিয়ে যাওয়া যায়, পেছনদিকে প্রয়োজনেও চালানো যায় না। নির্বচনে জিতলে তাই বামপন্থীদের সম্পর্কে জনসাধারণ বাধ্য হয়ে মোহমুক্ত হবেন।
কিন্তু পাশাপাশি আর একটা ব্যাপার অনিমেষ লক্ষ্য করছিল। ভারতের মার্কসবাদী কমুনিস্ট পার্টি আগামী নির্বাচনের কথা স্মরণ রেখে কৃষক সভার মাধ্যমে ব্যাপক আন্দোলনের কর্মসূচী নিয়েছে খাস জমি বন্টন, বর্গাস্বত্ব, খাদ্য, কাজ মজুরি হল তালিকাভুক্ত। একটু একটু করে অর্থনৈতিক দাবি–দাওয়া থেকে নিম্নবিত্তশ্রেণী গণতান্ত্রিক অধিকারও ক্ষমতা দখলের জন্য বাবতে শুরু করেছে। দ্রব্যমুল্যে বৃদ্ধি, ব্যাপক রাজনৈতিক নির্যাতন জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছিল। জনগনের একাংশ এর থেকে মুক্তি পাবার আশায় ক্রমশ রাজিৈতক পরিবর্তন কামনা করতে শুরু করেছে এই চেতনাটাকে কাজে লাগচ্ছে বামপন্থীরা। যদিও তাদের পথ বুর্জোয়া ডেমোক্রেসির বাধা পথেই শেষ হবে কারণ ব্যবস্থাটা যে এক। তবু এই আলোড়নের সময় যুক্ত থাকাই যে কোন কর্মীর উচিত। অনিমেষ বিমান-সুদীপদের সঙ্গে মিশে গেল।
আজকাল অনিমেষের হাতে তেমন পয়সা-কড়ি থাকে না। এবারে বাবার কাছে সে মুখ ফুটে বেশী টাকা চাইতে পারেনি। দাদুর অবস্থা দেখার পর তা সম্ভবও নয়। পরমহংসের মত টিউশানি যে তার পক্ষে করা সম্ভব নয় এটা বুঝতে পেরেছে। সামান্য কটা টাকার জন্যে ওরকম বাঁধা জীবন মেনে নেওয়া অসম্বব। অথচ কোন আশু সমাধান নেই।
দ্বিতীয় যে ব্যাপারটা জলপাইগুড়ি থেকে ফিরে এসে অনিমেষ শুরু করল সেটা হল পড়াশুনো। ইদানীং তার ঘরের টেবিলজুড়ে কম্যুনিজমেন ওপর লেখা নানান বই পত্রপত্রিকা ছড়ানো থাকতো। সব কাজ চুকিয়ে রাত্রের খাওয়ার পর নিয়ে বসত অনিমেষ। পড়তে গিয়ে অনিমেষ প্রথমে ভেবেছিল সে অসীম সমূদ্রে পড়বে। দীর্ঘদিন সংশ্রব না থাকায় একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। কিন্তু বাংলা এমন একটা বিষয় যে সামান্য মস্তিষ্ক থাকলে দখল নেওয়া কষ্টকর নয়। একমাত্র ভাষাতত্ত্ব বুঝতে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। ব্যাপারটা ফাঁকিবাজি দিয়ে সম্ভব নয়। পালি প্রাকৃতও প্রথমে ওইরকম মনে হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন পঠনের ফলে সব কিছুর মেডইজি বেরিয়ে যায়। অনিমেষ ঠিক করল, যাই হোক না কেন এম. এটা এবারেই সম্মানের সঙ্গে পাশ করতে হবে। কোন ফলশ্রুতি নেই, পাশ করলেও অন্ধকার–এসব জেনেও করতে হবে। কারণ নিজেকে অযোগ্য ভাবতে সে রাজি নয়। যে বাসনা নিয়ে এদেশের মানুষ রাজনীতি করে সেই বাসনাতেই তাকে পাশ করতে হবে।
মাধবীলতা এখন অদ্ভুত চুপচাপ। দাসপাড়ার অভিজ্ঞতা এবং তার পরের ঘটনা অনিমেষ ওকে বুঝিয়ে বলেছে। মাধবীলতা শুনেছে কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। যেন অনিমেষ যা করবে তা সে বুঝেসুঝেই করবে। ক্রমশ মেয়েটা যেন তার ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে ফেলছে। এ নির্ভরতা প্রতি মুহূর্তের অর্থনৈতিক চাহিদার নয়, মানসিকতার। অনিমেষ কোন অন্যায় করতে পারে না এরকম একটা বিশ্বাস ওর মনে অটল। সেই প্রথম দিকের জ্বলে ওঠা মেয়েটা যেন কোন জাদুমন্ত্রে এখন সমর্পণের ভঙ্গিতে বসে থাকে তার কাছে। যদি কোন কথায় বা কারনে ব্যথা পায় তাহলে চোখ তুলে শুধু চাহনিতেই বুঝিয়ে দেয় সে কথা। এরকম মেয়েকে আঘাত দেওয়া যায়না। অনিমেষ অনুভব করে, মাধবীলতা তার জীবনে থাকলে কোন অশুভ শক্তি তার ক্ষতি করতে পারবে না।
ভিয়েৎনামে আমেরিকা তার চুড়ান্ত আঘাতটি হানলো। যখন সাম্রাজ্যবাদি শক্তি মরিয়া হয়ে যায় তখন তার অন্ধতা আসে। কিন্তু এই নৃশংস আঘাতেও ভিয়েৎনামীরা ভেঙ্গে পড়র না। আমেরিকানরা কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে। এদিকে সমস্ত বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ আমেরিকার বিরুদ্ধে ধিক্কারে উত্তাল। বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়। এমনকি আমেরিকাতেও এই দৃশ্য দেখা গেল।
পর পর কয়েকদিন ওরা আমেরিকান দুতাবাস আর চৌরঙ্গী তথ্যকেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ করল, আমেরিকার রাষ্ট্রপতির কুশপুত্তলিকা পোড়াল। ট্রাফিক বন্দ, নেতারা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছেন ভিয়েতনামীদের সপক্ষে। অনিমেষরা শ্লোগান দিচ্ছিল, দুনিয়ার সর্বহারা একহোক।
কিন্তু ট্রাম-বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিরক্ত মানুষেরা চাপা উষ্মা প্রকাশ করছিল। অবশ্য এতবড় মিছিলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলার ক্ষমতা বা সাহস কারো নেই। অনিমেষ শুনল, একজন চাপা গলায় আর একজনকে বলছে, শালা আমাদের হাজারটা সমস্যার সমাধানের নাম নেই, কোথায় ভিয়েতনামে আমেরিকা কি করেছে তা নিয়ে কুমিরের কান্না কাঁদছে।
অনিমেষ কথাটা বিমানকে বলতেই বিমান ক্রুদ্ধ হল। সুরেন ব্যানার্জী রোডের রোদে দাঁড়িয়ে বলল, এই মানসিকতা কংগ্রেসী কুশাসনের ফসল। আমার ঘরে জল পড়ছে বলে অন্যের ঘরের আগুন নেভাতে ছুটব না?
অনিমেষ বলল, আমরা প্রতিবাদ করছি ঠিক আছে। কিন্তু ভিয়েৎনামীদের জন্যে আমাদের কিছু করা উচিত।
বিমান বলল, আমাদের সমর্থন ওদের কাছে পৌঁছে দিলে ওরা জোর পাবে।
তা ঠিক। অনিমেষ বলল, অন্যভাবে আমরা যদি সাহায্য করি তাহলে ওদের উপকার হয়, আমরাও কাজে কিছু করতে পারলাম বলে তৃপ্তি পাব।
কি ভাবে?
জামাকাপড়, ঔষধ, খাবার এসব পাঠিয়ে।
ভাল। কিন্তু আমাদের ফরেন সার্ভিস সেগুলো পৌঁছে দেবে কিনা কিংবা সরকার তাতে অনুমতি দেবে কিনা তো জানি না। ঠিকই বলেছ, ভিয়েৎনামী সংগ্রামীদের জন্য সাহায্য তোলা যায়, বিমান বলল।
সংগ্রামী শব্দটার পাশে সাহায্য কথাটা খুব খারাপ শোনালে অনিমেষের কানে। সে বলল, না, লোকের কাছে ভিক্ষে করব না। আমরা একটা বড়সড় অনুষ্ঠান করে টিকেট বিক্রী করে টাকা তুলে ঔষধ কিনতে পারি। আপনি কথা বলে দেখুন।
অনুমতি পাওয়া গেল। য়ুনিভার্সিটি য়ুনিয়ন থেকে ভিয়েৎনাম এইড কমিটি হল। সুদীপ কনভেনার, অনিমেষসম্পাদককয়েকদিন ধরে জোর আলোচনাচলল। ঠিক হল মহাজাতিসদনে অনুষ্ঠানটি হবে। সকালে হলে কম ভাড়া লাগে। যেরকমভাবে হোক খরচ কমাতে হবে। সবাই একমত হল যে কোনরকম হালকা গান-বাজনা বা নাটক হবে না। জনসাধারনকে উজ্জীবিত করতে পারে এইরকম অনুষ্ঠানসূচী করা দরকার। তখনই পালটা কথা এল, অর্থসংগ্রহ যদি প্রধান উদ্দেশ্য হয় তাহলে জাগরনের গানফান হলে টিকেট বেশী বিক্রী হবে না। দেখা গেল, কম্যুনিস্ট পার্টির গণনাট্য সংঘের সঙ্গে একদা যুক্ত থেকে যারা বিখ্যাত হয়েছেন তারা হয় পার্টি ছেড়ে দিয়ে লঘু অনুষ্ঠান করছেন। নয় ডানপন্তী কম্যুনিস্টবলে পরিচিত। ভারতীয় মার্কাসবাদি কম্যুনিস্ট পার্টির কালচারাল ফোরামে কোন কোন জনচিত্তজয়ী শিল্পী নেই। তাহলে? দুএকজন তাত্ত্বিক কিংবা প্রচুর কর্মী এবং বক্তা থাকা এক আর প্রকৃত শিল্পী থাকা অন্য কথা। তখন ঠিক হল ক্যুনিজমের প্রতি অনুগত অথচ কোন দলের সঙ্গে জড়িত নন এমন শিল্পীর সন্ধান করতে হবে। এই অবস্থায় সুদীপ প্রস্তার দিল নাটক অভিনয় করানোর। কলকাতার প্রখ্যাত দল জনবাণী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কৌতূহল এবং শ্রদ্ধা প্রচুর। কারন এই দলের বিখ্যাত পরিচালক অভিনেতা এখন বাংলাদেশের নাট্যজগতের অন্যতম স্তম্ভ। চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে সফল হলেও নাট্যকর্মেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন তিনি। তাঁর দল অত্যন্ত সুশৃংখল। ভারতীয় মার্কসবাদী কমুনিস্ট পার্টির সদস্য নন তিনি। কিন্তু জনবাণী দল সব সময় সর্বহারার জন্যে নাটক করে। প্রতিটি নাটকই প্রচন্ড জনসমর্থন পেয়েছে তার পরিবেশনা, প্রযোজনা এবয় প্রধান অভিনেতা পরিচালক সুবিমল গুপ্তের জন্যে। সুবিমলবাবুর নাটক গুলো কম্যুনিস্ট পার্টিকে প্রচন্ড সমর্থন করছে জনমানসগঠন করতে। মাঝে মাঝে পার্টির হয়ে পথ-নাটকও করছেন তিনি। এবং সবচেয়ে বড় কথা ওঁর সাম্প্রতিক নাটক ভিয়েৎতাম লাল সেলাম দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হল।
অনিমেষ আরো দুজন ছাত্রের সঙ্গে সুবিমলবাবুর ফ্যান প্রত্যেকেই। কিন্তু ব্যাপারটা অনেকের চোখে ঠেকবে বলে সে এল না। সুবিমলবাবুর বাড়িতে ঢুকে অনিমেষ হকচকিয়ে গেল। সুন্দর সাজানো গোছানো এবং চারপাশে বৈভব ছাড়ানো। একজন সংগ্রামী কমুনিষ্ট মানসিকতার মানুষ এত আরামে এদেশে থাকেন? ঘরের দেওয়ালে লেনিনের বিরাট ছবির পাশে রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন। চোস্ত পাজামা আর পাঞ্জাবী পরে হাতে চুরুট নিয়ে সুবিমলবাবু মোটা গলায় বললেন, আরে বসো বসো। তোমরা ঠিক সময়েই এসেছ বলে খুশী হলাম। তুমি বললাম বলে কিছু মনে করলে না তো?
অনিমেষ প্রথম দেখল সুবিমলবাবুকে কিন্তু তার সঙ্গীরা বেশ গদগদ হয়ে পড়েছে। তারা বলল, না, না, আপনি তুমিই বলুন।
ভেরি গুড। আমাদের দেশের তরুণ কমরেডদের দেখে খুশি হলাম। নাউ টেল মি, তোমাদের প্রব্লেম কি? মুখে চুরুট রেখেই কথা বললেন সুবিমলবাবু।
অনিমেষ নিজেই সামনের চেয়ারে বসে বলল, প্রব্লেম নয়। ভিয়েৎনামে আমরা কিছু ওষুধ পাঠাতে চাই।
খুব ভাল কথা। কনস্ট্রাকটিভ কাজ।
হ্যাঁ। এর জন্যে অর্থ দরকার। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহাজাতি সদনে একটি অনুষ্ঠান করে টাকাটা তুলবো। আমরা চাই আপনি সাহায্য করুন। অনিমেষ হাসল।
কিভাবে?
ভিয়েৎনাম লাল সেলাম অভিনয় করুন। আপনি পাশে দাঁড়ালে হাউসফুল হয়ে যাবে।
কবে?
বারো তারিখে সকালে হল পাওয়া যাবে।
তোমাদের বাজেট কত?
বাজেট?
এ-বাবদ আমার দলকে কত দেবে?
আমরা ভাবিনি কিছু। খরচ যতটা কমানো যায় তত আমরা সাহায্য পাঠাতে পারব।
বুঝলাম।
বোধহয় ওইদিন আমি খালি আছি। ওয়েল, আমার দলকল শো-এর জন্যে অনেক বেশী নেয়। যেভাবে খরচ বাড়ছে সামলানো মুশকিল। তবু তোমরা তিন দিও।
তিন, তিন হাজার? হাঁ হয়ে গেল অনিমেষ।
নো বারগেন।
অনিমেষ পাথর হয়ে গেল। এই মানুষটি সর্বহারাদের বন্ধু? কম্যুনিস্ট পার্টির হয়ে পথসভা করেন? ভিয়েৎনামীদের সমর্থক? সে খুব নীচু গলায় বলল, এতটাকা দিলে আমরা তো কিছুই ওখানে পাঠাতে পারব না।
আই কান্ট হেল্প। একবার যদি সবাই জেনে যায় ওর কম আমি শো করেছি তাহলে আমার বাড়ির সামনে একমাইল লাইন পড়ে যাবেল শোর। সবাই বলবে ওই টাকায় করুন। কাকে ঠেকাবো তখন! তুমি হয়তো ভাবলে আমার মুখে এ কি কথা! রাইট। কিন্তু আমার রাজনৈতিক চিন্তা আর প্রফেসনাল এটিকেট এক নয়। হতে পারে না। একজন সরকারীকর্মী যেমন সরকার বিদ্বেষী শ্লোগান দিলেও সরকারের কাজ করে মাইনে নেন পেটের জন্যে। আমিও দুটোকে এক করতে পারি না।
অনিমেষ কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। মনে মনে ভীষণ ভেঙে পড়ছিল সে। কোন চিন্তা মাথায় আসছিল না। এ কি ধরনের কমুনিজম-মনস্কতা?
সুবিমলবাবু হঠাৎ হাসলেন, ঠিক আছে! তোমরা এক হাজার দিতে পারবে? অনলি ওয়ান থাউজেন্ড।
সঙ্গে সঙ্গে নড়ে উঠল অনিমেষ, নিশ্চয়ই।
দেন, টিকিট বিক্রী করো। বারো তারিখ বললে না? এগার তারিখে বিকেলে টাকাটা পৌঁছে দিও। আই উইল বি দেয়ার।
বাইরে বেরিয়ে এসে সঙ্গীরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হল। অনিমেষের খারাপ লাগছিল নিজের কথা ভেবে। ভদ্রলোক যে ওকে নিয়ে খেলা করছিলেন তা সে বুঝতে পারেনি, না পেরে আজেবাজে চিন্তা করেছে। সুবিমলবাবুকে নিয়ে আজ সবাই গর্ব করে, তিনি কি ভিয়েৎনামের সাহায্য অনুষ্ঠানে না এসে পারেন? হু হু করে একদিনেই টিকেট বিক্রী হয়ে গেল। অনুষ্ঠানের আগের দিন টাকাটা পৌঁছে দেওয়া হল। মহাজাতি সদন টইটুম্বুর। সকালবেলাতেই জনবাণী এসে গেছে। মেকআপ নিচ্ছেন তাঁরা। অনিমেষকে নানান ঝামেলা সামলাতে ছুটোছুটি করতে হচ্ছে। সুদীপের সঙ্গে সুবিমলবাবু কথা বলছিলেন। অনিমেষ দেখল উনি এখনও মেক-আপ নেননি।
অভিনয় শুরুর একটু আগে সুদীপ বলল, আজকের অনুষ্ঠানের আগে কেন এটা করছি তা দর্শকদের বলা দরকার। সুবিমলবাবুও বলবেন।
পর্দা উঠল। অত মানুষের সামনে এই প্রথম অনিমেষ কথা বলল মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে। উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে দর্শকদের এবং জনবাণীকে ধন্যবাদ দিল সে। তারপর সুদীপ এসে বলল সে সুবিমলবাবুকে অনুরোধ করছে কিছু বলার জন্যে। সুবিমলবাবুর নামের আগে অনেক জনদরদী বিশেষণ দিল সে। উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে স্তম্ভিত অনিমেষ দেখল সুবিমলবাবুর আর একজন সঙ্গীর ওপর ভর দিয়ে কোনক্রমে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন, আমি অত্যন্ত অসুস্থ। ডাক্তার আমাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে বলছেন। কিন্তু ভিয়েৎনামের জন্যে ছাত্রবন্ধুরা যখন এই অনুষ্ঠান করছেন তখন কি আমি শুয়ে থাকতে পারি? না, আমি কোন বিশেষণের যোগ্য নই। একটু অভিনয় করতে চেষ্টা করি মাত্র। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে চিরকাল লড়ে যাব, জনসাধারণকে বোঝাবো তারা কি অবস্থায় আছেন। আমি একজন দৈনিক মাত্র। আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তবু না এসে পারলাম না। আমার দল অভিনয় করবে, আপনারা সহযোগিতা করুন। আমার সঙ্গে বলুন আপনারা, ভিয়েৎনাম লাল সেলাম। সঙ্গে সঙ্গে হল ফেটে গেল শব্দে, লাল সেলাম, লাল সেলাম।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্টেজ থেকে বেরিয়ে এসে অনিমেষের মুখোমুখি পড়ে গেলেন সুবিমল বাবু। চুরুট বের করে বললেন, একটা দেশলাই দাও তো।
চোয়াল শক্ত করে অনিমেষ বলল, আমার কাছে নেই। আর একজন ছুটে এসে দিল তাকে। সেটা নিয়ে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ অনিমেষকে দেখলেন সুবিমলবাবু। তারপর অদ্ভুত কায়দায় হাসলেন, দেশলাই-এর বাক্সটা দেখেছে? বারুদমাখানো কাঠিগুলোকে জলবাতাস থেকে বাঁচানোর জন্যে এই বাক্সটা দরকার। কোনটা দামী? বাক্স না কাঠি? দুটোই। তাই না?
কথাটা শেষ করে স্মার্টলি বেরিয়ে গেলেন হল থেকে। সেখানে তাঁর গাড়ি অপেক্ষা করছে। তখন নাটক শুরু হয়ে গেছে। আমেরিকান মিলিটারীর অত্যাচার দেখে দর্শকরা ধিক্কায় দিচ্ছে। জনবাণী দারুণ অভিনয় করছে। সুবিমলবাবুর বদলে যিনি করছেন তিনিই সর্বহারাদের কথা সমান দরদে মঞ্চে বলছেন।
অনিমেষ নাটক দেখছিল না। সমস্ত ব্যাপারটাই তার কাছে সাজানো, রঙিন বেলুনের মত মনে হচ্ছিল। বেলুনটা বাড়ে না কারণ সে জানে তাহলে ফেটে যেতে পারে। কিন্তু একটা সুচ দরকার, অবিলম্বে।
Leave a Reply