২২৫. অর্জুনের গাণ্ডীবলাভ, কৃষ্ণের গদাচক্রগ্রহণ

২২৫. অর্জুনের গাণ্ডীবলাভ, কৃষ্ণের গদাচক্রগ্রহণ

পঞ্চবিংশত্যধিকদ্বিশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, ভগবান হুতাশন অর্জুনকর্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া উদকমধ্যবাসী জলেশ্বর বরুণদেবকে স্মরণ করিলেন। চতুর্থ লোকপাল সরু তাহার চিন্তা অবগত হইয়া তৎক্ষণাৎ তথায় উপস্থিত হইলেন। ভগবান হুতাশন সমাগত বরুণকে যথোর্কিত সৎকার করিয়া কহিলেন, হে জলেশ্বর! লেমরাজ তোমাকে যে ধনুঃ, তূণীরদ্বয় ও কপি-লক্ষণ রথ প্রদান করিয়াছিলেন, তৎসমুদায় আমাকে শীঘ্র প্রদান কর। পার্থ গাণ্ডীবদ্বারা ও কৃষ্ণ চক্ৰদ্বারা কোনামহৎ কর্ম সম্পাদন করিবেন। বরুণরাজ অগ্নির প্রার্থনায় সম্মত হইয়া যশঃ-কীৰ্ত্তিবৰ্ধন সর্বশস্ত্রপ্রমাথী, সৰ্বায়ুধ-সারভূত সেই বিচিত্রবর্ণ পরমাদ্ভুত দিব্য শরাসন, অক্ষয় তৃণীয় এবং এক রমণীয় রথ প্রদান করিলেন। ঐ রথ সুবর্ণালঙ্কারে ভূষিত রক্তবর্ণ মহাবৈগশালী গান্ধৰ্ব অশ্বগণে সংযোজিত ছিল, উহ সমস্ত যুদ্ধোপকরণসংযুক্ত, দেবদানবগণের অজেয়, সৰ্বরত্ন সুশোভিত কিরণরাজিবিরাজিত, গভীরগর্জ্জনবিশিষ্ট এবং কপিকেতনে অলঙ্কৃত। ভুবনপ্রভু বিশ্বকর্মা ঐ রথ নির্মাণ করিয়াছিলেন। মহারাজ সোম ঐ রথে আরোহণপূর্বক দানবগণকে পরাজয় করিয়াছিলেন। কৃষ্ণ ও অঞ্জন সেই নবমেঘাকৃতি পরম রমণীয় রথের নিকটবর্তী হইয়া ইন্দ্রায়ুধের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। ঐ রথের ধ্বজযষ্টি সুবর্ণময়; উহার উপরিভাগে শালবৎ ভয়ঙ্কর এক প্রকাণ্ডকলৈবর বানর সন্নিবেশিত এবং ধ্বজে বিবিধ বৃহৎকায় জীবজন্তুর প্রতিমূর্তি নির্মিত আছে। রথের ধ্বনি শ্রবণ করিলে শত্রু। সৈন্যগণ বিলুপ্তচেতন হয়। যেমন সুকৃতি ব্যক্তি বিমানে আরোহণ করে, তদ্রূপ অর্জুন কবচ পরিধান, খড়গধারণ, গোধাঙ্গুলিত্র বন্ধন ও দেবগণকে নমস্কার করিয়া প্রদক্ষিণপূর্বক সেই রথে আরোহণ করিলেন। পরে ব্রহ্মনিৰ্ম্মিত গাণ্ডীবধনুঃ গ্ৰহণ করিয়া সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন। তখন তিনি হুতাশন-সমক্ষে বলপূর্বক ধনুঃ গ্ৰহণ করিয়া তাহাতে জ্যারোপণ করিলেন। জ্যারোপণকালে এরূপ ভয়ানক শব্দ হইতে লাগিল যে, উহা শ্রবণে সকলেরই মন ব্যথিত হইল। কুন্তীনন্দন অর্জুন রথ, ধনুঃ ও অক্ষয় তূণীরদ্বয় প্রাপ্ত হইয়া অতিমাত্র সন্তুষ্ট হইলেন।

তদনন্তর ভগবান্ হুতাশন কৃষ্ণকে সুদর্শনাস্ত্র প্রদান করিলেন এবং কহিলেন, হে মধুসূদন! তুমি এই চক্ৰদ্বারা যুদ্ধে দেবদনিবদিগকেও অনায়াসে পরাজয় করিতে পারিবে। কি মনুষ্য, কি দেব, কি রাক্ষস, কি পিশাচ, কি দৈত্য, কি না, তুমি যুদ্ধে সর্বাপেক্ষা সমধিক-প্রভাবসম্পন্ন এবং তাহাদের পরাজয়ে সমর্থ হইবে সন্দেহ নাই। হে মাধব! তুমি শত্রুর প্রতি যতবার এই চক্র নিক্ষেপ করিবে, ইহা ততবারই শক্ত নিপাত করিয়া পুনরায় তোমার হতে আসিবে। তৎপরে বরুণদেব কৃষ্ণকে দৈত্যান্তকারিণী কৌমে দকীনামী গদা প্রদান করিলেন। ঐ গদায় শব্দ বজ্রনির্ঘোষের ন্যায় ভয়ঙ্কর।

তখন অস্ত্রশস্ত্রসম্পন্ন রথারূঢ় কৃষ্ণ ও অর্জুন অগ্নিকে কহিলেন;–হে ভগবন্! এক্ষণে আমরা সমস্ত সুরাসুরগণের সহিতও যুদ্ধ করিতে পারি, ইন্দ্র একাকী পমগের নিমিত্ত যুদ্ধ করিয়া আমাদের নিরিবেন? অর্জুন কহিলেন, এক চক্রপাণি যুদ্ধে ভ্রমণপূর্বক চক্রাস্ত্র নিক্ষেপ করিলে যাহা না করিতে পারে, এমন কাৰ্য ত্রিজগতে লক্ষ্য হয় না; বিশেষতঃ আমি আবার গাণ্ডীব ধনুঃ ও অক্ষয় তূণীর লইয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছি, অতএব হে পাবক! আপনি খাণ্ডববনের চতুর্দিকে প্রজ্বলিত হইয়া নিঃশঙ্কচিত্তে উহা দগ্ধ করুন; আমরা আপনার সাহায্য করিতেছি।

ভগবান্ হুতাশন, কৃষ্ণ ও অর্জুন কর্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া তৈজসরূপ গ্রহণপূর্বক সপ্ত শিখা বিস্তার করত চতুর্দিকে প্রজ্বলিত হইয়া খাণ্ডবারণ্য দগ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন, তৎকালে যুগান্তকালের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। ঘন ঘটার গভীর নির্ঘোষের ন্যায় এব্দলিত নলের শব্দ শ্রবণে সমস্ত জীবজন্তু কম্পান্বিতকলেবর হইল। খাণ্ডবারণ্য হুতাশন কর্তৃক দহমান হইয়া সূৰ্য্যকিরণে ব্যাপ্ত পৰ্বতে মেরুর স্থায় শোভা পাইতে লাগিল।