২০৫. বিদুরের হিতোপদেশ

২০৫. বিদুরের হিতোপদেশ

পঞ্চাধিকদ্বিশততম অধ্যায়।

বিদুর কহিলেন, মহারাজ! বান্ধবগণ আপনাকে অবশ্যই হিতোপদেশ প্রদান করিবেন, কিন্তু আপনার শ্রবণেচ্ছা না থাকিলে সেই বাগজাল সকলই বিফল হইবে। কুরুপ্রধান ভীষ্ম আপনাকে প্রিয় ও হিতবাক্যে উপদেশ দিয়াছিলেন, কিন্তু আপনি তাহা গ্রহণ করিলেন না এবং দ্ৰোণও বহুতর শ্রেয়স্কর কথা কহিয়াছিলেন, কিন্তু রাধাপুত্র কর্ণ তাহা আপনার হিতকর বিবেচনা করিলেন না। এক্ষণে এই দুই পুরুষসিংহ অপেক্ষা কোন ব্যক্তি অধিক বুদ্ধিমান ও আপনার পরম মিত্র, ইহা ভাবিয়া স্থির করিতে পারিতেছি না। ইহার বিদ্যা, বুদ্ধি ও বয়ক্রমে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং আপনার ও যুধিষ্ঠিরাদির প্রতি সমভাবে স্নেহ করিয়া থাকেন। ইহার সত্যাচরণ ও ধর্মানুষ্ঠান বিষয়ে দাশরথি রাম ও গয় অপেক্ষা কোন অংশে নুন নহে। ইহারা পূর্বে কদাচ আপনাকে অহিত কাক্যে উপদেশ দেন নাই এবং আপনার কোনরূপ অনিষ্ট চেষ্টা পাইয়াছেন, ইহাও লক্ষ্য হয় না; অতএব এক্ষণে দ্রোণ ও ভীষ্ম মহারাজের অশুভসঙ্কল্পে মন্ত্রণা করিবেন, ইহা নিতান্ত অশ্রদ্ধেয়। এই জীবলোকে এই দুই ব্যক্তিই অধিকতর প্রাজ্ঞ ও শ্রেষ্ঠ, সুতরাং ইহারা আপনাকে কখন কূটপরামর্শ প্রদান করিবেন না। আর ইহারা অর্থলোলুপ হইয়া অন্যতর পক্ষে পক্ষপাত প্রদর্শনপূর্বক মন্ত্রণা করিবেন, ইহাও নিতান্ত অসম্ভব। অতএব হে মহারাজ! আপনকার পক্ষে ইহাই শ্রেয়ঃকল্প বোধ হইতেছে। দুর্য্যোধন প্রভৃতি যেমন আপনার পুত্র, পাণ্ডবেরাও তদ্রূপ পুত্রস্থানীয় সন্দেহ নাই; যাহারা এই বৃত্তান্ত সম্যক্ না জানিয়া পাণ্ডবপক্ষে কুমন্ত্রণা প্রদান করিবেন, সেই মন্ত্রী কোন অংশে সাধুদশী নহেন। কিন্তু যদি আপনি স্বীয় সত্তানগণের নিমিত্ত অন্তঃকরণে কোন বিশেষ অভিসন্ধি করিয়া থাকেন, আর মন্ত্রীগণ যদি তাহা প্রকাশ করেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আপনার হিতানুষ্ঠান করা হইবে না। মহাত্মা ভীষ্ম ও দ্রোণাচাৰ্য্য এই নিমিত্ত আপনার মনোগত ভাব জিজ্ঞাসা করেন নাই।

হে মহারাজ! ইঁহারা যে পাণ্ডবদিগের অজেয়ত্ব কীর্তন করিলেন, তাহার যথার্থবিষয়ে কোন সন্দেহ করিবেন না, আপনার মঙ্গল হউক। দেবরাজ ইন্দ্র কি সেই শ্ৰীমান অর্জুনকে যুদ্ধে পরাজয় করিতে পারেন? অযুত মাতঙ্গতুল্য বলশালী ভীমসেনকে দেবতারাও সংগ্রামে পরাজয় করিতে সমর্থ নহেন। কোন্ ব্যক্তি জীবনেচ্ছা সত্বে সেই যম সদৃশ যমজ নকুল সহদেবকে যুদ্ধে পরাজয় করিতে অগ্রসর হইবে? ধৈৰ্য্য, ক্ষমা, সত্য ও দয়াগুণে অলঙ্কত পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে রণে সহ করে, এমন লোক ত্রিজগতে লক্ষ্য হয় না। বিশেষতঃ বলদেব ও সাত্যকি যাঁহাদিগের পক্ষ, বাসুদেব মন্ত্রী, পাঞ্চালরাজ শ্বশুর এবং মহাবল পরাক্রান্ত ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি ভ্রাতৃবর্গ শ্যালক, সেই দুর্জয় পাণ্ডবেরা যুদ্ধে কাহাকে না পরাজয় করিতে পারেন? অতএব এক্ষণে তাহাদিগকে নিতান্ত দুর্জয় বিবেচনা করিয়া ধর্মানুসারে পৈতৃক ধন বিভাগ করিয়া দিন। অদ্য পাণ্ডবদিগের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়া পুরোচনকৃত যে মহতী অকীর্তি ত্বংকৃত বলিয়া লোকবিদিত হইয়াছে, তাহা ক্ষালন করুন। পণ্ডিবগণের প্রতি অনুগ্রহ ও তাঁহাদিগের জীবন আমাদিগের ক্ষত্রিয়-জাতির সর্বতোভাবে শ্রেয়স্কর। পূর্বে মহারাজ দ্রুপদের সহিত আমাদিগের বৈরভাব ছিল, এক্ষণে তাহাকে সংগ্রহ করিলেও স্বপক্ষের মঙ্গল করা হইবে। যাদবের বহুসংখ্যক ও মহাবল পরাক্রান্ত, বিশেষতঃ যে পক্ষে কৃষ্ণ, তাহারাও সেই পক্ষে অবশ্যই থাকিবেন, সুতরাং যে পক্ষে কৃষ্ণ, তৎপক্ষে নিশ্চয়ই জয়লাভ হইবে। হে রাজন! যে কাৰ্য্য সন্ধিদ্বারা সম্পাদন করিতে পারা যায়, কোন্ হতভাগ্য ব্যক্তি তাহার নিমিত্ত বিগ্ৰহ করিতে উদ্যত হইয়া থাকে।

মহারাজ! পৌর ও জনপদবর্গ, পাণ্ডবেরা জীবিত আছেন শুনিয়া, তাহাদিগকে দেখিবার নিমিত্ত অতিমাত্ৰ উৎসুক হইয়াছে; এক্ষণে তাহাদিগের প্রিয়কার্য সম্পাদন করুন। দুৰ্য্যোধন,কর্ণ ও শকুনি, ইহারা নিতান্ত অধার্মিক, দুর্ব দ্ধি ও বালক, ইহাদিগের কথায় কর্ণপাত করিবেন না। আমি পূর্বেই ত কহিয়াছি, দুর্যোধনের অপরাধে এই সুবিস্তীর্ণ রাজবংশ উচ্ছিন্ন হইবে।