২৩০. খাণ্ডবাগ্নিনির্মুক্ত শার্ঙ্গকগণ-বৃত্তান্ত, আত্মরক্ষার্থ শার্ঙ্গক-জননীর উপদেশ

২৩০. খাণ্ডবাগ্নিনির্মুক্ত শার্ঙ্গকগণ-বৃত্তান্ত, আত্মরক্ষার্থ শার্ঙ্গক-জননীর উপদেশ

ত্রিংশদধিকদ্বিশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন্! তদনন্তর ভগবান হুতাশন প্রবলবেগে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলে, সেই শার্ঙ্গকচতুষ্টয় আপনাদিগকে অশরণ বোধ করিয়া সাতিশয় দুঃখিত ও উৎকণ্ঠিতচিত্ত হইলেন। তাঁহাদের মাতা দীন জরিতা স্বীয় শাবকগণকে তদবস্থ দেখিয়া দুঃখ-শোকাকুলিত-চিত্তে বিলাপ করত কহিতে লাগিলেন, হায়! এখন কি করি! ঐ প্রজ্বলিত হতাশন ভূমণ্ডল সমুদ্দীপিত করিয়া ভয়ঙ্কর বেগে অরণ্য দগ্ধ করিতে করিতে এই দিকেই আসিতেছেন; আর আমাদের পূর্ব পুরুষগণের পরিত্রাণকারণ এই শাবকগুলিও আমার চিত্তাকর্ষণ করিতেছে। আমি কি করিয়া ইহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করি! ইহারা সকলেই অজাতপক্ষ এবং ইহাদিগের চরণ অতিশয় দুর্বল, সুতরাং স্বয়ং পলায়নে অসমর্থ। আমার এমন সামর্থ্য নাই যে, ইহাদিগের চারি জনকে লইয়া প্রস্থান করি; কিম্বা ইহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া যাই। এখন কি করি! কাহাকে পরিত্যাগ করি, কাহাকেই বা লইয়া যাই! হে পুত্রগণ! তোমরা বল, এক্ষণে আমার কি করা কর্তব্য। আমি, বিস্তর চিন্তা করিয়াও তোমাদের মোচনোপায় স্থির করিতে পারিলাম না, অতএব আমি স্বীয় গাত্রদ্বারা তোমাদিগকে আচ্ছাদন করিয়া তোমাদের সহিত এককালে হতাশনমুখে প্রাণ সমৰ্পণ করি। তোমাদিগের পিতা নিতান্ত নিষ্ঠুর। তিনি গমনকালে বলিয়া গিয়াছেন যে, জরিতারি সর্বজ্যেষ্ঠ, ইহাতেই কুলের প্রতিষ্ঠা হইবে; সারিসৃক্ক অপত্যোৎপাদনদ্বারা বংশ বর্ধন করিবে;ম্বমিত্র তপস্যা করিবে এবং দ্ৰোণ বেদবেভাদিগের অগ্রগণ্য হইবে; তিনি এইমাত্র বলিয়া আমাদিগকে পরিত্যাগপূর্বক প্রস্থান কুরিয়াছেন। এখন আমি কাহাকে অবলম্বন করিয়া এই বিপদ হইতে উদ্ধার হই! শার্জিকা এইরূপে ইতিকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া স্বীয় শাবকগণ রক্ষার কোন উপায় স্থির করিতে পারিযেন না, কেবল বিলাপ করিতে লাগিলেন।

শার্ঙ্গকগণ স্বীয় জননী শার্ঙ্গিকার এইরূপ বিলাপ বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন,—মাতঃ! আমাদিগের স্নেহ পরিত্যাগ করিয়া অগ্নিশূন্য স্থানে পলায়ন কর। দেখ, আমরা এস্থানে বিনষ্ট হইলে, তোমার অন্যান্য অনেক সন্তান হইতে পারিবে, কিন্তু তুমি প্রাণত্যাগ করিলে বংশরক্ষার উপায়ান্তর নাই। অতএব হে মাতঃ! এই উভয় পক্ষ বিবেচনা করিয়া যাহাতে আমাদের কুলের শ্রেয়ঃ হয়, তাহা কর। আমাদিগের প্রতি স্নেহ প্রকাশ করিয়া সৰ্বদিক্‌ বিনষ্ট করিও না এবং ইহা করিলে আমাদের পিতার মনোবাঞ্ছাও ব্যর্থ হইবে না।

জরিতা কহিলেন, হে পুত্রগণ! এই বৃক্ষের অতি সমীপবর্তী ভূতলে এক মুষিকের গর্ত আছে; তোমরা অতি ত্বরায় তন্মধ্যে প্রবেশ কর; তথায় অগ্নিভয়ের সম্ভাবনা নাই। হে পুত্রগণ! তোমরা ঐ গর্তমধ্যে প্রবিষ্ট হইলে, আমি পাংশুদ্বারা আপাততঃ উহার মুখ রুদ্ধ করিয়া দিব, তাহা হইলে তোমরা এক্ষণে অগ্নি হইতে পরিত্রাণ পাইতে পারিবে। পরে অগ্নি নির্বাণ হইলে পর, আমি পুনরায় আসিয়া পাংশুরাশি প্রক্ষেপপূর্বক ঐ গর্ভের মুখ পরিষ্কার করিয়া দিলে পুনৰ্বার উঠিবে। হে বৎসগণ! প্রজ্বলিত হুতাশন হইতে মুক্ত হইবার এই একমাত্র উপায় আছে, ইহা অবলম্বন করিয়া প্রাণ রক্ষা কর।

শার্ঙ্গকগণ কহিলেন, হে মাতঃ! মূষিক স্বভাবতঃ মাংসলোলুপ, বিশেযতঃ আমরা অজাতপক্ষ মাংসপিণ্ডভূত; আমরা গমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেই সে আমাদিগকে, ভক্ষণ করিবে, সন্দেহ নাই; এই ভয়ে গর্তে প্রবেশ করিতে সাহস হইতেছে না। পরে তাহারা কারস্বরে কহিতে লাগিল, হায়! এখন, কিরূপে আমরা প্রজ্বলিত হুতাশন হইতে রক্ষা পাই! কিরূপেই বা মূষিকহস্ত হইতে পরিত্রাণ পাই! কি প্রকারে আমাদের পিআর অপত্যোৎপাদন নিষ্ফল হয় এবং কি করিয়াই মাতা জীবিত থাকিবেন! গর্তে প্রবেশ করিলে মূষিকে ভক্ষণ করে, অন্তরীক্ষে থাকিলে অগ্নিদাহে প্রাণ যায়; এই উভয় পক্ষ বিবেচনা করিয়া দেখিলে, গর্তে গিয়া মূষিকমুখে প্রাণত্যাগ করা অপেক্ষা অগ্নিতে ভস্ম হওয়া শ্রেয়ঃকল্প, যেহেতু মূষিকমুখে মৃত্যু হইলে গর্হিত মরণ হইবে, কিন্তু হুতাশনে কলেবর পরিত্যাগ করিলে সদগতি লাভ হইতে পারিবে।