১৮৮. বিবাহপণ-কার্মুকে অর্জুনের জ্যা রোপন

১৮৮. বিবাহপণ-কার্মুকে অর্জুনের জ্যা রোপন

অষ্টাশীত্যধিকশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! সমাগত সমস্ত মহীপাল এইরূপে পামুখ হইলে অর্জুন উদায়ুধ হইয়া বিপ্রমণ্ডলীমধ্য হইতে গাত্রোত্থান করিলেন। ব্রাহ্মণেরা পার্থকে কাৰ্ম্মকাভিমুখে প্ৰস্থিত দেখিয়া অজিন বিধূননপূর্বক চীৎকার করিয়া উঠিলেন। কেহ কেহ বিমনা হইয়া রহিলেন, কেহ হর্ষিত হইলেন এবং কেহ কেহ বা পরস্পর মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন যে, যাহাতে ধনুর্বেদপারদর্শী শল্যপ্রমুখ সুবিখ্যাত ক্ষত্রিয় সকল অসমর্থ হইয়া প্রস্থান করিলেন, একজন হীলবল অকৃতাস্ত্র সামান্য ব্রাক্ষ্মণকুমার তদ্বিষয়ে কিরূপে কৃতকার্য হইবে! এই ব্যক্তি গর্বিত হইয়াই হউক, অথবা কন্যাগ্রহণহর্ষে মোহিত হইয়াই হউক, কিম্বা বিপ্রভাবসুলভ প্রলোভচপলতাপ্রযুক্তই হউক, পূর্বাপর পর্যালোচনা না করিয়া এই দুষ্কর কাৰ্যে প্ৰবৃত্ত হইতেছে। যদি কৃতকার্য হইতে না পারে, তাহা হইলে সমস্ত রাজগণের নিকট ব্রাহ্মণদিগকে যৎপয়োনাস্তি উপহাসম্পদ হইতে হইবে, সন্দেহ নাই; অতএব ইহাকে গমন করিতে নিবারণ কর। কেহ কেহ কহিলেন, আমরা উপহাসাস্পদ হইব না, আমাদিগের কোনপ্রকার লাঘবও হইবে না এবং রাজাদিগেরও দ্বেষ্য হইব না। কেহ কেহ বলিলেন, এই পীনস্কন্ধ, দীর্ঘবাহু, প্রশান্ত, গম্ভীরাকৃতি, গজেন্দ্রবিক্রম ও মৃগেন্দ্রগতি সুরূপ যুবার আকার ও অবিচলিত অধ্যবসায়দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে যে, ইনি কখনই বিফল প্রযত্ন হইবেন না। ইহার মহীয়সী উৎসাহশীলতা লক্ষিত হইতেছে। যে ব্যক্তি অক্ষম, সে কখন কোন কাৰ্য্যে স্বয়ং প্রবৃত্ত হয় না। ফলতঃ ব্রাহ্মণের অসাধ্য কাৰ্য্য ভূমণ্ডলে দৃষ্টিগোচর হয় না। অনাহার, বাহার, ফলাহার ও দৃঢ়ত, তন্নিবন্ধন ব্রাহ্মণ দেখিতে দুর্বল হইলেও তাহাদিগের অন্তঃসার ও তেজের হ্রাস হয় না। ব্রাহ্মণ সংকই করুন অথবা অসৎ কর্মই করুন, তিনি কদাপি অবমানিত হয়েন না; কারণ সুখজনক ও দুঃখজনক, সামান্য ও মহৎ সমুদায় কাৰ্যই ব্রাহ্মণকর্তৃক সম্পাদিত হইয়া থাকে। দেখ, জামদগ্ন্য পৃথিবীস্থ সমস্ত ক্ষত্রিয়কে পরাভব করিয়াছিলেন,অগস্ত্য স্বীয় ব্ৰহ্মতেজঃপ্রভাবে অগাধ জলনিধি পান করিয়াছিলেন; অতএব সকলে এই স্থানে অবস্থান করিয়া দেখ, এই ব্রাহ্মণতনয় কাৰ্ম্ম কে জ্যা রোপণ করিতেছে। এই কথা শুনিয়া সকলে প্রস্তাবিত বিষয়ে সম্মত হইলেন।

অর্জুন শরাসনসমীপে অচলরং দণ্ডায়মান হইয়া ব্রাহ্মণগণের কথোপকথন শ্রবণ করিলেন। অনন্তর বরপ্রদ মহাদেবকে প্রণামপূর্বক সেই কার্মুক প্রদক্ষিণ করিলেন এবং কৃষ্ণকে স্মরণ করিয়া শরাসন গ্রহণ করিলেন। শিশুপাল, সুনীথ, রাধেয়, দুৰ্য্যোধন, শল্য ও শাল্ব প্রভৃতি ধনুৰ্বেদপারগ নৃসিংহ সকল দৃঢ়প্রযত্নেও যে ধনুঃ সজ্য করিতে পারেন নাই, অর্জুন অবলীলাক্রমে নিমিষমধ্যে সেই শরাসনে জ্যা রোপণপূর্বক পাঁচটি শর গ্রহণ করিলেন, পরে ছিদ্রদ্বারা সেই অতি কষ্টবেধ্য লক্ষ্য বিদ্ধ ও ভূতলে পাতিত করিলেন। অনন্তর অন্তরীক্ষে ও সভামধ্যে মহা কোলাহল হইতে লাগিল। দেবতারা অর্জুনের মস্তকোপরি পুষ্পবর্ষণ করিতে লাগিলেন। সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণেরা স্ব স্ব বসন বিধূননপূর্বক অলক্ষিত হইয়া মহোল্লাস প্রকাশ করিতে লাগিলেন এবং নভোমণ্ডল হইতে চতুর্দিকে পুষ্পবৃষ্টি হইতে লাগিল। বাদ্যকরেরা শতাঙ্গ তুৰ্য বাদন করিতে লাগিল এবং সুকণ্ঠ সূত ও মাগধগণ স্তুতি পাঠ করিতে আরম্ভ করিল।

দ্রুপদরাজ পার্থকে নয়নগোচর করিয়া সাতিশয় প্রীত হইলেন এবং সৈন্যসামন্ত সমভিব্যাহারে তদীয় সহায়তা করিবার মানস করিলেন। অর্জুনের বিজয়শব্দ সমন্তাৎ প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিবে ধাৰ্মিকাণী যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেবের সহিত সত্বর অবাসে প্রত্যাগমন করিলেন। কৃষ্ণা লক্ষ্য বিদ্ধ হইয়াছে দেখিয়া এবং শত্রুপ্রতিম পার্থকে নয়নগোচর করিয়া সহর্ষে মাল্যদান ও শুভ্রবসন গ্রহণপূর্বক কুন্তীতসমীপে গমন করিলেন। অচিন্ত্যকর্ম। পার্থ বিজয়লাভ ও দ্রৌপদীদত্ত মালা গ্রহণপূর্বক দ্বিজাতিগণপরিপূজ্যমান হইয়া পত্নীসমভিব্যাহারে রঙ্গ হইতে বহির্গত হইলেন।