২১০. স্বর্গে মর্ত্যে সুন্দ-উপসুন্দের উপদ্রব

২১০. স্বর্গে মর্ত্যে সুন্দ-উপসুন্দের উপদ্রব

দশাধিকদ্বিশততম অধ্যায়।

নারদ কহিলেন,—এইরূপে দৈত্যপুর আনন্দে পরিপূর্ণ হইল; দানবেন্দ্র সুন্দ ও উপসুন্দ ত্রৈলোক্য জয় করিবার মানসে মন্ত্রণা করিয়া সৈন্যগণকে সজ্জিত হইতে আদেশ করিল। তৎপরে তাহারা সুহৃদগণ, বৃদ্ধ দৈত্যগণ ও মন্ত্রিগণের অনুজ্ঞা গ্রহণপূর্বক মঘনিক্ষত্রযুক্ত রজনীতে স্থানিক মঙ্গলাচরণ করত গদা, পটিশ, শূল, মুদগর প্রভৃতি বহুবিধ অস্ত্রশস্ত্রধারিণী দানববাহিনী সমভিব্যাহারে যুদ্ধযাত্রা করিল; গমনকালে চারণগণ মাঙ্গলিক স্তুতি পাঠ করিয়া তাহাদের প্রতিবর্ধন করিতে লাগিল।

তদনন্তর সেই যুদ্ধদুর্মদ কামচারী দানবদ্বয় অন্তরীক্ষে গমন করত দেবগণের ভবনে প্রবেশ করিল। দেবগণ তাহাদের আগমন দেখিয়া এবং ব্ৰহ্মার বরদানের বিষয় জানিতে পারিয়া স্বর্গ পরিত্যাগপূর্বক ব্ৰহ্মলোকে প্রস্থান করিলেন। সুন্দ ও উপসুন্দ অনায়াসে ইন্দ্রলোক জয় করিয়া যক্ষ রক্ষঃ প্রভৃতি খেচরগণের প্রাণ নাশ করিতে লাগিল এবং ক্রমে ক্রমে রসাতলস্থ নাগগণ ও সমুদ্রতীরবাসী ম্লেচ্ছজাতিদিগকে জয় করিল। পরে সমস্ত মেদিনীমণ্ডল-বিজয়ার্থী মহাবল পরাক্রান্ত দানবদ্বয় স্বীয় সেনাগণকে আহ্বান করিয়া কহিল, দেখ, রাজর্ষিগণ মহাষজ্ঞদ্বারা এবং দ্বিজগণ হব্য-কব্যদ্বারা দেবগণের তেজঃ, বল ও সম্পত্তি পরিবর্ধিত করিতেছে; চল, আমরা সকলে একত্র হইয়া সেই অসুরদ্বেষী দুষ্ট রাজগণ ও ব্রাহ্মণগণের প্রাণ নাশ করি। সুন্দ ও উপসুল সৈন্যগণকে এইরূপ আদেশ করিয়া মহাসমুদ্রের পূর্ব তীরে গমন করিল; তথায় যে সকল ব্রাহ্মণেরা যজ্ঞ করিতেছিলেন এবং যাঁহারা যজ্ঞ করাইতেছিলেন, তাঁহাদিগকে বিনাশ করিল। সৈন্যগণ তপোধনদিগের আশ্রমস্থিত অগ্নিহোত্র লইয়া জলে নিক্ষেপ করিল। মুনিগণ ক্রুদ্ধ হইয়া শাপ দিতে লাগিলেন, কিন্তু ব্রহ্মার বর প্রভাবে সে শাপ কোন কাৰ্যকারক হইল না। যখন তপোবনের দেখিলেন, তাহাদের শাপ শিলানিক্ষিপ্ত শিলামুখের ন্যায় ব্যর্থ হইল, তখন তাহারা অগত্যা তপোনুষ্ঠান পরিত্যাগপূর্বক পলায়নপরায়ণ হইলেন। অধিক কি কুজিব, পৃথীতলে যে সমস্ত মহর্ষিগণ তপঃসিদ্ধ, দান্ত ও শমপরায়ণ ছিলেন, তাঁহারাও গরুড়ভয়ে ভীত সর্পগণের ন্যায় পলায়ন করিতে লাগিলেন। তাহাদিগের উপদ্রবে অশ্রম সকল ভয় ও কলস শ্রুব প্রভৃতি যজ্ঞীয় দ্রব্য সামগ্ৰীসকল চতুর্দিকে বিকীর্ণ হইল। ফলতঃ তৎকালে সমুদায় জগৎ কালগ্রস্তের ন্যায় শূন্যপ্রায় বোধ হইতে লাগিল।

এইরূপে মহর্ষিগণ পলায়ন করিলে সুন্দ ও উপসুন্দ তাহাদিগকে বিনাশ করিরার মানসে নানাপ্রকার কৌশল আরম্ভ করিল। তাহারা কখন মদস্রাবী মও কুঞ্জরের রূপ ধারণপূর্বক দুর্গমধ্যে লুকায়িত ঋষিগণকে বধ করিত; কখন সিংহরূপী কখন বা ব্যাঘ্ররূপী হইয়া তপোধনগণের প্রাণ সংহার করিত। সেই দুর্দান্ত দানবদ্বয়ের দৌরাত্ম্যে বহুসংখ্যক নৃপতিগণ ও ব্রাহ্মণগণ প্রাণত্যাগ করিলেন। যজ্ঞানুষ্ঠান ও বেদাধ্যয়ন একবারে রহিত হইল; উৎসবের সম্পর্ক ও রহিল না। চতুর্দিকে কেবল হাহাকার শব্দ, সকলেই ভয়ে কম্পান্বিত কলেবর। ক্রয়-বিক্রয়-ব্যবহার এবং কৃষি গোরক্ষা কাৰ্য্য সমুদায় নিবৃত্ত হইল; দেবকাৰ্য্য, পিতৃকাৰ্য্য ও পুণ্যেদ্বাহ প্রভৃতি শুভ কর্ম সকল বিলুপ্ত প্রায় এবং নগর ও অশ্ৰম সমুদায় উৎস হইয়া গেল। চতুর্দিকে কেবল অস্থি ও কঙ্কাল দৃষ্ট হইতে লাগিল। তৎকালে ভূমণ্ডল একেবারে দুক্ষ্যে হইয়া উঠিল। চন্দ্র সূৰ্য্য প্রভৃতি গ্রহগণ, তারা সমুদায়, নক্ষত্রমণ্ডল ও অন্যান্য দেবগণ সেই কুরকর্ম। দানবদ্বয়ের নৃশংসাচরণ দর্শনে বিষাদসাগরে নিমগ্ন হইলেন। এইরূপে সুদ ও উপসুল কুর-কর্মদ্বারা সমস্ত দিক বিজয়, করিয়া নিষ্কণ্টকে কুরুক্ষেত্রে বাস করিতে লাগিল।