১৭২. তপতির অদর্শনে সম্বরণের মোহ

১৭২. তপতির অদর্শনে সম্বরণের মোহ

দ্বিসপ্তত্যধিকশততম অধ্যায়

গন্ধর্বরাজ কহিলেন, হে অর্জুন! কন্যা অন্তর্হিত হইলে সেই শত্রুপাতন সম্বরণ কামমোহিত হইয়া সহসা ভূতলে নিপতিত হইলেন। রাজাকে তদবস্থ দেখিয়া সেই চারুহাসিনী কামিনী পুনরায় তথায় আবির্ভূত হইলেন এবং হাস্যমুখে ও মধুরবাক্যে সম্বোধন করিয়া রাজাকে কহিলেন, মহারাজ। গাত্রোত্থান কর, তোমার মঙ্গল হইবে; মোহাবেশপরবশ হইয়া তুমি ধরাতলে শয়ন করিয়া রহিয়াছ, ইহা নিতান্ত অসঙ্গত হইতেছে। ভূপতি কন্যার অমৃতময় বাক্য শ্রবণে গাত্রোত্থান করিয়া দেখিলেন, সেই সৰ্বসুলক্ষণ। কন্যা সম্মুখে দণ্ডায়মান রহিয়াছেন। তাঁহাকে দেখিয়া রাজা সন্দিগ্ধকচনে কহিতে লাগিলেন, হে সুন্দরি! আমি কামান্ধ হইয়া তোমার ভজনা করিতেছি, তুমি ভক্তজনের প্রতি অনুকম্পা প্রকাশ কর, আমার প্রাণ বহির্গত হইতেছে। দেখ, তোমার নিমিত্ত পঞ্চশর আমাকে অনবরত তীক্ষ্ণশর প্রহার করিয়াও ক্ষান্ত হইতেছে না। বিষম অনঙ্গরূপ ভুজঙ্গ : একবারেই আমাকে দংশন করিয়াছে। সন্নিহিত হও, যাহা কর্তব্য হয় কর, আমার জীবন নিতাস্তই তোমার অধীন হইয়াছে। তোমার সমাগম ব্যতিরেকে আমি ক্ষণকালও জীবন ধারণ করিতে পারি না। হে বিশাললোচনে! কামশরে প্রাণান্ত হইল; আমার প্রতি অনুকম্পা কর, আমি তোমার একান্ত ভক্ত ও অনুরক্ত; আমাকে পরিত্যাগ করা তোমার উপযুক্ত নহে। তুমি প্রীতিপ্রদর্শনপূর্বক আমাকে পরিত্রাণ কর। তোমার দর্শনকালাবধি স্নেহসঞ্চার হইয়া আমার মন অতিশয় চঞ্চল হইয়াছে; তোমাকে দেখিয়া আমার কোন মহিলা অবলোকন করিতে অভিরুচি নাই। প্রসন্ন হও; আমি তোমার নিতান্ত বশম্বদ, অতএব আমাকে ভজনা কর। হে কমলায়তলোচনে! যদবধি তোমাকে নয়নগোচর করিয়াছি, সেই অবধিই স্বকীয় শাণিতশরে অনঙ্গ আমার মর্মভেদ করিতেছে। এক্ষণে প্রণয়সলিল সেচন করিয়া মন্মথানলসস্তৃত দাহ শান্তি করিয়া আপ্যায়িত কর। তদ্দর্শনজনিত নিতান্ত দুর্ধর্ষ পঞ্চবাণ, প্রচণ্ড ধনু ও প্রচণ্ড শর করে লইয়া মদীয় হৃদয় বিদ্ধ করিতেছে। এক্ষণে তুমি আত্মসমর্পণ করিয়া আমার এ অপ্রতিম দুঃখের অবসান কর। হে রম্ভোরু! বিবাহের মতে গান্ধর্বই শ্রেষ্ঠ; অতএব গান্ধৰ্ববিধানে পরিণয়ক্রিয়া সম্পাদন কর।

তপতী কহিলেন—মহারাজ! আমি পিতৃমতী ও অবিবাহিতা; অতএব এক্ষণে স্বেচ্ছাচারিণী হইতে পারি না। যদি আমার উপর তোমার নিতান্তই প্রণয়সঞ্চার হইয়া থাকে, তবে তুমি আমার পিতার নিকটে প্রার্থনা কর। হে নরেশ্বর! যাদৃশ আমি তোমার প্রাণ হরণ করিয়াছি, ক্ষণমাত্র দর্শনে তুমিও সেইরূপ আমার প্রাণ হরণ করিয়াছ। শাস্ত্রে কহে, স্ত্রীলোকের কোন কালেই স্বাতন্ত্র অবলম্বন করা বিধেয় নহে; আমি একান্ত পরাধীন, এ কারণ তোমার সন্নিধানে গমন করিতে সম্মত নহি। এই ত্রিলোকমধ্যে কোন্ কন্যা প্রখ্যাতবংশোৎপম্ন ভক্তবৎসল ভূপালকে পতিত্বে অঙ্গীকার করিতে অভিলাষ না করে? অতএব তুমি প্রণাম, নিয়ম ও তপশ্চরণদ্বারা প্রসন্ন করিয়া আমার জন্মদাতা সূৰ্য্যদেবের নিকটে প্রার্থনা করিবে। যদি তিনি স্বীকার করেন, তাহা হইলে আমি চিরকাল তোমার বশবর্তিনী হইয়া থাকিব। আমি সাবিত্রীর কনিয়সী ভগিনী, লোকপ্রদীপ সূৰ্যদেবের কন্যা; আমার নাম তপতী।