খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছিল ঘটনাগুলো। জীবনটা কি এই রকম? যখন কিছু ঘটে না তখন দমবন্ধ গ্রীষ্মের দুপুরের মত থমকে থাকে সব কিছু। আর যখন ঘটার পালা আসে তখন উত্তাল ঢেউ এর মত কোন কিছু গ্রাহ্য না করে বেপরোয়া ছুটে চলে। সেই রকম ছুটে যাওয়ার সময় যেন এই দিনগুলো। অনিমেষ পেছন ফিরে তাকাবার সুযোগ পাচ্ছিল না।
সুবাসদার সঙ্গে দেখা হয়নি অনেকদিন। খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছে সে কিন্তু সঠিক সংবাদ পাওয়া যায়নি। এই নিয়ে দুবার সুবাসদা নিজে আসবে বলে আর আসেনি। এখন অনিমেষদের কাজকর্ম খুব বেড়ে গেছে। পার্টি অফিস য়ুনিভার্সিটি করতে করতে অনেকটা সময় ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন লোকের সঙ্গে নিত্য পরিচয় হচ্ছে। কিন্তু পুরোন যারা রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট নয়, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে আসছে। যেমন পরমহংস। যেদিন সময় পায় সেদিন ক্লাস করতে গেলে দেখা হয়। একই রকম আছে ছেলেটা। এই যেমন আজ দেখা হতেই বলল, মালকড়ির শেয়ার পাচ্ছ মনে হচ্ছে গুরু। কামিয়ে নাও যত পারো। অনিমেষ হকচকিয়ে বলল, শেয়ার পাচ্ছি মানে?
পরমহংস বলল, তুমি যদি ভূত হও তাহলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে। তা নাহলে এখান থেকে ফায়দা তুলবে।
অনিমেষ প্রতিবাদ করতে গিয়ে থেমে গেল। কোন লাভ নেই। যে নিয়মটা চালু হয়ে গেছে তার বাইরে চিন্তা করতে আমরা অভ্যস্ত নই। এই মুহূর্তে তার পকেটে মাত্র দুটো টাকা পড়ে আছে। মাসের শেষ হতে অনেক দেরী এবং এতবড় কলকাতায় তাকে ওই টাকায় মাসটা চালাতে হবে। পরমহংস ওর মুখের পরিবর্তন লক্ষ্য করে বলল, এক সময় তুমি টিউশুনি করবে বলে খেপে উঠেছিলে। অথচ এখন সেসব কথা ভুলেও বল না। তার মানে তোমার টাকার দরকার নেই। ঠিক কিনা?
অনিমেষ বলল, তা নয়। আসলে আমি বোধ হয় খুব উদ্যোগী ছেলে নই। যা মাথায় আসে তাই করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তাছাড়া পার্টির কাজে এত সময় দিতে হয় যে ধরাবাধা অনেক কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই কাজ করতে কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি। কিন্তু আমি এ কাজ না করেও পারব না। তার ফলে অনেক আর্থিক কষ্টের মধ্যে আমার দিন কাটাতে হয়। বিশ্বাস করো রাজনীতি করে যারা পয়সা পায় তাদের সঙ্গে আমার এখনও আলাপ হয়নি এবং সেই ভূমিকায় নিজেকে দেখার কোন আগ্রহ নেই।
পরমহংস বলল, এ রকম নেশার কোন মানে আমি বুঝতে পারি না। যখন সময় চলে যাবে তখন দেখবে তোমার স্কোরে একটাও রান জমেনি। তুমি কি ভাবছ এই করে দেশের চেহারা পালটে দিতে পারবে? মিছিমিছি নিজেকে নষ্ট করার কোন মানে হয়!
অনিমেষ বলল, এই রকম চিন্তা যদি সবাই করে তাহলে আগামী দশ বছর পরে দেশের কি অবস্থা হবে তা ভাবতে পারো?
পরমহংস বলল, এখন কথাটা মানছ না, পরে বুঝবে। তুমি যাই বোঝাতে চাও দেশের সাধারণ মানুষ তা বুঝবে না। তারা একটা জিনিসই জানে, যে তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটাবে সেই তাদের বন্ধু। ওসব ইজম টিজমে ওদের কিছু যায় আসে না। সব শালা আমরা দারোগা বাবু হয়ে বসে আছি। হাঁসে ডিম পাড়ুক আমরা হাফবয়েল খাব। তা তোমার পরীক্ষা টরীক্ষা দেবার ইচ্ছে আছে?
অনিমেষ বলল, কোন লাভ নেই দিয়ে তবুও দেব।
পরমহংস বলল, লাভ নেই জেনেই তো এম এ পড়তে এসেছিল বাংলায়। দুবছর ভাল ভাল মেয়ের সঙ্গে আড্ডা মারার এই সুযোগ কি কেউ ছাড়ে? কপালে কোন ব্যাংক বা সরকারি অফিসের কেরানীগিরি অপেক্ষা করছে তা তো জানি। কিন্তু পরীক্ষা না দিলে প্রেস্টিজ থাকে না। তুমি তো ক্লাস করছো না, পড়াশুনা হচ্ছে কি?
অনিমেষ বলল, লাস্ট দুমাসে ম্যানেজ হবে না? তুমি কি বল?
রামকৃষ্ণর মত মুদ্রা করল হাতের আঙ্গুলে পরমহংস। তারপর বলল, ও হ্যাঁ মনে পড়েছে তোমাকে শোভনাদি খুঁজছিল একদিন দেখা করো।
কেন, কি ব্যাপার?
টিউশুনির জন্যে গিয়েছিলে বোধ হয় সেই ব্যাপারেই।
ভদ্র মহিলা বেশ ভাল। অন্যমনস্ক গলায় বলল অনিমেষ।
তাই নাকি? স্পিন ধরেছে মনে হচ্ছে।
ইয়ার্কি মেরো না। মহিলার মুখে একটা ব্যথার ছায়া ঘোরে।
দয়া করে সেই ছায়াটা সরাবার চেষ্টা করো না, তাহলেই উনি আরো ব্যথা পাবেন। তোমার বান্ধবী আসছেন, আমি চলি।
পরমহংস ঘুরে দাঁড়াতেই অনিমেষ দেখল মাধবীলতা আসছে। বেলঘরিয়া থেকে ফিরে আসার পর ওর সঙ্গে দেখা হয়নি অনিমেষের। সাদা জামা সাদা শাড়িতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। সে পরমহংসের হাত ধরে বলল, এই, পালাবে না।
মাধবীলত সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাসল, কি খবর?
অনিমেষ বলল, কোথায় ছিলে?
লাইব্রেরীতে। আমাদের তো পাস করতে হবে।
একে চেন?
সঙ্গে সঙ্গে পরমহংস সামান্য ঝুঁকে নমস্কার করে বলল, ঈশ্বর, এও আমাকে শুনতে হল, অনিমেষ আমার পরিচয় দিচ্ছে।
অনিমেষ দেখল মাধবীলতা হাসছে এখনো। সে বলল, তোমরা কি আগে থেকেই–।
পরমহংস হাত নেড়ে জানাল, অফকোর্স। আমিই তো ফাস্ট ওর পেছনে লাইন দিই তুমি তো পেছন থেকে ওভারটেক করে চেয়ার দখল করলে। আমার কপালই এই রকম বন্ধুরাই শত্রু হয়। ওর বলার ভঙ্গী এমন যে মাধবীলতা হাতের খাতা দিয়ে ওকে কপট আঘাত না করে পারল না। শরীর খর্বকায় বলে পরমহংস মাথা নীচু করে এক পাশে সরে গিয়ে উচ্চ গ্রীমে হাসতে শুরু করল। অনিমেষের মনে পড়ল, তার এ্যারেস্ট হওয়ার বিকেলে এই পরমহংসই ওকে খবর দিয়েছিল বসন্ত কেবিনের ওপরে মাধবীলতা বসে আছে। সে ব্যাপারটা বলতেই পরমহংস বলল, দারুণ ব্যাপার হয়েছিল সেদিন। আমি য়ুনিভার্সিটির উলটো ফুটে থেকে দেখলাম তুমি ফালতু ফালতু শহীদ হয়ে গেলে।
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ফালতু ফালতু মানে?
নিরীহ হরিণ শাবকের মত তুমি রাস্তা পার হচ্ছিলে আর পুলিশ ভ্যানটার তখন একটা কেস দেখাবার প্রয়োজন ছিল তাই টুক করে তোমায় তুলে নিল। কোনরকম বিপ্লব বিদ্রোহ নয়, ঠাকুরঘরে ঢোকার মত তুমি ভ্যানের ভেতরে ঢুকে গেলে।
অনিমেষ হাসল, তারপর?
তারপর আর কি? পুলিশ চলে গেলে তুমি ছাত্রদের কাছে বিপ্লবী হয়ে গেলে। কমরেড অনিমেষের মুক্তি চাই, বাপস। মেয়েরা গুজব ছড়াবে লাগল। অনেক লড়াই করে তুমি ধরা দিয়েছ এইসব। তা এ মহিলাও বোধ হয় সেই সব গুজবের একটি শ্রবণ করে বসন্ত কেবিনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমি কি ছাই সেসব জানতাম। দেখলাম একা হরিণ কচি ঘাস খাচ্ছে। দেখে নির্মল হৃদয়ে পাশে গিয়ে বসলাম, নিজের পরিচয় দিয়ে লাইন করার চেষ্টা করলাম।
মাধবীলতা ঠোঁট কামড়ে বলল, কিসের লাইন?
একটা মোগলাই পরোটা আর চায়ের।
ওমা! মাধবীলতা হতবাক।
অনিমেষ বলল, খাওয়ালো না?
খাওয়াবে কি! এক ডজন অমাবস্যা মুখে নিয়ে বসে থাকলে কাউকে খাওয়ানোর কথা মনে আসে! আমি শালা আলাপ জমাবার জন্যে কারেন্ট টপিক ব্যবহার করতেই ফেঁসে গেলাম। আফসোসের মুখ করল পরমহংস।
ডিটেলস প্লিজ।
যেই বললাম, অনিমেষ একটা দারুণ ছেলে। চেনেন নিশ্চয়ই? আমাদের সঙ্গে পড়ে মাই ফ্রেন্ড। আজ পুলিশকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভ্যানে উঠে বাড়ি চলে গেল। অমনি এই মহিলা ভেঙ্গে পড়লেন।
মোটেই না, একদম ইয়ার্কি করবেন না। খুঁসে উঠল মাধবীলতা।
বেশ, তাহলে একা একা বসন্ত কেবিনে কি করছিলেন?
আশ্চর্য। আমি ওখানে চা খেতে যেতে পারি না?
একা একা?
হ্যাঁ। আপনারা যেটা পারেন সেটা একটা মেয়ের পক্ষে কি পারা অন্যায়?
হাত জোড় করল পরমহংস, ক্ষমা করুন, আমার অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু এতসব শোনার পরও যদি হৃদয় না গলে তাহলে আফসোসের কথা।
হৃদয় গলবে কি কারণে?
বাঃ আমি যদি খবর না দিতাম তাহলে অনিমেষ আপনার কাছে যেত? সেই সুবাদে আমার একটা মাটন ওমলেট আর কফি পাওনা হয়ে আছে।
ঠিক আছে, এত করে যখন বলছেন, আর একদিন খাওয়াবো। আজ আমার কাছে বেশি পয়সা নেই।
নেই তো কি হয়েছে, ধার দিচ্ছি।
মানে? আপনার কাছ থেকে ধার নিয়ে আপনাকেই খাওয়াতে হবে? কি ডেঞ্জারাস লোক। কপালে চোখ তুলল মাধবীলতা!
ওরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। আজকের মত ক্লাস শেষ হলেও কিছু কিছু ছেলেমেয়ে এখনও ঘোরাঘুরি করছে। অনিমেষের খেয়াল হল টিএনজি সেদিন ক্লাসে বলেছিলেন একবার দেখা করতে। করা হয়নি। ভদ্রলোক যদি এখনও টিচারস রুমে বসে থাকেন তাহলে দেখা করে এলে হয়। সে শুনল পরমহংস বলছে, ওর ব্যাপারটা নিয়ে আপনি কিছু ভাবছেন?
কী ব্যাপার? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।
এই যে, শ্রীমান, ক্লাস করছেন না। দেশ উদ্ধার করতে পার্টি করছেন, এসব করে ভবিষ্যতে গোলমালে পড়বে তা বুঝতে চাইছে না। আপনার এখন কর্তব্য ওকে বুঝিয়ে বলা। পরমহংস গড়গড় করে বলে গেল।
আমি কেন?
দোহাই আর খেলবেন না, আমি মাইরি কিছুতেই এই রকম খেলা সহ্য করতে পারি না। কেমন নার্ভ ছেড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়।
মাধবীলতা হাসল, দেখুন, ওকে আমি খুব অল্প জানি। তবে যদি কেউ মনে করে সে যা করছে তা ঠিক করছে তাতে কোন বাধা দেওয়া উচিত নয় বলেই বিশ্বাস করি।
কিন্তু যদি সাফরিংস আসে।
সেটা তো জেনে শুনেই ডেকে আনা হচ্ছে তাই এলে তার জন্য আফসোস করে লাভ কি। এমন ছেলে মানুষের মত কথা বলেন না।
অনিমেষের মনে হল এবার কথার মোড় ঘোরানো দরকার। পরমহংস ক্রমশ ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে আলোচনাটা। আর একটু এগুলোই নিশ্চয়ই মাধবীলতা ফোঁস করে উঠবে আর তখন সামলানো মুশকিল হয়ে পড়বে। সেই একটু ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল, তোমরা এখন কি করছ?
পরমহংস বলল, কফিহাউসে যাব।
মাধবীলতা ঠাট্টা করল, কেন, কফি শিকার করতে?
পরমহংস বলল, কি করি বলুন, অন্য কিছুর এলেম নেই যে।
অনিমেষ ওদের দাঁড়াতে বলে টিচার্স রুমে চলে এল। যা ভেবেছিল তাই, ঘর ফাঁকা। ফিরে এসে বলল, টিএনজির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, উনি নেই। চল, বেরিয়ে পড়ি।
মাধবীলতা হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ টিএনজি কেন?
একদিন ক্লাসে আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন, আর যাওয়া হয়নি।
কথাটা শোনা মাত্র দুজনে অবাক হয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল। পরমহংস বলল, গুরুদেব লোক মাইরি। ছমাস আগের কথা আজ মনে পড়ল? এরপর হয়তো দশ বছর বাদে একদিন এসে জিজ্ঞাসা করবে, মাধবীলতা তুমি যেন কি কথা বলছিলে সেদিন–, কথাটা শেষ না করে দ্রুত পা চালাল সে।
চিৎকার করে বলল, কফিহাউসে আছি, ইচ্ছে হলে এসো, নইলে চলে যাও।
চোখ মুখ লাল করে মাধবীলতা বলল, আচ্ছা ফাজিল তো।
অনিমেষ বলল, কিন্তু ভীষণ হাসিখুশি।
তা অবশ্য, মনে প্যাঁচ থাকলে কেউ এ রকম কথা বলতে পারে না। যার যত প্যাঁচ সে তত গম্ভীর।
এতদিন পরে দেখা হল তবু হাসি দেখলাম না।
অনিমেষ চোখ ছোট করল, আমার মনে প্যাঁচ আছে?
আছেই তো। মাধবীলতা অন্যদিকে মুখ ফেরালো।
কি রকম?
এতদিন দেখা হয়নি তবু খোঁজ নেবার ইচ্ছে হয়েছিল?
তুমি ক্লাসে আসোনি?
আমি কিছু বলব না। গম্ভীর মুখে হাঁটতে শুরু করল মাধবীলতা।
হঠাৎ এই পরিবর্তনের কোন কারণ বুঝতে না পেরে অনিমেষের অস্বস্তি শুরু হল। সেদিন বাসে যা হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি যদি হয় তাহলেই সর্বনাশ। মাধবীলতা মুখ গম্ভীর করলেই মনে হয় বুকের ভেতরটা টলমল করছে। সে দ্রুত পা চালিয়ে মাধবীলতার পাশাপাশি গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এই কি হয়েছে!
মাধবীলতা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাঁটলেও অনিমেষ ওর গালের নীচে একটা শিরার কাঁপুনি লক্ষ্য করল। আর প্রশ্ন করতে সাহস পেল না। চুপচাপ ওরা হেঁটে গেল অনেকটা পথ।
বউ বাজার ছাড়িয়ে যেতে গিয়ে অনিমেষ পাশের একটা রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে বলল, একটু চা খাব।
আমার খাওয়ার ইচ্ছে নেই। থমথমে মুখ এখনও মাধবীলতার।
থাক তাহলে।
একটু ইতস্তত করল মাধবীলতা, তারপর বলল, আমি বসছি।
না, একা একা চা খাওয়া যায় না।
কপালে ভাঁজ ফেলে মাধবীলতা অনিমেষের মুখের দিকে এক পলক দেখে নিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকল। বেশ ভিড় দোকানটায়। একটা টেবিলে দুজন লোক বসে আছে। অনিমেষ সেদিকে এগাতেই বয় একটা কেবিনের পরদা উঁচু করে ধরে তাদের ডাকল। অনিমেষ হাত নেড়ে তাকে নিষেধ করতে যেতেই অবাক হল। মাধবীলতা সেই কেবিনে ঢুকে গেল। এ রকমটা কখনই হয়নি। অনুচ্চারিত একটা শর্ত ছিল যেন ওদের কোন নির্জন কেবিনে বসবে না। মাধবীলতার ধারণা কেবিনের পর্দা ফেলে লোকে বদমাইসি করতে বসে। অথচ আজ অমন নির্দ্বিধায় সে ঢুকে গেল কেন?
অনিমেষ কেবিনে ঢুকে বিপরীত দিকের চেয়ারে বসতেই বয়টা জিজ্ঞাসা করল, মোগলাই ফিসফ্রাই, ব্রেস কাটলেট, কবিরাজি কি দেব?
অনিমেষ বলল, কিছু না, শুধু চা।
ওনলি চা। ছেলেটা যেন তাচ্ছিল্যের গলায় প্রশ্নটা করল। অনিমেষের রাগ হয়ে গেল বলার ধরনে। যেন রেস্টুরেন্টে ঢুকলেই একগাদা খাবার খেতে হবে নইলে মান থাকবে না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মাধবীলতা বলে উঠল, ফিসফ্রাই আছে? তাহলে দুটো দিন।
ছেলেটি হাসল, তারপর পর্দা ফেলে দিয়ে চলে গেল।
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এটা কি হল?
তোমার খিদে পেয়েছে। মাধবীলতার মুখের ভাব একটুও বদলায়নি।
তুমি কি করে জানলে?
মুখ দেখলেই বোঝা যায়।
কিন্তু আমার পকেটে মাত্র দুটো টাকা আছে। এতে মিটবে?
এবার বিচলিত হল মাধবীলতা। আজ ব্যাগ নিয়ে আসেনি, হাতে শুধু খাতা ছিল। কিন্তু কোমড় থেকে রুমাল বের করে তার গিঁট খুলে একটা টাকা আর কিছু খুচরো পয়সা বের করলো। একটু বিব্রত মুখে সে জিজ্ঞাসা করল, এতে হবে না?
অনিমেষ হেসে ফেলল, ছেড়ে দাও, আমি ওকে শুধু চা দিতে বলছি।
না, ঘাড় শক্ত করল মাধবীলতা, ফিসফ্রা খাবই। আমার হাতে সোনার বালা আছে।
সোনার বালা দিয়ে কি হবে?
জমা দিয়ে যাব, পরে দাম দিয়ে ছাড়িয়ে নেব।
একদৃষ্টে মেয়েটাকে দেখল অনিমেষ। অসম্ভব জেদী কিন্তু ছেলে মানুষ মনে হচ্ছে ওকে। ব্যাপারটা যে হাস্যকর তা ওর মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। অনিমেষের মনে হল এই রকম অপ্রস্তুত অবস্থায় ঢোকাটাই তার অন্যায় হয়েছে। সে মুখ নামিয়ে টেবিলের কাঁচের তলায় রাখা মেনুকার্ডের ওপর চোখ রাখল। ফিসফ্রাই এর দাম এক টাকা চল্লিশ আর চায়ের দাম তিরিশ। অর্থাৎ তিন টাকা চল্লিশ পয়সা ব্যয় করলেই এ যাত্রায় রেহাই পাওয়া যায়। দুজনের কুড়িয়ে বাড়িয়ে সেটা হয়ে যাবে কিন্তু বাড়ি ফেরা?
সে জিজ্ঞাসা করল, তোমার রেলের টিকিট আছে?
ঘাড় কাত করল মাধবীলতা। তারপর খাতাটা খুলে মাসের টিকিটটা দেখাল। অনিমেষ নিশ্চিত গলায় বলল, যাক প্রব্লেম সলভড। তোমার সোনার বালা হাতেই স্থির থাক। আমাদের যা পয়সা আছে তাতে স্বচ্ছন্দে দাম মেটানো যাবে।
বোঝাটা কমে যেতে হাসল মাধবীলতা। এই হাসি দেখলে মনে হয় একটি সুন্দর মুখের সরল বালক হাসছে। একটু আগে হেঁটে আসার সময় যে কালো মেঘ জমেছিল তা এখন উধাও, ভাগ্যিস এই টাকার সমস্যাটা উঠেছিল, অনিমেষ মনে মনে বয়টাকে ধন্যবাদ দিল। সে একটু সহজ গলায় জিজ্ঞাসা করল, এবার বল তোমার কি হয়েছে?
যাই হোক, তোমার কিছু এসে যায়?
যায়। যায় বলেই তো তুমি মুখ গম্ভীর করলেই মরে যেতে ইচ্ছে করে। অনিমেষ সত্যি কথাই বলল।
যাও! যত বানিয়ে বানিয়ে কথা বলা। আমি যে ক্লাসে ছদিন আসিনি, মরে আছি কি বেঁচে আছি খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন নেই, না? আমি তো ভেবেছিলাম আজ তোমার হোস্টেলেই চলে যাব। মাধবীলতা আবদারের ভঙ্গীতে কথা শেষ করল।
পার্টি অফিস থেকে বেরুতে রোজ দেরি হয়ে যাচ্ছিল। এই যাঃ আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার জন্য নোট নিয়ে যাচ্ছ– মুশকিলে পড়তে হবে। যাক, কি হয়েছে বল?
মেয়েদের তো এই বয়সে একটাই সমস্যা থাকে। আমার বিয়ের জন্য সবাই এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে যে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আমি ওদের বোঝা হয়ে আছি যেন। এদেশে মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই পাপ।
একথাটা তুমি বলছ, কিন্তু ভাবো তো, য়ুনিভার্সিটি অবধি আসার সুযোগ তো তুমি পেয়েছ! এ রকম কটা মেয়ের ভাগ্যে ঘটছে?
বাঃ তাই একটা লজ্জার কথা ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে?
লজ্জা কেন? মেয়েরা বড় হলে বাপ-মা তাকে সুপাত্রে দিয়ে জীবনটা নিশ্চিত করতে চাইবে না? স্নেহ থেকেই তো এটা আসে।
তাহলে সুপাত্রটিকে মেনে নেব? কি বল তুমি?
তোমার যদি বাসনা হয়।
দেখো, আমি তোমাকে ধরে রাখিনি। যদি মনে হয় আমাকে তোমার কোন প্রয়োজন নেই তাহলে স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পার। কারো দয়া নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে চাই না। আমি আমার ব্যাপার নিজেই বুঝে নেব।
মাধবীলতার মুখ আবার থমথমে হয়ে যাচ্ছে দেখে অনিমেষ বলল, তখন থেকে শুধু আমায় বকেই যাচ্ছ, আসল কথাটা বলে ফেল।
এমন জ্বালায় না। মাধবীলতা আনমনে কথাটা বলতেই বয় খাবার দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কিছু বললেন?
না, না, আপনাকে নয়।
বয় চলে যেতে অনিমেষ বলল, জ্বালাল তো অথচ নয় বললে কেন?
মাধবীলতা তার সেরা অলঙ্কার ভুরুর তলায় চাহনি রাখতেই অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। ওর এই চাহনিটায় বুকের মধ্যে যেন লক্ষ জলতরঙ্গ বেজে ওঠে। সে দেখল মাধবীলতা নিজের প্লেটের ফ্রাইটা দুভাগ করে একটা টুকরো তার প্লেটে তুলে দিয়ে বলল, অনেক কষ্টে থামিয়েছি।
কি? অনিমেষ বুঝতে পারল না।
বিয়ে। বাড়িতে খুব ঝামেলা হয়েছে। মা তো কথাই বন্ধ করে দিয়েছেন। বুঝতে পারছি না কতদিন এভাবে চলবে। কোন রকমে এম. এ. পাস করতে পারলে আর চিন্তা করি না। মাধবীলতাকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল।
অনিমেষ দেখল সে খাচ্ছে না, ছুরিটা দিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছে শুধু। বুকের মধ্যে এক ধরনের চাপ অনুভব করল অনিমেষ। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে সে মাধবীলতার কবজি ধরল, তুমি ভেঙ্গে পড়ো না লতা–।
কথা না বলে ঘাড় নেড়ে না বলল মাধবীলতা। তারপর কেমন কান্না মেশানো গলায় বলল, শোন, তুমি আমাকে কখনো অবহেলা করো না।
আমি প্রতিজ্ঞা করছি। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না ওকথা।
মাধবীলতা ধীরে ধীরে হাত ছাড়িয়ে নিল।
কিছুক্ষণ বাদে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, সেদিন আমি গিয়েছিলাম বলে বাড়িতে কোন অসুবিধে হয়নি তো?
কথা হয়েছিল। তুমি কে, কোথায় থাক, এইসব। আমি জানি আমার ব্যাখ্যা ওদের সুখি করেনি। আচ্ছা, একটা কথা বলতে পারো, যে মেয়েকে তিল তিল করে বাবা মা বড় করল আদর যত্নে, সেই মেষে বড় হয়ে গেলেই কেন তাকে সন্দেহ করতে হবে সব সময়? কেন মনে হয় সে অন্যায় করছে বোধহয়?
স্নেহের আধিক্যই এর কারণ।
কি জানি, অধিকারবোধ বড় অন্ধ করে দেয় মানুষকে।
খাবারের বিল মিটিয়ে বাকী পয়সা কটা টিপস দিয়ে দিতে ছেলেটি খুশি হয়ে নমস্কার করল।
ওরা রাস্তায় বেরিয়ে আসতেই মাধবীলতা বলল, তোমার আমার দুজনের কাছেই আর পয়সা নেই, না?
হুঁ। অনিমেষ শূন্য পকেটের কথা ভাবতে চাইছিল না। এখনও মাসটা চালাতে হবে। কি করে যে চলবে ঈশ্বর জানে। মুখে বলল, বেশ মুক্ত পুরুষ মনে হচ্ছে।
মাধবীলতা ঠোঁট বেঁকালো, এমন স্বার্থপর না, আমারও যে পয়সা নেই এটা ভুলে গেলে কথাটা বলার সময়!
ও হাসল। মুক্ত পুরুষ বললে যে ছবিটা মনে আসে, মুক্তনারী বললে তা কখনই বোঝা যায় না। সে বলল, তোমার তো বাবা বাড়িতে পৌঁছালেই পয়সা পাওয়ার সুযোগ আছে কিন্তু ওই দুটো টাকাই আমার শেষ সম্বল ছিল। এখন এই কলকাতায় আমার একটা পয়সাও নেই।
কত লাগবে তোমার?
মানে?
আমি কাল তোমাকে দিতে পারি। আমার কিছু জমানো টাকা আছে।
থাক, দেখি ম্যানেজ করব যাহোক করে।
দেখলে, তোমার মনে কেমন প্যাঁচ! আমার কাছে পয়সা নিলে অহঙ্কারে লাগবে, না? যে মেয়েটা–।
আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। কাল গোটা ত্রিশ টাকা এনো। কবে কখন শোধ করতে পারব আগে থেকে কথা দিতে পারছি না কিন্তু।
আমি যাকে দিই তার থেকে ফেরত নেবার জন্যে দিই না।
বেশ। কিন্তু মহারানী, তুমি কি ভাল করে ব্যাপারটা ভেবে দেখেছ? আমার জীবন এর পর অনিশ্চয়তায় ভরে যাবে। রাজনীতির কাজে কখন কোথায় থাকব তার ঠিক নেই। চাকরি-বাকরি করে স্থির হয়ে থাকব তারও কোন সম্ভাবনা নেই। তখন?
তখন আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকব। একথা বোঝ না কেন আমি কখনই তোমার বাধা হয়ে দাঁড়াব না।
শেয়ালদা স্টেশনে পৌঁছানোর পর মাধবীলতা বলল, তুমি যেন কবে বাইরে যাচ্ছ?
সামনের মাসে। নির্বাচনের কাজ করলে অনেক অভিজ্ঞতা হবে। তাছাড়া জায়গাটা আমার একদম অচেনা নয়।
কবে ফিরছ?
ভাবছি নির্বচন শেষ হলে বাড়ি ঘুরে আসব।
আমাকে নিয়ে যাবে সঙ্গে?
তুমি যাবে?
হ্যাঁ।
তোমার বাড়ি?
সে আর ভাবি না। না, এখন যাব না। যেদিন তোমার পরিচয় নিয়ে যেতে পারব সেদিন আমি যাব। এখন তুমি কাজ করে এসো।
পকেটে পয়সা না থাকায় পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল অনিমেষ। পথ যদিও দীর্ঘ নয় তবু তার মনে হচ্ছিল সে যেন উড়ে উড়ে যাচ্ছে। এত আনন্দ কেউ পায়?
Leave a Reply