১৯৩. বৈবাহিক পর্বাধ্যায়, পাণ্ডবসহ কৃষ্ণার বিবাহমন্ত্রণা

১৯৩. বৈবাহিক পর্বাধ্যায়, পাণ্ডবসহ কৃষ্ণার বিবাহমন্ত্রণা

ত্রিনবত্যধিকশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! রাজকুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন পিতা কর্তৃক পরিপৃষ্ট হইয়া হৃষ্টচিত্তে যথাযৎ বৃত্তান্ত বৰ্ণন করিয়া কহিতে লাগিলেন, হে পিতঃ! যিনি দেবতুল্য রূপবান্ কৃষ্ণাজিনধারী, যাহার নয়নযুগল আয়ত ও লোহিতবর্ণ, যিনি সেই ধনুতে গুণাধিনরাপণ করিয়া বিনায়াসে লক্ষ্যবিদ্ধ করিয়াছিলেন, যে তরম্বী দ্বিজগণকর্তৃক পরিবেষ্টিত ও পূজ্যমান হইয়া দেবতা ও ঋষিগণে পরিবৃত দানবসভাপ্রবিষ্ট সুধরাজের ন্যায় গমন করিতে লাগিলেন, কৃষ্ণা সানন্দিত নাগবধূর যায় সেই মাগেতুল্য বীরপুরুষের অজিন গ্রহণপূর্বক তাহার অনুবর্তিনী হইলেন।

অনন্তর সেই ক্ষিতিপসমাজে কোন ভূপাল এক প্রকাণ্ড মহীরুহ উৎপাটপূর্বক সমাগত রাজগণকে অবরোধ করিলেন। হে নরেন্দ্র! চন্দ্রসূৰ্যসদৃশ সেই বীরযুগল সমস্ত পার্থিবগণসমকে কৃষ্ণাকে গ্রহণপূর্বক নগরের বহির্ভাগ তাগবঋষির পর্ণশালায় গমন করিলেন। তথায় অবিকল সেই দুই জনের ন্যায় আর তিনটি মহাবীর ও অগ্নিশিখার ন্যায় তেজস্বিনী এক বৃদ্ধা উপবিষ্ট ছিলেন। বোধ হয়, ঐ বৃদ্ধা তাঁহাদিগের জননী হইবেন। অনন্তর তাঁহারা দুইজন সেই বর্ষীয়সীর চরণে অভিবাদনপূর্বক কৃষ্ণাকে প্রণাম করিতে কহিলেন এবং কৃষ্ণা এইস্থানে থাকিলেন, এই বলিয়া সকলে ভিক্ষার্থে গমন করিলেন। কৃষ্ণা তাহাদিগের আহৃত ভৈক্ষ্য গ্রহণপূর্বক তাহার অগ্রভাগ দেবাৎ ও বিপ্রসাৎ করিয়া সেই বৃদ্ধা ও সেই সমস্ত নরপ্রবীরদিগকে পরিবেশন করিলেন, পরিশেষে স্বয়ং ভোজন করিলেন। দ্রৌপদী তাহাদিগের পাদোপাধানস্বরূপ পদতলে শয়ন করিলেন। শয়নান্তে তাহারা গভীর ঘনগর্জনশ্বরে বিচিত্র কথা সকল কহিতে লাগিলেন, কিন্তু তাদৃশ কথাপ্রসঙ্গে ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও শূদ্রের কোন প্রকার উপযোগিতা নাই; অতএব নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, তাঁহারা ক্ষত্ৰকুলজাত হইবে, নতুবা যুদ্ধের কথায় তাহদিগের এত সমাদর কেন? যাহা হউক, এতদিনে আমাদিগের আশা ফলবর্তী হইল। শুনিয়াছি পাণ্ডবেরা অগ্নিদাহ হইতে মুক্ত হইয়াছেন। বোধ হয়, তাঁহাদিগেরই অন্তত শসন সজ্য ও লক্ষ্য বিদ্ধ করিয়াছেন। যার এরূপ জনশ্রুতি হইয়াছে যে, পাণ্ডবেরা প্রচ্ছন্নবেশে দেশে দেশে ভ্রমণ করিতেছেন।

তখন দ্রুপদরাজ হষ্টচিতে পুরোহিতকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, হে দ্বিজোত্তম! আপনি ভার্গবকর্মশালায় গমন করিয়া লক্ষনবেধকারী বীরপ্রচয়ের কুলশীলের পরিচয় জিজ্ঞাসা করুন। পুরোহিত নৃপতির আদেশানুসারে তথায় উপনীত হইয়া বাগাড়ম্বরপূর্বক তাঁহাদিগের ভূরি ভূরি প্রশংসা করিয়া সমগ্র রাজবাক্য অবিকল কহিতে লাগিলেন। মহারাজ। পালেশ্বর আপনাদিকে জানাইয়াছেন যে, তিনি সেই লক্ষ্যবোকে নয়নগোচর করিয়া অপার আনন্দসাগরে মগ্ন ইইয়াছেন। তিনি কহিয়াছেন, আপনারা অরাতিযজ্ঞকে পদাঘাত এবং আমার ও আমার আত্মীয়বর্গের হৃদয় আনন্দিত করুন। মহারাজ পাণ্ডু দ্রুপদের প্রিয় সখা ছিলেন, তন্নিমিত তাঁহার নিতান্ত বাসনা যে, তিনি আপন দুহিতা কোন কৌরবকে সম্প্রদান করেন। তাহার অভিলায় এই যে, অর্জুন তদীয় কন্যার পাণিগ্রহণ করেন, তাহা হইলেই তাহার, পুণ্যকীতি ও সুকৃতি সকলই চরিতার্থতা প্রাপ্ত হয়।

পুরোহিত সমুদায় নিবেদন করিয়া ক্ষান্ত হইলে মহানুভব যুধিষ্ঠির অতি বিনীতভাবে তাঁহাকে সন্দর্শন করিয়া সৰ্মীপন্থ ভীমকে কহিলেন, ইঁহাকে পাদ্য ও অর্থ প্রদান কর। ইনি দ্রুপদরাজের অতীব মান্য পুরোহিত, ইঁহাকে অধিকতর পূজা করা কর্তব্য। ভীম জ্যেষ্ঠের নির্দেশানুসারে তৎসমুদায় সম্পাদন করিলে, ব্রাহ্মণ পূজা পরিগ্রহ করিয়া সুখে অধ্যাসীন হইলেন। যুধিষ্ঠির কহিলেন, পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ যেমন নিষ্কাম হইয়া ও ধর্মপথে দৃষ্টি রাখিয়া কন্যা পণিত করিয়াছিলেন, তদনুরূপ কাৰ্যও করিয়াছেন। তিনি তদ্বিষয়ে কুল, শীল, গোত্র ও জাতির কোন অপেক্ষা করেন নাই। তাঁহার প্রতিজ্ঞ ছিল যে, যিনি কাক সজ্য এবং লক্ষ্য বিদ্ধ করিতে সমর্থ হইবেন, তিনিই কন্যারত্ব লাভ করিবেন। মহাত্মা অর্জুনই সমস্ত রাজমগুল হইতে কৃষ্ণাকে জয় করিয়াছেন। এরূপ ঘটিয়াছে বলিয়া তাহাকে দুঃখ করিতে নিষেধ করিবেন। তাহার এই কন্যাটি অতি রূপবতী ও সুলক্ষণসম্পন্না; বোধ হয়, অচিরাৎ রাজার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইয়ে। সেই কাকে গুণযোজনা কর হীনবল ব্যক্তির অসাধ্য এবং অকৃতান্ত্র নীচকুলজাত ব্যক্তি কোনরুমেই যেই দুর্ভেদ্য লক্ষ্য পাতিত করিতে পারে না। অতএব দুহিতার নিমিত্ত পাঞ্চালরাজের পরিতাপ করিবার আবশ্যকতা নাই। যুধিষ্ঠির পুরোহিত সমক্ষে এই সমস্ত কথা বলিতেছেন, ইত্যবসরে রাজপ্রেরিত অপর এক ব্যক্তি ভোজ্য নিবেদন করিবার নিমিত্ত তথায় সমুপস্থিত হইল।