১৮৫. পাঞ্চালদেশে পাণ্ডব গমন

১৮৫. পাঞ্চালদেশে পাণ্ডব গমন

পঞ্চাশীতাধিকশতম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পাণ্ডবেরা ব্রাহ্মণগণের নিকট এইরূপ আদিষ্ট হইয়া পরাজ-পরিরক্ষিত দক্ষিণ পাঞ্চালদেশে গমন করিলেন। গমনকালে বিশুদ্ধাত্মা অকলুষ মহর্ষি দ্বৈপায়নকে সর্শন করিয়া তাঁহার যথাবিধি সংকার করিলেন এবং তৎকৃত সৎকার গ্রহণপূর্বক নানা বিষয়ক কথোপকথনান্তে অনুজ্ঞাত হইয়া দ্রুপদভবনাভিমুখে গমন করিলেন। পথিমধ্যে যে যে স্থানে রমণীয় বন ও সুশোভন সরোবর তাঁহাদিগের নয়নপথে পতিত হইয়াছিল, সেই সেই স্থানে উপবিষ্ট ও গরম হইয়া ধীরে ধীরে গমন করিতে লাগিলেন। স্বাধ্যায়সম্পন্ন, বিশুদ্ধস্বভাব, প্রিয়ম্বদ পাণ্ডুতনয়েরা ক্রমে ক্রমে পাঞ্চালদেশে উপনীত হইয়া স্কন্ধাবার ও নগর নিরীক্ষণপূর্বক এক কুম্ভকারের আলয়ে বাস করিয়া ব্রাহ্মণের বৃত্তি অবলম্বনপূর্বক ভিক্ষাদ্বারা জীবিকা নির্বাহ করিতে লাগিলেন। রাজা যজ্ঞসেনের মনে মনে অভিলাষ হইয়াছিল যে, পাণ্ডুতনয় কিরীটীকে স্বীয় দুহিতা সম্প্রদান করিবেন; কিন্তু তিনি এ কথা কাহারও অগ্রে ব্যক্ত করেন নাই। এক্ষণে স্বাভিলষিত পাত্র পাইবার মানসে এক সুদৃঢ় দুরানম্য শাসন প্রস্তুত করাইলেন এবং কৃত্ৰিম আকাশযন্ত্র নির্মাণ করাইয়া তৎসঙ্গে লক্ষ্য সংস্থাপনপূর্বক ঘোষণা করিয়া দিলেন যে, যে ব্যক্তি এই সজ্য শাসনে শরসন্ধানপূর্বক যন্ত্র অতিক্রম করিয়া লক্ষ্য বিদ্ধ করিতে সমর্থ হইবে, আমি তাহাকেই কন্যা দান করিব।

এইরূপ ঘোষণা শ্রবণে চতুর্দিক হইতে ভূপালগণ আগমন করিতে লাগিলেন। স্বয়ম্বরদিদৃক্ষু ঋষিগণ এবং কর্ণসমভিব্যাহারী দুৰ্য্যোধনপ্রমুখ কুরুবর্গ সমুপস্থিত হইলেন। নানাদিদেশ হইতে কত শত ব্রাহ্মণগণ আসিতে লাগিলেম। দ্রুপদরাজ সমাগত ব্যক্তিদিগের যথোচিত সৎকার করিলেন। রাজগণ তাহা পরিগ্রহ করিয়া স্বয়ম্বর দর্শনার্থে মঞ্চোপরি উপবেশন করিলেন এবং পৌরজনেরা মহাকোলাহল পূর্বক দর্শনমানসে মণ্ডপ সন্নিকটস্থ শিশুমার বৃক্ষোপরি আরোহণ করিল। নগরের প্রাগুত্তর প্রান্তবর্তিনী এক পরিষ্কৃত সমতল ভূমিতে স্বয়ম্বরসমাজ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সভাগৃহ প্রাকার ও পরিখাহারা পরিবেষ্টিত এবং মধ্যে মধ্যে তোরণরজি বিরাজিত ছিল। উহার চারিদিকে সুধাংবলিত সৌধাবলী, তুষারজালজড়িত হিমালয়শিখরের ন্যায় শোতা পাইতেছে। ঐ সকল প্রাসাদের কুট্টিমভূমি রমণীয় মণিময় শিলাপটে উদ্ভাসিত, ঘার সকল সমসূত্রপাতে বিন্যস্ত এবং সোপানশার্গ সমুদায় সুসংঘটিত। বিচিত্র চন্দ্রাতপ ও অপূর্ব মাল্যজাম উহার অতীব মনোহারিণী শোভা সম্পাদন করিতেছে। ঐ প্রদেশ সুবাসিত, গন্ধবারিদ্বারা পরিষিক্ত হইয়াছে। স্থানে স্থানে মহার্হ আসন ও দুগ্ধফেনমিত শয্যা সকল সরিবেশিত রহিয়াছে। কোন স্থানে নৃত্যগীত, কোন স্থানে বাদ্যোদ্যম, কোথাও বা জনগণ নানাবিধ মহোৎসব করিতেছে।

ভূপালগণ রমণীয় বেশভূষা সমাধানপূর্বক তত্ৰত্য বিমানশ্রেণীতে সমাসীন হইলেন এবং পরস্পর স্পৰ্ধাপূর্বক সমাগত নৃপতিদিগকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। পৌরবৃন্দ ও জনপদগণ দ্রৌপদীদর্শনার্থ পরার্দ্ধ মঞ্চেপরি উপবেশন করিলেন। পাণ্ডবেরা সমাগত ব্ৰাহ্মণগণ সমভিব্যাহারে আসন পরিগ্রহপূর্বক পাঞ্চালরাজের ঐশ্বৰ্য্য সন্দর্শন করিতে লাগিলেন।

অনন্তর রাজসভায় নৃত্যগীত আরম্ভ হইল। রত্নোপকরণ ও সুনিপুণ নর্তকগণের অভিনয়দ্বারা সভার শোভা দিন দিন পরিবর্ধিত হইতে লাগিল। সভারম্ভের ষোড়শ দিবসে কৃতাব ভৌপদী অপূৰ্ব বেশভূষা পরিধানপূর্বক বিচিত্র কাঞ্চনী মালা গ্রহণ করিয়া নৃপসমাজে প্রবেশ করিলেন। চন্দ্র বংশীয় পুরোহিত হুতাশনে যথাবিধি আহুতি প্রদানপূর্বক অগ্নির তর্পণ ও ব্রাহ্মণগণের স্বস্তিবাচন করিলেন এবং ভূৰ্য্যাজীবদিগকে বাল্যেদিম করিতে নিবারণ করিলেন। এইরূপে সেই প্রদেশ নিঃশব্দ হইলে ধৃষ্টদ্যুম্ন স্বীয় ভগিনী দ্রৌপদীকে লইয়া রঙ্গমধ্যে উপস্থিত হইলেন এবং ঘন ঘোষণ গভীর স্বরে অর্থবৎ মধুরবাক্যে কহিতে লাগিলেন, হে সমাগত নরেন্দ্রবর্গ। আপনারা শ্রবণ করুন। এই ধনুর্বাণ ও লক্ষ্য উপস্থিত আছে। যিনি যন্ত্রের ছিদ্রদ্বারা পঞ্চ শর নিক্ষেপ করিয়া লক্ষ্য পাতিত করিতে পারিবেন, মদীয় ভগিনী কৃষ্ণা কুলশীল-রূপলাবণ্য-সম্পন্ন সেই মহাত্মার ভাৰ্য্যা হইবেন, সন্দেহ নাই। দ্রুপদপুত্র সভামধ্যে এইরূপ প্রস্তাব করিয়া সমবেত ভূপতিগণের নাম, গোত্র ও কাৰ্যাদি কীর্তনপূর্বক ভগিনীকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন।