২১১. সুন্দ-উপসুন্দ সংহার মন্ত্রণা

২১১. সুন্দ-উপসুন্দ সংহার মন্ত্রণা, বিশ্বকর্মার তিলোত্তমাসৃজন, তিলোত্তমা-দর্শনে শিবের চতুরাননত্ব

একাদশাধিকদ্বিততম অধ্যায়।

নারদ কহিলেন,-তদনন্তর সমস্ত দেবর্ষিগণ, সিদ্ধগণ ও পরমর্ষিগণসুন্দোপন্দকৃত সেই উপদ্রব দর্শনে যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইলেন। ঐ সকল জিতক্রোধ, জিতাত্মা ও জিতেন্দ্রিয়গণ জগতের দুরবস্থা দর্শনে অনুকম্পা পরতন্ত্র হইয়া ব্রহ্মার ভবনে গমন করিলেন। তথায় দেখিলেন, সর্বলোকপিতামহ ভগবান্ কমলাসন দেবগণের সহিত সুখে উপবিষ্ট রহিয়াছেন, সিদ্ধগণ ও ব্রহ্মর্ষিগণ তাঁহার চতুর্দিকে উপবিষ্ট রহিয়াছেন। তখন দেবাদিদেব মহাদেব অগ্নি, বায়ু, চন্দ্র, সূর্য, ইন্দ্র, ঋষিগণ, বৈখানসগণ, বালিখিল্যগণ ও মরীচিপায়ী বানপ্রস্থগণ পিমেহের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন; মহর্ষিগণ তথায় গমন করিয়া অতি কাতরম্বরে সুন্দোপন্দকৃত উপদ্রব বৃত্তান্ত আনুপূর্বিক নিবেদন করিলেন। তখন দেবগণ, সিদ্ধগণ ও পরমষিগণও ঐ দানবদ্বয়ের দৌরাত্ম্য-বৃত্তান্ত পিতামইকে জানাইলেন।

ভগবান্ কমলাসন তাঁহাদিগের বাক্য শ্রবণানন্তর কর্তব্য বিষয়ে মুহূর্ত কাল চিন্তা করত সুন্দ ও উপসুন্দকে সংহার করিবার বাসনায় বিশ্বকর্মাকে আহ্বান করিলেন। বিশ্বকর্মা তৎক্ষণাৎ তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। তখন সৰ্বলোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা তাঁহাকে এক সৰ্বাঙ্গসুন্দরী কামিনী নির্মাণ করিতে আদেশ করিলেন। বিশ্বকর্মা “যে আজ্ঞা” বলিয়া ব্রহ্মার বাক্য স্বীকার ও তাঁহাকে নমস্কার করিয়া পুনঃপুনঃ চিন্তা করিয়া তাহার অজ্ঞানুরূপ রমণী নির্মাণ করিতে আরম্ভ করিলেন। ত্রিলোকমধ্যে কি স্থাবর, কি জঙ্গম, যে কোন বস্তু অতীব রমণীয় বলিয়া খ্যাতি বিশ্ববিৎ বিশ্বকর্মা সেই সমস্ত বস্তু তথায় অনিয়ন করিলেন। তিনি নির্মাণকালে সেই কামিনীর গাত্রে কোটি কোটি রত্ন সন্নিবেশিত করিলেন। বিশ্বকর্মা-বিনির্মিত রত্নসংঘাত-খচিত সেই কামিনী ত্রিলোকস্থ সমস্ত মহিলাগণের অধিক্ষেপস্বরূপ হইল। তাহার গাত্রে এমন একটি স্থান ছিল না যে, দর্শকগণের দৃষ্টি যে স্থানে পতিত হইলে আসক্ত না হয়। ফলতঃ মূর্তিমতী লক্ষমীরূপা সেই কামিনী সর্বভূতের মনোনয়নহারিণী হইলেন। ঐ লোকলোমভূতা ললনা রত্নসমূহের তিল তিল অংশ লইয়া নির্মিত হইয়াছিল বলিয়া সৰ্বলোকপিতামহ ব্রহ্ম তাঁহার নাম, তিলোত্তমা রাখিলেন। তিলোত্তমা ব্রহ্মাকে নমস্কার করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিল, ভগবন্! কি নিমিত্ত আমাকে সৃষ্টি করিলেন, আজ্ঞা করুন। ব্রহ্মা কহিলেন, তিলোত্তমে! তুমি দানবরাজ সুন্দ ও উপসুন্দের সমীপে গমনপূর্বক স্বীয় রূপসম্পত্তিদ্বারা তাহাদিগকে এইরূপে প্রলোভিত কর, যেন তাহারা তোমার অলোক সামান্য রূপলাবণ্য দর্শনে মুগ্ধ হইয়া পরস্পর বিরোধ করে।

তিলোমা “যে আজ্ঞা” বলিয়া পিতামহকে নমস্কার করিল এবং দেবগণকে প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল। দেবসভায় ভগবান বিষ্ণু পূর্বমুখে, মহেশ্বর দক্ষিণ মুখে, অন্যান্য দেবগণ উত্তরমুখে এবং ঋষিগণ সর্বতোমুখে উপবিষ্ট ছিলেন। তিলোত্তমা অতি সাবধানতাপূর্বক ভগবান্ মহাদেবকে ও ইন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করিল। প্রদক্ষিণকালে সে মহাদেবের দক্ষিণ পার্শ্বে গমন করিলে তদীয় অলোকসামান্য লাবণ্য দর্শনার্থ দক্ষিণ দিকে তাঁহার এক মুখ নির্গত হইল, পশ্চাৎভাগে গমন করিলে পশ্চাৎভাগে আর এক মুখ নির্গত হইল এবং উত্তরদিকে গমন করিলে সে দিকেও আর একটি মুখ নির্গত হইল। ভগবান্ পুরন্দরের ও সর্বাঙ্গে অতি বিশাল সহস্রলোচন অবিভূত হইল। এইরূপে পূৰ্বকালে ভগবান্ মহাদেব চতুর্মুখ এবং বলনিসূদন ইন্দ্র সহস্রলোচন হইয়াছিলেন। অধিক কি বলিব, তৎকালে সৰ্বলোক-পিতামহ ব্ৰহ্মা ব্যতীত তত্রস্থ সমস্ত দেবগণ ও ঋষিগণ তিলোত্তমার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া রহিলেন। এইরূপে তিলোত্তমা দেবগণকে প্রদক্ষিণ করিয়া সুন্দ ও উপসুন্দকে প্রলোভিত করিতে গমন করিল। তিলোত্তমা গমন করিলে দেবগণ ও পরমষিগণ তাহার অতীব রমণীয় রূপলাবণ্য স্মরণ করিয়া পিতামহের অভিসন্ধি সিদ্ধপ্রায় বিবেচনা করিলেন। পরিশেষে ভগবান্ ভূতভাবন কমলযোনি সমস্ত ঋষিগণ ও দেবগণকে বিদায় করিলেন।