১৯৭. কৃষ্ণার বহুস্বামিকতা-সিদ্ধান্ত

১৯৭. কৃষ্ণার বহুস্বামিকতা-সিদ্ধান্ত

সপ্তনবত্যধিকশততম অধ্যায়।

ব্যাসদেব কহিলে, হে রাজন! পূর্বে দেবতারা নৈমিষারণ্যে এক মহাস আরম্ভ করেন। সেই সত্ৰে স্বৈত যম ব্ৰতী হইয়াছিলেন। তিনি ঋজ্ঞ দীক্ষিত হইয়া অবধি এজাবিনাশরূপ স্বীয় কৰ্তব্য কর্মে বিরত থাকেন, সুতরাং অনতিকাল বিলম্বে প্রজাসংখ্যা বহুল হইয়া উঠিল। সোম, শুক্র, বরুণ, কুবের, রুদ্র, বসুগণ, অশ্বিনীকুমার এবং অন্যান্য দেবতারা মিলিত হইয়া বিশ্বপ্রণেত প্রজাপতির নিকট গমন করিলেন এবং সর্বলোকপিতামহকে নিবেদন করিলেন, হে লোকনাথ! আমরা মনুষ্যসংখ্যার বৃদ্ধি দেখিয়া সাতিশয় ভীত হইয়াছি, এক্ষণে যাহাতে নিরুদ্বিগ্নচিতে সুখে কালযাপন করিতে পারি, এই আশয়ে আপনার শরণাগত হইলাম। পিতামহ কহিলেন, তোমরা অমর; মনুষ্যজাতির নিকট তোমাদের ভয়ের বিয়য় কি? দেবতারা কহিলেন, মর্ত্যলোক দেবলোক তুল্য হইয়াছে, কিছুমাত্র বিশেষ নাই, এই নিমিত্ত অমিরা উদ্বিগ্ন হইয়া প্রভেদকরণ মানসে আপনার নিকট আগমন করিলাম। ভগবান্ প্রত্যুত্তর করিলেন, যম যজ্ঞে ব্যাপৃত রহিয়াছেন বলিয়া লোকের মৃত্যু হইতেছে না। তাহার সত্ৰ সমাপনীনন্তর নরলোকের অন্তকাল উপস্থিত হইবে। তোমাদিগের বলবীর্যে যমের শরীর অলঙ্কত ও সবল হইয়া উঠিবে। তৎকালে নরলোকের শৌর্য বীৰ্য্য থাকিবে না।

তাঁহারা বিধাতার বাক্য শ্রবণানন্তর যে স্থানে দেবতারা যজ্ঞ করিতেছিলেন, তথায় যাত্রা করিলেন। পথে গমন করিতে করিতে তাহারা বিশ্রাম ভাগীরথীতীরে উপবেশন করিলেন। ইত্যবসরে গঙ্গাজলে একটা সুবর্ণ পদ্ম তাঁহাদের নয়নগোচর হইল। তদ্দর্শনেতাঁহারা সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন এবং তাহার তথ্যানুসন্ধানৰ্থ মহাবল ইন্দ্র সন্নিকটস্থ প্রদেশে ভ্রমণ করিতে করিতে দেখিলেন যে, যে স্থানে ভাগীরথী প্রভূতরূপে প্রবাহিত হইতেছেন, সেই স্থানে একটা কামিনী জলার্থিনী হইয়া গঙ্গায় অবগাহনপূর্বক রোদন করিতেছেন। তাহার অশ্রুবিন্দু গঙ্গাজলে পতিত হইয়। কাঞ্চনপদ্মরূপে পরিণত হইতেছে। ইন্দ্র সেই অদ্ভুতব্যাপার অবলোকন করিয়া নিকটবর্তী হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ভদ্রে! তুমি কে? কাহার নিমিত্ত রোদন করিতেছ? তাহা যথার্থ করিয়া বল। ললনা কহিলেন, হে দেবরাজ! আমি যে এবং যে নিমিত্ত রোদন করিতেছি, আমার সমভিব্যাহারে কিয়দ্দর গমন করিলে তাহার সবিশেষ জানিতে পারিবেন। তৎশ্রবণে ইন্দ্র সেই স্ত্রীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিয়া অনতিদূরে দেখিলেন, এক পরম সুন্দর যুবা পুরুষ গিরিরাজশিখরোপরি সিংহাসনে অধ্যাসীন হইয়া এক সৰ্বাঙ্গসুন্দরী যুবতী স্ত্রী সমভিব্যাহারে পাশক্রীড়া করিতেছেন। দেবরাজ যুবাকে পাশক্রীড়ায় আসক্ত ও অভ্যাগতসংকার বিমুখ দেখিন্না ক্ৰেধ ভর কহিলেন, এই ভুমগুল আমার অধীন, আমি ইহার প্রভু; আমার সমুচিত সৎকার না করিয়া পাশক্রীড়ায় প্রমত্ত থাকা অতীব অনুচিত। তখন সেই দেব ইন্দ্রকে কুদ্ধ দেখিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া তাঁহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিবামাত্র দেবরাজ তৎক্ষণাৎ স্থাণুর ন্যায় স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন।

পাশক্রীড়া সমাপনানন্তর মহাপুরুষ সেই রোরুদ্যমান স্ত্রীকে কহিলেন, ইহাকে আমার নিকটে আনয়ন কর; আমি ইহাকে এরূপ উপদেশ প্রদান করিব, যাহাতে ইহার শরীরে পুনর্বার দর্প প্রবেশ না করে। তখন সেই স্ত্রী ইন্দ্রকে স্পর্শ করিবামাত্র তদীয় অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সকল শিথিল হওয়াতে তিনি তৎক্ষণাৎ ভূতলে পতিত হইলেন। ইন্দ্রকে তদবহু দর্শনে ভগবান উগ্রতেজাঃ কহিলেন, হে শত্রু! পুনর্বার এরূপ কর্ম কদাচ করিও না। তুমি অপরিমিত বলশালী, অতএব এই পৰ্বত উত্তোলনপূর্বক যে বিবরে সূর্যের ন্যায় তেজস্বী ভবাদৃশ ব্যক্তিরা সমাসীন আছেন, সেই ছিদ্রে তুমিও প্রবেশ কর। ইন্দ্র সেই বিবরানুসন্ধানপূর্বক তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া তুল্যতেজাঃ অন্য চারি জনকে দেখিতে পাইলেন। তাঁহাদিগকে তাদৃশ জ্যোতির্ময় অবলোকন করিয়া “আমিও কি ইহাদিগের ন্যায় হইতে পারি না” দুঃখিতমনে এইরূপ বিতর্ক করিতে লাগিলেন।

অনন্তর ভগবান্ মহাদেব ক্রুদ্ধ হইয়া নেত্র বিস্ফারণপূর্বক ইন্দ্রকে কহিলেন, হে শতক্ৰতো! তুমি বালম্বভাবসুলভ চপলতায় আমাকে অপমান করিয়াছ, অতএব তোমাকে এই গুহামধ্যে প্রবেশ করিতে হইবে। দেবরাজ মহাদেব কর্তৃক এইরূপ অজ্ঞাত হইয়া ভয়ে গিরিরাজমকে পবনচালিত অশপত্রের ন্যায় কম্পিত হইতে লাগিলেন। পরে বিবরপ্রবেশ সময়ে কৃতাঞ্জলিপুটে ত্রিলোচনকে নিবেদন করিলেন, ভগব! অদ্যাবধি আপনাকেই এই অশেষ ভুবনের রক্ষণাবেক্ষণ করিতে হইবে। তুচ্ছ বণে দেবদেব হাস্য করিয়া কহিলেন, ইহা ভবাদৃশ গর্বিত লোকের অধিকার যোগ্য নহে। পূর্বে ইহারাও তোমার ন্যায় গর্বিত ছিলেন; অতএব এই গুহাবিষ্ট হইয়া সকলে একঞ্জ, কালযাপন কর। অধুনা তোমরা স্বীয় গর্হিত কর্মফলে মনুষ্যযোনি প্রাপ্ত হও। পরে জন্মান্তরীণ স্ব স্ব কর্মফলাজ্জিত মহাই ইন্দ্রলোকে পুনরায় গমন করিবে। তোমাদিগের যাহা যাহা কৰ্তব্য তৎসমুদায় আদেশ করিলাম।

শিববাক্য শ্রবণ করিয়া ভূতপূৰ্বেন্দ্রেরে কহিলেন, হে প্রভো! আমরা দেবলোক পরিত্যাগপূর্বক যে স্থানে মোক্ষ অতীব দুষ্প্রাপ্য, সেই নরলোকে গমন করিব; কিন্তু ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্র ও অশ্বিনীকুমার, ইহারাই যেন কোন মানুষীর গর্ভে আমাদিগকে উৎপন্ন করেন। ইহা শ্রবণ করিয়া ঐ মহাদেবকে পুনর্বার কহিলেন, আমি স্বীয় বীর্য্যে কাৰ্যক্ষম এক পুরুষ উৎপাদন করিব, তিনিই ইহাদিগের পঞ্চম হইবেন। ইন্দ্রের এবম্প্রকার কিনতিতে সম্মত হইয়া ভগবান্ উগ্রতেজাঃ তাহাদিগকে স্ব স্ব অভীষ্ট প্রদান করিলেন এবং লোকলোমভূত সেই ললনাকে তাহাদিগের ভাৰ্য্যা নির্দিষ্ট করিলেন। অনন্তর মহাদেব তাহাদিগের সমভিব্যাহারে নারায়ণ সমীপে উপনীত হইলেন। নারায়ণ মহাদেবের নিকট সমস্ত বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া তাহার নির্দিষ্ট নিয়মে অনুমোদন করিলেন। পরৈ ধর্ম প্রভৃতি দেবগণ ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ হইলেন। তাহারা বিদায় হইলে নারায়ণ স্বীয় মস্তক হইতে কেশখুগল উৎপাটন করিলেন। তন্মধ্যে একটি শুক্ল, দ্বিতীয়টি কৃষ্ণবর্ণ। সেই কেশযুগল যদুকুলকামিনী দেবকী ও রোহিণীতে সমাবিষ্ট হইল। শুভ্র কেশ বলদেবরূপে এবং কৃষ্ণ কেশ কেশবরূপে অবতীর্ণ হইলেন; তন্নিমিত্তই লোকে বাসুদেবকে কেশব কহে।

পূর্বে ইন্দ্ররূপী যে মহাপুরুষের অদ্রিগুহায় নিবদ্ধ ছিলেন, তাঁহারাই পাণ্ডবরূপে ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ হইলেন এবং ইন্দ্রের অংশে সব্যসাচী অর্জুন জন্মগ্রহণ করিলেন। পূর্বেগণ এইরূপে পঞ্চপাণ্ডব হইলেন এবং তাহাদিগের বনিতা হইবার নিমিত্ত মহাদেবের উপদেশক্রমে লক্ষ্মী দ্রৌপদীরূপে আবিষ্কৃত হইলেন। মহারাজ! দৈবসংযাগ ব্যতিরেকে কখন কি ধরণীতল হইতে অলোকসামান্য স্ত্রীর সমুৎপন্ন হইতে পারে।

হে নরেন্দ্র! আমি প্রতিপূর্বক আপনাকে অত্যাশ্চর্য দিব্য চক্ষুঃ প্রদান করিতেছি,আপনি সেই দিব্য চক্ষু উন্মীলন করিলে অনায়াসে জানিতে পারিবেন, কুন্তীতনয়েরা পবিত্ৰ পূৰ্বদেহ ধারণপূর্বক জগতীতলে বিচরণ করিতেছেন। মহর্ষি ব্যাস স্বীয় তপঃপ্রভাবে রাজাকে দিব্য চক্ষুঃ প্রদান করিলেন। রাজ৷ তদ্বারা দেখিতে পাইলেন, পাণ্ডবেরা অতি পবিত্র পূর্ব শরীর ধারণ করিয়া রহিয়াছেন। তাঁহাদিগের মস্তকে হেমকিরীট ও সর্বাঙ্গে বিবিধ অলঙ্কার দীপ্তি পাইতেছে। সুচারু রূপলাবণ্যসম্পন্ন তপনতুল্য তেজস্বী সেই তরুণগণ পরিষ্কৃত দিব্য বস্ত্র এবং সুগন্ধ ও রমণীয় মাল্য ধারণ করিয়া অনির্বচনীয় শোভমান হইয়াছেন। রাজা দ্রুপদ সেই পরম সুন্দর ভূতপূর্ব ইন্দ্রদিগকে নয়নগোচর করিয়া এবং ইন্দ্রপ্রতিম-যুবাকে ইন্দ্রাত্মজ শ্রবণ করিয়া যুগপৎ প্রত ও বিস্মিত হইলেন। তিনি মায়াময়ী দ্রৌপদীকে সাক্ষাৎ সোম ও বহুির ন্যায় দীপ্তিমতী দেখিয়া এবং রূপ, তেজঃ ও যশঃপ্রভৃতি সর্বপ্রকারে তাহাকে পাণ্ডবগণের অনুরূপ। পত্নী বিবেচনা করিয়া পরম পরিতুষ্ট। হইলেন। পার্থিবেন্দ্র দ্রুপদ এই অদ্ভুতব্যাপার নেত্রগোচর করিয়া ব্যাসদেবের চরণ গ্রহণপূর্বক নিবেদন করিলেন, মহর্ষে! আপনাতে সকলই সুম্ভবে, আপনার পক্ষে ইহা বিচিত্র নহে। মুনিবর রাজার প্রতি প্রসন্ন হইয়া কহিলেন, মহারাজ শ্রবন করুন।

কোন তপোবনে এক মহর্ষিকন্যা বাস করিতেন। সেই রূপবতী কন্যা পরিণয়কাল অতীত হইলেও অনুরূপ ভর্তৃভাগিনী হইলেন না। অনন্তর তিনি কঠোর তপস্যাদ্বারা ভগবান্ ভবানীপতিকে প্রসন্ন করিলেন। মহাদেব উঁহার প্রতি প্রীত হইয়া স্বয়ং তাঁহাকে কহিলেন, তুমি স্বাভিলষিত বর প্রার্থনা কর। ঋষিকন্যা ত্রিলোচন কর্তৃক এই প্রকার আদিষ্ট হইয়া তাহাকে বারম্বার কহিলেন ভগবন্! আমি সৰ্বগুণসম্পন্ন পতি প্রার্থনা করি। দেবেশ শঙ্কর কন্যার প্রতি প্রীত হইয়া তাহাকে অভিলষিত বর প্রদানপূর্বক কহিলেন, ভদ্রে! তোমার পাঁচজন স্বামী হইবেন। ঋষিতনয়া পুনর্বার মহাদেবকে কহিলেন, প্রভো! আমি এক পতি প্রার্থনা করি। দেবদেব কহিলেন, ভদ্রে! তুমি উপর্যুপরি পাঁচবার, পতি প্রার্থনা করিয়াছ, অতএব জন্মান্তরে তোমার পঞ্চস্বামী হইবে। মহারাজ! আপনার কন্যা সেই দেবরূপিণী মহর্ষিনন্দিনী; ভগবান্ চন্দ্রশেখর ইহার পঞ্চস্বামী বিধান করিয়াছেন। ইনি স্বলক্ষী, পাণ্ডবগণের নিমিত্ত আপনার যজ্ঞে সমুৎপন্ন হইয়াছেন। ইনি অতি কঠোর তপস্যার ফলে আপনার দুহিতৃত্ব লাভ করিয়াছেন। এই সৰ্বাঙ্গসুন্দরী দেবদুলভা দেবী স্বকীয় কর্মফলে পঞ্চপাণ্ডবের সহধর্মিণী হইবেন। স্বয়ম্ভু এই নিমিত্তই ইহার সৃষ্টি করিয়াছেন। এক্ষণে আপনার যেমন অভিরুচি হয়, করুন।