১৮৯. রাজগণসহ অর্জুনের যুদ্ধ

১৮৯. রাজগণসহ অর্জুনের যুদ্ধ

ঊননবত্যধিকশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন,—রাজা সেই ব্রাহ্মণকে কন্যাদান করিবার অভিলাষ করিলে, ভূপতিগণ সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া পরস্পরের বদন নিরীক্ষণ করিয়া কহিতে লাগিলেন, দ্রুপদরাজ সমাগত রাজমণ্ডলকে তৃণতুল্য জ্ঞান করিয়া বরবর্তিনী দ্রৌপদীকে বিপ্রসাৎ করিবার বাসনা করিয়াছেন। ইনি সমস্ত নাধিপগণকে আহ্বান ও যথাবিধি সৎকারপূর্বক উত্তমরূপ ভোজন করাইয়া পরিশেষে তাদৃশ সম্মান রক্ষা করিলেন না। বস্তুতঃ বৃক্ষ রোপণ করিয়া ফলকালে উম্মলিত করিলেন। অতএব সমধিক গুণসম্পন্ন হইলেও কোনক্রমে ইনি সম্মানযোগ্য হইতে পারেন না, প্রত্যুত উক্ত অপরাধে এই দুরাত্মা নৃপাধমকে সপুত্র বিনষ্ট করিব। কি আশ্চর্য! দেবতুল্য নৃপসমূহের মধ্যে এক ব্যক্তিকেও আপন কন্যার অনুরূপ বিবেচনা করিলেন না। স্বয়ম্বরে ব্রাহ্মণের অধিকার নাই, কেবল ক্ষত্রিয়েরই স্বয়ম্বরবিবাহ শাস্ত্রসম্মত। আর যদি এই কন্যা আমাদিগের মধ্যে কাহাকেও মনোনীত না করে, তাহা হইলে উহাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করিয়া আমরা স্ব স্ব রাজ্যে প্রতিগমন করিব।

যদি ব্রাহ্মণ লোভাকষ্ট হইয়া অথবা নৈসর্গিক চপলতাযুক্ত রাজাদিগের অনভিমত কাৰ্য করেন, তথাপি তিনি অবধ্য। আমরা ব্রাহ্মণের উপকারার্থে রাজ্য, ধন, সম্পত্তি, পুত্র, পৌত্র এবং জীবিতপৰ্যন্তও পরিত্যাগ করিতে পারি। রাজর্ষিগণ অবমানভয়ে স্বধর্ম রক্ষার নিমিত্ত আর অন্য স্বয়স্বরে এইরূপ গতি না হয়, এই অভিপ্রায়ে পদের প্রাণ সংহার করিবার নিমিত্ত হৃষ্টচিত্তে আয়ুধ গ্রহণপূর্বক খাবমান হইলেন। সেই সশস্ত্র ক্রোধান্ধ অসংখ্য রাজশাৰ্দল বেগে ধাবমান হইতেছে,দেখিয়া, দ্রুপদরাজ ভয়ে ব্রাহ্মণদিগের শরণাগত হইলেন। অর্জুন ও ভীমসেন মদাবী গজেস্ট্রের ন্যায় বেগাভিত রাজেন্দ্রদিগকে নিরীক্ষণ করিয়া ধনুর্বাণ গ্রহণ পূর্বক তাহাদিগের সম্মুখীন হইলেন। অমর্ষ প্রদীপ্ত মহীপালেরাও ভীমার্জুনজিঘাংসু হইয়া অস্ত্র গ্রহণপূর্বক যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হইলেন।

অনন্তর অবিচলিত অধ্যবসায় সহকারে মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন হস্তদ্বারা এক মহামহীরুহ উৎপাটনপূর্বক নিষ্পত্র করিলেন এবং লোকান্তক যম যেমন ভীষণ দণ্ড গ্রহণ করেন, তদ্রূপ রিপুনিসূদন ভীম সেই বৃক্ষ গ্রহণ করিয়া অর্জুনের সমীপে দণ্ডায়মান হইলেন। লোকাতীতধীশক্তিসম্পন্ন অচিন্তকর্মা অর্জুন ভ্রাতার পরাক্রম দর্শনে চমৎকৃত হইয়া ভয় পরিত্যাগপূর্বক শরাসন গ্রহণ করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। এই সমস্ত পৰ্যবেক্ষণ করিয়া মহানুভব কৃষ্ণ মহাবীৰ্য্য বলদেবকে কহিলেন, মহাশয়! যিনি এই বিস্তীর্ণ শরাসন, অনায়াসে আকর্ষণ করিতেছেন, ইনিই অর্জুন; তাহাতে আর সন্দেহ নাই। আর যিনি বাহুবলে বৃক্ষ উৎপাটনপূর্বক নিয়ে রাজমণ্ডলে প্রবিষ্ট হইতেছেন, ইহার নাম বৃকোদর। ভীম ব্যতিরেকে যুদ্ধস্থলে ঈদৃশ পরাক্রম প্রদর্শন করিতে পারে, পৃথিবীতে এমন বীর কে আছে? এবং যে কমললোচন গৌরবর্ণ পুরুষ অতি বিনীতভাবে অগ্রে অগ্রে গমন করিতেছেন, ইনি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। আর কুমারতুল্য সুকুমার এই কুমারযুগল দেখিয়া বোধ হইতেছে, ইহারাই নকুল ও সহদে হইবে। শুনিয়াছিলাম যে, পৃথা পুত্রগণ সমভিব্যাহারে সেই ভয়াবহ জতুগৃহদাহ হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছে, তাহা যথার্থ বটে। এই সমস্ত শ্রবণানন্তর নির্জলজলদ সভি বলদেব কৃষ্ণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বাসুদেব! পিতৃষ্বসা পৃথা এবং পাণ্ডবদিগকে বিপদবিমুক্ত শ্রবণ করিয়া অদ্য পরম প্রীত হইলাম।