১৭৩. সম্বরণের সূর্য্যোপাসনা, সম্বরণের তপতীলাভ, রাজব্যসনে ইন্দ্রের কোপ

১৭৩. সম্বরণের সূর্য্যোপাসনা, সম্বরণের তপতীলাভ, রাজব্যসনে ইন্দ্রের কোপ

ত্রিসপ্তত্যধিকশততম অধ্যায়।

গন্ধর্বরাজ কহিলেন,—হে অর্জুন! অনন্তর সর্বাঙ্গসুন্দরী সূৰ্যতনয়া তপতী রাজাকে এইরূপ কহিয়া পুনরায় অতি সত্বরে আকাশপথে উত্থিত ও অন্তর্হিত হইলেন। রাজাও তথায় পূর্ববৎ ভূতলে পতিত রহিলেন। এই অবসরে রাজমন্ত্রী রাজার অন্বেষণার্থ সৈন্যসামন্তসমভিব্যাহারে সেই নিবিড় অরণ্যানী মধ্যে প্রবেশপূর্বক দেখিলেন, শারদীয় শত্রুধ্বজের ন্যায় রাজা ধরাতলে শয়ন করিয়া আছেন। রাজমন্ত্রী তাহাকে তদবস্থায় ভূতলে পতিত দেখিয়া যেন হুতাশনদ্বারা প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন। তিনি স্নেহবশতঃ অস্ত্যেব্যস্তে সন্নিহিত হইয়া যেমন পিতা পুত্রকে উত্তোলন করেন, তদ্রূপ কামমোহিত মহীপালকে উথাপিত করিলেন। প্রজ্ঞা, বয়স, কীর্তি ও নীতিগুণে সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্রী রাজাকে ভূতল হইতে উত্থাপিত করিলে, তাঁহার মনেজ্বর দূরীকৃত হইল। তিনি তাহাকে উত্থিত দেখিয়া মধুরবাক্যে, সম্বোধনপূর্বক কহিলেন, মহারাজ! কোন শঙ্কা নাই, আপনার মঙ্গল হউক; মন্ত্রী রাজাকে বলবতী ক্ষুৎপিপাসায় একান্ত কাতর দেখিয়া তদীয় মস্তকোরি সুগন্ধি ও সুশীতল জল সেচন করিলেন। তাহাতে তাহার মস্তকস্থিত মুকুট স্ফুটিক হইয়া গেল।

অনন্তর রাজা চৈতন্যলাভ করিয়া মন্ত্রী ব্যতিরেকে সমুদয় সৈন্যসামন্তকে বিদায় করিয়া দিলেন। তাহারা রাজার আদেশপ্রাপ্তিমাত্রে তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিল। সকলে প্রস্থান করিলে রাজা সেই গিরি প্রস্থে বাস করিতে লাগিলেন। তথায় তিনি সূর্য্যদেবের আরাধন! কারবার নিমিত্ত শুচি হইয়া কালিপটে ও উর্ধ্বমগে ভূতলে অবস্থান করিয়া মনে মনে মহর্ষি বশিষ্ঠকে পুরোহিত বরণ করিলেন। রাজা এইরূপে দিবারাত্র এক স্থানে অবস্থান করিতে লাগিলেন। পরে বিপ্রর্ষি বশিষ্ঠ দিবসে তথায় উপস্থিত হইলেন! তপতী নৃপতির মন হরণ করিয়াছেন, মহর্ষি ইহা জানিতে পারিয়াও পুনরায় যোগবলে সমুদায় অবগত হইয়। তাঁহার কাৰ্যসিদ্ধর্থে প্রস্তাব করিলেন। পরে সূৰ্যসমদ্যুতি ঋসি সূৰ্য্য সন্দর্শনের নিমিত্ত উর্দ্ধে উত্থিত হইলে, রাজা একদৃষ্টে তাঁহার পথ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। মহর্ষি কৃতাঞ্জলিপুটে সূর্গসন্নিধানে উপনীত হইয়া প্রতিপূর্বক আপনার পরিচয় দিলেন। মহাতেজাঃ সূর্য্য উঁহার পরিচয় প্রাপ্ত হইয়া স্বাগত প্রশ্নপূর্বক জিজ্ঞাসিলেন, হে মহর্ষে, বল তোমার অভিলাষ কি? আমার নিকটে তুমি যাহা প্রার্থনা করিবে, নিতান্ত দুর্লভ হইলেও আমি তাহা প্রদান করি। বিপ্রর্ষি বশিষ্ঠ এইরূপ অভিহিত হইয় প্রণিপাতপূর্বক প্রত্যুত্তর করিলেন, হে দিবাকর! আমি আপনকার কনীয়সী কন্য। তপতীকে মহারাজ সম্বরণের নিমিত্ত প্রাপন করি। ঐ রাজা পরম ধার্মিক ও অত্যুদার ধীশক্তি সম্পন্ন; তাহার কীর্তিকলাপ অতি বিস্তীর্ণ; তিনিই আপনকার কন্যার একমাত্র উপযুক্ত পাত্র! এই কথা শুনিয়া সূর্য্য কন্যাদান স্বীকার করিয়াও তদায় বাক্যে অভিনন্দন করিয়া কহিলেন, হে মুনে! মহারাজ সম্বরণ সকল রাজলোকের শ্রেষ্ঠ, তুমিও ঋষিদিগের শ্রেষ্ঠ, আর আমার কন্যা তপতীও স্ত্রীলোকের শ্রেষ্ঠ, অতএব এমন সুপাত্রে সম্প্রদান না করিব কেন? এই বলিয় সূৰ্য্য স্বয়ং সর্বাঙ্গসুন্দরী তপতীকে রাজ সম্বরণের নিমিত্ত বশিষ্ঠহস্তে সমর্পণ করিলেন। তখন মহর্ষি তপতীকে প্রতি গ্রহপূর্বক বিদায লইয়া পূনরায় কুরুবংশাবতংস মহারাজ সম্বরণের নিকটে আগমন করিলেন।

রাজা সেই তপনকন্যা তপতীকে বশিষ্ঠ-সমভিব্যাহারে আগমন করিতে দেখিয়া একান্ত সন্তুষ্ট হইলেন। যৎকালে তপতী স্বীয় প্রভাপুঞ্জে নভোমণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়া ভূতলে অবতীর্ণ হয়েন, তখন তিনি মেঘস্খলিত সৌদামিনীর ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। রাজা সমাধিদ্বারা অতি কষ্টে দ্বাদশ দিবস অতিবাহিত করিলে মহর্ষি বশিষ্ঠ তথায় উপনীত হইলেন। হে অর্জুন! এইরূপে মহারাজ সম্বরণ বরদ সূৰ্য্যদেবকে তপস্যাদ্ধারা প্রসন্ন করিয়া বশিষ্ঠের তেজঃপ্রভাবে ভার্য্যা লাভ করেন।

তদনন্তর রাজা সম্বরণ সেই দেবগন্ধর্বসেবিত গিরিশৃঙ্গে বিধিপূর্বক তপতীর পাণি গ্রহণ করলেন। পাণি গ্ৰহণানন্তর তিনি নিতান্ত, ভোগবাসনায় বাধ্য হইয়া উপযুক্ত অমাত্যহস্তে রাজ্যভার সমর্পণ করিলেন। মহর্ষি ও রাজাকে বিহারাভিলাষী দেখিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। ভূপাল সেই গিরিশিখরে ভাৰ্য্যাসমভিব্যাহারে বিহার করিতে লাগিলেন।

হে অর্জুন! এইরূপে তিনি ক্রমাগত দ্বাদশ বৎসর কাননে ও পর্বতে তপতীর সহিত যদৃচ্ছ বিহার করেন। অনন্তর দেবরাজ ইন্দ্র তদীয় রাজ্য মধ্যে দ্বাদশ বৎসর অনাবৃষ্টি করিলেন। সেই ঘোরতর অনাবৃষ্টি দ্বারা সমুদায় স্থাবর জঙ্গম ও প্রজাবর্গ ক্রমশঃ ক্ষয় প্রাপ্ত হইতে লাগিল। সেই দারুণ কাল উপস্থিত হইলে পৃথিবীতে বিন্দুমাত্র জলপাত বা নীহারপাত না হওয়াতে শস্যোৎপত্তির বিলক্ষণ ব্যাঘাত হইতে লাগিল। রাজ্যস্থ লোকেরা ক্ষুধায় একান্ত পীড়িত ও উদ্ভান্তমনাঃ হইয়া স্ব স্ব গৃহ পরিত্যাগপূর্বক দেশ বিদেশে ভ্রমণ করিতে লাগিল। গ্রাম ও নগরীমধ্যে সকলেই ক্ষুধায় অতিশয় কাতর হইয়া পুত্র কলুত্র প্রভৃতি অত্মীয় স্বজন সমুদয় পরিত্যাগপূর্বক দীনভাবে পরস্পর পরস্পরের আশ্রয় লইল। ক্ষুধার্ত, নিরাহার ও শবাকার মনুষ্যসমূহে পরিপূর্ণ নগরী প্রেতপালপরিবৃত যমপুরীর ন্যায় বোধ হইতে লাগিল।

অনন্তর ভগবান্ বশিষ্ঠ লোকের এইরূপ দুরবস্থা দর্শন করিয়া বৃষ্টি করিলেন। রাজা রাজকাৰ্য্য পরিত্যাগ করিয়া বহুকাল বিহার করিতেছিলেন, তাহাকে পত্নীর সহিত পুনরায় রাজধানীতে আনয়ন করিলেন। মহারাজ সম্বরণ পুনর্বার নগরপ্রবেশ করিলে সমুদয় পূৰ্ববং হইল। দেবরাজ মূষলধারে অজস্র বারি বর্ষণ করিতে লাগিলেন। প্রচুর পরিমাণে শস্য উৎপন্ন হইতে লাগিল। গ্রামবাসী ও নগরবাসী লোকেরা সাতিশয় হর্ষ প্রকাশ করিতে লাগিল। এই অবসরে রাজা নিজ সহধর্মিণী তপতীসমভিব্যাহারে দ্বাদশনব্যাপী এক য করিলেন। হে অর্জুন! এই তপনকন্যা তপতী তোমাদিগের পূৰ্ববংশীয়া ছিলেন। রাজা সম্বরণের ঔরসে তপতীর গর্ভে কুরুর জন্ম হয়, এই কারণে তোমাদিগকে “তাপত্য” বলিয়া সম্বোধন করিলাম।