২২০. সুভদ্রাহরণ, অর্জুনের বিরুদ্ধে যাদবগণের যুদ্ধসজ্জা, বলরামের রোষপ্রকাশ

২২০. সুভদ্রাহরণ, অর্জুনের বিরুদ্ধে যাদবগণের যুদ্ধসজ্জা, বলরামের রোষপ্রকাশ

বিংশত্যধিকদ্বিশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে এই সংবাদ প্রদান ও তাহার মত গ্রহণপূর্বক রৈবতকপৰ্বতে সুভদ্রা গমন করিয়াছেন, ইহা অবগত হইয়া তথায় যাইবার নিমিত্ত বাসুদেবের অনুজ্ঞা লাভ করিলেন। তিনি কবচ, বর্ম ও অঙ্গুলিস্রাণ ধারণপূর্বক সুবর্ণাকঙ্কিণীজালালঙ্কত অস্ত্রশস্ত্রোপেত প্রজ্বলিত হুতাশনকল্প অপূৰ্ব দিব্যরথে আরোহণপূর্বক মৃগয়াব্যপদেশে কৃষ্ণকে ইতিকৰ্তব্যতা নিবেদন করত রৈবতক পর্বতে গমন করিলেন।

এদিকে সুভদ্রা মহাগিরি রৈবতক ও দেবতাদিগকে অর্চনা ও দ্বিজাতিগণের আশীর্বাদ গ্রহণপূর্বক শৈলকে প্রদক্ষিণ করিয়া দ্বারকাভিমুখে যাত্রা করিতেছেন, ইত্যবসরে মহাবীর অর্জুন মদনবাণে একান্ত আহত হইয়া সেই সর্বাঙ্গসুন্দরী সুভদ্রাকে বলপূর্বক গ্রহণ করিয়া রথে আরোহিত করিলেন।

তদনন্তর তিনি সুভদ্রাকে সেই সুবর্ণময় রথে আরোহিত করিয়া নিজ রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থে প্রস্থান করিলেন। সৈনিক পুরুষেরা সুভদ্রাকে অপহৃতা দেখিয়া মহাকোলাহলপূর্বক দ্বারকাপুরীর উভয়পর্শে ধাবমান হইল। তাহারা তত্ৰত্য সুধর্মানামী সভায় সমুপস্থিত হইয়া সভাপিলসন্নিধানে অর্জুনের বলবিক্রমের বিষয় সমুদায় নিবেদন করিল। সভাপাল সৈন্যমুখে সুভদ্রাহরণ বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া মহাসুবর্ণময় রণভেরী বাদন করিতে লাগিলেন। সেই ভেরীরব শ্রবণ করিবামাত্র ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয়রা অতিমাত্র ক্রুদ্ধ হইয়া অনুপান পরিত্যাগপূর্বক চতুর্দিক হইতে আগমন করিতে লাগিলেন। তাহার। তথায় উপস্থিত হইয়া বিচিত্র মণিবিক্রমাদিখচিত, অপূৰ্ব আস্তরণপটে আচ্ছাদিত, শত শত সুবর্ণময় সিংহাসনে প্রজ্বলিত হুতাশনের ন্যায় উপবিষ্ট হইলেন। সভাপাল অনুচরবর্গের সহিত সমুপবিষ্ট দেবতুল্য যাদবদিগের নিকট অর্জুন-বৃত্তান্ত সমস্ত বর্ণন করিলেন।

মহাবীর যাদবেরা অর্জনের এই অসহ অত্যাচার শ্রবণে ক্রোধে লোহিতলোচন হইয়া অহঙ্কার প্রকাশপূর্বক আসন হইতে উত্থিত হইয়া তৎক্ষণাৎ সারথিদিগকে আদেশ করিলেন, তোমরা শীঘ্র রথযোজনা কর এবং প্রাস, মহা ধনুঃ ও বৃহৎ কবচ সকল অনিয়ন কর। কেহ কেহ উচ্চৈঃস্বরে সারথিকে আহ্বান করিয়া রথযোজনা করিতে আদেশ দিলেন। কেহ বা স্বয়ংই সুবর্ণালঙ্কত তুরঙ্গমগণ যানে যোজনা করিতে লাগিলেন। রথ, কবচ এবং ধ্বজপতাকা সকল আনয়ন করিলে, সেই বীরসম্মর্দ তুমুল হইয়া উঠিল। তদনন্তর মধুপামে মত্ত নীলাম্বরধর মহাবীর হলধর তাহাদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে বীরগণ! তোমরা কি করিতেছ? কৃষ্ণ মৌনভাবে রহিয়াছেন, তাঁহার অভিপ্রায় না জানিয়া ক্রোধ প্রকাশ করা, কিম্বা তর্জন গর্জন করা সকলই বৃথা; বৃথা কেন আস্ফালন করিতেছ? মহামতি বাসুদেব প্রথমতঃ স্বীয় অভিপ্রায় ব্যক্ত করুন, পরে ইহার যেরূপ ইচ্ছা, তোমরা তদনুসারে কাৰ্য করিবে। বলদেবের এইরূপ যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণগ্যেবাক্য শ্রবণ করিয়া তাহারা সকলেই সাধুবাদ প্রদানপূর্বক মৌনভাব অবলম্বন করিয়া রহিলেন।

বলদেবের বাক্যাবসানে তাঁহারা পুনরায় সভামধ্যে উপবেশন করিলেন। সকদে উপবিষ্ট হইলে বলদের কৃষ্ণকে কহিলেন, হে কৃষ্ণ! দেখ, সকলেই তোমার মুখ নিরীক্ষণ করিতেছে, এ সময়ে কেন মৌনাবলম্বন করিয়া রহিয়াছ? আমরা তোমার উপরোধেই সেই কুলপাংশুল অর্জুনকে সৎকার করিয়াছি, কিন্তু সে সৎকারের উপযুক্ত পাত্র নহে। কোন পুরুষ আপনাকে কুলীন বিবেচনা করিয়া কি, যে পাত্রে ভোজন করে সেই পাত্র চূর্ণ করিয়া থাকে? কোন্ মূঢ় ব্যক্তি পূর্বকৃত সম্বন্ধে আদর ও নূতন সম্বন্ধ সংস্থাপন করিতে ইচ্ছা করিয়া এবং ঐশ্বর্যের অভিলাষ রাখিয়া এইরূপ সাহসিক কাৰ্য্য করিতে সমর্থ হয়? অর্জুন আমাদিগকে তাদৃশ অবমাননা ও তোমাকে অনাদর করিয়া অদ্য বলপূর্বক আপন মৃত্যুস্বরূপ সুভদ্রাকে হরণ করিয়াছে। হে গগাবিন্দ! মস্তকে পদাঘাত-তুল্য তাহার এই অসহ্য অত্যাচার কিরূপে সহ করিব? সর্পকে পদাঘাত করিলে সে কি তাহা ক্ষমা করিয়া থাকে? আমি একাকীই অদ্য এই বসুন্ধরাকে নিকৌরব করিব, অর্জুনের এই ব্যতিক্রম আমি কখনই সহ করিব না। তখন অন্ধকগণও নিবিড় মেঘবৎ গভীরস্বরে গর্জমান বলদেবের বাক্যে অনুমোদন করিলেন।

সুভদ্রাহরণ পর্বাধ্যায় সমাপ্ত।