০৩. অর্থ, অথবা পণ্য-সঞ্চলন (তৃতীয় অধ্যায়)

তৃতীয় অধ্যায় অর্থ, অথবা পণ্য-সঞ্চলন

৩.১ মূল্যের পরিমাপ

এই গ্রন্থের আগাগোড়াই, সরলতার স্বার্থে, আমি ধরে নিয়েছি যে সোনাই হচ্ছে অর্থ-পণ্য।

অর্থের প্রথম প্রধান কাজ হল পণ্যসমূহ যাতে নিজ নিজ মূল্য প্রকাশ করতে পারে, কিংবা একই সংজ্ঞাধীন, গুণগত ভাবে সমান এবং পরিমাণগত ভাবে তুলনীয় বিভিন্ন আয়তন হিসেবে তাদের বিভিন্ন মূল্যকে অভিব্যক্ত করতে পারে, তার জন্য তাদেরকে উপযুক্ত সামগ্রী সরবরাহ করা। এই ভাবে অর্থ কাজ করে মূল্যের সর্বজনীন পরিমাপক হিসেবে। এবং কেবল এই কাজটির গুণেই সমার্ঘ সামগ্রী হিসেবে সর্বোৎকৃষ্ট পণ্য যে সোনা সেই সোনাই পরিণত হয় অর্থে।

অর্থ বিভিন্ন পণ্যকে একই মান দিয়ে পরিমেয় করে তোলে—একথা ঠিক নয়। বরং ঠিক উলটো। যেহেতু সমস্ত পণ্যই, মূল্য হিসেবে, হচ্ছে বাস্তবায়িত মনুষ্যশ্রম, সেই হেতু তাদের ভিন্ন ভিন্ন মূল্যকেও মাপা যায় একই অভিন্ন বিশেষ পণ্যের দ্বারা, এবং এই বিশেষ পণ্যটিকে রূপান্তরিত করা যায় তাদের সকলের মূল্যের অভিন্ন পরিমাপ রূপে, তথা, অর্থ রূপে। পণ্যের মধ্যে যে পরিমাণ মূল্য অর্থাৎ শ্রম-সময় নিহিত থাকে, সেই মূল্যের পরিমাপক হিসেবে অর্থকে তার পরিদৃশ্যমান রূপ বলে অবশ্যই ধরে নিতেই হবে।[১]

কোন পণ্যমূল্যের সোনার মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি, সেটাই হল তার অর্থ-রূপ বা দাম, যেমন, ও পণ্য ক=ঔ অর্থপণ্য। ১ টিন লোহা = ২ আউন্স সোনার মতো একটি মাত্র সমীকরণই এখন সমাজ-সিদ্ধভাবে লোহার মূল্য প্রকাশের পক্ষে যথেষ্ট। যেহেতু সোনা নামক সমার্ঘ সামগ্রীটি এখন অর্থের চরিত্রসম্পন্ন, সেইহেতু এখন আর সমীকরণটিকে বাকি সমস্ত পণ্যের ভিন্ন ভিন্ন মূল্য প্রকাশকারী বহুসংখ্যক সমীকরণের একটি অখণ্ড শৃংখলের মধ্যে একটি খণ্ড গ্রন্থি হিসেবে দেখাবার দরকার নেই। আপেক্ষিক মূল্যের সাধারণ রূপটি এখন তার সরল বা বিছিন্ন আপেক্ষিক মূল্যের আদি রূপ ফিরে পেয়েছে। অন্য দিকে, আপেক্ষিক মূল্যের সম্প্রসারিত প্ৰকাশটি—সংখ্যাহীন সমীকরণের শেষহীন প্রস্তটি এখন হয়ে উঠেছে অর্থ-পণ্যের আপেক্ষিক মূল্যের স্ববিশিষ্ট রূপ। এই প্রস্তটিও এখন সুনির্দিষ্ট এবং সত্যকার পণ্য-সমূহের বিভিন্ন দাম হিসেবে সমাজ দ্বারা স্বীকৃত। নানান। ধরনের পণ্যের মাধ্যমে প্রকাশিত অর্থ-মূল্যের আয়তন জানবার জন্য আমাদের এখন। একটি দামের তালিকার উপরে চোখ বোলানোই যথেষ্ট। কিন্তু অর্থের নিজের নিজের কোনো দাম নেই। এই দিক থেকে সে যদি অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে একই মর্যাদায় দাড়াতে চায়, তা হলে আমরা বাধিত হব তাকে তার নিজেরই সমার্থ সামগ্রী হিসেবে সমীকরণ করতে।

পণ্যসমূহের মূল্য-রূপের মতো, তাদের দাম বা অর্থ-রূপও হচ্ছে এমন একটি রূপ যা তাদের দৃশ্যমান দেহগত রূপ থেকে সুস্পষ্ট, সুতরাং, এটা হচ্ছে নিছক ভাবগত বা মনোগত রূপ। যদিও অদৃশ্য, লোহা, ছিট এবং শস্যের মূল্যের অস্তিত্ব এই সমস্ত সামগ্রীর মধ্যেই আছে : তাকে ভাবগত ভাবে দৃশ্যমান করে তোলা হয় সোনার সঙ্গে এগুলির সমতা বিধান করে বলা যেতে পারে, এটা এমন একটা সম্পর্ক যা কেবল তাদের মাথায়ই ছিল। অতএব তাদের দাম বাইরে বিজ্ঞাপিত করার আগে তাদের মালিককে অবশ্যই কাজ করতে হবে—হয় তার নিজের জিহ্বাটা তাদেরকে দিয়ে দিতে হবে আর নয়তো তাদের গায়ে একটা করে টিকিট সেঁটে দিতে হবে।[২] যেহেতু সোনার আকারে পণ্যমূল্যের প্রকাশ হচ্ছে নিছক একটি ভাবগত রূপ, সেই হেতু এই উদ্দেশ্যে আমরা ব্যবহার করতে পারি কাল্পনিক বা ভাবগত অর্থ। প্রত্যেক ব্যবসায়ী জানে যে যখন সে তার পণ্যসামগ্রীর মূল্যকে একটা দামের আকারে কিংবা কাল্পনিক অর্থের অঙ্কে প্রকাশ করেছে তখনো সে তার পণ্যসামগ্রীকে অর্থে রূপান্তরিত করা থেকে চের দূরে আছে; সে এ-ও জানে সোনার অঙ্কে লক্ষ লক্ষ পাউণ্ডের পণ্য সামগ্রীর মূল্য হিসাব করতে তার এক টুকরো সোনারও প্রয়োজন পড়েনা। সুতরাং অর্থ যখন মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে, তখন তাকে ব্যবহার করা হয় কেবল কাল্পনিক ভাবগত অর্থ হিসেবে। এই ঘটনা থেকে উদ্ভট উদ্ভট সব তত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছে।[৩] কিন্তু যদিও যে-অর্থ মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে, সে হচ্ছে ভাগবত অর্থ, ৩। হলেও কিন্তু দাম নির্ভর করে সেই বাচ্চা বস্তুটির উপরে যাকে বলা হয় অর্থ’। এক টন লোহায় যে-মূল্য তথা যে-পরিমাণ মনুষ্য-শ্ৰম বিধৃত থাকে, কল্পনায় তাকে প্রকাশ করা হয় সেই পরিমাণ অর্থ-পণ্যের দ্বারা যা ঠিক সেই লোহার সম-পরিমাণ শ্রমকে বিধৃত করে আছে। যেহেতু মূল্যের পরিমাপক হচ্ছে সোনা, রূপা বা তামা, সেহেতু উক্ত এক টন লোহার মূল্য অভিব্যক্তি লাভ করবে খুবই ভিন্ন ভিন্ন খণ্ডের মাধ্যমে অথবা ঐ ধাতুগুলির খুবই ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণের মাধ্যমে।

সুতরাং, যদি দুটি ভিন্ন ভিন্ন ধাতু, যেমন সোনা এবং রূপা, যুগপৎ মূল্যের পরিমাপক হয়, তা হলে সমস্ত পণ্যেরই থাকে দুটি করে দাম—একটি সোনার অঙ্কে অন্যটি রূপার অঙ্কে। যত দিন পর্যন্ত রূপার মূল্য আর সোনার মূল্যের অনুপাত ধরা যাক ১৫:১, অপরিবর্তিত থাকে ততদিন দুটো দামই অনায়াসে পাপাপাশি চলতে থাকে। তাদের মধ্যেকার অনুপাতে যখনি কোন পরিবর্তন ঘটে তখনি পণ্যের সোনার অঙ্কে দাম আর রূপার অঙ্কে দামের মধ্যেকার অনুপাতেও পরিবর্তন ঘটে এবং এতে এটাই প্রতিপন্ন হয় যে একটি মানের কার্যাবলী সম্পাদনের সঙ্গে মূল্যের দ্বৈতমান অসঙ্গতি পূর্ণ।[৪]

 নির্দিষ্ট দামের পণ্যসমূহ নিজেদেরকে উপস্থিত করে নিম্নলিখিত রূপে :

ক পরিমাণ    ক পণ্য = ও পরিমাণ সোনা;
খ পরিমাণ    খ পণ্য = জ পরিমাণ সোনা;
 গ পরিমাণ   গ পণ্য = ঔ পরিমাণ সোনা। ইত্যাদি সেখানে

ক, খ এবং গ হল যথাক্রমে ক, খ এবং গ পণ্যের নির্দিষ্ট পরিমাণসমূহ আর ও, জ এবং ও হল যথাক্রমে সোনার নির্দিষ্ট পরিমাণসমূহ। সুতরাং এই সমস্ত পণ্যের মূল্যসমূহ কল্পনায় বিভিন্ন পরিমাণের সোনায় পরিবর্তিত হয়ে যায়। অতএব পণ্যসম্ভারের বিভ্রান্তি কর বিচিত্রতা থাকা সত্ত্বেও, তাদের মূল্যসমূহ কিন্তু পরিণত হয় একই অভিধার অন্তর্গত বিভিন্ন আয়তনে তথা সোনার অঙ্কে বিভিন্ন আয়তনে। তাদের এখন পরস্পরের সঙ্গে তুলনা করা এবং পরিমাপ করা যায়। তখন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনাকে পরিমাপে একক হিসাবে ধরে নিয়ে তাদের তুলনা করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এই একই পরবর্তীকালে বিভিন্ন ভগ্নাংশে বিভক্ত হয়ে পরিমাপের মানে পরিণতি লাভ করে। অর্থে পরিণত হবার আগেই সোনা, রূপা এবং তামা তাদের বিভিন্ন ওজনের মান অনুসারে এমন বিভিন্ন মানের পরিমাপ ধারণ করে, যাতে করে একটি স্টার্লিং পাউণ্ড যখন একদিকে, একক হিসাবে উপযুক্ত সংখ্যক আউন্সে বিভক্ত হতে পারে, তখন অন্যদিকে, তা আবার উপযুক্ত সংখ্যক পাউণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরিণত হতে পারে একটি হাতে ওয়েটে[৫]। এই কারণে সমস্ত ধাতব মুদ্রা ব্যবস্থাতেই দেখা যায় যে অর্থের বিভিন্ন মানের বা দামের বিভিন্ন মানের যেসব নামকরণ করা হয়েছিল, সে সব নামই নেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন ওজনের পূর্বাগত নামগুলি থেকে।

মূল্যের পরিমাপ এবং দামের মান হিসেবে অর্থের দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কাজ সম্পাদন করতে হয়। যে পরিচয়ে তা মনুষ্য শ্রমের সমাজ-স্বীকৃত মূর্তরূপ, যে পরিচয়ে অর্থ হচ্ছে মূল্যের পরিমাপ; যে পরিচয়ে তা কোন ধাতুর নির্দিষ্ট পরিমাণ সে, পরিচয়ে তা দামের মান। মূল্যের পরিমাপ হিসেবে তা সমস্ত বিচিত্র বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর বহুবিধ মূল্যকে দামে তথা সোনার বিভিন্ন কল্পিত পরিমাণে পরিবর্তিত করে; দামের মান হিসেবে তা আবার ঐ পরিমাণগুলির পরিমাপ করে। মূল্যের পরিমাপ পণ্যসামগ্রীকে পরিমাপ করে মূল্য হিসেবে; উল্টো দিকে, দামের মান পরিমাপ করে সোনার একটি এককের সাহায্যে সোনার বিভিন্ন পরিমাণ অন্য কোন পরিমাণ সোনার ওজনের সাহায্যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনার মূল্যকে নয়। মোনাকে দামের মানে পরিণত করতে হলে, তার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণকে স্থির করতে হবে একক হিসেবে। একই অভিধার অন্তর্গত সমস্ত মূল্য পরিমাপের ক্ষেত্রে যেমন, এ ক্ষেত্রেও তেমন, পরিমাপের একটি সুস্থির একক প্রতিষ্ঠা করার গুরুত্ব সর্বময়। অতএব, উক্ত একক যত কম অস্থির হবে, তত ভালো ভাবে দামের মান তার ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু কেবল তত দূর পর্যন্তই সোনা পারে মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করতে, যতদূর পর্যন্ত সে নিজেই হচ্ছে শ্রমের ফল এবং সেই কারণেই অস্থিরমূল্যতার সম্ভাবনা-যুক্ত। [৬]

প্রথমত, এটা সম্পূর্ণ, পরিষ্কার যে সোনার মূল্যে কোনো পরিবর্তন দামের মান হিসেবে তার ভূমিকাকে কোনক্রমেই ক্ষুন্ন করে না। এই মূল্য কিভাবে পরিবর্তিত হয় তাতে কিছু এসে যায় না, উক্ত ধাতুর বিভিন্ন পরিমাণের মধ্যকার অনুপাত স্থিরই থাকে। মূল্য যত বেশিই হ্রাস পাক না কেন, ১২ আউন্স সোনার মূল্য তখনো থাকে ১ আউন্স সোনার ১২ গুণ আর দামের ক্ষেত্রে একমাত্র যে জিনিসটি বিবেচনা করা হয় তা হল সোনার বিভিন্ন পরিমাণের মধ্যকার সম্পর্কটি। যেহেতু একদিকে, এক আউন্স সোনার মূল্য, কোনো বৃদ্ধি বা হ্রাসই তার ওজনে কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে না, সেই হেতু তার ভগ্নাংশগুলির ওজনেও কোনো পরিবর্তন ঘটতে পারে না। সুতরাং সোনার মূল্যে যতই পরিবর্তন ঘটুক না কেন, তা দামের অপরিবর্তনীয় মান হিসেবে একই কাজ দিয়ে থাকে।

দ্বিতীয়ত, সোনার মূল্যে কোন পরিবর্তন মূল্যের পরিমাপ হিসেবে তার যে কাজ, তাকে ক্ষুন্ন করে না। এই পরিবর্তন সমস্ত পণ্যের উপরেই যুগপৎ প্রভাব বিস্তার করে এবং সেই কারণেই, caeteris paribus, তা তাদের আপেক্ষিক মূল্যগুলিকেও inter se, অপরিবর্তিতই রেখে দেয়—যদিও এই মূল্যগুলি এখন অভিব্যক্ত হয় উচ্চতর বা নিম্নতর স্বর্ণ-দামে।

যেমন আমরা অন্য কোন পণ্যের ব্যবহার-মূল্যের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দিয়ে কোন পণ্যের মূল্য হিসেব করে থাকি, ঠিক তেমনি সেই পণ্যটির মূল্য সোনার অঙ্কে হিসেব করতে গিয়ে, আমরা এথেকে বেশি কিছুই ধরে নেই না যে একটি বিশেষ সময়ে একটি বিশেষ পরিমাণ সোনা উৎপাদন করতে ব্যয় হয় একটি বিশেষ পরিমাণ শ্রম। সাধরণ ভাবে দামসমূহের ওঠা নামা সম্পর্কে উল্লেখ্য যে আগেকার একটি অধ্যায়ে যে প্রাথমিক আপেক্ষিক মূল্যের নিয়মগুলি সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে এই ওঠা-নাম। সেই নিয়মগুলিরই অধীন।

পণ্য সম্ভারের দামসমূহে একটা সাধারণ বৃদ্ধি ঘটতে পারে কেবল তখনি যখন অর্থের মূল্য স্থির থেকে তাদের মূল্য বৃদ্ধি পায় অথবা কেবল তখনি যখন পণ্য-সমুহের মূল্য স্থির থেকে অর্থের মূল্য বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, দামসমূহে একটি সাধারণ হ্রাস ঘটতে পারে কেবল তখনি, যখন—অর্থের মূল্য একই থেকে—পণ্যসম্ভারের মূল্য-সমূহে হ্রাস ঘটে, কিংবা—পণ্যসম্ভারের মূল্য-সমূহ একই থেকে—অর্থের মূল্যে বৃদ্ধি ঘটে। সুতরাং এ থেকে কিছুতেই এ সিদ্ধান্ত আসে না যে, অর্থের মূল্যে কোনো বৃদ্ধি আবশ্যিক ভাবেই ঘটায় পণ্যের দামে অনুপাতিক হ্রাস কিংবা এ সিদ্ধান্তও আসে না যে অর্থের মূল্যে হ্রাস ঘটলে পণ্যের দামেও ঘটে আনুপাতিক বৃদ্ধি। দামের এবংবিধ পরিবর্তন ঘটে কেবল সেইসব পণ্যের ক্ষেত্রে, যাদের মূল্য থাকে স্থির। দৃষ্টান্ত স্বরূপ যেসব জিনিসের মূল্য অর্থের মূল্যের সঙ্গে একই সময়ে এবং একই অনুপাতে বৃদ্ধি পায়, সে সব জিনিসের বেলায় দামে কোনো বৃদ্ধি ঘটে না। এবং যদি তাদের মূল্য অর্থের মূল্য থেকে ধীরতর বা দ্রুততর তালে বৃদ্ধি পায়, তা হলে তাদের দামে হ্রাস বৃদ্ধি বা নির্ধারিত হবে তাদের মূল্য এবং অর্থের মূল্য—এই দুইয়ের পার্থক্যের দ্বারা ইত্যাদি ইত্যাদি।

এখন দাম-রূপের আলোচনায় যাওয়া যাক। কালক্রমে অর্থ হিসেবে চালু মহার্ঘ ধাতুটির বিভিন্ন ওজনের বিভিন্ন প্রচলিত অর্থ নামসমূহ এবং শুরুতে ঐ সমস্ত নাম যে যে ওজনের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করত, সেই সব ওজন এই দুয়ের মধ্যে ক্রমে ক্রমে পার্থক্য দেখা দেয়। এই পার্থক্য বিবিধ ঐতিহাসিক কারণের ফল, যেগুলির মধ্যে প্রধান প্রধান কারণগুলি নিম্নরূপ :-(১) একটি অপূর্ণাঙ্গ ভাবে বিকশিত সমাজে বিদেশী অর্থের আমদানি। রোমের প্রথম যুগে এই রকম ঘটেছিল, সেখানে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা প্রথমে চালু হয়েছিল বিদেশী পণ্য হিসাবে। এই সমস্ত বিদেশী মুদ্রার নাম কখনো দেশীয় ওজন গুলির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতো না। (২) ধন-সম্পদ যতই বৃদ্ধি পায়, ততই অধিক মূল্য ধাতু অল্প মূল্য ধাতুকে মূল্যের পরিমাপকের ভূমিকা থেকে উৎখাত করে দেয়, রূপা দেয় তামাকে, সোনা দেয় রূপাকে,তা এই ঘটনাক্রম যতই কাব্যে বর্ণিত ঘটনাক্রমের বিরোধী হোক না কেন।[৭] যেমন ‘পাউণ্ড’ কথাটি শুরুতে ছিল সত্যকার এক পাউণ্ড ওজনের রূপার অর্থ-নাম। যখন মূল্যের পরিমাপক হিসেবে রূপার স্থান সোনা নিয়ে নিল, তখন রূপা ও সোনার মুল্যের অনুপাত অনুযায়ী সেই একই নাম প্রযুক্ত হ’ল সম্ভবতঃ সোনার ৫ ভাগ বোঝাবার জন্য। এইভাবে অর্থ-নাম হিসেবে পাউণ্ড কথাটির মানে ওজন-নাম হিসেবে তার যে মানে তা থেকে আলাদা হয়ে গেল।[৮]

(৩) শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজ-রাজড়ারা অর্থের এমন মাত্রায় অপকর্ষ ঘটিয়েছে যে বিভিন্ন মুদ্রার মূল ওজন সমূহের নামগুলি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না। [৯]

এই সব ইতিহাসগত কারণের দরুণ ওজন-নাম থেকে অর্থ-নামের এই যে বিচ্ছেদ তা সমাজের পক্ষে প্রতিষ্ঠিত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল। যেহেতু অর্থের মান হচ্ছে একদিক থেকে, নিছকই একটি রীতিগত ব্যাপার এবং অন্যদিক থেকে, তাকে অবশ্যই হতে হয় সাধারণতগ্রাহ, সেইহেতু শেষ পর্যন্ত তা নিয়ন্ত্রিত হয় আইনের দ্বারা। মহার্ঘ ধাতুগুলির মধ্যে একটি ধাতুর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণকে, ধরা যাক, এক আউন্স সোনাকে সরকারীভাবে ভাগ করা হয় বিভিন্ন ভগ্নাংশে, দেওয়া হয় আইনগত সব নাম, যেমন পাউণ্ড, ডলার ইত্যাদি।[১০] এই ভগ্নাংশগুলি তখন থেকে কাজ করতে থাকে অর্থের বিভিন্ন একক হিসেবে; এবং বিভিন্ন উপভাগে বিভক্ত হয়ে পেয়ে থাকে আইনগত সব নাম, যেমন, শিলিং পেনি ইত্যাদি। কিন্তু এইসব ভাগ বিভাগের অগে এবং পরে—উভয় সময়েই কোন একটি ধাতুর নির্দিষ্ট পরিমাণই থাকে ধাতব অর্থের মান। একমাত্র যে পরিবর্তন ঘটে তা হ’ল এই বিভক্তীকরণ আর নামকরণ।

পণ্যের মূল্য ভাবগত ভাবে যে দামে বা সোনার পরিমাণে পরিবর্তিত হয়, তা এখন অভিব্যক্ত হয় মুদ্রার নামে অথবা স্বর্ণ মানের বিভিন্ন উপভাগের আইনগত ভাবে সিদ্ধ নামে। অতএব, এক কোয়ার্টার গম এক আউন্স সোনার সমান, একথা না বলে, আমরা বলি এক কোয়ার্টার গম হ’ল ৩ পা: ১৭ শিঃ ১০ই পেঃ। এই ভাবে পণ্য তার দামের মারফৎ বলে দেয় তার মর্যাদা কতটা এবং যখনি কোন জিনিসের মূল্য তার অর্থ-রূপে স্থির করার প্রশ্ন দেখা দেয় তখনি অর্থ কাজ করে হিসাবের অর্থ হিসাবে। [১১]

কোন জিনিসের নাম এমন কিছু যা তার গুণাবলী থেকে স্বতন্ত্র। কোন মানুষের নাম জ্যাকব, এইটুকুমাত্র জানলে আমি সেই মানুষটির সম্বন্ধে আর কিছুই জানি না। অর্থের ক্ষেত্রেও এই একই কথা; পাউণ্ড, ডলার, ফ্রা, ডুকাট ইত্যাদি নামে মূল্য সম্পর্কের প্রত্যেকটি চিহ্নই অন্তৰ্হিত। এই সমস্ত গোপনীয়তা ঘাতক অভিজ্ঞানগুলির উপরে প্রচ্ছন্ন তাৎপর্য আরোপ করে, ব্যাপারটিকে ঢের বেশি বিভ্রান্তিকর করে তোলা হয়, কেননা এই অর্থ-নামগুলি একই সময়ে দুটি জিনিসকে প্রকাশ করে থাকে—পণ্যের মূল্যকে এবং সংশ্লিষ্ট ধাতুটির বিভিন্ন ভগ্নাংশের ওজনকে, যা অর্থের মান।[১২] অন্যদিকে, এটা চূড়ান্তভাবে আবশ্যক যে, যাতে করে বিবিধ পণ্যের বিভিন্ন দেহগত রূপগুলি থেকে মূল্যকে আলাদা করা যায়, সেইহেতু তাকে ধারণ করতে হবে এই বস্তুগত এবং নিরর্থক, অথচ একই সময়ে, বিশুদ্ধ সামাজিক রূপ।[১৩]

দাম হচ্ছে কোন পণ্যে যে-শ্রম বাস্তবায়িত হয়, তার অর্থ-নাম। সুতরাং কোন পণ্যের দাম-বাচক অর্থের পরিমাণটির সঙ্গে তার সমার্থতা প্রকাশ করা নিছক একই কথা পুনরুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়[১৪], ঠিক যেমন সাধারণ ভাবে কোন পণ্যের আপেক্ষিক মূল্যকে প্রকাশ করা পুনরুক্তি করা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু যদিও, কোন পণ্যের মূল্যের আয়তনের প্রতিনিধি হওয়ার কারণে দাম অর্থের সঙ্গে তার বিনিময় হারের প্রতিনিধি, এ থেকে এ সিদ্ধান্ত করা যায় না এই বিনিময় হারের প্রতিনিধিটি আবশ্যিক ভাবেই হবে উক্ত পণ্যটির মূল্যের আয়তনের প্রতিনিধি। ধরুন, সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমের দুটি সমান পরিমাণের প্রতিনিধিত্ব করছে যথাক্রমে ১ কোয়ার্টার গম এবং £২ ( প্রায় ২ আউন্স সোনা); এক্ষেত্রে ৫২ হচ্ছে উক্ত এক কোয়াটার গমের মূল্যের আয়তনের অর্থের অঙ্কে অভিব্যক্তি, তার মানে, এক কোয়ার্টার গমের দাম। এখন যদি ঘটনাক্রমে গমের দাম বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় £ অথবা হ্রাস পেয়ে দাড়ায় ৫১, তা হলে, যদিও £১ এবং £3 গমের মূল্যকে যথাযথ ভাবে প্রকাশ করবার পক্ষে খুব কম বা খুব বেশি হয়ে পড়তে পারে, তা হলেও এরাই হবে তার দাম; কেন না প্রথমতঃ এরাই হচ্ছে সেইরূপ যে-রূপের অধীনে মূল্য তার মূল্য দৃশ্যমান হয় অর্থাৎ অর্থরূপ; এবং দ্বিতীয়ত, এরাই হচ্ছে অর্থের সঙ্গে তার বিনিময় হার। যদি উৎপাদনের অবস্থাবলী বা ভাষান্তরে, যদি শ্রমে উৎপাদিকা শক্তি থাকে স্থির, তা হলে, দাম পরিবর্তনের আগে এবং পরে, একই পরিমাণ সামাজিক শ্রম-সময় ব্যয়িত হবে এক কোয়ার্টার গমের পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রে। কি গম-উৎপাদনকারীর খুশি-অখুশি আর কি অন্যান্য পণ্যের উৎপাদনকারীদের খুশি-অখুশি—এই ঘটনা এদের কোনটির উপর নির্ভর করে না।

মূল্যের আয়তন প্রকাশ করে একটি সামাজিক সম্পর্ককে; কোন একটি জিনিস আর সেই জিনিসটিকে উৎপাদন করতে সমাজের মোট শ্রম-সময়ের ব্যায়িতব্য অংশ এই দুয়ের মধ্যে যে সম্পর্কটি আবশ্যিক ভাবে বিদ্যমান মূল্য প্রকাশ করে সেই সম্পর্কটিকে। যে মুহূর্তে মূল্যের আয়তন পরিবর্তিত হয় দামে, সেই মুহুর্তে উল্লিখিত আবশ্যিক সম্পর্কটি একটি একক পণ্য এবং অন্য একটি পণ্যের-অর্থ-পণ্যের-মধ্যে মোটামুটি আপতিক একটা বিনিময়-হারের আকার ধারণ করে। কিন্তু এই বিনিময় হার যে কোন একটা জিনিসকে প্রকাশ করতে পারে- হয়, উক্ত পণ্যটির মূল্যের যথার্থ আয়টিকে, নয়তো, ঘটনাচক্রে উক্ত মূল্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যে পরিমাণ সোনার বিনিময়ে ঐ পণ্যটিকে হাতছাড়া হতে হয়েছে, সেই পরিমাণ সোনাকে। অতএব, দাম এবং মূল্য-আয়তনের মধ্যে অসঙ্গতির অথবা মূল্য-আয়তন থেকে দামের বিচ্যুতির এই যে সম্ভাব্যতা, তা স্বয়ং দাম-রূপের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এটা কোনো দুষণীয় ব্যাপার নয় বরং তা দাম-রূপটিকে প্রশংসনীয় ভাবেই এমন একটি উৎপাদন-পদ্ধতির সঙ্গে অভিযোজিত করে নেয়, তার অন্তর্নিহিত নিয়মগুলি পারস্পরিক প্রতিপূরণকারী বাহত উচ্ছংখল অনিয়মিকতাগুলির উপরে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করে কেবল মধ্যবর্তী হিসাবে।

মূল্য-আয়তন এবং দামের মধ্যে অর্থাৎ মূল্য-আয়তন এবং তার অর্থ-রূপের মধ্যে অসঙ্গতির সম্ভাব্যতার সঙ্গেই যে কেবল এই দাম-রূপ নিজেকে মানিয়ে নেয় তা-ই নয়, একটা গুণগত অসঙ্গতিকেও তা লুকিয়ে রাখে লুকিয়ে রাখে এত দূর পর্যন্ত যে, যদিও অর্থ পণ্যসামগ্রীর মূল্য-রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়, তা হলেও দাম এই মূল্য প্রকাশের কাজ থেকেই পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়ে। বিবেক, মর্যাদা ইত্যাদির মতো বিষয় যেগুলি নিজের কোনো পণ্যই নয়, এমনকি সেগুলিকেও তাদের অধিকারীরা। বিক্রয়ের জন্য উপস্থিত করতে পারে এবং এইভাবে এগুলি নিজেদের দামের মারফৎ পণ্যের রূপ অর্জন করতে পারে। সুতরাং মূল্য না থাকলেও একটা বিষয়ের দাম থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে দাম হচ্ছে কাল্পনিকগণিত বিজ্ঞানের কতকগুলি রাশির মতো। অন্য দিকে এই কাল্পনিক দাম রূপ আবার কখনো কখনো লুকিয়ে রাখিতে পারে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোন সত্যকার মূল্য-রূপকে, যেমন ধরা যাক অকর্ষিত জমির দাম, যার কোনো মূল্য নেই, কেননা কোন মনুষ্য-শ্ৰম তাতে বিধৃত হয়নি।

সাধারণভাবে আপেক্ষিক মূল্যের মতো দামও আমাদের বলে দেয় যে সমার্থ সামগ্রীটির একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ( যথা এক আউন্স সোনা ) সরাসরি লোহার সঙ্গে বিনিময়ে এবং এইভাবে দাম কোন পণ্যের (যথা এক টন লোহার ) মূল্য প্রকাশ করে। কিন্তু তা কখনো এর বিপরীতটি প্রকাশ করে না, বলেনা যে লোহা সোনার সঙ্গে সরাসরি বিনিময়ে। সুতরাং, একটি পণ্য যাতে কার্যক্ষেত্রে বিনিময় মূল্য হিসেবে কার্যকরীভাবে কাজ করতে পারে, সেইহেতু তাকে তার দেহরূপ পরিহার করতে হবে, নিজেকে রূপান্তরিত করতে হবে নিছক কাল্পনিক সোনা থেকে বাস্তবিক সোনায়-যদিও ‘আবশ্যিকতা থেকে স্বাধীনতায়’ রূপ-পরিগ্রহণের হেগেলীয় ধারণাটির তুলনায় অথবা একটি চিংডিমাছের পক্ষে খোলস ছেড়ে ফেলার তুলনায় সেন্ট জেরোমের পক্ষে অ্যাডাম স্মিথকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার তুলনায় কোনো পণ্যের পক্ষে এমন রূপ-পরিগ্রহণ হতে পারে টের বেশি কঠিন। [১৫] যদিও একটি পণ্য (যেমন, লোহা) তার নিজস্ব বাপের পাশাপাশি, আমাদের কল্পনায়, সোনার রূপও ধারণ করতে পারে, তবু কিন্তু তা একই সময়ে বাস্তবে লোহা এবং সোনা—দুই-ই হতে পারে না। এর দাম স্থির করার জন্য, কল্পনায় একে সোনার সঙ্গে সমীকরণ করাই যথেষ্ট। কিন্তু এর মালিকে কাছে লোহ’কে যদি সমার্ঘ সামগ্রীর ভূমিকা পালন করতে হয়, তা হলে তাকে অবশ্যই সত্যকার সোনাকে তার নিজের স্থলাভিষিক্ত করতে হবে। লোহার মালিককে যদি বিনিময়ের জন্য উপস্থাপিত অন্য কোন পণ্যের মালিকের কাছে যেতে হয়, এবং তার হাতের লোহাকে দেখিয়ে প্রমাণ করতে হয় যে তা-ই হচ্ছে সোনা, তা হলে দান্তেকে স্বর্গে সেন্ট পিটার যে উত্তর দিয়েছিলেন, সেই উত্তরই তাকেও শুনতে হবে, মন্ত্রের মতো উচ্চারিত, সেই উত্তরটি হচ্ছে :

“Assai bene e trascorsa
D’esta moneta gia’ la lega e’l peso.
 Ma dimmi se tu l’hai nella tua borsa.”

অতএব একটা দামের নিহিত মানে দুটি; এর মানে এইযে, একটি পণ্য অর্থের সঙ্গে বিনিময়ে এবং, সেই সঙ্গে, এর মানে এ-ও যে, সে এইভাবে অবশ্যই বিনিমিত হবে। অন্যদিকে, যেহেতু সোন। এরই মধ্যে বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আদর্শ অর্থ-পণ্য হিসেবে, কেবল সেই হেতুই সোনা কাজ করে মূল্যের ভাবগত পরিমাপক হিসেবে। মূল্যের ভাবগত পরিমাপের আড়াল থেকে উকি দেয় নগদ টাকা।

————

১. প্রশ্ন হলো—অর্থ সাসরি শ্রম-সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে না কেন, যাতে করে এক টুকরো কাগজ, ধরা যাক, x-ঘণ্টার শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে—এই প্রশ্নটি মূলতঃ অন্য একটি প্রশ্নেরই ভাবান্তর; সে প্রশ্নটি এই : পণ্যোৎপাদন চালু থাকাকালে উৎপন্ন দ্রব্যাদি কেন আবশ্যিকভাবেই পণ্যের রূপ নেবে? এটা স্বতঃস্পষ্ট, কেননা তাদের পণ্যে রূপ পরিগ্রহণের মানে হচ্ছে তাদের পণ্যে এবং অর্থে পৃথগীভবন। কিংবা, ব্যক্তিগত এম, তথা ব্যক্তিবিশেষদের শ্রম, কেন তার বিপরীত হিসেবে, প্রত্যক্ষত সামাজিক প্রম হিসেবে পরিগণিত হতে পারে না? অন্যত্র আমি পণ্যোৎপাদনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজে এম-অর্থ সম্পর্কিত ইউরোপীয় ধারণাটির সবিস্তার আলোচনা করছি। এই বিষয়ে আমি আর এইটুকুমাত্র বলতে চাই যে ওয়েন-এর শ্রম-অর্থকে অর্থ বলে গণ্য করা এবং একটি থিয়েটার টিকিটকে অর্থ বলে গণ্য করা একই ব্যাপার। ওয়েন ধরে নিয়েছেন সরাসরিভাবে সম্মিলিত শ্রম, যা পণ্যোৎপাদনের সঙ্গে পুরোপুরি অসঙ্গতিপূর্ণ। শ্রমের সার্টিফিকেট হচ্ছে কেবল একটি সাক্ষ্যপত্র, সাধারণ শ্রমে ব্যক্তি-শ্রমিক যে অংশ নিয়েছে তার নিদর্শন। এর জোরে সে পরিভোগর জন্য উদ্দিষ্ট সাধারণ উৎপন্নসম্ভারের অংশ বিশেষের দাবিদার হয়। কিন্তু এটা ওয়েন-এর মাথায় ঢুকছে না যে পণ্যোৎপাদনের অস্তিত্বকে ধরে নিয়ে সেই সঙ্গে অর্থ নিয়ে কথার মারপ্যাচ করা হচ্ছে সেই উৎপাদনেরই আবশ্যিক শর্তগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া।

২. বন্য এবং অর্ধসভ্য সঞ্জাতিগুলি (races) জিহ্বাকে ব্যবহার করে ভিন্নতরভাবে। বাফিন বে’-র তীরবর্তী অধিবাসীদের কথা বলতে গিয়ে ক্যাপ্টেন প্যারী বলেন, ‘এই ক্ষেত্রে ( দ্রব্য-বিনিময়ের ক্ষেত্রে) তারা উপস্থাপিত দ্রব্যটিকে দুবার জিহবা দিয়ে লেহন করে, তারপরেই লেনদেনটি সন্তোষজনক ভাবে নিষ্পন্ন হয়েছে বলে তারা মেনে নেয়। অনুরূপভাবে, ইষ্টার্ণ একিমোরাও বিনিময়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত জিনিসগুলিকে চেটে নিত। উত্তরে যদি জিহ্বাকে এইভাবে ব্যবহার করা হত আত্মীকরণের ইন্দ্রিয় হিসেবে, তাহলে আশ্চর্যের কি আছে যে দক্ষিণে পাকস্থলীকে ব্যবহার করা হত সঞ্চিত সম্পত্তির ইন্দ্রিয় হিসেবে এবং এই কারণেই কোন ‘কাফির’ কারো ধনদৌলতের পরিমাপ করে তার পেটের আয়তন অনুসারে। কাফিররা কি বোঝাতে চায় তা যে তারা জানে তা এ থেকেই বোঝা যায় : ব্রিটিশ সরকারের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্টে ১৮৬৪ সালে যখন প্রকাশ পায় যে শ্রমিক শ্রেণীর একটা বড় অংশ চর্বিজাতীয় খাদ্যের অভাবে ভুগছে, তখন জনৈক উ: হার্ভে (রক্ত-সঞ্চলনের আবিষ্কর্তা প্রখ্যাত ডঃ হার্ভে নন) এক বিজ্ঞাপন মারফৎ বুর্জোয়া এবং অভিজাতদের চর্বি কমাবার ব্যবস্থাপত্র প্রচার করেন।

৩. দ্রষ্টব্য : কার্লমার্কস। zur Kritik’, &c Theorien von der Mass einheit des Geldes.” পৃ: ৫৩।

৪. “যখনি আইনের জোরে সোনা এবং রূপাকে পাশাপাশি অর্থ হিসেবে এবং মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করানো হয়েছে, তখনি তাদের একই সামগ্রী বলে গণ্য করার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমসময়ের ধারক হিসেবে সোনা ও রূপার পরিমাণের মধ্যে এটা কোন অপরিবর্তনীয় অনুপাতের অস্তিত্ব আছে ধরে নেওয। আর সোনা ও রূপা একই সামগ্রী; এটা ধরে নেবার মানে বস্তুতঃ একই এবং অরে। ধরে নেওয়া যে, কম মূল্যবান ধাতুটির, রূপার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের নিত্যস্থায়ী ভগ্নাংশ। তৃতীয় এডােয়ার্ড-এর রাজত্বকাল থেকে দ্বিতীয় জর্জ-এর রাজত্বকাল পর্যন্ত ইংল্যাণ্ডের অর্থসংক্রান্ত ইতিহাস পড়লে দেখা যায় যে এই গোটা সময়টা ধরেই সোনা ও রূপার মধ্যকার সরকারিভাবে নির্ধারিত হার এবং তাদের আসল মূল্যের মধ্যে চলেছে গরমিল। এক সময়ে সোনা হল খুব চড়া, আরেক সময়ে রূপা। যেটার হার যখন তার মূল্যের কমে নির্ধারিত হত, সেটাই তখন গলিয়ে ফেলে বিদেশে রপ্তানি করে দেওয়া হত। দুটি ধাতুর। মধ্যে কার অনুপাতটি তখন আবার আইনের মাধ্যমে পরিবর্তন করা হত, কিন্তু এই নোতুন নামীয় অনুপাতটিও আবার বাস্তবের সঙ্গে সংঘাতে আসত। আমাদের কালেও অমর। দেখেছি যে রূপার জন্য ইন্দো-চাইনিজ চাহিদার দরুণ সোনার মূল্যে যে ক্ষণস্থায়ী এবং যৎকিঞ্চিৎ হ্রাস ঘটেছিল, তার ফলে ফ্রান্সে কী বিপুল প্রতিক্রিয়া ঘটল-রূপা বিদেশে রপ্তানি হতে থাকল এবং সঞ্চলনে থেকে গেল কেবল সোনা। ১৮৫৫, ১৮৫৬ এবং ১৮৫৭-এই বছরগুলিতে ফ্রান্সে সোনা-রপ্তানির তুলনায় সোনা আমদানির আধিক্যের পরিমাণ বাড়িয়ে ছিল ৪ ৪১,৫৮০,০০০, আর রূপা-আমদানির তুলনায় রূপ-রপ্তানির আধিক্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল £ ১৪,৭০৪, …। বাস্তবিক পক্ষে, যে সব দেশে দুটি ধাতুই মূল্যের আইন-স্বীকৃত পরিমাপ, সুতরাং আইন সিদ্ধ বিনিময়-মাধ্যম, যাতে করে প্রত্যেকেরই অধিকার আছে যে-কোনো একটিতে দাম দেবার, সেখানে যে ধাতুটির মূল্য বৃদ্ধি পায় সেটি হয় লাভজনক, এবং বাকি প্রত্যেকটি পণ্যের মত, নিজের দাম পরিমাপ করে অতিমূল্যায়িত ধাতুটির মাধ্যমে, সেটি একাই বাস্তবে কাজ করে মুল্যের মান হিসাবে। এই প্রশ্নটি সম্পর্কে সমস্ত অভিজ্ঞতা, সমস্ত ইতিহাস একটিমাত্র শিক্ষাই দেয় : যেখানে আইনের অনুশাসনে দুটি পণ্য মূল্য পরিমাপকের কাজ করে, সেখানে কার্যক্ষেত্রে তাদের একটিমাত্রই থেকে যায়। [ কার্লমার্কস l.c, ৫২, ৫৩]

৫. যেখানে এক আউন্স সোনা ইংল্যাণ্ডে অর্থের মান হিসেবে কাজ করে সেখানে পাউণ্ড-স্টার্লিং তার একটি আঙ্গেয় হিসাবে কাজ করে না-এই যে কৌতুহলকর ঘটনা, তাকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, “কেবল রূপাকেই ব্যবহার করা হবে এটা ধরে নিয়েই গোড়াতে আমাদের মুদ্রাংকন শুরু হয়েছিল। সেইহেতু এক আউন্স রূপা সব সময়েই একাধিক আঙ্গেয় অংশে বিভাজ্য ছিল; কিন্তু পরে সোনা চালু হল—রূপার সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে। তাইতো এক আউন্স সোনা কিন্তু আর সেভাবে বিভাজ্য, হল না। ম্যাকলারেন, “A Sketch cf the History of the curreney”, 1858 পৃ:, ১৬।

৬. ইংরেজ লেখকদের কাছে মূল্যের পরিমাপ এবং দামের (মূল্যের মান ), এই দুয়ের মধ্যে বিভ্রান্তি অবর্ণনীয়। উভয়ের কাজ এবং উভয়ের অভিধা তারা সব সময়েই আলবদল করে ফেলেন।

৭. তাছাড়া এটা সাধারণভাবে ইতিহাস-সিদ্ধও নয়।

৮. যেমন ইংল্যাণ্ডে পাউণ্ড-স্টার্লিং, তার মূল ওজনের মাত্র ঔএর কম পরিমাণকে বোঝায়; স্কটল্যাণ্ডে, ইউনিয়নের আগে পর্যন্ত, বোঝাতা, ফ্রান্সে যেভাবে বোঝায় ১/৭৪; স্পেনে মার্বেদি বোঝায় ১/১০০০ এবং পর্তুগালে বোঝায় তা থেকেও কম এক ভগ্নাংশ।

৯. ‘Le monete le quali oggi sono ideali sono le piu antiche d’ogin nagione, tutte furono uotempo reali, eperehe reali conesse si contava’ (Galiaia Della moneta 1.c. p 153)

১০. ডেভিড আর্কুহার্ট তার “ফ্যামিলিয়ার ওয়ার্ডস” (“Familiar Words”)-এ এই বিকট বিকৃতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে আজকাল পাউণ্ড,যা নাকি হচ্ছে ইংল্যাণ্ডের প্রমাণ-মুদ্রা, তা হচ্ছে এক আউন্স সোনার চার ভাগেরও এক ভাগের মতো। এটা ‘মাপ’-এর প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়, ‘মাপ’-এর প্রতিষ্ঠা তো নয়ই।” তিনি এই মিথ্যা নামকরণের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছেন সভ্যতার সত্য-অপলাপকারী হস্তের অনাচার।

১১. অ্যানাটাসিসকে যখন প্রশ্ন করা হয়, কি উদ্দেশ্যে গ্রীকরা অর্থ ব্যবহার করত, তিনি উত্তর দেন, গণনার উদ্দেশ্যে।” (Athen-Deipn. IV. 49, V 2 ed. Schweighauser, 1802 )

১২. “যেহেতু দামের মান হিসেবে কাজ করার সময়ে অর্থ পণ্যের দামের মত একই পরিচয়বাহী নামে আবির্ভূত হয় এবং যেহেতু সেই কারণেই £৩. ১৭s. ১২d. একই সঙ্গে বোঝাতে পারে এক আউন্স সোনা এবং এক টন লোহার মুল্য, সেহেতু অর্থের এই পরিচয়বাহী নামটিকে অভিহিত করা হয় ‘টাকশালের দাম (mint price) বলে। এই থেকেই উদ্ভব ঘটল এই অসাধারণ ধারণাটির যে, সোনার মূল্য নিরূপিত হয় তার নিজেরই সামগ্রী দিয়ে এবং অন্যান্য জিনিসের দামের মতো না হয়ে এর দাম নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রের দ্বারা। ভুলভাবে মনে করা হত যে সোনার নির্দিষ্ট ওজনকে তার পরিচয়বাহী নাম করা আর ঐ ওজন পরিমাণ সোনার মূল্য নিরূপণ করা বুঝি একই জিনিস। (কার্লমার্কস, শেষোক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৫২)।

১৩. “Zur kritik der Pol. Oekon’—’Theorien von der Masseinbeit des Geldes. পৃ: 53. সোনা ও রূপার নির্দিষ্ট ওজনের উপরে আইনত নির্ধারিত নামগুলিকে অপেক্ষাকৃত বেশি বা কম পরিমাণ সোনা ও রূপার পরিমাণের উপরে স্থানান্তরিত করে অর্থের টাকশালে-দাম বৃদ্ধি বা হ্রাস করার আজগুবি ধারণাগুলি অন্ততঃ যে সমস্ত ক্ষেত্রে, এগুলি সরকারি ও বেসরকারি ক্রেডিটরদের বিরুদ্ধে নোংবা কাজকারবারের উদ্দেশ্যে পরিচালিত নয়, পরন্তু হাতুড়ে প্রতিকারের উদ্দেশ্যে পরিচালিত, সেই সমস্ত ক্ষেত্রে এই ধারণাগুলি উইলিয়াম পেটি তার “Quantulumcunque concerning money : To the Lord Marquis of Halifax, 1862-60 40 বিশদভাবে আলোচনা করেছেন যে, পরবর্তী অনুগামীদের কথা না হয় উল্লেখ নাই করলাম, এমনকি স্যার ভাভলি নথ এবং জন লক-এর মত তার সাক্ষাৎ অনুগামীরা পর্যন্ত তাকে কেবল তরলীকৃত করতেই সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছেন, “যদি কোন দেশের ধন একটি ঘোষণা জারি করে দশগুণ বৃদ্ধি করা যেত, তা হলে এটা আশ্চর্য যে আমাদের গভর্ণর এত কাল ধরে এমন ঘোষণা জারি করেন নি। (c. পৃ: ৩৬)।

১৪. “Ou bien, il faut, consentir a dire qu’une valeur d’un million en argent vaut plus qu’une valeur egale en marchandises.” (le Trosne, 1. c, p 919 ) which amounts to saying “qu’une valeur vaut plus qu’une valeur egale”.

১৫. কেবল তার যৌবনেই যে তাকে তার কল্পনার সুন্দরীদের দৈহিক বক্ত মাংসের সঙ্গে কুস্তি লড়তে হয়েছিল, শুধু তাই নয়, জেরোম ( Jerome )-কে কুস্তি লড়তে হয়েছে তার বার্ধক্যেও—অবশ্য তখন শুধু আত্মিক রক্তমাংসের সঙ্গে। তিনি লিখেছেন, “আমি ভেবেছিলাম, মহাবিশ্বের বিচারপতির সম্মুখে আমি আত্মিকভাবে উপস্থিত ছিলাম। তুমি কে?’—প্রশ্ন হল। আমি একজন খ্ৰীষ্টধর্মী।’ ‘তুমি মিথ্যা বলছ’-বজ্রকণ্ঠে উত্তর দিলেন সেই মহান বিচারপতি, তুমি একজন সিসেখোনীয় ছাড়া অন্য কিছু নও।

.

.

৩.২ সঞ্চলনের মাধ্যম

. পণ্যের রূপান্তর

পূর্বতন একটি অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে পণ্য-বিনিময়ের ব্যবস্থায় একাধিক স্ববিরোধী ও পরম্পর ব্যতিরেকী শর্তাবলী নিহিত থাকে। পণ্য এবং অর্থের মধ্যে পণ্য সম্ভারের বিভিন্নতা প্রাপ্তির ফলে এই অসংগতিগুলি দূর হয়ে যায়না বরং একটি কর্ম প্রক্রিয়ার উদ্ভব ঘটে—এমন একটি রূপের উদ্ভব ঘটে যাতে পণ্য এবং অর্থ, দুই-ই পাশাপাশি থাকতে পারে। সাধারণতঃ এই পথেই বাস্তব দ্বন্দ্বগুলির সমন্বয় ঘটে থাকে। যেমন, ধরুন, একটি সত্তা নিরন্তর অন্য একটি সত্তার দিকে নিপতিত হচ্ছে এবং সেই সঙ্গেই আবার নিরন্তর তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন এমন একটা চিত্র অবশ্যই দ্বন্দ্বমূলক। উপবৃত্ত হচ্ছে গতির এমন একটা রূপ যাতে, একদিকে যখন এই দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকার সুযোগ পায় আবার অন্যদিকে তখন তার সমম্বয়ও ঘটে।

যে-পর্যন্ত বিনিময় হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা বিভিন্ন পণ্য স্থানান্তরিত হর, যাদের কাছে সেগুলি অ-ব্যবহার-মূল্য তাদের হাত থেকে, তাদের হাতে যাদের কাছে সে-গুলি হয়ে ওঠে ব্যবহার-মূল্য, সে-পর্যন্ত বিনিময় হচ্ছে বস্তুর সামাজিক সঞ্চলন। এক ধরনের ব্যবহার্য (উপযোগী ) শ্রমের ফল অন্য ধরনের ব্যবহার্য (উপযোগী ) শ্রমের জায়গা নেয়। একটি পণ্য যখন একটি অবলম্বন পেয়ে গিয়েছে, যেখানে সে ব্যবহার মূল্য হিসেবে কাজে লাগতে পারে, এখনি সে সঞ্চলনের পরিধি থেকে নিস্ফান্ত হয়ে পরিভোগর পরিধির মধ্যে প্রবেশ লাভ করে। কিন্তু বর্তমানে আমরা কেবল সঞ্চলনের পরিধি নিয়েই ব্যস্ত থাকব। সুতরাং আমাদের এখন বিনিময়কে বিবেচনা করে দেখতে হবে রূপগত দিক থেকে, অনুসন্ধান করে দেখতে হবে পণ্যের সেই রূপ পরিবর্তন বা রূপান্তরকে যার ফলে বস্তুর সামাজিক সঞ্চচলন সংঘটিত হয়।

রূপের এই যে পরিবর্তন, তার উপলব্ধি, তা সচরাচর খুবই অসম্পূর্ণ। মূল্যের ধারণ সম্পর্কে নানাবিধ অস্পষ্টতা ছাড়াও, এই অসম্পূর্ণতার কারণ এই যে, একটি পণ্যে প্রত্যেকটি রূপ পরিবর্তনই হচ্ছে দুটি পণ্যের একট মামুলি পণ্য এবং বাকিটি অর্থ পণ্যের বিনিময়ের ফলশ্রুতি। একটি পণ্যের বিনিময় ঘটেছে সোনার সঙ্গে কেবল মাত্র এই বস্তুগত ঘটনাটিকেই যদি আমরা মনে রাখি, তা হলে যে জিনিসটি আমাদের লক্ষ্য করা উচিত ঠিক সেই জিনিসটিকেই আমরা করি উপেক্ষা; সেই জিনিসটি হল, আলোচ্য পণ্যটির রূপে কী ঘটে গেল সেইটি। আমরা এই ঘটনাটিকে উপেক্ষা করি যে সোনা যখন একটি পণ্য মাত্র, তখন তা অর্থ নয় এবং অন্যান্য পণ্য যখন তাদের নিজ নিজ দাম সোনার অঙ্কে প্রকাশ করে, তখন এই সোন। ঐ পণ্যগুলির অর্থরূপ ছাড়া আর কিছুই নয়।

প্রথমতঃ বিভিন্ন পণ্য যে যা ঠিক সেই ভাবেই বিনিময়ের প্রক্রিয়ার প্রবেশ করে। এই প্রক্রিয়াই তার পরে তাদের মধ্যে পণ্য এবং অর্থ হিসাবে বিভিন্নতা এনে দেয়। এবং, এই ভাবে, একই সঙ্গে ব্যবহার-মূল্য ও বিনিময়মূল্য হবার দরুণ তাদের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য প্রচ্ছন্ন থাকে, তারই আনুষঙ্গিক একটি বাহিক প্রকাশ্য বিরোধিতার জন্ম দেয়। ব্যবহার-মূল্যরূপী পণ্যসম্ভার এখন প্রতিস্থাপিত হয় বিনিময় মূল্যরূপী অর্থের বিপরীতে। অন্য দিক থেকে, দুটি প্রতিপক্ষই কিন্তু পণ্য ব্যবহার-মূল্য এবং বিনিময়মূল্যের ঐক্যস্বরূপ। কিন্তু বিভিন্নতার এই অভিজ্ঞতা বা ঐক্য নিজেকে অভিব্যক্ত করে দুটি বিপরীত মেরুতে এবং প্রত্যেকটি মেরুতে বিপরীত ভাবে। মেরু বলেই আবার তার আবশ্যিকভাবেই পরস্পরের বিপরীতও বটে আবার পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত বটে। সমীকরণের একদিকে আমরা পাই একটি মামুলি পণ্য, যা হচ্ছে আসলে একটি ব্যবহার-মূল্য। এর মূল্য কেবল ভাবগতভাবেই প্রকাশিত হয় দামের মাধ্যমে যে দামের দ্বারা সে তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে তথা সোনার সঙ্গে সমীকৃত হয়, যেমন হয় তার মূল্যের বাস্তব বিগ্রহ সঙ্গে। সোনা হিসেবেই সোনা বিনিময়-মূল্য। তার ব্যবহার-মূল্য সম্বন্ধে উল্লেখ্য যে তার আছে কেবল একটা ভাবগত অস্তিত্ব; বাকি সমস্ত পণ্যের মুখোমুখি সোনা যখন দাড়ায় তখন যে আপেক্ষিক মুল্য-প্রকাশের রাশিমালা তৈরি হয়, সেই রাশিমালাই হচ্ছে এই ব্যবহার মূল্যের প্রতিনিধি; সংশ্লিষ্ট সমস্ত পণ্যের ব্যবহারসমূহের যোগফলই হচ্ছে সোনার বিবিধ ব্যবহারের যোগফল। পণ্য সম্ভারের এই পরস্পর বিশুদ্ধ রূপগুলিই হল সেই সব বস্তুর রূপে তাদের বিনিময়-প্রক্রিয়াটি চলে এবং ঘটে।

এখন কোন একটি পণ্যের মালিকের সঙ্গে, ধরা যাক, আমাদের পুরোনো বন্ধু ছিট-কাপড়ের তন্তুবায়ের সঙ্গে, তার কর্মক্ষেত্রে অর্থাৎ বাজারে যাওয়া যাক। তার ২০ গজ ছিট কাপড়ের একটা নির্দিষ্ট দাম আছে ২ পাউণ্ড। সে ২ পাউণ্ডের বদলে তার পণ্যটি বিনিময় করল এবং তার পরে পুরনো দিনের ভালো মানুষ যা করে। থাকত তাই করল-সে তার পরিবারের জন্য ঐ একই দামের একখানি বাইবেল কিনল এবং তার হাতের টাকাটা-ঐ পাউণ্ড দুটি-হাতছাড়া করল। ঐ যে ছিট কাপড় তা তার কাছে একটি পণ্য-মাত্র, মূল্যের আধারমাত্র; তাকে সে সোনার বিনিময়ে, অর্থাৎ ছিট-কাপড়টি মূল্য-রূপের বিনিময়ে পরকীকৃত করল; এই সোনা তথা মূল্যরূপটিকে সে আবার হস্তান্তরিত করল আরেকটি পণ্যের জন্য তথা বাইবেল খানির জন্য—সে বাইবেলখানি তার পরিবারে স্থান পাবে একটি উপযোগপূর্ণ সামগ্রী হিসেবে, পরিবারের লোকজনদের কাছে আরাধ্য গ্রন্থ হিসেবে। এই বিনিময় প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণায়িত হল দুটি বিপরীত অথচ পরিপুরক রূপান্তরণের মাধ্যমে পণ্যটির অর্থ রূপান্তরণ এবং ঐ অর্থের আকার পণ্যে পুনঃরূপান্তরণ। এই রূপান্তরণের দুটি পর্যায়ই আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটির দুটি সুস্পষ্ট লেনদের—বিক্রয় বা অর্থের জন্য পণ্যের বিনিময়, আবার ক্রয় বা পণ্যের জন্য অর্থের বিনিময় এবং দুটি কাজের ঐক্য হল : ক্রয়ের জন্য বিক্রয়।

আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটির কাছে গোটা লেনদেনটির ফলশ্রুতি হল এই যে ছিট কাপড়ের মালিক না হয়ে, সে এখন হল বাইবেলখানির মালিক; তার মূল পণ্যটির পরিবর্তে তার মালিকানায় এসেছে একই মূল্যের অথচ ভিন্নতর উপযোগিতার অন্য একটি পণ্য। একই উপায়ে সে জীবনধারনে অন্যান্য উপায়-উপকরণ এবং উৎপাদনের উপায়-উপকরণ করে থাকে। তার দৃষ্টিকোণ থেকে, গোটা প্রক্রিয়াটির ফল যা দাড়ালো তা অন্য কারো শ্রমজাত দ্রব্যের জন্য নিজের শ্রমজাত দ্রব্যের বিনিময় ছাড়া, নিছক দ্রব্যের বদলে দ্রব্য বিনিময় ছাড়া আর কিছুই নয়।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে বিবিধ পণ্যের বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলি সংঘটিত হয়।

পণ্য—অর্থ-পণ্য
প-অ—প

সংশ্লিষ্ট দ্রব্যগুলির পথে সমগ্র প্রক্রিয়াটির ফল হল একটি পণ্যের জন্য আরেকটি পণ্যের বিনিময়-বাস্তবায়িত সামাজিক শ্রমের সঞ্চলন। যখন এই ফলটি অর্জিত হয়ে যায়, গোটা প্রক্রিয়াটাও শেষ হয়ে যায়।

অঃ প্রথম রূপান্তরণ বা বিক্রয়

পণ্যের দেহ থেকে সোনার দেহ মুল্যের এই যে উম্ফন, অন্যত্র আমি তাকে অভিহিত করেছি পণ্যের ‘Salto mortale’ বলে। যদি তার কমতি হয়, তা হলে পণ্যটির নিজের কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু মালিকের ক্ষতি হয় নিশ্চয়ই। শ্রমের সামাজিক বিভাজনের ফলে তার প্রম হয় যেমন একপেশে তার অভাবগুলি হয় তেমন অনেক পেশে। আর ঠিক এই কারণেই তার শ্রমের ফল তার সেবায় লাগে কেবল বিনিময়মূল্য হিসেবেই। কিন্তু অর্থে রূপান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত তার শ্রম ফল সমাজস্বীকৃত সর্বজনীন সমার্থরূপের গুণাবলী অর্জন করে না। কিন্তু সেই অর্থ থাকে অন্য কারো পকেটে। সেই পকেট থেকে তাকে প্রলুব্ধ করে বাইরে নিয়ে আসতে হলে আমাদের বন্ধুর পণ্যটিকে হতে হবে সব কিছুর উপরে ঐ অর্থের অধিকারীর কাছে ব্যবহার মূল্য ভূষিত। এই কারণে, উক্ত পণ্যে ব্যয়িত শ্রমকে হতে হবে এমন এক ধরনের যা সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয়, এমন এক ধরনের যা সামাজিক শ্রম-বিভাগেরই একটি শাখা স্বরূপ। কিন্তু শ্রম-বিভাগ হচ্ছে এমন একটি উৎপাদন-প্রণালী যা গড়ে উঠেছে এবং বেড়ে উঠতে থাকে স্বতঃস্ফুত ভাবে উৎপাদনকারীদের অজান্তে। বিনিময়ে পণ্যটি হয়তো এমন কোনো নতুন ধরনের শ্ৰম-ফলত হতে পারে যা নতুন করে উদ্ভূত কোনো অভাব বোধের পরিতৃপ্তি সাধনের কিংবা, এমন কি নতুন করে কোনো অভাব বোধের উদ্ভব ঘটানোর দাবি নিয়ে হাজির হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট পণ্য-উৎপাদনের উদ্দেশ্যে কোন উৎপাদনকারীর পরিচালনায় পরিচালিত বহুবিধ উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি মাত্র প্রক্রিয়া হয়েও গতকালের কোনো একটি উৎপাদন প্রক্রিয়া আজকে নিজেকে এই সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে নিজেকে একটি স্বতন্ত্র এম-শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এবং নিজেকে অসম্পূর্ণ উৎপন্ন-দ্রব্যটিকে একটি স্বতন্ত্র পণ্য হিসেবে বাজারে পাঠাতে পারে। অবস্থাবলী এই ধরনের বিচ্ছেদের পক্ষে পরিণত হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। আজই ঐ পণ্যটি সামাজিক অভাব-বোধের তৃপ্তি সাধন করছে। আগামীকাল অন্য কোনো ঘোগ্যতার উৎপন্ন-দ্রব্য অংশতঃ বা সম্পূর্ণতঃ তার জায়গা দখল করে নিতে পারে। অধিকিন্তু যদি আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটির শ্রম সমাজ স্বীকৃত এম-বিভাগের একটি শাখা বলে পরিগণিত, তা সত্বেও কিন্তু কেবল এই ঘটনা কোন ক্রমেই তার ২০ গজ ছিট কাপড়ের উপযোগিতাকে নিশ্চয়ীকৃত করে না। অন্যান্য প্রত্যেকটি অভাবের মতো সমাজের কাছে ছিট কাপড়ের অভাবও সীমাবদ্ধ এবং সেই কারণেই যদি প্রতিদ্বন্দ্বী তন্তুবায়দের উৎপন্ন ছিট-কাপড়ের সমাজের এই বিশেষ অভাবটি পুরোপুরি মিটে গিয়ে থাকে তা হলে আমাদের বন্ধুটির উৎপন্ন ছিট কাপড হয়ে পড়বে বাড়তি, ফালতু, এবং কাজেকাজেই অকেজো। একথা ঠিক যে মানুষ দানের ঘোড়াতে যাচাই করে নেয়না কিন্তু আমাদের বন্ধুটিত দান-খয়রাতের জন্য তার ছিট-কাপড় নিয়ে বাজারে আনাগোনা করে না। কিন্তু ধরুন, যদি তার উৎপন্নদ্রব্য একটি সত্যকার ব্যবহার মূল্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সেই হেতু অর্থকে আকর্ষণ করে? তখন প্রশ্ন জাগবে, কতটা অর্থ সে আকর্ষণ করবে? সন্দেহ নেই যে সংশ্লিষ্ট জিনিসটির মূল্য আয়তনের মুখপাত্রস্বরূপ যে দাম সেই দামের মধ্যেই উত্তরটি আগেভাগেই ধরে নেওয়া হয়েছে। আমাদের বন্ধুটি অবশ্য তার দামের হিসেবে হঠাৎ কোন ভুলও করে বসতে পারে, সে ক্ষেত্রে এই ধরনের ভুল বাজারে গিয়ে অনতি বিলম্বেই সংশোধিত হয়ে যাবে; তাই এই ধরনের ভুলচুক আমরা আমাদের আলোচনার বাইরে রাখছি। আমরা ধরে নিচ্ছি যে সে তার উৎপন্ন দ্রব্যে কেবল ততটা পরিমাণ শ্রম-সময় ব্যয় করেছে, যতটা পরিমাণ শ্রম-সময় গড় হিসেবে সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয়। তা হলে, দাম হচ্ছে কেবল একটা অর্থ-নাম তার পণ্যটিতে যে পরিমাণ সামাজিক শ্রম বাস্তবায়িত হয়েছে তারই অর্থ-নাম। কিন্তু আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটির অনুমতি ব্যতিরেকেই তার অজ্ঞাতসারেই বয়নের পুরনো ধাঁচের পদ্ধতিটি বদলে গেল। সে ক্ষেত্রে গতকাল পর্যন্ত এক গজ ছিট-কাপড় বুনতে সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় যে-পরিমাণ শ্রম-সময়ের দরকার পড়ত, আজ থেকে তা আর দরকার পড়ে না। তখন আমাদের বন্ধুটির যারা প্রতিযোগী, তারা যে-দাম চাইছে, সেই দামের উল্লেখ করে অর্থের মালিক এই ঘটনাটা ব্যগ্র ভাবে প্রমাণ করতে চেষ্টা করবে। আমাদের বন্ধুটির দুর্ভাগ্য যে তন্তুবায়ের সংখ্যায় অল্প নয় আর তারা দূরদূরান্তেও অবস্থান করে না। সর্বশেষে, ধরে নেওয়া যাক যে বাজারে উপস্থাপিত ছিট-কাপড়ের প্রত্যেকটি টুকরো যে-পরিমাণ শ্রম-সময় সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় তা থেকে মোটেই বেশী শ্রম সময় ধারণ করছে না। তা সত্ত্বেও কিন্তু ছিট-কাপড়ের এই সমস্ত টুকরোগুলির মোট পরিমাণ প্রয়োজনাতিরিক্ত শ্রম-সময় ধারণ করে থাকতে পারে। গজ প্রতি ১ শিলিং এই স্বাভাবিক দামে বাজার যদি মোট পরিমাণ ছিট-কাপড়কে উদৱস্থ করতে না পারে তা হলে প্রমাণ হয়ে যায় যে সমাজের মোট শ্রমের অবাঞ্ছনীয় রকমের একটা বড় অংশ বয়নের আকারে ব্যয় করা হয়েছে। প্রত্যেকটি তন্তুবায় ব্যক্তিগত ভাবে যদি তার উৎপন্ন দ্রব্যের উপরে সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমের অতিরিক্ত শ্রম ব্যয় করত, তা হলে যে ফল হত, এক্ষেত্রেও ফল তাই হবে। জার্মান প্রবচনটির ভাষায় এখানে আমরা বলতে পারি। এক সঙ্গে ধরা এক সঙ্গে মরা। বাজারে সমস্ত ছিট কাপড় তখন গণ্য হয় বাণিজ্যের একটি মাত্র অখণ্ড সামগ্রী হিসাবে যার মধ্যে এক-একটি টুকরো হচ্ছে এক-একটি খণ্ডাংশ মাত্র। আর বাস্তবিক পক্ষে, প্রত্যক গজ ছিট কাপড়ের মূল্য হচ্ছে এক ও অভিন্ন সমজাতীয় মনুষ্য-শ্রমের সুনির্দিষ্ট, সামাজিক ভাবে স্থিরীকৃত পরিমাণের বাস্তবায়িত রূপ মাত্র।*

[* এন. এফ. ড্যানিয়েলসন-এর কাছে লেখা তার ২৮শে নভেম্বর, ১৮৭৮ তারিখের চিঠিতে মার্কস প্রস্তাব করেন যে তার এই বাক্যটি এইভাবে পুনলিখিত করা হোক, আর বাস্তবিক পক্ষে, প্রত্যেক গজ ছিট-কাপড়ের মূল্যও সমগ্র-সংখ্যক গজের উপরে ব্যয়িত সামাজিক শ্রমের বাস্তবায়িত রূপের একটি অংশমাত্র’-রুশ সংস্করণ মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-তালিন ইনষ্টিটিউট’-এর টীকা।]

তা হলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে পণ্যের। অর্থের সঙ্গে প্রেমাসক্ত, কিন্তু “যথার্থ প্রেমের পথ কখনো মসৃণগতি নয়”। শ্রমের গুণগত বিভাজন যেভাবে সংঘটিত হয়, ঠিক সেই একই স্বতঃস্ফূর্ত ও আপতিক ভাবে সংঘটিত হয় শ্রমের মাত্রাগত বিভাজন। সুতরাং পণ্যসম্ভারের মালিকেরা আবিষ্কার করে, যে-শ্রমবিভাজন তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র ব্যক্তি মালিকে পরিণত করে, ঠিক সেই একই শ্রমবিভাজন উৎপাদনের সামাজিক প্রক্রিয়াকে এবং সেই প্রক্রিয়ার অন্তর্গত ব্যক্তিগত উৎপাদন কারীদের পারস্পরিক সম্পর্ককে সেই উৎপাদনকারীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা থেকে মুক্ত করে, এবং ব্যক্তি-মালিবদের আপাত-দৃশ্য পারস্পরিক স্বাতন্ত্রকে উৎপন্ন দ্রব্যসমূহের মাধ্যমে বা সাহায্যে সাধারণ ও পারস্পরিক সাপেক্ষতার একটি প্রণালীর দ্বারা পরিপুরিত করে।

শ্রম-বিভাজন শ্ৰজাত দ্রব্যকে পণ্যে পরিবর্তিত করে এবং এইভাবে তার অর্থে পরিবর্তনের পর্যায়টিকে আবশ্যিক করে তোলে। একই সময়ে আবার তা এই পর্যায়ান্তিক পরিবর্তনের সম্পাদনাকে আপতিক করে তোলে। এখানে অবশ্য আমরা কেবল তার অখণ্ডতার ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করছি এবং সেই কারণেই তার পুরে।গতিকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিচ্ছি। অধিকন্তু, এই পরিবর্তন যদি আদৌ ঘটে অর্থাৎ আলোচ্য পণ্যটি যদি একেবারেই অবিক্রেয় না হয়, তা হলে এই রূপান্তর অবশ্যই ঘটে- যদিও প্রাপ্ত দাম মূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক ভাবে বেশী বা অস্বাভাবিক কম হতে পারে।

বিক্রেতা তার পণ্যের বদলে পায় সোনা এবং ক্রেতা তার সোনার বদলে পায় একটি পণ্য। যে ঘটনাটি আমরা এখানে প্রত্যক্ষ করছি, তা এই যে, একটি পণ্য এবং সোনার-২০ গজ ছিট কাপড় এবং ২ পাউণ্ড-এর-হাত বদল এবং জায়গা বদল হয়েছে, অর্থাৎ তাদের বিনিময় হয়েছে। কিন্তু কিসের সঙ্গে পণ্যটি বিনিমিত হল? তারই নিজের মূল্য যে আকার পরিগ্রহ করেছে, সেই আকারের সঙ্গে তথা সর্বজনীন সমার্ঘটির সঙ্গে। এবং ঐ সোন বিনিমিত হল কিসের সঙ্গে? বিনিমিত হল তার নিজেরই ব্যবহার মূল্যের একটি রূপের সঙ্গে। ছিট-কাপড়ের মুখোমুখি সোনা অর্থের রূপ ধারণ কেন? কারণ ছিট-কাপড়ের ২ পাউণ্ড দাম তথা অর্থ-রূপ তাকে এরই মধ্যে অর্থ-রূপে অভিব্যক্ত সোনার সঙ্গে সমীকৃত করে দিয়েছে। পরকীকৃত হবার সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ যে মুহূর্তে তার ব্যবহার মূল্য সোনাকে আকৃষ্ট করে যে সোনা এর আগে তার। দামের মধ্যে বিস্তৃত ছিল কেবল ভাবগত ভাবে, সেই মুহূর্তে পণ্য তার মূল্যটিকে অর্থাৎ পণ্যরূপটিকে পরিহার করে। অতএব দেখা যাচ্ছে যে কোনো পণ্যের দাম কিংবা তার মূল্যের ভাবগত রূপের বাস্তবায়ন হচ্ছে সেই একই সঙ্গে অর্থের ভাবগত ব্যবহার মূল্যের বাস্তবায়ন; কোন পণ্যের অর্থে রূপ-পরিগ্রহণের মানে হল সেই একই সঙ্গে অর্থেরও পণ্যে রূপ-পরিগ্রহণ। বাহ্যতঃ যাকে মনে হয় একটিমাত্র একক প্রক্রিয়া বলে কার্যত সেটি হচ্ছে একটি দ্বৈত প্রক্রিয়া পণ্য মালিকের মেরু থেকে এটাকে বলা হয় ‘বিক্রয’, অর্থ মালিকের বিপরীত মেরু থেকে এটা হচ্ছে ‘ক্রয়’। ভাষান্তরে একটা বিক্রয় মানেই একটা ক্ৰয়। প—অ আবার অ—প ও বটে।[১]

এ পর্যন্ত আমরা মানুষদের বিবেচনা করেছি কেবল তাদের একটি মাত্র অর্থনৈতিক অবস্থানে, সেটা হল পণ্যসমূহের বিভিন্ন মালিকের অবস্থানে, যে অবস্থানে থেকে তারা অন্যদের ম-ফলকে আত্মসাৎ করে এবং তা করতে গিয়ে তাদের নিজেদের শ্রম থেকেই তাদেরকে পরকীকৃত করে। সুতরাং অর্থের অধিকারী এমন একজন মালিকের সঙ্গে যদি একজন পণ্য মালিককে সাক্ষাৎ করতে হয়, তা হলে যা দরকার হয় তা হচ্ছে এই : হয়, অর্থের অধিকারী ব্যক্তিটির তথা ক্রেতা ব্যক্তিটির শ্রমের ফল নিজেই হবে অর্থ, নিজেই হবে সোনা, মানে সেই সামগ্রী যা দিয়ে অর্থ তৈরী হয়; আর নয়তো, তার শ্রম ফল হবে এমনটি যা এরই মধ্যে তার আবরণ পালটে ফেলেছে এবং ব্যবহার্য ( উপযোগী) জিনিসের মূল রূপটিকে পরিহার করেছে। যাতে করে সে অর্থের ভূমিকা পালন করতে পারে তার জন্য সোনাকে অবশ্যই কোন না কোন বিন্দুতে অথবা অত্র বাজারে প্রবেশ লাভ করতে হবে। এই বিন্দুটি লক্ষ্য করা যায় সংশ্লিষ্ট ধাতুটির উৎপাদনের উৎসক্ষেত্রে যে জায়গায় সমান মূল্যের অন্য কোন উৎপন্নের সঙ্গে শ্রমের অব্যবহিত ফল হিসেবে সোনার বিনিময় সংঘটিত হয়। সেই মুহূর্ত থেকে তা সর্বদাই হয় কোন পণ্যের বাস্তবায়িত দামের প্রতিনিধি।[২] নিজের উৎপাদনের উৎসক্ষেত্রে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে তার বিনিময় ছাড়াও, সোন? তা সে যারই হাতে থাক না কেন সোনা হচ্ছে মালিকের দ্বারা পরকীকৃত কোন পণ্যের রূপান্তরিতু আকার; এ হচ্ছে একটি বিক্রয়ের তথা প-অ এই রূপান্তরণের ফল। [৩] অন্যান্য পণ্য যখন নিজ নিজ মূল্য সোনার অঙ্কে পরিমাপ করতে লাগল এইভাবে উপযোগী সামগ্রী হিসেবে তাদের স্বাভাবিক আকারের সঙ্গে ভাবগত ভাবে তার প্রতি তুলনা করতে থাকল আর এইভাবে তাকে তাদের মূল্যের আকারে পরিণত করল, তখনি সোনা হয়ে উঠল ভাবগত ভাবে অর্থ তথা মূল্য সমূহের পরিমাপ। পণ্যাবলীর সাধারণ পরকীকরণের মাধ্যমে, নিজ নিজ স্বাভাবিক আকার সহ-উপযোগী দ্রব্য হিসেবে তাদের স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে এবং এর ফলে বাস্তবে তাদের বিভিন্ন মূল্যের মৃত বিগ্রহে পরিণত হবার মাধ্যমেই সোনা বস্তুতই অর্থ হয়ে উঠল। পণ্যের যখন এই অর্থ-আকার ধারণ করে, তখন সমজাতীয় মনুষ্য-শ্রমের এক ও অভিন্ন সমাজ-স্বীকৃত মূর্ত বিগ্রহে নিজেদের রূপান্তরিত করার জন্য তারা তাদের স্বাভাবিক ব্যবহার মূল্যের প্রত্যেকটি চিহ্ন থেকে এবং শ্রমের যে বিশেষ বিশেষ ধরন থেকে তাদের সৃষ্টি সেই সব ধরন থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ মুক্ত করে নেয়। কেবল একটা মুদ্রা দেখেই আমরা বলতে পারি না কোন বিশেষ পণ্যের সঙ্গে তার বিনিময় হয়েছে। অর্থ-রূপের অধীনে সব পণ্যই একইরকম দেখায়। সুতরাং, অর্থ মাটিও হতে পারে, যদিও মাটি অর্থ নয় : আমরা ধরে নিচ্ছি যে, দুটি স্বর্ণখণ্ড যার বিনিময়ে আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটি তার ছিট কাপড় হাতছাড়া করেছে সেই দুটি স্বর্ণ খণ্ড এক কোয়ার্টার গমের রূপান্তরিত আকার, ছিটকপিডের বিক্রয় প-অ আবার একই সঙ্গে তার ক্রয়ও বটে অপ। কিন্তু বিক্রয় হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়ার প্রথম ক্রিয়া যার শেষ হয় বিপরীত প্রকৃতির একটি লেনদেনে যথা বাইবেল-এর ক্রয়; অপর পক্ষে, ছিট কাপডের ক্রয়, যার শুরু হয়েছিল একটি বিপরীত প্রকৃতির ক্রিয়ায়, যথা গমের বিক্রয় প-অ (ছিট কাপড়-পণ্য, যা হচ্ছে প—অপ (ছিট কাপড়—অর্থ-বাইবেল) এর প্রথম পর্যায়, তা হচ্ছে আবার অ—প (অর্থ-ছিট কাপড়। ও, আরেকটি গতিক্রমের শেষ পর্যায় প-অ-প (গম—অর্থ-ছিট কাপড়)। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, একটি পণ্যের প্রথম রূপান্তরণ, পণ্য থেকে অর্থে তার রূপ-পরিবর্তন আবার আবশ্যক ভাবেই একই অন্য কোন পণ্যের দ্বিতীয় রূপান্তরণ, তার অর্থ থেকে পণ্যে রূপ-পরিবর্তন।[৪]

.

কিংবা ক্রয়
পণ্যের দ্বিতীয় তথা সর্বশেষ রূপান্তরণ

যেহেতু অর্থ হচ্ছে বাকি সমস্ত পণ্যের রূপান্তরিত আকার, তাদের সাধারণ পরকীকরণের ফলশ্রুতি, সেহেতু সে নিজেই বিনা বাধায়, বিনা শর্তে পরকীকরণীয়। সে সমস্ত দামকেই পেছন দিক থেকে পডে, এবং এইভাবে, বলা যায় যে, বাকি সমস্ত পণ্যের দেহে নিজেকে একে দেয়—যেসব পণ্য তাকে দেয় তার নিজের ব্যবহার মূল্য বাস্তবায়িত করার সামগ্রীটি। একই সময়ে, বিভিন্ন দাম তথা অর্থের প্রতি বিভিন্ন পণ্যের মনোহরণ কটাক্ষপাত, তার পরিমাণের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে, তার রূপ পরিবর্তনীয়তার সীমা নিরূপণ করে দেয়। যেহেতু প্রত্যেকটি পণ্যই অর্থে রূপায়িত হবার পরেই পণ্য হিসেবে অন্তহিত হয়ে যায়, সেহেতু স্বয়ং অর্থ থেকে এটা বলা অসম্ভব যে কেমন করে সে তার মালিকের অধিকারে চলে গিয়েছিল অথবা কোন্ জিনিস তাতে পরিবর্তিত হয়েছিল। তা সে অর্থ যে উৎস থেকেই আসুক না কেন। এক দিকে সে যখন প্রতিনিধিত্ব করছে একটি বিক্রিত পণ্যের, অন্যদিকে সে তখন প্রতিনিধিত্ব করছে এমন একটি পণ্যের যেটা ক্রয় করা হবে।[৫]

অ—প, একটি ক্রয়, আবার একই সঙ্গে প-অ, একটি বিক্রয়; একটি পণ্যের সর্বশেষ রূপান্তরণ হচ্ছে আরেকটি পণ্যের সর্বপ্রথম রূপান্তরণ। আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটির বেলায়, তার পণ্যের জীবনবৃত্ত শেষ হল বাইবেল এর সঙ্গে, যাতে সে পুন:-রূপ পরিবর্তিত করেছে তার ২টি পাউণ্ডকে। কিন্তু ধরুন, তন্তুবায়ের দ্বারা বিমুক্ত পাউণ্ড ২টিকে যদি বাইবেল-এর বিক্রেতা মদে রূপ-পরিবর্তিত করে অর্থ-প, তা হলে প-অ—প ( ছিট-কাপড়, অর্থ, বাইবেল)-এর সর্বশেষ পর্যায়টি হবে, আবার প-অ অর্থাৎ প—অ—প (বাইবেল, অর্থ, মদ্য )-এর প্রথম পর্যায়টিও। একটি বিশেষ পণ্যের উৎপাদনকারীর হাতে থাকে দেবার মতো সেই একটি জিনিসই, সেটাকেই সে বিক্রয় করে প্রায়ই বিরাট বিরাট পরিমাণে; কিন্তু তার বহু সংখ্যক ও বহুবিধ অভাব তাকে বাধ্য করে অসংখ্য ক্রয়ের মধ্যে তার আদায়ীকত দামকে, বিযুক্ত অর্থের মোট পরিমাণকে বিভক্ত করে দিতে। সুতরাং একটি বিক্রয়ের পরিণতি ঘটে বহুবিধ জিনিসের বহুসংখ্যক ক্ৰয়ে। একটি পণ্যের সর্বশেষ রূপান্তরণ এইভাবে সংঘটিত করে অন্যান্য বহুবিধ পণ্যের সর্বপ্রথম রূপান্তরণসমূহের একটি সামূহিক সমষ্টি।

এখন যদি আমরা একটি পণ্যের সম্পূর্ণীকৃত রূপান্তরণটিকে সামগ্রিকভাবে বিচার করি, তা হলে দেখতে পাই যে, প্রথমে, তা গঠিত হয় দুটি বিপরীত কিন্তু পরিপুর্বক গতিক্রমের দ্বারা প—অ এবং অপ। পণ্যের এই দুটি বিপরীতমুখী আকার পরিবর্তন সংঘটিত হয় মালিকদের পক্ষ থেকে দুটি বিপরীতমুখী সামাজিক ক্রিয়ার দ্বারা আর এই ক্রিয়াগুলি আবার তার দ্বারা সম্পাদিত বিভিন্ন ভূমিকার উপরে যথােচিত অর্থ নৈতিক অভিধায় ভূষিত করে দেয়। ব্যক্তি যখন বিক্রয় করে সে তখন বিক্রেতা; আবার সে যখন ক্রয় করে, সে তখন ক্রেতা। কিন্তু যেমন যে-কোনো পণ্যের এই ধরণের প্রত্যেকটি আকার-পরিবর্তনে পরেই তার দুটি রূপ, পণ্যরূপ ও অর্থরূপ, যুগপৎ দৃশ্যমান হয়—অবশ্য দুটি বিপরীত মেরুতে, ঠিক তেমনি প্রত্যেক বিক্রেতারই প্রতিপক্ষে থাকে একজন ক্রেতা এবং প্রত্যেক ক্রেতারই প্রতিপক্ষে থকে একজন বিক্রেতা। যখন কোন বিশেষ একটি পণ্য পণ্যরূপ ও অর্থপ—তার দুটি রূপের মধ্য দিয়ে পরপর অতিক্রান্ত হয় তখন তার মালিকও পরপর অতিক্রান্ত হয় তার বিক্রেতারূপ ভূমিকা থেকে তার তোরূপ ভূমিকায়। সুতরাং বিক্রেতা এবং ক্রেতা হিসেবে এই যে বিভিন্ন চরিত্র তা স্থায়ী নয়, বরং পণ্য সঞ্চলনে যে বিভিন্ন ব্যক্তি নিযুক্ত থাকে এই বিভিন্ন চরিত্র পালাক্রমে সেই ব্যক্তিদের সঙ্গে লগ্ন হয়।

সরলতম রূপে একটি পণ্যের সম্পূর্ণ রূপান্তণের মধ্যে নিহিত থাকে চারটি চরম বিন্দু এবং তিনটি নাটকীয় চরিত্র। প্রথমে একটি পণ্য মুখোমুখি হয় অর্থের সঙ্গে, অর্থ হচ্ছে পণ্যটির মূল্যের দ্বারা পরিগৃহীত রূপ, এবং তা তার নিরেট বস্তুরূপে অবস্থান করে ক্রেতার পকেটে। পণ্যের মালিক এইভাবে আসে অর্থের মালিকের সংস্পর্শে। এখন যত তাড়াতাড়ি পণ্যটি অর্থে পরিবর্তিত হয় তত তাড়াতাড়ি অর্থ হয় তার ক্ষণস্থায়ী সমার্ঘ রূপ-যে সমার্ঘ রূপটির ব্যবহার মূল্য দৃশ্যমান হয় অন্যান্য পণ্যের দেহে। প্রথম আকার পরিবর্তনের অন্তিম সীমা হল অর্থ, আবার এই অর্থই হল দ্বিতীয় অকার পরিবর্তনের যাত্রা-বিন্দু। প্রথম লেনদেনে যে ব্যক্তিটি থাকে বিক্রেতা সেই ব্যক্তিটিই দ্বিতীয় লেনদেনে হয়ে পড়ে ক্রেতা; আর এই দ্বিতীয় লেনদেনের মঞ্চে আবির্ভূত হয় তৃতীয় এক পণ্য মালিক।[৬]

পরস্পরে বিপরীত এই যে দুটি পর্যায়-যা একটি পণ্যের রূপান্তর সম্পূর্ণায়িত করে। সেই পর্যায় মিলেই রচনা করে একটি গতিক্রম, একটি আবর্ত : পণ্য-রূপ, পণ্য রূপের পরিহার এবং আবার সেই পণ্য রূপে প্রত্যাবর্তন। সন্দেহ নেই যে পণ্যটি এখানে দেখা দেয় ভিন্ন ভিন্ন দুটি চেহারায়। যাত্রা-বিন্দুতে সে তার মালিকের কাছে ব্যবহার-মূল্য থাকে না; সমাপ্তি বিন্দুতে সে কিন্তু হয়ে যায় একটি ব্যবহার-মূল্য। একই রকমে অর্থ প্রথম পর্যায় দেখা দেয় মূল্যের একটি ঘনীভূত স্ফটিক হিসেবে—এমন একটি স্ফটিক যার মধ্যে পণ্যটি ব্যগ্রভাবে ঘনত্ব পরিগ্রহ করে, এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে তা আবার বিগলিত হয়ে পরিণত হয় এমন একটি ক্ষণস্থায়ী সমার্থরূপে-যার ভবিতব্য হচ্ছে একটি ব্যবহার মূল্যের দ্বারা স্থানচ্যুত হওয়া।

আবত গঠনকারী এই যে দুটি আকার পরিবর্তন তা আবার একই সময়ে অন্য দুটি পণ্যের দুটি বিপরীতমুখী আংশিক রূপান্তরণ। এক ও অভিন্ন একটি পণ্য, এখানে ছিট-কাপড়, খুলে দেয় তার রূপান্তরণ-সমূহের একটি পর্যায়ক্রমে এবং পূর্ণ করে দেয় আরেকটি পণ্যের এখানে গমের রূপান্তরণ। প্রথম পর্যায়ে তথা বিক্রয়ে। ছিট-কাপড় তার নিজের ব্যক্তিরূপেই এই দুটি ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু তারপর সোনায় পরিবর্তিত হয়ে সে তার নিজের দ্বিতীয় এবং চূড়ান্ত রূপান্তরণ সম্পূর্ণায়িত করে এবং সেই সঙ্গে তৃতীয় আরেকটি পণ্যের প্রথম রূপান্তরণে সাহায্য করে। অতএব, নিজের ভিন্ন ভিন্ন রূপান্তরণের গতিপথে একটি পণ্য যে আবর্ত সৃষ্টি করে তা অন্যান্য পণ্যের আবর্তসমূহের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে ভাবে জড়িত। এই সমস্ত ও বিভিন্ন আবর্তের মোট যোগফলই হচ্ছে পণ্যসমূহের সঞ্চলন।

দ্রব্যের বদলে দ্রব্যের প্রত্যক্ষ লেনদেন ( দ্রব্য-বিনিময়) ব্যবস্থা থেকে পণ্য সঞ্চলন ব্যবস্থা কেবল বহিঃরূপের দিক থেকেই নয় অন্তর্বস্তুর দিক থেকেও ভিন্নতর। ঘটনাবলীর গতিধারাটাই বিবেচনা করে দেখুন। কার্যত তন্তুবায় তার ছিট-কাপড় বিনিময় করেছে বাইবেলের সঙ্গে অর্থাৎ তার নিজের পণ্য বিনিময় করেছে অন্য কারো পণ্যের সঙ্গে। কিন্তু এটা কেবল তত দূর পর্যন্তই সত্য, যত দূর পর্যন্ত সে নিজে সংশ্লিষ্ট। গমের সঙ্গে তার ছিট-কাপড়টির বিনিময় ঘটেছে-এই ঘটনা সম্পর্কে আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটি যতট। অবহিত ছিল, বাইবেলের ক্রেত ব্যক্তিটি, যে তার ভিতরটা গরম রাখবার জন্য কিছু চাইছে, সে-ও তার বাইবেলখানার বদলে ছিট কাপড় বিনিময় করা সম্পর্কে তার চেয়ে বেশী আগ্রহান্বিত ছিল না। খ-এর পণ্য ক-এর পণ্যের জায়গা নেয় কিন্তু ক এবং খ পরস্পর এই দুটি পণ্যের বিনিময় করে না। এমন ঘটনা অবশ্য ঘটতে পারে যে ক এবং খ একজনের কাছ থেকে অন্যজন যুগপৎ ক্রয় করেছে কিন্তু এমন বিরল ব্যতিক্রমগুলি কোন ক্রমেই পণ্য সঞ্চলনের সাধারণ অবস্থাবলীর আবশ্যিক ফলশ্রুতি নয়। এখানে এক দিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি পণ্যের বিনিময় কেমন করে প্রত্যক্ষ দ্রব্য-বিনিময় প্রথার সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত সমস্ত স্থানগত ও ব্যক্তিগত সীমানাকে ভেদ করে এবং সামাজিক শ্রমের উৎপন্নসমূহের সঞ্চলনের বিকাশ ঘটায়, অন্য দিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি কেমন করে তা স্বতস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ বহিভূত সামাজিক সম্পর্কসমূহের একটি গোটা জালের বিকাশ ঘটায়। কৃষক তার গম বিক্রয় করেছে বলেই তো তন্তুবায় তার কাপড় বিক্রয় করতে সক্ষম হয়, আবার তন্তুবায় তার কাপ ও বিক্রয় করেছে বলেই তো আমাদের হটলপুর তার বাইবেল বিক্রয় করতে সক্ষম হয়, আর যেহেতু হটপুর তার অমৃত-জীবনের বারি বিক্রয় করেছে সেহেতু চোলাইকার তার ‘সঞ্জীবনী সুধা বিক্রয় করতে সক্ষম হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রত্যক্ষ দ্রব্য-বিনিময় প্রথার মতো পণ্য-সঞ্চলন, ব্যবহার-মূল্যসমূহের হাত ও জায় ল সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় না। কোন পণ্যের রূপান্তরণের আবর্ত থেকে খসে যাবার পরে অর্থের অন্তর্ধান ঘটে না। তা নিরন্তর সঞ্চলনের আঙ্গিনায় অন্যান্য পণ্যের শূন্যস্থলে নতুন নতুন জায়গায় স্থান পায়। যেমন, ছিট কাপড়ের সম্পূর্ণায়িত রূপান্তরণে ছিট-কাপড় অর্থ-বাইবেল এই রূপান্তরণে ছিট কাপড় সবার আগে সঞ্চলনের বাইরে চলে যায় এবং অর্থ তার স্থান গ্রহণ করে। পরে বাইবেল চলে যায় সঞ্চনের বাইরে, এবং অর্থ আবার তার স্থান গ্রহণ করে। যখন একটি পণ্য আরেকটি পণ্যের স্থান গ্রহণ করে, তখন অর্থ সর্বদাই তৃতীয় কোন ব্যক্তির হাতে লেগে থাকে।[৭] সঞ্চলন অর্থের প্রত্যেকটি রন্ধ্র থেকে ঘাম ঝরিয়ে দেয়।

এমন একটা আপ্তবাক্য চালু আছে যে, যেহেতু প্রত্যেকটি বিক্রয়ই হচ্ছে একটি ক্রয়, আবার প্রত্যেকটি ক্রয়ও হচ্ছে একটি বিক্রয় সেহেতু পণ্য-সঞ্চলন আবশ্যিক ভাবেই বিক্রয় ও ক্রয়ের সাম্যাবস্থায় পরিণতি লাভ করে—এই ধরনের আপ্তবাক্য বালসুলভ সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। যদি এর অর্থ হয় যে বাস্তব বিক্রয়ের সংখ্যা বাস্তব ক্রয়ের সংখ্যার সমান, তা হলে এটা হয়ে পড়ে নিবৃক পুনরুক্তি। কিন্তু আসলে এর যা বক্তব্য তা হচ্ছে এটা প্রমাণ করা যে প্রতেক বিক্রেতাই তার সঙ্গে বাজারে একজন করে ক্রেতাকে নিয়ে আসে। তেমন কিছুই অবশ্য ঘটে না। বিক্রয় এবং ক্রয়—এই দুটি মিলে হয় একটি অভিন্ন ক্রিয়া-পণ্য মালিক এবং অর্থমালিকের মধ্যে একটি বিনিময়, একটি চুম্বকের দুটি বিপরীত মেরুতে অবস্থিত দুজন ব্যক্তির মধ্যে বিনিময়। যখন একক ব্যক্তির দ্বারা সম্পন্ন হয়, তখন তারা হয় মেরুসদৃশ বিপরীত চরিত্রের দুটি সুস্পষ্ট ক্রিয়া। সুতরাং বিক্রয় এবং ক্রয়ের অভিন্নতার মানে দাঁড়ায় যে পণ্যটি উপযোগিতা, বিহীন, যদি তাকে ছুড়ে দেওয়া হয় সঞ্চলনের অরাসায়নিক বকযন্ত্রে, তা হলে তা অর্থের আকারে আর ফিরে আসে না; ভাষান্তরে বলা যায় যে তা তার মালিকের দ্বার। বিক্রীত হতে পারবেনা—আর সেই জন্যেই অর্থের মালিকের দ্বারা ক্রীত হতে পারবেনা। অভিজ্ঞতার আরো মাঝে দাঁড়ায় যে বিনিময়-যদি তা ঘটেও থাকে তা হলেও তা ঘটায় পণ্যের জীবনে একটা বিশ্রামের কাল, একটা অবকাশ—তা সে অল্পস্থায়ীই হোক আর দীর্ঘস্থায়ীই হোক। যেহেতু একটি পণ্যের প্রথম রূপান্তরণ একই সঙ্গে একটি বিক্রয় এবং ক্রয়, সেই হেতু এটা নিজেই একটা স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া। ক্রেতা পায় পণ্য অর বিক্রেতা পায় অর্থ তথা এমন একটি পণ্য যা যেকোনো সময়ে সঞ্চলনে প্রবেশ করতে প্রস্তুত। কেউই বিক্রয় করতে পারে না-যদি অন্য কেউ ক্রয় না করে। কিন্তু যেহেতু সে বিক্রয় করেছে, সেইহেতুই কেউতো সঙ্গে সঙ্গেই ক্রয়ের জন্য বাধ্য থাকে না। সরাসরি দ্রব্য-বিনিময় প্রথা স্থান-কাল-ব্যক্তি ইত্যাদি বিষয়ে যেসব সীমাবদ্ধতা আরোপ করে, সঞ্চলন ব্যবস্থা সে সব কিছুকে ভেঙেচুরে বেরিয়ে যায় এবং তা সে করে দ্রব্য-বিনিময় প্রথায় একজনের নিজের উৎপন্ন দ্রব্যের পরকীকরণ এবং আরেকজনের উৎপন্ন দ্রব্যের আপনীকরণের মধ্যে যে অভিন্নতা থাকে, সেই অভিন্নতাকে বিক্রয় ও ক্রয়ের বৈপরীত্যে বিভিন্ন করে দিয়ে। এই দুটি স্বতন্ত্র এবং বিপরীতমুখী ক্রিয়ার মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত ঐক্য আছে, তা মূলতঃ একত্র কথা বলা, আর অন্তর্নিহিত একত্ব নিজেকে প্রকাশ করে একটি বাহ্যিক বৈপরীত্যের মধ্যে—এ কথা বলার মানে একই। একটি পণ্যের সম্পূর্ণ রূপান্তরণের দুটি পরিপূরক পর্যায়ের মধ্যবর্তী অবকাশ যদি খুব বেশী হয়, বিক্রয় এবং ক্রয়ের মধ্যকার বিচ্ছেদ যদি বেশী হয়, তা হলে তাদের মধ্যকার অন্তরঙ্গ সুযোগ, তাদের একত্ব, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে সৃষ্টি করে একটি সংকট। ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্যের এই যে বৈপরীত্য; প্রত্যক্ষ সামাজিক শ্রম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে ব্যক্তিগত শ্রম বাধ্য, একটা বিশেষ ধরনের মূর্ত শ্রম যে নির্বিশেষ অমৃত মনুষ্য-শ্রমের রূপে চালু থকতে বাধ্য-এই যে সব দ্বন্দ্ব; বিষয়ের ব্যক্তিরূপ এবং ব্যক্তির দ্বারা বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব—এই যে দ্বন্দ্ব; এই সমস্ত বৈপরীত্য এবং দ্বন্দ্বই অন্তনিহিত থাকে পণ্যের অন্তরে এবং একটি পণ্যের রূপান্তরণের বৈপরীত্যসংকুল পর্যায়সমূহে সংঘটিত পণ্যের গতি প্রক্রিয়া। স্বভাবতই এই প্রক্রিয়াগুলি আভাসিত করে সংকটের সম্ভাবনা-হা, কেবল, সম্ভাবনাই তার বেশী কিছু নয়। এই যে নিছক সম্ভাবনা তার বাস্তবে রূপায়ণ হচ্ছে এক দীর্ঘ সম্পর্ক ক্রমের ফলশ্রুতি—কিন্তু সরল সঞ্চলনের বর্তমান বিষয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে আপাতত সে সম্পর্ক আমাদের সামনে অনুপস্থিত।[৮]

.

. অর্থের চলাচল*

প-অ-প-এর রূপ পরিবর্তনের ফলে, অর্থাৎ যার দ্বারা শ্ৰমজাত বস্তুগত দ্রব্যাদির সঞ্চলন সংঘটিত হয়, তার রূপ পরিবর্তনের ফলে প্রয়োজন হয়ে পড়ে যে কোন একটি পণ্যের আকারে একটি নির্দিষ্ট মূল্য উক্ত প্রক্রিয়াটির সূচনা করবে এবং আবার, একটি পণ্যের আকারেই তার সমাপ্তি ঘটাবে। অতএব, একটি পণ্যের গতিক্রম হচ্ছে একটি আবর্তস্বরূপ। অন্যদিকে, এই গতিক্রমের রূপই এই রকম যে অর্থ এই আবর্ত সংঘটিত করতে পারে না। এর ফলে অর্থের প্রত্যাবর্তন ঘটে না, যা ঘটে তা হচ্ছে তার যাত্রাবি থেকে ক্রমেই আরো আরো দূরে তার অপসারণ। যতক্ষণ পর্যন্ত বিক্রেতা তার অর্থের সঙ্গে শক্তভাবে লেগে থাকে—যে অর্থ তার পণ্যেরই রূপ পরিবর্তিত আকার, ততক্ষণ পর্যন্ত উক্ত পণ্যটি তার রূপান্তরণের প্রথম পর্যায়েই থেকে যায়—সে তখন তার গতিপথের কেবল অর্ধেকটা পর্যন্ত পৌঁছেছে। কিন্তু যে-মুহূর্তে সে ঐ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণায়িত করে ফেলে, যে মুহূর্তে সে তার বিক্রয়টিকে একটি ক্রয়ের দ্বারা অনুপুরণ করে, সেই মুহূর্তেই ঐ অর্থ তার হাত থেকে বেহাত হয়ে যায়। এ কথা সত্য যে আমাদের তন্তুবায় বন্ধুটি যদি বাইবেলখানা কেনার পরে আরো ছিটকাপড় বিক্রয় করে, তা হলে তার অর্থ ফিরে আসে। কিন্তু অর্থের এই যে ফিরে আসাটা তা কিন্তু প্রথম ২০ গজ ছিটকাপড়ের সঞ্চলনের দরুণ নয়; ঐ সঞ্চলনের দরুণ নয়; ঐ সঞ্চলনের ফলে তো অর্থ চলে গিয়েছিল ঐ বাইবেলখানার বিক্রেতার হাতে। তন্তুবায় ব্যক্তিটির হাতে অর্থের প্রত্যাবর্তন সংঘটিত হয় কেবল তখনি, যখন একটি নতুন পণ্যের সঙ্গে সঞ্চলন-প্রক্রিয়ার পুননবায়ন বা পুনরাবর্তন ঘটে—যে পুনবায়িত প্রক্রিয়াটিরও তার পূর্ববর্তী প্রক্রিয়াটির মতো একই পরিণতিতে সমাপ্তি ঘটে। অত এব, পণ্যদ্রব্যাদির সঞ্চলনের দ্বারা যে গতি অর্থে সঞ্চারিত হয়, তা তাকে—এক পণ্য মালিকের হাত থেকে আরেক পণ্য-মালিকের হাতে যাবার যে গতিপথ, সেই গতিপথে —তার যাত্রাবিন্দু থেকে ক্রমাগত দূর থেকে আরো দূরে সরিয়ে নেবার একটি নিরন্তর গতির রূপ ধারণ করে। এই গতিপথই হচ্ছে তার চলাচলের পথক্ৰম (Cours de la monnaie)।

[* ইংরেজি অনুবাদকের টাকা-উপশিরোনাম : শব্দটি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে তার মূল অর্থে-হাত থেকে হাতে যাবার জন্য অর্থ যে পথ অনুসরণ করে, সেটি বোঝাবার উদ্দেশ্য; এ পথটি কিন্তু সঞ্চলন থেকে ভিন্নতর।]

অর্থের চলাচল হচ্ছে একই প্রক্রিয়ার নিরন্তর ও একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি। পণ্য সব সমযেই থাকে বিক্রেতার হাতে আর ক্রয়ের উপায় হিসেবে অর্থ সব সময়েই থাকে। ক্রেতার হাতে। আর অর্থ যে ক্রয়ের উপায় হিসেবে কাজ করে, তা করে ঐ পণ্যটির দামকে বাস্তবায়িত করেই। বাস্তবায়নের ফলে পণ্যটি বিক্রেতার হাত থেকে ক্রেতার হাতে স্থানান্তরিত হয়, এবং সেই সঙ্গে ক্রেতার হাতের অর্থও বিক্রেতার হাতে স্থানান্তরিত হয়; সেখানে আবার তা আরেকটি পণ্যের সঙ্গে একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়। অর্থের গতির এই যে একপেশে চরিত্র তার উদ্ভব ঘটে পণ্যের গতির একপেশে চরিত্র থেকেই কিন্তু এই ঘটনাটি থাকে অবগুণ্ঠিত। পণ্য-সঞ্চলনের নিজস্ব প্রকৃতি থেকেই, তার বিপরীত আকৃতির উদ্ভব ঘটে। একটি পণ্যের প্রথম রূপান্তরণ যে কেবল অর্থের গতিক্রমেই লক্ষ্য করা যায়, তা-ই নয়; খোদ পণ্যটির গতিক্রমেও তা লক্ষ্য করা যায়। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় রূপান্তরণে গতিক্রমটি আমাদের কাছে দেখা দেয় একমাত্র অর্থেরই গতিক্রম হিসেবে। পণ্য সঞ্চলনের প্রথম পর্যায়ে অর্থের সঙ্গে পণ্যেরও স্থানান্তর ঘটে। তার পরে, উপযোগপূর্ণ সামগ্রী হিসেবে পণ্যটি সঞ্চলন থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে পৰিভভাগের অন্তর্গত হয়।[৯] তার জায়গায় আমরা পাই তার মূল্য-অকার—অর্থ। তার পরে পণ্যটি প্রবেশ করে তার সঞ্চলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে নিজের স্বাভাবিক আকারে নয়, অর্থের আকারে। সুতরাং গতির নিরন্তর রক্ষিত হয় একমাত্র অর্থের দ্বারাই এবং যে গতিক্ৰম পণ্যের বেলায় আত্মপ্রকাশ করে একটি বিপরীতমুখী চরিত্রের দুটি প্রক্রিয়া হিসেবে, সেই একই গতিক্রম অর্থের বেলায় আত্মপ্রকাশ করে নিত্য নতুন পণ্যের সমাগমে স্থান থেকে স্থানান্তরে পরিবর্তনের একটি নিরন্তর ধারার মতো। সুতরাং পণ্য-সঞ্চলনের ফলে এক পণ্যের পরিবর্তে অন্য পণ্যের স্থলাভিষেকের আকারে যে ফলশ্রুতি সংঘটিত হয়, তা এমন একটি আকার ধারণ করে যে মনে হয় যেন পণ্যের রূপ-পরিবর্তনের মাধ্যমে তা ঘটেনি, বরং তা ঘটেছে সঞ্চলনের মাধ্যম হিসেবে অর্থ যে কাজ করে তারই মাধ্যমে, এমন একটি ক্রিয়ার মাধ্যমে যা আপাতদৃষ্টিতে গতিহীন পণ্যদ্রবাদিকে সঞ্চলিত করে এবং যে সব মানুষের কাছে তাদের কোন ব্যবহার-মূল্য নেই সেই সব মানুষের হাত থেকে তাদের স্থানান্তরিত করে এমন সব মানুষের হাতে যাদের কাছে তাদের ব্যবহার-মূল্য আছে এবং সঞ্চলিত করে এমন একটি দিকে যা অর্থের দিকের বিপরীতমুখী। অর্থ নিরন্তর পণ্য দ্রব্যাদিকে সঞ্চলন থেকে তুলে নিচ্ছে এবং তাদের জায়গায় নিজে এসে দাড়াচ্ছে এবং এই ভাবে সে নিরন্তর তার যাত্রাবিন্দু থেকে দূরে সরে সরে যাচ্ছে। অতএব যদিও অর্থের গতিক্রম পণ্য-সঞ্চলনের গতিক্রমেরই অভিব্যক্তি, তা হলেও যেন বিপরীতটাই ঘটনা হিসেবে প্রতীয়মান হয়; মনে হয় যেন পণ্যের সঞ্চলনই হচ্ছে অর্থের গতিক্রমের ফলশ্রুতি।[১০]

অধিকন্তু, অর্থের মধ্যে পণ্যদ্রব্যাদির মূল্য সমূহের স্বতন্ত্র বাস্তবতা আছে বলেই অর্থ কাজ করে সঞ্চলনের উপায় হিসেবে। সুতরাং সঞ্চলনের মাধ্যম হিসেবে তার যে গতি কম তা আসলে নিজ নিজ রূপ পরিবর্তনে নিরত পণ্যদ্রব্যাদিরই গতিক্রম মাত্র। এই ঘটনা অবশ্যই অর্থের চলাচল প্রক্রিয়ায় নিজেকে দৃশ্যমান করে তুলবে। যেমন* ছিট কাপড় সর্বপ্রথমে তার পণ্যরূপকে পরিবর্তিত করে অর্থরূপে। তার প্রথম রূপান্তরণে দ্বিতীয় পর্যায়টি প-ম, তথা অর্থরূপটি তারপরে পরিণত হয় তার চূড়ান্ত রূপান্তরণের প্রথম পর্যায়ে, তথা বাইবেল-এ তার পুনঃ-রূপ-পরিবর্তনে। কিন্তু এই দুটি রূপ-পরিবর্তনে প্রত্যেকটিই সম্পাদিত হয় পণ্য এবং অর্থের মধ্যে বিনিময়ের দ্বারা, তাদের পারস্পরিক স্থানচ্যুতির দ্বারা। একই মুদ্রাগুলি বিক্রেতার হাতে আসে উক্ত পণ্যের পরকীকৃত রূপ হিসেবে এবং তাকে পরিত্যাগ করে পণ্যটির চুড়ান্ত ভাবে পরকীকরণীয় রূপ হিসেবে। তার স্থানচ্যুতি হয় দুবার। ছিটকাপড়ের প্রথম রূপান্তরণে ফলে ঐ মুদ্রাগুলি যায় তন্তুবায়ের পকেটে, দ্বিতীয় রূপান্তরণের ফলে সেগুলির নিম্ফান্তি ঘটে সেখান থেকে। একই পণ্যের এই দুটি বিপরীতমুখী পরিবর্তন প্রতিফলিত হয় একই মুদ্রসমূহের দুবার, কিন্তু বিপরীত দিকে, পুনরাবৃত্ত স্থানচ্যুতিতে।

[* এখানে (যেমন ছিট কাপড় থেকে সাধারণভাবে পণ্য” পৃঃ ৯১) চতুর্থ জার্মান সংস্করণের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা কবে ইংরেজি সংস্করণে পরিবতিত করা হয়েছে।]

পক্ষান্তরে যদি রূপান্তরণের কেবল একটিমাত্র পর্যায় অতিক্রান্ত হয়, যদি কেবলমাত্র বিক্রয় কিংবা কেবলমাত্র ক্রয়ই সংঘটিত হয়, তা হলে একটি নিদিষ্ট মুদ্রা কেবল একবার মাত্রই তার স্থান পরিবর্তন করে। তার দ্বিতীয় স্থান পরিবর্তন সর্বদাই প্রকাশ করে পণ্যটির দ্বিতীয় রূপান্তরণ, অর্থ থেকে তার পুনঃপরিবর্তন। একই পণ্যসমূহের স্থানচ্যুতির ঘন ঘন পুনরাবৃত্তি কেবল যে একটি পণ্য যে রূপান্তরণ ক্রমের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়েছে তাই প্রতিফলিত করে, তা-ই নয়, তা সাধারণভাবে পণ্যজগতের অসংখ্য রূপান্তরণের পারস্পরিক গ্রন্থিবন্ধনকেও প্রতিফলিত করে থাকে। এ কথা বলা বাহুল্য যে, এই সমস্ত কিছুই প্রযোজ্য কেবল পণ্যদ্রব্যাদির সরল সঞ্চলনের ক্ষেত্রে–বর্তমানে যে-রূপটি আমরা আলোচনা করছি একমাত্র তারই ক্ষেত্রে।

পণ্যমাত্রই যখন প্রথম সঞ্চলনে প্রবেশ করে এর প্রথম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, তখন সে তা করে আবার সঞ্চলনের বাইরে চলে যাওয়ার জন্য, এবং অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের দ্বারা স্থানচ্যুত হবার জন্য। পক্ষান্তরে সঞ্চলনের মাধ্যম হিসেবে অর্থ কিন্তু নিরন্তর সঞ্চলনের পরিধির মধ্যেই থাকে এবং এই পরিধির মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। সুতরাং প্রশ্ন দেখা দেয়, কী পরিমাণ অর্থ এই পরিধির মধ্যে নিরন্তর আত্মভূত হয়?

কোন একটি দেশে প্রতিদিনই একই সময়ে কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে পণ্যদ্রব্যাদির অগণিত একপেশে রূপান্তরণ ঘটে, অর্থাৎ, অগণিত বিক্রয় ও ক্রয় সংঘটিত হয়। কল্পনায় আগেভাগেই পণ্যদ্রব্যগুলি বিশেষ বিশেষ পরিমাণ অর্থের সঙ্গে সমীকৃত হয়। এবং যেহেতু, বর্তমানে আলোচনাধীন সঞ্চলন-রূপটিতে, অর্থ এবং পণ্যদ্রব্যাদি সর্বদাই সশরীরে পরস্পরের মুখোমুখি হয়, একটি হয় ক্রয়ের ইতিবাচক মেরুটি থেকে আর অন্যটি বিক্রয়ের নেতিবাচক মেরুটি থেকে, সেইহেতু এটা স্পষ্ট যে সঞ্চলনের কত পরিমাণ উপায়ের দরকার হবে, সেটা আগেভাগেই নির্ধারিত হয়ে যায় সংশ্লিষ্ট সমস্ত পণ্যদ্রব্য যোগফলের দ্বারা। বস্তুতঃ, অর্থ সেই পরিমাণ বা সেই অঙ্ক সোনারই প্রতিনিধিত্ব করে, যা আগে ভাগেই ভাবগত ভাবে পণ্যদ্রব্যাদির দামসমূহের যোগফলের মধ্যে প্রকাশ পেয়ে যায়। সুতরাং এইদুটি পরিমাণের সমতা স্বতঃস্পষ্ট। আমরা অবশ্য জানি যে পণ্যাদির মূল্যসমূহ যদি স্থির থাকে, তা হলে তাদের দামগুলি সোনার (অর্থের বস্তুগত উপাদানের) মূল্যের পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে যায়—সোনার মূল্য যে হারে বাড়ে পণ্যের দাম সে হারে কমে, সোনার মূল্য যে হারে কমে পণ্যের দাম সে হারে বাড়ে। এখন, সোনার মূল্যে এই ধরনের ওঠা-নামার ফলে, পণ্যদ্রব্যগুলির দাম-সমূহের যোগফলে নামা-ওঠা ঘটে, তাহলে সঞ্চলনে প্রয়োজনীয় অর্থের সেই হারে নামা-ঠা ঘটবে। এটা সত্য যে, এক্ষেত্রে সঞ্চলন-মাধ্যমের পরিমাণে এই যে পরিবর্তন তা সংঘটিত হয় স্বয়ং অর্থের দ্বারাই—কিন্তু এটা যে ঘটে তা তার সঞ্চলন-মাধ্যম হিসেবে যে ভূমিকা তার গুণে নয়, ঘটে মূল্যের পরিমাপ হিসেবে তার যে ভূমিকা তার গুণে। প্রথমতঃ, পণ্যের দাম অর্থের মূল্যের বিপরীত দিকে পরিবর্তিত হয় আর অন্য দিকে সঞ্চলন মাধ্যমের পরিমাণ পণ্যের দামের সঙ্গে পরিবর্তিত হয় সরাসরি ভাবে একই দিকে। ঠিক এই একই জিনিস ঘটত, যদি, ধর! যাক, সোনার মূল্যে হ্রাস না ঘটে সোনার আসল মূল্যের পরিমাপ হিসেবে রূপার প্রতিষ্ঠা ঘটত, কিংবা যদি রূপার মূল্য বৃদ্ধি না পেয়ে সোনা রূপাকে মূল্যের পরিমাপের আসন থেকে উৎখাত করে দিতে পারত। একটি ক্ষেত্রে, আগেকার চালু সোনার পরিমাণ থেকে অধিকতর পরিমাণ রূপা হত; অন্য ক্ষেত্রে, আগেকার চালু রূপার পরিমাণ থেকে অল্পতর পরিমাণ সোনা চালু হত। উভয় ক্ষেত্রেই অর্থের বস্তুগত উপাদানটির অর্থাৎ যে-পণ্যটি মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে, সেই পণ্যটির মূল্যে পরিবর্তন ঘটত এবং সেই কারণেই যে-সব পণ্য নিজেদের মূল্য অর্থের অঙ্কে প্রকাশ করে সেই সব পণ্যের দামগুলিও পরিবর্তিত হত, পরিবর্তিত হত চালু অর্থের পরিমাণও যায় কাজই হচ্ছে ঐ দামগুলিকে বাস্তবায়িত করা। আমরা আগেই দেখেছি যে সঞ্চলনের পরিধির মধ্যে একটা ফাক আছে যার ভিতর দিয়ে সোনা (কিংবা সাধারণভাবে অর্থের বস্তুগত উপাদান। তার মধ্যে প্রবেশ করে একটা নির্দিষ্ট মূল্যের পণ্য হিসেবে। সুতরাং অর্থ যখন মূল্যের পরিমাপ হিসেবে তার কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে, যখন সে বিবিধ দাম প্রকাশ করে, তখন তার মূল্য ইতিমধ্যেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। এখন যদি তার মূল্য পড়ে যায়, তা হলে এই ঘটনা প্রথম প্রতিফলিত হয় সেই সব পণ্যের দাম পরিবর্তনের মধ্যে যেসব পণ্য মহার্ঘ ধাতুগুলির সঙ্গে সরাসরি পণ্য-বিনিময় প্রথায় বিনিমিত হয় সেই সব ধাতুর উৎপাদনের উৎসস্থলেই। অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর বৃহত্তর অংশ দীর্ঘকাল ধরে হিসেব করা হতে থাকে মূল্য পরিমাপের পূর্বতন প্রাচীন ও অলীক মূল্য রূপের দ্বারা বিশেষ করে সেই সব সমাজে যেগুলি রয়ে গিয়েছে সভ্যতার নিম্নতর বিভিন্ন পর্যায়ে। যাই হোক একটি পণ্য অন্য পণ্যকে তাদের অভিন্ন মূল্য-সম্পর্কের মাধ্যমে সংক্রামিত করে, যাতে করে তাদের সোনায় বা রূপায় প্রকাশিত দামগুলি ক্রমে ক্রমে তাদের আপেক্ষিক মূল্যের দ্বারা নির্ধারিত বিভিন্ন নির্দিষ্ট অনুপাতে স্থিতি লাভ করে—যে পর্যন্ত না সমস্ত পণ্যের মূল্যসমূহ চূড়ান্ত ভাবে অর্থরূপী ধাতুর নতুন মূল্যের অঙ্কে নির্ধারিত না হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটে মহার্ঘ ধাতুসমূহের পরিমাণে নিরন্তর বৃদ্ধি; এই বৃদ্ধি ঘটে, তার কারণ মহার্ঘ ধাতুগুলির উৎপাদনের উৎস সমূহেই দ্রব্য-বিনিময় প্রথা অনুসারে তাদের সঙ্গে বহুবিধ জিনিসের যে প্রত্যক্ষ বিনিময় ঘটে থাকে, তারই দরুন উক্ত জিনিস গুলির জায়গায় ক্রমাগত ঐ ধাতুগুলির স্থানগ্রহণের ক্রমিক ফলশ্রুতি। অতএব যে অনুপাতে পণ্যদ্রব্যাদি সাধারণ ভাবে তাদের সত্যকার দাম অর্জন করে, যে-অনুপাতে তাদের মূল্য মহার্ঘ ধাতুটির হ্রাস মূল্যের হিসেবে নিরূপিত হয়, সেই অনুপাতেই ঐ নতুন দামগুলি বাস্তবায়িত করার জন্য ধাতুটির প্রয়োজনীয় পরিমাণেরও সংস্থান করা হয়। সোনা ও রূপার নতুন নতুন সরবরাহের আবিষ্কারের একদেশ-দশী পর্যবেক্ষণের ফলে সপ্তদশ শতকের এবং বিশেষ করে অষ্টাদশ শতকের কোন কোন অর্থনীতিবিদ এই মিথ্যা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, সঞ্চলনের উপায় হিসেবে সোনা ও রূপার পরিমাণে বৃদ্ধিপ্রাপ্তির ফলেই পণ্যদ্রব্যাদির দাম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল। এখন থেকে সোনার মূল্যকে নির্দিষ্ট ধরে নিয়েই আমরা আলোচনায় এগোব; আর তা ছাড়া, বাস্তবিক পক্ষে, যখনি আমরা কোন পণ্যের দাম হিসেব করি সোনার মূল্য, অস্থায়ী ভাবে হলেও, নির্দিষ্টই থাকে।

এটা ধরে নিলে আমরা দেখি যে সঞ্চলনের মাধ্যমের পরিমাণ নির্ধারিত হয় বাস্তবায়িতব্য দামসমূহের যোগফলের দ্বারা। এখন যদি আমরা আরো একটু ধরে নিই যে, প্রত্যেকটি পণ্যের দামই নির্দিষ্ট, তা হলে এটা পরিষ্কার যে দামসমূহের যোগফল নির্ভর করে সঞ্চলনের অন্তর্গত পণ্যসমূহের মোট সম্ভারের উপরে। এটা বুঝতে খুব বেশী মাথা ঘামানোর দরকার পড়েনা যে এক কোয়ার্টার গমের জন্য যদি খরচ লাগে £২, তা হলে ১০০ কোয়ার্টার গমের জন্য খরচ লাগবে £২০০ এবং ২০০ কোয়ার্টারের জন্য £৪ ০ ০ ইত্যাদি ইত্যাদি আর এই কারণেই গম বিক্রীত হলে যে পরিমাণ অর্থ স্থানান্তরিত হয় তা-ও বিক্রীত গমের পরিমাণে বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায়।

যদি পণ্যের মোট সম্ভার স্থির থাকে, তা হলে সঞ্চলনশীল অর্থের পরিমাণ পরিবর্তিত হয় ঐ পণ্যগুলির দামসমূহে হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। দাম পরিবর্তনের ফলে দামসমূহের যোগফল বৃদ্ধি বা হ্রাস পেলে সঞ্চলনশীল অর্থের পরিমাণেও বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটে। এই পরিণতি ঘটাবার জন্য এটা মোটেই আবশ্যিক নয় যে, সব পণ্যের সব দামই একই সঙ্গে বৃদ্ধি বা হ্রাস পেতে হবে। কিছু কিছু প্রধান প্রধান সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটাই সমস্ত পণ্যের দামের যোগফল, এক ক্ষেত্রে, বৃদ্ধি এবং অন্য ক্ষেত্রে, হ্রাস ঘটাবার পক্ষে যথেষ্ট এবং সেই কারণেই বেশী বা কম পরিমাণ অর্থ সঞ্চলনশীল করার পক্ষে যথেষ্ট। পণ্যদ্রব্যাদির মুল্যে বস্তুতঃই যে পরিবর্তন ঘটে, দামের পরিবর্তন তার অনুরূপই হোক কিংবা দামের পরিবর্তন কেবল বাজারদামের ওঠা-নামার ফলশ্রুতিই হোক, সঞ্চলনের মাধ্যমের পরিমাণের উপর তার ফল একই হয়।

ধরে নেওয়া যাক যে নিম্নলিখিত জিনিসগুলি বিভিন্ন এলাকায় যুগপৎ বিক্রয় করা হবে কিংবা অংশত রূপান্তরিত হবে : ১ কোয়ার্টার গম, ২০ গজ ছট কাপড, একখানা বাইবেল এবং ৪ গ্যালন মদ। যদি প্রত্যেকটি জিনিসেরই দাম হয় ২ পাউণ্ড করে এবং ফুলতঃ, বাস্তবায়িতব্য মোট দাম হয় ৮ পাউণ্ড, তা হলে এটা পরিষ্কার যে অর্থে অঙ্কে ৮ পাউণ্ড সঞ্চলনে যাবে। পক্ষান্তরে, এই একই জিনিসগুলি যদি নিম্নলিখিত রূপান্তরণ শৃংখলের মধ্যে এক-একটি করে গ্রন্থিস্বরূপ হয় : ১ কোয়ার্টার গম-২ পাউণ্ড-২০ গজ ছিটকাপড়-২ পাউণ্ড-বাইবেল-২ পাউণ্ড-৪ গ্যালন মদ-২ পাউণ্ড, তা হলে ঐ পাউণ্ড দুটির বিভিন্ন পণ্যের একের পর এক সঞ্চলন ঘটায় এবং পর্যায়ক্রমে তাদের দামগুলিকে তথ। ঐ দামগুলির যোগফলকে তথা ৮ পাউকে বাস্তবায়িত করাবার পরে অবশেষে মদ-বিক্রেতার পকেটে এসে বিরাম লাভ করে। দেখা যাচ্ছে £২ (দুটি পাউণ্ড) চার বার নড়ল। অর্থের একই খণ্ডগুলির এই যে বারংবার স্থান-পরিবর্তন তা পণ্য দ্রব্যাদির দু’বার রূপ পরিবর্তনের—সঞ্চলনের দুটি পর্যায়ের মারফৎ বিপরীত দিকে তাদের গতির—এবং বিভিন্ন পণ্য-দ্রব্যের রূপান্তরণসমূহের মধ্যেকার গ্রন্থিবন্ধনের—অনুষঙ্গী।[১১] এই যে বিপরীতমুখী অথচ পরস্পর পরিপূরক পর্যায়সমূহ—রূপান্তরণের প্রক্রিয়াটি যেগুলি দিয়ে গঠিত সেগুলি যুগপৎ অতিক্রান্ত হয় না—অতিক্রান্ত হয় পরম্পরাক্রমে। সুতরাং সমগ্ৰ ক্ৰমটির সম্পূৰ্ণায়নের জন্য সময় লাগে। সেই জন্যই অর্থের প্রচলন-বেগ পরিমাপ করা হয় একটি অখণ্ড একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কতবার স্থান বদল করেছে তার সংখ্যা দিয়ে। ধরুন, ৪টি জিনিসের সঞ্চলনে লাগে একটি দিন। ঐ দিনটিতে বাস্তবায়িত করতে হবে ৮ পাউণ্ড পরিমাণ মোট দাম, দুটি অর্থখণ্ডের স্থানবদলের সংখ্যা হচ্ছে চার এবং সঞ্চলুনে চলনশীল অর্থ হচ্ছে ২ পাউণ্ড। সুতরাং সঞ্চলন চলাকালীন একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য আমরা পাই নিম্নলিখিত সম্পর্কটি : সঞ্চলন-মাধ্যম হিসেবে কার্যরত অর্থের পরিমাণ = পণ্যদ্রব্যগুলির দামসমূহের যোগফল : একই নামের মুদ্রাসমূহের স্থান বদলের সংখ্যা। সাধারণ ভাবে এই নিয়মটি সত্য।

একটি নির্দিষ্ট দেশে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পণ্যসমূহের মোট সঞ্চলন একদিকে গঠিত হয় অসংখ্য বিচ্ছিন্ন ও যুগপৎ-সংঘটিত আংশিক রূপান্তরণসমূহের দ্বারা, বিক্রয় যা একই সঙ্গে আবার ক্রয় তার দ্বারা, যাতে প্রত্যেকটি মুদ্রা কেবল একবার করেই স্থান বদল করে; অন্যদিকে গঠিত হয় রূপান্তরণের অসংখ্য স্বতন্ত্র ক্রমের দ্বারা, যেগুলি অংশত চলে পাশাপাশি, অংশত পরস্পরের সঙ্গে মেশামিশি, যেগুলির প্রত্যেকটি ক্রমে প্রত্যেকটি মুদ্রা কয়েকবার স্থান-বদল করে, অবস্থানুযায়ী স্থানবদলের সংখ্যা কখনো হয় বেশী, কখনো কম। একই নামের সমস্ত সঞ্চলনশীল মুদ্রার স্থানবদলের সংখ্যাকে নির্দিষ্ট ধরে নিলে, আমরা ঐ দামীয় একটি মুদ্রার স্থানবদলের গড় সংখ্যা বা অর্থের প্রচলন বেগের গড় হার বের করতে পারি। প্রত্যেক দিনের শুরুতে যে-পরিমাণ অর্থ সঞ্চলনে নিক্ষিপ্ত হয়, তা অবশ্য নির্ধারিত হয় একই সঙ্গে পাশাপাশি সঞ্চলনশীল সমস্ত পণ্যের দামসমূহের যোগফলের দ্বারা। কিন্তু একবার সঞ্চলনে নামলে তারপরে, বলা যায় যে, মুদ্রাগুলি হয় পরস্পরের জন্য দায়িত্বশীল। একটি মুদ্রা যদি তার প্রচলন বেগ বৃদ্ধি করে, তা হলে অন্যটি হয় তার নিজের প্রচলন-বেগ হ্রাস করে অথবা একেবারেই সঞ্চলনের বাইরে চলে যায়। কেননা সঞ্চলনে কেবল সেই পরিমাণ সোনাই আত্মভূত হতে পারে যা, একটি মাত্র মুদ্রা বা উপাদানের স্থানবদলের সংখ্যার গড়ের দ্বারা বিভক্ত হলে, হবে বাস্তবায়িতব্য মোট দামের সমান। সুতরাং আলাদা আলাদা খণ্ডগুলির স্থানবদলের সংখ্যা যদি বৃদ্ধি পায়, তা হলে সঞ্চলনশীল ঐ খণ্ডগুলির মোট সংখ্যা হ্রাস পায়। যদি স্থানবদলের সংখ্যা হ্রাস পায়, তা হলে খণ্ডগুলির মোট সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যেহেতু সঞ্চলনে যত অর্থ আত্মভূত হতে পারে তার পরিমাণ একটি নির্দিষ্ট গড় প্রচলন বেগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট, সেই হেতু সঞ্চলন থেকে একটি নির্দিষ্টসংখ্যক ‘সভরিনকে নিস্কষিত করতে হলে যা আবশ্যক তা হচ্ছে একই সংখ্যক এক পাউণ্ডের নোট সঞ্চলনে নক্ষেপ করা, এ কৌশলটা সব ব্যাংক-ব্যবসায়ীর কাছেই সুবিদিত।

যেমন, সাধারণভাবে বললে, অর্থের প্রচলন পণ্যদ্রব্যটির সঞ্চলন কিংবা তাদের বিপরীতধর্মী রূপান্তরণসমূহের একটি প্রতিক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই নয়, তেমনি অর্থ প্রচলনের গতিবেগ পণ্যদ্রবাদির স্থানবদলের দ্রুতত। এক প্রস্ত রূপান্তরণের আরেক প্রস্থ রূপান্তরণের সঙ্গে অব্যাহত গ্রন্থিবদ্ধতা, বস্তুর ক্ষিপ্রগতি সামাজিক আন্তঃপরিবর্তন, সঞ্চলনের ক্ষেত্র থেকে পণ্যদ্রব্যাদির দ্রুত অন্তর্ধান এবং সমান দ্রুততার সঙ্গে নতুন নতুন পণ্যদ্রব্যের দ্বারা তাদের স্থানগ্ৰহণ ইত্যাদির প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং অর্থ প্রচলনের গতিবেগের মধ্যে আমরা পাচ্ছি বিপরীতমুখী অথচ পরিপূরক পর্যায়গুলির স্বচ্ছন্দ ঐক্য, পণ্যদ্রব্যাদির উপযোগ গত দিকের মূল্যগত দিকে রূপ পরিবর্তনের, এবং তাদের মূল্যগত দিকের পুনঃ উপযোগগত দিকে রূপ-পরিবর্তনের স্বচ্ছন্দ ঐক্য, কিংবা বিক্রয় ও ক্রয়ের দুটি প্রক্রিয়ার ঐক্য। অন্যদিকে, অর্থ-প্রচলনের গতিবেগে ব্যাহতাবস্থা প্রতিফলিত করে এই দুটি প্রক্রিয়ার বিচ্ছিন্ন বিপরীতধর্মী পর্যায়সমূহে পৃথগীভবন, প্রতিফলিত করে বস্তুর রূপ-পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এবং অতএব সামাজিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও, অচলাবস্থা। খোদ সঞ্চলন থেকেই অবশ্য এই অচলাবস্থার কি কাৰ্বণ তার কোনো হদিশই পাওয়া যায় না; সঞ্চলন কেবল ব্যাপারটাকে গোচরীভূতই করে। জনসাধারণ, যারা অর্থের প্রচলনবেগের ব্যাহতা বস্থার সঙ্গে সঙ্গেই যুগপৎ প্রত্যক্ষ করে সঞ্চলনের পরিধিমধ্যে অর্থের আবিভাব ও তিরোভাবের গতিমস্থরতা, তারা স্বভাবতই এই ব্যাহতাবস্থার জন্য দায়ী করে সঙ্কলনী মাধ্যমটির পরিমাণগত স্বল্পতাকে।[১২]

একটি নির্দিষ্ট সময়কালে সঞ্চলনশীল মাধ্যম হিসেবে কার্যরত অর্থের মোট পরিমাণ নির্ধারিত হয়, এক দিকে, সঞ্চলনশীল পণ্যদ্রব্যাদির মোট দামের দ্বারা এবং অন্য দিকে, কত দ্রুততার সঙ্গে রূপান্তরণসমূহের বিপরীতধর্মী পর্যায়গুলি একে অপরকে অনুসরণ করে, তার দ্বারা। এই দ্রুততার উপরে নির্ভর করে মোট দামের কত অনুপাতকে প্রত্যেকটি মুদ্রার দ্বারা গড়ে বাস্তবায়িত করা যায়। কিন্তু সঞ্চলনশীল পণ্যসমূহের মোট দাম নির্ভর করে ঐ পণ্যগুলির পরিমাণ এবং সেই সঙ্গে সেগুলির দামসমূহেও উপরে। অবশ্য, দামসমূহের পরিস্থিতি, সঞ্চলনশীল পণ্যগুলির পরিমাণ এবং অর্থের প্রচলন-বেগ-এই তিনটি বিষয়ই হচ্ছে অস্থিতিশীল। সুতরাং, বাস্তবায়িতব্য দামগুলির যোগফল এবং কাজে কাজেই, ঐ যোগফলের উপরে নির্ভরশীল সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমানও পরিবর্তিত হবে এই উপাদান-ত্রয়ীর অসংখ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। এইসব পরিবর্তনের মধ্যে আমরা কেবল সেই পরিবর্তনগুলি নিয়েই আলোচনা। করব; দামের ইতিহাসে যে-পরিবর্তনগুলি গ্রহণ করেছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

দাগসমূহ যখন স্থির থাকে, তখন সঞ্চলনশীল পণ্যদ্রব্যাদির বৃদ্ধি প্রাপ্তির ফলে কিংবা অর্থের প্রচলন-বেগের হ্রাসপ্রাপ্তির ফলে কিংবা এই দুইয়েরই সম্মিলিত ক্রিয়ার ফলে সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। অন্যদিকে, পণ্যদ্রব্যাদির সংখ্যা হ্রাসপ্রাপ্তির ফলে কিংবা তাদের সঞ্চলন বৃদ্ধি প্রাপ্তির ফলে সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে।

পণ্যদ্রব্যাদির দামসমূহের সাধারণ বৃদ্ধিপ্রাপ্তি ঘটলেও সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ স্থিতিশীলই থাকবে—যদি পণ্য সংখ্যা স্থির থেকে দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চলনশীল পণ্যদ্রব্যাদির সংখ্যা অনুপাতিক ভাবে হ্রাস পায় কিংবা দাম যে হারে বৃদ্ধি পায়, অর্থেব প্রচলন-বেগও সেই হারে বৃদ্ধি পায়। দাম বৃদ্ধির তুলনায় পণ্য সংখ্যা দ্রুততর ভাবে হ্রাস পেলে কিংবা অর্থের প্রচলন-বেগ দ্রুততর ভাবে বৃদ্ধি পেলে সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে।

পণ্যদ্রব্যদির দামসমূহের সাধারণ হ্রাসপ্রাপ্তি ঘটলেও সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ স্থিতিশীলই থাকবে-যদি দাম হ্রাসের সঙ্গে সমান অনুপাতে পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কিংবা ঐ একই অনুপাতে অর্থের প্রচলন-বেগ হ্রাস পায়। সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে–যদি দাম হ্রাস পাবার তুলনায় দ্রুততর ভবে পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় কিংবা সঞ্চলনের গতিশীলতা দ্রুততর ভাবে হ্রাস পায়।

বিভিন্ন উপাদানের হ্রাসবৃদ্ধি পরস্পরকে নিরপেক্ষ করে দিতে পারে, যার ফলে তাদের নিরন্তর অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও, বাবায়িতব্য দামগুলির ঘোগফল এবং সঞ্চলনশীল অর্থের পরিমাণ স্থির থাকতে পারে; অতএব, বিশেষ করে যদি আমরা দীর্ঘ সময়কালের কথা বিবেচনা করি, তা হলে আমরা দেখতে পাই যে কোন দেশে অর্থের পরিমাণের গড় মাত্রা থেকে বিচ্যুতি আমাদের প্রাথমিক অনুমান থেকে অনেক অল্পতর — অবশ্য কিছুকাল অন্তর অন্তর শিল্পগত ও বাণিজ্যগত সংকটজনিত যে প্রচণ্ড আথালি-পাথালি দেখা দেয় কিংবা আরো কম ঘন ঘন অর্থের মূল্যে যে ওঠানামা ঘটে থাকে তা এ ক্ষেত্রে ধরা হয় নি।

সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ নির্ধারিত হয় সঞ্চলনশীল পণ্যগুলির দামসমূহের যোগফল এবং অর্থ-প্রচলনের গড় গতিবেগ[১৩] দ্বারা-এই যে নিয়ম, এটিকে এই ভাবেও বিবৃত করা যায় : পণ্যসমূহের মূল্যগুলি এবং তাদের রূপান্তরণসমূহের গড় গতিশীলতা নির্দিষ্ট থাকলে, অর্থ প্রচলিত মহার্ঘ ধাতুটির পরিমাণ নির্ভর করে ঐ মহার্ঘ ধাতুটিরই মূল্যের উপরে। দামসমূহই নির্ধারিত হয় সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণের দ্বারা এবং সঞ্চলনশীল মাধ্যমটির পরিমাণ নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের মহার্ঘ ধাতুগুলির পরিমাপের উপরে[১৪]–এই যে ভ্রান্ত মত, এর প্রবক্তারা একে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এই অসম্ভব প্রকল্পের উপরে যে যখন তারা প্রথম সঞ্চলনে প্রবেশ করে তখন পণ্যদ্রব্যাদির কোন দাম থাকে না এবং অর্থেরও থাকে না কোন মূল্য এবং একবার সঞ্চলনে প্রবেশ করার পরেই কেবল পণ্যসম্ভারের একটি আঙ্গেয় অংশ বিনিমিত হয় মহার্ঘ ধাতুপের একটি আঙ্গেয় অংশের সঙ্গে।[১৫]

.

. মুদ্রা এবং মূল্যের প্রতীকসমূহ

অর্থ যে মুদ্রার আকার নেয়, তা সঞ্চলনের মাধ্যম হিসেবে তার যে ভূমিকা, সেই ভূমিকা থেকেই উদ্ভূত হয়। পণ্যদ্রব্যাদির দামসমূহ ব! অৰ্থনামসমূহ কল্পনায় সোনার যে ওজনের প্রতিনিধিত্ব করে, সেই ওজনের সোনাকে সঞ্চলনের পরিধির মধ্যে অবশ্যই মুদ্রার আকারে বা নির্দিষ্ট নামের স্বর্ণখণ্ড বা রৌপ্যখণ্ডের আকারে ঐ পণ্যগুলির মুখোমুখি হতে হবে। দামসমূহের একটি নির্দিষ্ট মান প্রতিষ্ঠা করার মতো মুদ্রা চালু করাও হচ্ছে রাষ্ট্রের কাজ। স্বদেশের মধ্যে মুদ্রা হিসেবে সোনা ও রূপ। যে বিভিন্ন জাতীয় পোশাক পরিধান করে এবং বিশ্বের বাজারে আবার তারা যেগুলি পরিহার কবে, তা থেকেই বোঝা যায় পণ্যদ্রব্যাদির সঞ্চলনের আভ্যন্তরিক বা জাতীয় পরিধি এবং তাদের আন্তর্জাতিক পরিধির মধ্যকার বিচ্ছেদ।

অতএব, মুদ্রা এব° ধাতুপণ্ডের মধ্যে যে পার্থক্য তা একমাত্র আকারের ক্ষেত্রে এবং সোনা যে-কোন সময়েই এক রূপ থেকে অন্য রূপে চলে যেতে পারে।[১৬] কিন্তু যে-মুহতে মুদ্রা টাকশাল থেকে ছাড়া পায়, সেই মুহূর্তেই সে যাত্রা করে বিগলন কটাহের অভিমুখে। প্রচলন-কালে মুদ্রাগুলি ক্ষয় পাষ, কতকগুলি বেশী ভাবে, আবার কতকগুলি কম ভাবে। নামে এবং, বস্তুত, নামীয় ওজনে আর আসল ওজনে পার্থক্যের প্রক্রিয়া শুরু হয়। একই নামেব মুদ্রাসমূহ ওজনগত পার্থক্যের দরুন মূল্যের দিক থেকে পৃথক হয়ে যায়। দামের মান হিসেবে স্থিরীকৃত সোনার ওজন সঞ্চলনশীল মাধ্যম হিসেবে তার যে ওজন, তা থেকে বিচ্যুত হয় এবং ফলতঃ, সঞ্চলনশীল মাধ্যমটি আর সেই সব পণ্যের—যে সবের মূল্য তা বাস্তবায়িত করে, সেই সব পণ্যের–সত্যকার সমর্ণরূপ থাকে না। মধ্যযুগে এবং তখন থেকে শুরু করে আঠারো শতক পর্যন্ত মুদ্রা প্রচলনেব ইতিহাস এই কারণটি থেকে উদ্ভূত এই পৌনঃপুনিক বিভ্রান্তির সাক্ষ্য বহন কৰে। সঞ্চনের যেটা স্বাভাবিক প্রবণতা, তা হচ্ছে মুদ্রা নিজেকে যা বলে দাবি কবে, তা নিছক রূপক-মাত্রে তাকে রূপান্তরিত করা; যতটা সোনা তা ধারণ করে বলে দাবি করে, তার প্রতীকমাত্রে তাকে পরিণত করা এই প্রবণতা বর্তমান রাষ্ট্রগুলিতে আইনের স্বীকৃতি লাভ করেছে, আইনের স্থির করে দেওয়া হচ্ছে কতটা সোনা ক্ষয় পেয়ে গেলে স্বর্ণমুদ্রাটি আব মুদ্রা বলে। পৰিগণিত হবে না। অর্থাৎ বৈধ মুদ্রার মর্যাদা পাবে না।

মুদ্রার প্রচলন নিজেই যে তার নামীয় ও আসল ওজনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায়, এক দিকে নিছক সোনার টুকরো হিসেবে এবং অন্যদিকে নির্দিষ্ট ভূমিকা সহ মুদ্রা হিসেবে পার্থক্য সৃষ্টি করে এই ঘটনাই আভাসিত করে যে ধাতব মুদ্রার পরিবর্তে অন্য কোন বস্তুর তৈরী প্রতীকের প্রচলন, মুদ্রা হিসেবে অন্য কোন অভিজ্ঞানের প্রচলন সম্ভব। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিমাণ সোনা ও রূপাকে মুদ্রাকারে রূপ দিতে গিয়ে কার্যক্ষেত্রে যেসব অসুবিধা দেখা দেয় সেই সব অসুবিধা এবং এই ঘটনা যে প্রথম দিকে অধিকতর মহার্ঘ ধাতুর পরিবর্তে অল্পতর মহার্ঘ ধাতুর মূল্যের পরিমাপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেমন রূপার পরিবর্তে তামা, সোনার পরিবর্তে রূপা ইত্যাদি আর যে পর্যন্ত না অধিকতর মহার্ঘ ধাতুর দ্বারা সিংহাসনচ্যুত হয় সে পর্যন্ত অল্পতর মহার্ঘ ধাতুই অর্থ হিসেবে প্রচলিত থাকে—এই সব তথ্য থেকেই আমরা বুঝতে পারি সোনার মুদ্রার বিকল্প হিসেবে রূপা ও তামার প্রতীকগুলি যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে, সেই ভূমিকার তাৎপর্য। সঞ্চলনের সেই সব অঞ্চলেই সোনা ও রূপার প্রতীকগুলি সোনার স্থান দখল করে, যে সব অঞ্চলে মুদ্রার হাতবদল খুব ঘন ঘন হয় এবং সেই কারণেই তা সবচেয়ে বেশী ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সেখানে নিরন্তর খুবই অল্প-স্বল্প আয়তনে বিক্রয় ও ক্রয় সংঘটিত হয়, সেখানেই এই ধরনের ঘটনা ঘটে। এই সব উপ গ্রহ যাতে স্থায়ী ভাবে সোনার আসনে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ না করতে পারে, সেই জন্য সোনার বদলে কতটা পরিমাণে এই সব মুদ্রা গ্রহণ করা যেতে পারে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট আইন প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। প্রচলন বাবস্থায় বিভিন্ন প্রজাতির মুদ্রার। যে বিশেষ বিশেষ পথচারণা করে, সে পথওল। স্বভাবতই পরস্পরেব উপর দিয়ে চলে যায়। ক্ষুদ্রতম স্বর্ণমুদ্রার ভগ্নাংশিক অ শ প্রদানের জন্য প্রতীকগুলি সোনার সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে; এক দিকে, সোনা নিবন্তর খুচবে। সঞ্চলনের মধ্যে স্রোতধারার মতো বয়ে আসে, এবং অন্য দিকে, তই আবার প্রতীকে পরিবর্তিত হয়ে নিরন্তর সঞ্চলনের বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়।[১৭]

রূপা ও তামার প্রতীকগুলিতে কতটা করে ধাতু থাকবে তা খুশিমতো আইনের দ্বারা নির্ধারিত হয়। যখন প্রচলনে থাকে, তখন তারা এমনকি সোনার মুদ্রা থেকেও বেশী তাড়াতাড়ি ক্ষয় পায়। সুতরাং তারা যে যে কাজ করে, তা তাদের ওজন এবং, কাজে কাজেই, সমস্ত মূল্য থেকে পুরোপুরি নিরপেক্ষ। মুদ্রা হিসেবে সোনার যে কাজ তা সোনার ধাতব মূল্য থেকে পুরোপুরি নিরপেক্ষ হয়ে যায়। অতএব, যে সমস্ত জিনিস আপেক্ষিক ভাবে মূল্যহীন, যেমন কাগজের নোট ইত্যাদি, সেগুলি তার বদলে মুদ্রা হিসেবে কজে করতে পারে। এই যে বিশুদ্ধ প্রতীকী চরিত্র তা কিছুটা পরিমাণে অবগুণ্ঠিত থাকে ধাতব প্রতীকগুলিতে। কাগজের নোটে এই চরিত্রটি বেরিয়ে আসে পরিষ্কার ভাবে। বাস্তবিক পক্ষে, ce nest que le preinier pas qui coute.

আমরা এখানে কেবল অরূপান্তরণীয় কাগুজে নোটের কথাই উল্লেখ করছি—যা রাষ্ট্রের দ্বারা ছাড়া হয় এবং বাধ্যতামূলক ভাবে চালু থাকে। ধাতব মুদ্রা থেকেই তার প্রত্যক্ষ উৎপত্তি। পক্ষান্তরে ক্রেডিট-এর উপরে প্রতিষ্ঠিত যে অর্থ তা এমন সমস্ত অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত, যা পণ্যদ্রব্যাদির সরল সঞ্চলনের দৃষ্টিকোণ থেকে এখনো আমাদের কাছে পুরোপুরি অপরিজ্ঞাত। কিন্তু এখানে আমরা এ পর্যন্ত বলতে পারি যে, যেমন সঞ্চলনের মাধ্যম হিসেবে অর্থের ভূমিকায় সত্যকার কাগুজে নোটের উদ্ভব ঘটে ঠিক তেমনি ক্রেডিট এর উপরে প্রতিষ্ঠিত অর্থেরও স্বতঃস্ফুত ভাবে উদ্ভব ঘটে পরিপ্রদানের উপায় হিসেবে অর্থের ভূমিকায়।[১৮]

রাষ্ট্র টুকরো টুকরো কাপজ চালু করে; সেই সব টুকরো কাগজগুলিতে ছাপিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন মুদ্রাংক যেমন £১, ৫৫, ইত্যাদি ইত্যাদি। যতদূর পর্যন্ত এই টুকরো বা কাগজগুলি কার্যক্ষেত্রে একই পরিমাণের সোনার স্থান গ্রহণ কবে, তত দূর পর্যন্ত তাদের চলাচল, স্বয়ং অর্থের প্রচলন যে সব নিয়মের দ্বারা নিয়মিত হয়, সেই সব নিয়মেরই অধীন থাক। ঐ কাগুকে অর্থ যে অনুপাতে সোনার প্রতিনিধিত্ব করে, কেবল সেই অনুপাত থেকেই কাগুজে অর্থের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য কোন নিমের উদ্ভব ঘটতে পারে। এমন একটি নিয়ম রয়েছে, সহজ ভাবে বললে সেই নিয়মটি এই প্রতীকের দ্বারা স্থানচ্যুত না হলে যে-পরিমাণ সোনা বা রূপ) বস্তুতই সঞ্চলনে থাকে, কাগুজে অর্থের ‘ইসু্য অবশ্যই সেই পরিমাণের বেশি হবে না। এখন, সঞ্চলন যে-পরিমাণ সোনাকে আত্মভূত করে, তা নিরন্তর একটি বিশেষ মাত্রার। কাছাকাছি ওঠা-নামা করে। তবু কোন দেশে সঞ্চলন-মাধ্যমটির মোট পরিমাণ বখনো একটি নূ্যনতম মাত্রার নীচে নেমে যায় না-যে নূ্যনতম মাত্রাটি অভিজ্ঞতার সাহায্যে সহজেই নির্ণয় করা যায়। এই ন্যূনতম পরিমাণটির অন্তর্গত এককগুলিতে যে নিরন্তর পরিবর্তন ঘটে কিংবা সোনার টুকরোগুলি যে নতুন নতুন টুকরো দিয়ে। স্থানচ্যুত হয়—এই ঘটনা কিন্তু সঞ্চলনের পরিমাণে বা নিরবচ্ছিন্নতায় কোন পরিবর্তন ঘটায় না। সুতরাং তার বদলে কাগুজে প্রতীক চালু করা যায়। পক্ষান্তরে, সঞ্চলনের সমস্ত কয়টি নলই যদি তাদের আত্মভূত করার পূর্ণ ক্ষমতার শেষ সীমা পর্যন্ত কাগুজে অর্থে ভরাট করে দেওয়া হত, তা হলে আগামীকাল পণ্য-সঞ্চলনে পরিবর্তনের ফলে সেগুলি উপচে পড়তে পারত। সেক্ষেত্রে আর কোনো মানেরই অস্তিত্ব থাকত না। কাগুজে অর্থের যথােচিত সীমা হচ্ছে একই মুদ্রাংকের স্বর্ণ মুদ্রার সেই পরিমাণ যা সঞ্চলনে চালু হতে পারে; কাগুজে অর্থ যদি তার যথােচিত সীমা ছাড়িয়ে যায় তা হলে যে কেবল সর্বসাধারণের আস্থা হারাবার বিপদে পড়বে তা-ই নয়, তা হলে তা প্রতিনিধিত্ব করবে কেবল সেই পরিমাণ সোনার পণ্য সঞ্চলনের নিয়মাবলী অনুযায়ী যে-পরিমাণটুকুর প্রয়োজন হবে এবং কেবল যে-পরিমাণটুকুই কাগজের প্রতিনিধিত্বের আওতায় আসতে পারে। যদি যতটা ছাড়া উচিত তার দ্বিগুণ কাগুজে অর্থ ছাড়া হয়, তা হলে বাস্তব ক্ষেত্রে ৫১ পাউণ্ড আর ৪ ভাগ আউন্স পরিমাণ সোনার অর্থ নাম থাকবে না, তা পরিণত হবে ৮ ভাগ আউন্স পরিমাণ সোনার অর্থনামে। দামের মান। হিসেবে সোনার ভূমিকার অদলবদল হলে যে ফল হত, এক্ষেত্রেও সেই ফলই হবে। অতীতে যে মূল্য অভিব্যক্ত হত ৪১ পাউণ্ড দামের দ্বারা, এখন তা অভিব্যক্ত হবে ৫২ পাউণ্ড দামের দ্বারা।

কাগুজে অর্থ হচ্ছে সোনা বা অর্থের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতীক মাত্র। এর সঙ্গে পণ্যমূল্যের সম্পর্ক এই পণ্যমূল্য ভাবগত ভাবে অভিব্যক্ত হয় একই পরিমাণ সোনার অঙ্কে যা প্রতীকগত ভাবে অভিব্যক্ত হয় কাগজের অঙ্কে। যে পর্যন্ত কাজে অর্থ সোনার প্রতিনিধিত্ব করে, যার অন্যান্য সব পণ্যেব মতই আছে মূল্য, সেই পর্ষন্তই কাগুজে মুদ্রা হচ্ছে মূল্যের প্রতীক।[১৯]

সর্বশেষে কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, যেসব প্রতীকের নিজেদের কোনো মূল্য নেই, সেই সব প্রতীক কিভাবে সোনার স্থান গ্রহণ করে? কিন্তু যে কথা আমরা আগেই বলেছি, এই সব প্রতীক কেবল ততটা পর্যন্তই সোনার স্থান গ্রহণ করতে পারে, যতটা পর্যন্ত তা একান্ত ভাবেই মুদ্রা হিসেবে কিংবা সঞ্চলনী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, অন্য কোনো হিসেবে নয়। এখন, এ কাজটি ছাড়াও অর্থের আবে। অনেক কাজ আছে এবং নিছক সঞ্চলনী মাধ্যম হিসেবে কাজ করার বিচ্ছিন্ন ভূমিকাটিই স্বর্ণমুদ্রার সঙ্গে আবশ্যিক ভাবেই সংলগ্ন একমাত্র ভূমিকা নয় -যদিও ঘষায় ঘষয ক্ষয়ে যাওয়া যে মুদ্রাগুলি চানু থাকে, সেগুলির ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে একমাত্র ভূমিকা। যতক্ষণ পর্যন্ত তা চালু থাকে ততক্ষণ পর্যন্তই প্রত্যেকটি মুদ্রা কেবল মুদ্র বা সঞ্চলনী মাধ্যম। কিন্তু এটা কেবল সেই ন্যূনতম পরিমাণ সোনর ক্ষেত্রেই সত্য যার স্থান কাগজ গ্রহণ করতে পারে। সেই ন্যূনতম পরিমাণটি নিরন্তর সঞ্চলনের পরিধির মধ্যেই থাকে, নিরন্তর সঞ্চলনী মাধ্যম হিসেবেই কাজ করতে থাকে, এবং একান্ত ভাবে সেই কাজেই ব্যস্ত থাকে। অতএব, তার গতিক্রম প—অপ রূপান্তরনটির বিপরীত পর্যায়গুলির-যে-পর্যায়গুলিতে পণ্যেরা তাদের মূলরূপসমূহের মুখোমুখি হয় কেবল অচিরাং অন্তর্হিত হয়ে যাবার জন্যই–সেই পর্যায়গুলির অব্যাহত পরম্পরা ছাড়া আর কিছুই প্রতিনিধিত্ব কবে না। এক্ষেত্রে একটি পণ্যের বিনিময়-মূল্যে নিরপেক্ষ অস্তিত্ব একটি ক্ষণস্থায়ী কায়াভাস মাত্র যায় মাধ্যমে পণ্যটি অচিরাৎ অন্য একটি পণ্যের দ্বারা স্থানচ্যুত হয়। অতএব, এই যে প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অর্থ এক হাত থেকে অন্য হাতে অপসারিত হয়, এই প্রক্রিয়ায় অর্থের নিছক প্রতীকী অস্তিত্বই যথেষ্ট। বলা যায় যে তার কার্যগত অস্তিত্ব তার বস্তুগত অস্তিত্বকে আত্মভৃত করে ফেলে। পণ্যের দামের ক্ষণস্থায়ী এবং বিষয়গত প্রতিক্ষেপণ হবার দরুন, এ কেবল কাজ করে নিজের প্রতীক হিসেবে এবং সেই কারণেই সে স্থানচ্যুত হতে পারে একটি প্রতীকের দ্বারা।[২০] অবশ্য একটি জিনিস আবশ্যিক; এই প্রতীকটির অবশ্যই থাকতে হবে নিজস্ব একটি বিষয়গত সামাজিক সিদ্ধতা এবং এটা এই কাগুজে অর্থ অর্জন করে তার বাধ্যতামূলক প্রচলনের বলে। রাষ্ট্রের এই বাধ্যতামূলক ব্যবস্থাটি কার্যকরী হতে পারে কেবল সঞ্চলনের সেই আভ্যন্তরিণ পরিধির মধ্যে যা তার রাষ্ট্রিক সীমানার সঙ্গে সমবিস্তৃত এবং কেবল এই মধ্যেই অর্থ সঞ্চলনী মাধ্যম হিসেবে তার ভূমিকা পরিপূর্ণভাবে পালন করে অথবা মুদ্রা হিসেবে কাজ করে।

————

১. “Toute vente est achat”. (: CPCAT: “Dialogues sur le commerceet les Travaux des Artisans.” Physiocrates ed. Daire I. Partie, Paris, 1846. p. 170 ) কিংবা যেমন ডঃ কেনে তার *Maximes generales”-a 96979, “Vender est acheter.”

২. “Le prix d’une marchandise ne pouvant etre paye que Par le prix d’une autre marchandise ( Mercier de la Riviere L’Ordre naturel et essentiel de societes politiques” Physiocrates ed. Daire II partie p. 554).

৩. “Pour avoir cet argent, il faut avoir vendu” 1.c. p. 543.

৪. পূর্বে যেমন উল্লিখিত হয়েছে, সোনা বা রূপার সত্যকার উৎপাদক একটি ব্যতিক্রম। প্রথমে বিক্রয় না করেই সে সরাসরি তার উৎপন্ন অন্য একটি পণ্যের সঙ্গে বিনিময় করে।

৫. “Si l’argent repres ente, dans nos mains les choses que nous pouvons desirer d’acheter, il y represente aussi les choses que nous avons vendues pour cet argeni” (Mercier de la Riviere” 1.c. p. 586).

৬. “Il y adonc….. quatre termes et trois contractants dont l’un. intervient deux fois ( Le Trosnel.c. p. 909 “

৭. যদিও ব্যাপারটা স্বতঃস্পষ্ট তবু প্রায়শঃই এটরাষ্ট্রীয় অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিগোচর হয় না, বিশেষ করে “স্বাধীন ব্যবসায়ের ধ্বজাধারীদের।”

৮. “Zur Kritik”-এ জেমস মিল প্রসঙ্গে আমার মন্তব্য দ্রষ্টব্য পৃ: ৭৪-৭৬। এই বিষয়টি প্রসঙ্গে আমরা চাটুভাষী অর্থনীতির স্বভাবসুচক দুটি পদ্ধতি লক্ষ্য করতে পারি প্রথমটি হল পণ্য সঞ্চলন এবং প্রত্যক্ষ দ্রব্য-বিনিময়ের মধ্যেকার পার্থক্যগুলিকে। সোজাসুজি সরিয়ে রেখে দুটিকে এক ও অভিন্ন হিসাবে গণ্য করা, দ্বিতীয়টি হল ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতিতে নিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যেকার সম্পকে পণ্য-সঞ্চলন থেকে উদ্ভূত সহজ-সরল সম্পর্কে পর্যবসতি করে ঐ উৎপাদন-পদ্ধতির দ্বন্দ্বগুলিকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করা। যাই হোক, পণ্যের উৎপাদন ও সঞ্চলন এমন দুটি ব্যাপার যা একেবারে ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদন-পদ্ধতিতেও কমবেশি অভিন্ন। এই সবরকনের উৎপাদন-পদ্ধতির মধ্যে অভিন্ন সঞ্চলনের অমূর্ত বর্গগুলির সঙ্গে ছাড়া আর কিছুর সঙ্গেই যদি আমাদের পরিচয় না থাকে, তা হলে সম্ভবতঃ আমরা ঐ পদ্ধতিগুলির মধ্যেকার নির্দিষ্ট পার্থক্যগুলি বুঝতে পারি না এবং সেগুলি সম্পর্কে কোনো মতামত দিতে পারি না। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ছাড়া আর কোনো বিজ্ঞানেই মামুলি স্বতঃসিদ্ধ সত্য নিয়ে হৈ চৈ করা হয় না। যেমন জে বি সে নিজেকে সংকটের বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত করেন কেননা তিনি বাস্তবিকই জানেন যে পণ্য হল একটি উৎপন্ন দ্রব্য।

৯. এমনকি যখন কোন পণ্য বারংবার বিক্রীত হয়, তখনো শেষবারের মতো বিক্রীত হয়ে গেলে সঞ্চলন থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গিয়ে পরিভোগর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়; সেখানে তা জীবনধারণের উৎপাদনের উপায় হিসেবে কাজ করে।

১০. “Il ( l’argent ) n’a d’autre mouvement que celui qui luiest imprime par les productions.” (Le Trosne 1.c. p. 885 ).

১১. “Ce sont les productions qui le (l’argent) mettent en mouve ment et le font circuler… La celerite de son mouvement ( sc. de l’argent ) supplee a sa quatite. Lorsqu’il en est besoin, il ne fait que glisser d’une main dans l’autre sans s’arreter un instant.” (Le Trosne 1. c., pp. 915-916.)

১২. “যেহেতু অর্থ হচ্ছে ক্রয় ও বিক্রয়ের অভিন্ন পরিমাপ, সেই হেতু যারই কিছু বিক্রয়ের আছে এবং এর জন্য গ্রাহক সংগ্রহ করতে পারে না, সেই চটপট ভেবে নেয় যে, রাজ্যে বা দেশে অর্থের অভাবই হচ্ছে তার জিনিস না বিক্রি হবার কারণ; সুতরাং অথের অভাবই হয়ে ওঠে সকলের অভিন্ন নালিশ; সেটা হচ্ছে একটা মস্ত বড় ভুল। এই লোকেরা কি চায়, কারা গলা ছেড়ে অথের দাবি জানায়? : কৃষকের অভিযোগ সে ভাবে দেশে যদি আরো অথ থাকত, তা হলে সে তার জিনিসের দাম পেত। তা হলে মনে হয় তার দাবি অর্থের জন্য নয়, তার ফসল ও গবাদি পশুর দামের জন্য, যা সে বিক্রি করতে চায় কিন্তু পারে না।: (১) হয় দেশে তত বেশি ফসল ও গবাদি পশু আছে যে, যারাই বাজারে আসে, তারাই তার মৃত কেবল বিক্রি করতেই আসে, এবং খুব সামান্য লোকই আসে ক্রয় করতে। (২) অথবা সে খালি আছে পরিবহণের সাহায্যে বিদেশে দ্রব্যাদি স্থানান্তরের মামুলি অব্যবস্থা (৩) অথবা পরিভোগ ব্যথ হয়, যখন মানুষ দারিদ্রের কারণে বাড়ির জন্য আর আগের মত খরচ করে না; অতএব, বিশেষ ভাবে অর্থের বৃদ্ধিই কৃষকের জিনিসগুলির সুরাহা করতে পারবে না, বরং এই যে তিনটি কারণ, যা বাজারকে দাবিয়ে রেখেছে, তার যে কোনো একটির অপসারণই পারে তার জিনিসগুলির সুরাহা করতে, বণিক এবং দোকানদার অথ চায় একই ভাবে, অথাৎ তারা চায় তাদের জিনিসগুলি বিক্রি করার একটি পথ, কারণ বাজারে মন্দা চলছে।” [ একটি জাতি “কখনো এর চেয়ে ভাল অবস্থার নাগাল পায় না, যখন টাকা-কড়ি হাত থেকে হাতে হস্তান্তরিত হয়।” ( Sir Dudley North. *Discourses upon Trade”, Lond, 1691 pp. II—15, passim. ) হেরেনশোয়াণ্ড-এর কল্পনাশ্রয়ী ধারণাগুলির মানে দাঁড়ায় কেবল এই যে, বৈরতা, যার উৎস রয়েছে পণ্যের প্রকৃতির মধ্যে, এবং যা পুনরুৎপাদিত হয় পণ্যের সঞ্চলনে, তা অপসারিত করা যেতে পারে সঞ্চলন-মাধ্যমটিকে বৃদ্ধি করে। কিন্তু অন্যদিকে, উৎপাদন ও সঞ্চলনে অচলাবস্থার জন্য সঞ্চলন-মাধ্যমের অপ্রতুলতাকে দায়ী করা যদি হয় সাধারণ মানুষের বিভ্রম, এ থেকে এটা অনুসরণ করে না যে, অর্থের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আইন সভার গোলমেলে হস্তক্ষেপের দরুণ উদ্ভূত সঞ্চলন মাধ্যমের যথাথ অপ্রতুলতা এই ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে পারে না।

১৩. কোন জাতির বাণিজ্য পরিচালনা করতে একটা বিশেষ পরিমাপ ও অনুপাত অর্থের প্রয়োজন হয়, যার বেশি বা কম হলে বাণিজ্য ব্যাহত হয়। ঠিক যেমন একটি ছোট খুচরো বাণিজ্যে রৌপ্যমুদ্রা ভাঙাতে এবং যেসব লেনদেনে ক্ষুদ্রতম রৌপমুদ্রা দিয়েও হিসাব মিলানো যায় না সেগুলি মিটাতে একটা নির্দিষ্ট অনুপাতে ফার্দিংএর প্রয়োজন হয়। এখন, যেমন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ফাদিং-এর অনুপাত গ্রহণ করতে হয় লোকজনের সংখ্যা, তাদের বিনিময়ের পৌনঃপুনিকতা থেকে এবং তদুপরি প্রধানতঃ ক্ষুদ্রতম রৌপ্যমুদ্রাগুলির মূল্য থেকে, তেমনি অনুরূপ ভাবে, আমাদের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের ( স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার ) অনুপাত গ্রহণ করতে হবে যোগাযোগের পৌনঃপুনিকতা এবং প্রদেয় অর্থের পরিমাণ থেকে।” (উইলিয়ম্ পেটি, A Treatise of Taxes and cnntributions,Lnod 1667, p. I7)। জে: স্টুয়ার্ট এবং অন্যান্যদের আক্রমণের বিরুদ্ধে হিউম-এর ‘থিয়োরি’-কে সমর্থন করেছিলেন আর্থার ইয়ং তাঁর ‘Political Arithmetic’ গ্রন্থে (১৭৭৪), ১১২ পৃষ্ঠায় যেখানে দাম নির্ভর করে অর্থের পৰিমাণের উপরে’ শীর্ষক একটি আলাদা অধ্যায় আছে। Zur Kritik & c.’-এ (পৃঃ ১৭৯) আমি বলেছি “তিনি (অ্যাডাম স্মিথ ) সঞ্চলনরত মুদ্রার পরিমাণ সংক্রান্ত প্রশ্নটি কোনো মন্তব্য না করেই পার হয়ে গিয়েছেন, এবং অর্থকে খুবই ভুল ভাবে কেবল একটি পণ্য হিসাবেই গণ্য করেছেন।” এই মন্তব্যটি কেবল অ্যাডাম স্মিথের উল্লিখিত অর্থ সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অবশ্য, এখানে সেখানে, যেমন পূর্বতন রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির প্রণালীগুলি সম্পর্কে তার সমালোচনায় তিিন সঠিক বক্তব্যই রেখেছেন : “প্রত্যেক দেশেই অর্থের পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত হয় সেই পণ্য সমূহের মূল্যের দ্বারা, যে-পণ্যসমূহকে সঞ্চলিত করবে। একটি দেশে বছরে যত করুক এবং তাদের সঠিক পরিভোক্তাদের মধ্যে তাদেরকে বণ্টন করে দিক, এবং আর বেশিক নিয়োগ করতে না পারাকে। সৃঞ্চলনের প্রণালীটি আবশ্যিক ভাবেই তার মধ্যে টেনে আনে এমন একটি পরিমাণ যা তাকে পূর্ণ করে দেবার পক্ষে পর্যাপ্ত এবং তার চেয়ে অধিকতর পরিমাণকে সে স্থান দেয় না।” (Wealth of Notions, Bk. IV, ch. I)। অনুরূপ ভাবে তিনি তার গ্রন্থ শুরু করেন শ্রম-বিভাগের উপরে মহিমা আরোপ করে। পরে সর্বশেষ খণ্ডে, যেখানে সরকারি আয় সম্পর্কে আলেচনা রয়েছে, সেখানে তিনি তার শিক্ষক এ-ফাগুসন শ্রম-বিভাগের যে-নিন্দামন্দ করেছেন, প্রায়শঃই তার পুনরাবৃত্তি করেছেন।

১৪. কোন জাতির জনগণের মধ্যে সোনা ও রূপা বৃদ্ধি পেলে জিনিসপত্রের দাম নিশ্চয়ই বৃদ্ধি পাবে, বিপরীত দিকে, সোনা ও রূপা হ্রাস পেলে তার সঙ্গে সমঅনুপাতে জিনিসপত্রের দামও হ্রাস পাবে। [ Jacob Vanderlint : Money Answers all Things’, 1734, P. 5] এই বইটির সঙ্গে হিউমের “Essays”-এর সতর্ক তুলনার ফলে আমার ধারণা হয়েছে যে ভ্যাণ্ডারলিন্ট-এর এই গুরুত্বপূর্ণ বইখানার সঙ্গে নিঃসন্দেহে হিউমের পরিচয় ছিল। জিনিসপত্রের দাম যে সঞ্চলনের মাধ্যমটির পরিমাণের দ্বারা নির্ধারিত হয় এই মতটি বার্বন এবং তারও অনেক আগেকার লেখকদের লেখায় পাওয়া যায়। ভ্যাণ্ডারলিন্ট লিখেছেন, “নিয়ন্ত্রণহীন বাণিজ্যের ফলে অসুবিধা তো হবেই না, বরং বিপুল সুবিধাই হবে; কেননা এর ফলে যদি জাতির টাকা কমে যায়, যা নিবারণ করার জন্য বিধি-নিষেধ রচনা করা হয়, তা হলে যেসব জাতি ঐ টাকা পাবে, তারা দামের মধ্যে সবকিছু অগ্রগতি পেয়ে যাবে, কেননা তাদের মধ্যে টাকা বেড়ে যাবে। এবং আমাদের কারখানা-মালিকেরা, এবং বাকি সবকিছু, এমন ধীর-স্থির হয়ে উঠবে যে বাণিজ্যের ভারসাম্য আমাদের অনুকূলে চলে আসবে, এবং এই ভাবে ঐ টাকাটা আবার ফিরিয়ে আনবে।” (i. c. পৃ: ৪৩, ৪৪)।

১৫. প্রত্যেক এক ধরনের পণ্যের দামই যে সঞ্চলনের অন্তর্গত সমস্ত পণ্যের দাম সমূহের যোগফলের একটি অংশ, তা সুস্পষ্ট। কিন্তু কেমন করে ব্যবহার-মূল্য সমূহকে—যেগুলি পরস্পরের সম্পর্কে পরিমেয় নয় সেগুলিকেসর্বসাকুল্যে অন্য কোন দেশের সোনা ও রূপার মোট পরিমাণের সঙ্গে বিনিময় করা যায়, তা অবোধ গম্য। যদি আমরা এটা ধরে নিয়ে অগ্রসর হই যে সমস্ত পণ্য মিলে একটামাত্র পণ্য, বাকি সব পণ্যই তার অংশবিশেষ, তা হলে আমরা এই সুন্দর সিদ্ধান্তটিতে উপনীত হই : মোট পণ্যটি = x cwt, স্বর্ণ; ‘ক’ পণ্য = মোট পণ্যটির অংশ বিশেষ = 1 cwt স্বর্ণের = একাংশ। মতাম্বু খুব গুরুগম্ভীরভাবে এই কথাটিই God i “Si l’on compare la masse de l’or et de l’argent qui est dans le monde avec la somme des marchandises qui’y soot, il est certain que chaque denree ou mas bandise, en particulier, pourra etre comparee a une certaine portion de la masse entiere. Supposons qu’il n’y ait qu’une seule denree, ou marchandise dans le monde, ou qu’il n’y ait qu’une seule qui s’achete, et qu’elle se divise comme l’argent : Cette partie de cette marchandise repondra a une partie de la masee de l’argent; la moitie du total de l’une a la moitie du total de l’autre, &c l’etablissement du prix des choses depend toujours fondamentalement de la raison du total des choses au total des signes.” (Montesquieu, l.c, t. iii, pp. 12, 13). রিকার্ডো এবং তার শিষ্যবৃন্দ জেমস মিল,লর্ড ওভারেস্টোনও অন্যান্যদের হাতে এই তত্ত্বটির আরো বিকাশপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে Zur kritik &c” দ্রষ্টব্য, পৃঃ ১৪০-১৪৬ এবং ১৫০ জন স্টুয়ার্ট মিল তার স্বভাব সিদ্ধ পল্লবগ্রাহী যুক্তিবিদ্যা নিয়ে জানেন কিভাবে তার পিতা জেমস মিল-এর মত এবং তার বিপরীত মত একই সঙ্গে পোষণ করা যায়। তার সংক্ষিপ্তসার “Principles of pol. Economy”-র মূল অংশের সঙ্গে যদি তার ভূমিকাটি তুলনা করা যায়, যে ভূমিকাটিতে তিনি নিজেকে তার যুগের অ্যাডাম স্মিথ বলে ঘোষণা করেছেন, তা হলে আমরা বুঝতে পারি না যে কার সরলতার আমরা প্রশংসা করব—ঐ ব্যক্তিটির, না জনসাধারণের যারা সরল বিশ্বাসে তাকে তার স্ব-ঘোষিত অ্যাডাম স্মিথ হিসাবেই মেনে নিয়েছেন, যদিও অ্যাডাম স্মিথের সঙ্গে তার সাদৃশ্য ধরুন, জেনারেল উইলিয়স অব কার্স’-এর সঙ্গে ‘ডিউক অব ওয়েলিংটন’-এর সঙ্গে সাদৃশ্যেরই অনুরূপ। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে জেমস মিল-এর স্বকীয় গবেষণা ব্যাপকও নয়, গভীরও নয়, তা তার “Some unsetlled Questions of political Econoiny” নামক ক্ষুদ্র পুস্তকটির মধ্যেই সন্নিবিষ্ট, যা প্রকাশিত হয় ৮৪৪ সালে। স্বর্ণ ও রৌপ্য মূল্যে অনস্তিত্ব এবং কেবল পরিমাণের দ্বারা তাদের মূল্য নির্ধারণের কথা লক ( Locke) সরাসরি ঘোষণা করেন। “স্বর্ণ ও রৌপ্যের উপরে একটি কল্পিত মূল্য আরোপ করতে মানবজাতি সম্মত হয়। এই ধাতুগুলির অন্তর্নিহিত মূল্য পরিমাণটি ছাড়া কিছুই নয়।” (Some considerations” & c. 1691, Works, 1777, vol. II, p. 15)।

১৬. ‘মিন্ট’-এর উপরে ‘সেইনিয়োরেঞ্জ’ ইত্যাদি খুঁটিনাটি ব্যাপার আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে অ্যাডাম মূলার যিনি মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করেছেন “মহান বদান্যতা” যাকে ইংরেজ সরকার অর্থ দ্বারা পুরস্কৃত করতেন তার মতো ভাব প্রবণ কাভজাদের সুবিধার জন্য আমি ডাডলিনৰ্থ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি : “অন্যান্য পণ্যের মতো সোনা ও রূপারও জোয়ার-ভাটা হয়। স্পেন থেকে আনীত হবার পরে তা বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় টাওয়ারে, এবং সেখানে তাকে মুদ্রায়িত করা হয়। বেশি দিন যেতে না যেতেই আবার সেই ধাতু পিণ্ড রপ্তানির চাহিদা। উঠবে। যদি রপ্তানি করার মতো ধাতুপিণ্ড না থেকে থাকে, সবই যদি মুদ্রায় পরিণত হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে কি হবে? সেই মুদ্রাকে আবার গলিয়ে ফেলতে হবে, তাতে কোনো লোকসান নেই নো মুদ্রায়িত করতে মালিবের কোনো খরচ নেই। এইভাবে জাতিকে প্রতারিত করা হয়, তাকে বাধ্য করা হয় গাধার খাওয়ার জন্য তা হলে খড় তৈরি করে দিতে। মালিককে যদি মুদ্রায়িত করার জন্য ব্যয় বহন করতে হত, সে না ভেবেচিন্তে মুদ্রায়িত করার জন্য টাওয়ারে রূপা পাঠাতে না; সেক্ষেত্রে মুদ্রায়িত অর্থের মূল্য অমুদ্রায়িত রৌপ্যের তুলনায় বেশি থেকে যেত।” (North c. p. 18) দ্বিতীয় চার্লসএর রাজত্বকালে নর্থ নিজেই একজন সর্বাগ্রবর্তী মালিক।

১৭. “ছোটখাটো ব্যয়ের জন্য যতটা দরকার, রূপা যদি কখনো তা থেকে বেশি না হত তা হলে বড় বড় ব্যয়ের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে সংগ্রহ করা যেত না। … বড় বড় ব্যয়ের ক্ষেত্রে সোনার ব্যবহার ছোটখাটো ব্যয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যবহারকে অভাসিত করে। ছোটখাটো ব্যয়ের জন্যও যারা সোনার মুদ্রা ব্যবহার করে এবং ক্রীত পণ্যের সঙ্গে পাওনা বাড়তিটা রূপ হিসাবে পায়, তার উন্নত রূপাটাকে টেনে নেয় এবং সাধারণ সঞ্চলনে ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু সোনা ছাড়াই ছোটখাটো ব্যয় মেটানোর জন্য যতটা রূপার দরকার, ঠিক ততটা রূপাই যদি থাকে, সেক্ষেত্রে খুচরো ব্যবসায়ীর হাতেও রূপা সঞ্চিত হবে।” (David Buchanan, “Inquiry into the Taxation and Commercial Policy of Great Britain”. Edinburgh, 1844 pp. 248, 249 )।

১৮. চীনের ‘চ্যন্সেলর অব এক্সচেকার’ বাজপুরুষ ওয়ান-মাও-ইন-এর মাথায় একদিন এলো যে তিনি ঈশ্বর পুত্রের কাছে প্রস্তাবে রাখবেন গোপনে সাম্রাজ্যের কাগজে নোটকে ( assignats ) রূপান্তরযোগ্য ব্যাংক-নোটে পরিবর্তন করার। কাগুজে নোট কমিটি ১৮৫৪ সালে তার রিপোর্টে তাকে খুব জোর ধমক লাগালো। তাকে চিরাচরিত বাশ-ডলা দেওয়া হয়েছিল কিনা, তা বলা হয়নি। রিপোর্টের শেষ অংশটি ছিল এই রকম : কমিটি সযত্নে তার প্রস্তাবটি পরীক্ষা করে দেখেছে এবং দেখেছে যে প্রস্তাবটি সম্পূর্ণ ভাবেই বর্ণিকদের স্বার্থে এবং সম্রাটের পক্ষে কোনো স্বার্থ ই সাধন করবে না।” (Arbeiten der kaiserlich Russischen Gesandts chaft zu peking uber china.” Aus dem Russischen von Dr. K. Abelund F. A. Mecklenburg. Erster Band. Berlin 1858 p. 47 sq) ব্যাংকআইন সংক্রান্ত লর্ড সভার কমিটির সমক্ষে সাক্ষ্যদান প্রসঙ্গে ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড এর এক গভনর বলেন ‘প্রত্যেক বছরই নোতুন এক শ্রেণীর ‘সতরেইন’ অতিরিক্ত হালকা হয়ে যায়। যে শ্ৰেণীটি এক বছর পুরো ওজন নিয়ে চালু থাকে, তাই আবার ক্ষয়ক্ষতির ফলে পরের বছরে ওজন হারিয়ে নিজেকে হালকা করে ফেলে।” ( House of Lords’ Committee 1848 n. 429).

১৯. ফুলাটন থেকে উদ্ভূত এই অনুচ্ছেদটি থেকে বোঝা যায় অর্থ-বিষয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ লেখকদের পর্যন্ত অর্থের বিভিন্ন কাজ সম্বন্ধে ধারণা কত অস্পষ্ট ছিল : “এই ঘটনা অনস্বীকার্য যে আমাদের আভ্যন্তরীণ বিনিময সমূহে অর্থ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ, যেগুলি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার সাহায্যে করা হয়, সেই সবগুলিই করা যায় অ-রূপান্তর যোগ্য নোটের সাহায্যে, যাব আইন-বলে আরোপিত প্রথাগত মূল্য ছাড়া আর কোনো মূল্য নেই। এই ধরনের মূল্যকে অন্তনিহিত ফুল্যের যাবতীয় প্রয়োজন। পূরণের জন্য এবং এমনকি একটি মান’-এর আবশ্যকতা অতিক্রম করার জন্যও ব্যবহার করা যায় একমাত্র যদি সেই নোট কত পরিমাণে ছাড়া (ই) হবে তা যথােচিত নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।’ (ফুলার্টন: Regulation of currencies” লণ্ডন, ১৮৪৫, পৃঃ ২১) যেহেতু যে পণ্যটি অর্থ হিসাবে কাজ করতে সক্ষম, তাকে সঞ্চলনের ক্ষেত্রে কেবল মূল্যের প্রতীকসমূহের দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা যায়, সেই জন্য মূল্যের পরিমাপ ও মান হিসাবে তার কাজগুলিকে অপ্রয়োজনীয় বাংলা বলে ঘোষিত করা হল!

২০. স্বর্ণ এবং রৌপ্য যখন মুদ্রা হিসাবে কিংবা একান্ত ভাবে সঞ্চলনের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে, তখন তারা হয় নিজেদের প্রতীক—এই ঘটনাটি থেকে নিকোলাস বার্বন সরকারের অর্থ উন্নীত করার অধিকার অর্থাৎ যে-ওজনের রূপাকে শিলিং বলে অভিহিত করা তাকে বেশি ওজনের রূপার যেমন ক্রাউন-এর নামে অভিহিত করার অধিকার আছে বলে সিদ্ধান্ত করে করেন; সুতরাং পাওনাদারদের সে ক্রাউনের বদলে শিলিং দিতে পারে। “অর্থ বারংবার গণনার ফলে ক্ষয় এবং হাকা হয়।’ সুতরাং দর দাম করার সময় মানুষ কেবল অর্থের অভিধা ও সচলতাই বিবেচনা করে, রূপার পরিমাণ বিবেচনা করে না। ধাতুর উপরে সরকারের কর্তৃত্বই তাকে অর্থে পরিণত করে। (N. Barbon1 c. পৃঃ ২৯, ৩০, ২৫)

.

.

.

৩.৩  অর্থ

যে পণ্যটি নিজেই স্বশরীরে বা কোন প্রতিনিধির মাধ্যমে মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে, সেই পণ্যটিই হচ্ছে অর্থ। অতএব সোনা { কিংবা রূপা) হচ্ছে অর্থ। একদিকে যখন তাকে নিজেকেই তার স্বর্ণময় স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে হয়, তখন সে কাজ করে অর্থ হিসেবে। তখন সে মূল্যের পরিমাপ হিসেবে, কিংবা সঞ্চলনী মাধ্যম হিসেবে অন্যের প্রতিনিধিত্বে উপস্থাপিত হতে সক্ষম ভাগবতরূপমাত্র নয়; তখন সে হচ্ছে অর্থপণ্য। অন্যদিকে সে অর্থ হিসেবেও কাজ করে, যখন সে নিজের কর্মগুণে তা সে কর্ম স্বয়ং স্বশরীরে সম্পাদিত হোক বা কোন প্রতিনিধির মাধ্যমেই সম্পাদিত হোক-মূর্ত হয়ে ওঠে মূল্যের একমাত্র রূপ হিসেবে বাকি সমস্ত পণ্য যে-ব্যবহারমূল্যের প্রতিনিধিত্ব করে, তার বিপরীতে বিনিময়মূল্যের অস্তিত্বধারণের একমাত্র যথোপযোগী রূপ হিসেবে।

. মওজুদ

রূপান্তরণের দুটি বিপরীতমুখী আবর্তের মধ্যে পণ্যসমূহের এই যে নিবন্তর আবর্তন কিংবা বিক্রয় ও ক্রয়ের এই যে বিরতিবিহীন পরম্পরা, তা প্রতিফলিত হয় অর্থের অবিরাম চলাচলে কিংবা সঞ্চলনের ‘perpetuum mobile” হিসেবে অর্থের যে ভূমিকা সেই ভূমিকায়। কিন্তু যে-মুহূর্তে রূপান্তরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়, যে-মুহূর্তে বিক্রয় আর তৎপরবর্তী ক্রয়ের দ্বারা পরিপূরিত না হয়, সেই মুহূতেই অর্থও হয়ে পড়ে চমৎশক্তিরহিত; বয়সগিলেবাট্‌-এর ভাষায় বলা যায় যে সে রূপান্তরিত হয় “জঙ্গম” থেকে “স্থাবরে”, সচল থেকে অচলে, মুদ্রা থেকে অর্থে।

পণ্যদ্রব্যাদির সঞ্চলনের সেই প্রথম পর্যায়ের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই, বিকাশ লাভ করে প্রথম রূপান্তরণের ফলটিকে ধরে রাখবার আবশ্যিকতা ও উদগ্র কামনা। এই ফলটি হচ্ছে সংশ্লিষ্ট পণ্যেরই পরিবর্তিত রূপ কিংবা তার স্বর্ণস্ফটিক।[১] অতএব অন্যান্য পণ্য ক্রয় করার জন্য পণ্যাদি বিক্রয় করা হয় না; বিক্রয় করা হয় তাদেব অর্থরূপকে তাদের পণ্যরূপের স্থলাভিষিক্ত করার জন্য। কেবলমাত্র পণ্য সঞ্চলন সম্পাদন করার মাধ্যম হিসেবে না থেকে, এইরূপ পরিবর্তনই হয়ে ওঠে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এইভাবে সংশ্লিষ্ট পণ্যটির পরিবর্তিত রূপটির বিরত রাখা হয় তার নিঃশর্তভাবে পরকীকরণীয় রূপ হিসেবে যে কাজ তথা তার বিশুদ্ধ ক্ষণস্থাৰী অৰ্থরূপ হিসেবে যে কাজ, সেই কাজটি সম্পাদন করা থেকে অর্থশিলীভূত হয় মওজুদের আকারে এবং বিক্রেতা পরিণত হয় অর্থের মওজুদদারে।

পণ্য-সঞ্চলনের গোড়ার যুগগুলিতে কেবল উদ্বৃত্ত ব্যবহার-মূল্যই রূপান্তরিত হত অর্থে। সুতরাং সোনা এবং রূপা নিজেরাই তখন দেখা দিত বাহুল্য বা ধনসমৃদ্ধির সামাজিক অভিব্যক্তি হিসেবে। যে সমস্ত সমাজে আভ্যন্তরীণ অভাবগুলি যোগাবার জন্য একটি নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ পরিমাণ দ্রব্যাদি চিরাচরিত উৎপাদন-পদ্ধতি অনুসারে উৎপন্ন হয়, সেইসব সমাজেই কেবল মওজুদের এই সরল রূপটি চালু থাকে। এশিয়া এবং বিশেষ করে, ইষ্ট ইণ্ডিজের জন জীবনে এই ঘটনাই ঘটেছে। ভাণ্ডারলিন মনে করেন যে, কোন দেশে দাম নির্ধারিত হয় সেই দেশে প্রাপ্ত সোনা ও রূপার পরিমাণের দ্বারা; তিনি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছেন ভারতের পণ্যসামগ্রী এত সস্তা কেন। তার উত্তর এই : কারণ হিন্দুরা (ভারতীয়) তাদের অর্থ এই মাটির তলায় পুতে রাখে। ১৬০২ থেকে ১৩৪ সাল পর্যন্ত, তার মন্তব্য অনুসারে, মাটির তলায় পুতে রাখা অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ১৫০ মিলিয়ন রৌপ্য নির্মিত পাউণ্ড স্টার্লিং যা শুরুতে এসেছিল আমেরিকা থেকে ইউরোপ।[২] ১৮৫৬ থেকে ১৯১৮ সালের এই দশ বছরে মধ্যে ইংল্যাণ্ড ভারতে এবং চীনে রূপার অঙ্কে রপ্তানী করে £১২০,০০০,০০০ পউণ্ড-যা। পাওয়া গিয়েছিল অষ্ট্রেলিয়ার সোনার বিনিময়ে। চীনে যে-পরিমাণ রূপা রপ্তানী করা হয়েছিল তার বেশির ভাগটাই ভারতে চলে যায়।

পণ্য-উৎপাদন বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে, প্রত্যেক উৎপাদনকারীই ‘nexus rerum’ বা সামাজিক অঙ্গীকারটি পম্পর্কে নিশ্চয়তা লাভ করতে বাধ্য হয়েছিল।[৩] তার অভাবগুলি নিরন্তর তাকে তাড়না করে এবং অন্যান্য লোকজনের কাছ থেকে পণ্যাদি ক্রয় করতে নিরন্তর বাধ্য করে, যখন তার নিজের পণ্য উৎপাদনে সময়ের প্রয়োজন পড়ে এবং নানাবিধ ঘটনারর উপরে নির্ভর করে। সেক্ষেত্রে বিক্রয় না করেও ক্রয় করার জন্য, সে নিশ্চয়ই আগেভাগে ক্রয় না করেও বিক্র করে থাকবে। এই প্রক্রিয়া ব্যাপক আকারে চললে একটি দ্বন্দ্ব আত্ম প্রকাশ করে। কিন্তু মহার্ঘ ধাতুগুলি তাদের উৎপাদনের উৎসক্ষেত্রে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে সরাসরি বিনিমিত হয়। এবং এখানে। আমরা বিক্রয় প্রত্যক্ষ করি (পণ্য দ্রব্যাদি মালিকদের দ্বারা ক্রয় ব্যাতিরেকেই (সোনা ও রূপার মালিকদের দ্বারা)। [৪] এবং অন্যান্য উৎপাদনকারীদের দ্বারা পরবর্তী বিক্রয়াদি-যে-বিক্রয়াদির পরে কোন ক্ৰয়াদি ঘটেনি-এমন বিক্রয়াদি কেবল সংঘটিত করে নতুন উৎপাদিত মাহার্ঘ ধাতুসমূহের বণ্টন-পণ্যদ্রব্যাদির সকল মালিকদের মধ্যে। এইভাবে আগাগোড়া বিনিময়ের ধারা ধরে বিভিন্ন পরিমাণের সোনা ও রূপার মওজুদ সঞ্চিত হতে থাকে। একটি বিশেষ পণ্যের আকারে বিনিময়-মূল্য ধরে রাখা ও সঞ্চিত কৰাৰ এই সম্ভাব্যতার সঙ্গে সঙ্গে সোনার প্রতি লোলুপতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সঞ্চলনের সম্প্রসারণ-লাভের সঙ্গে সঙ্গে, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় অর্থের ক্ষমতা–ব্যবহারের জন্য সদা-প্রস্তুত, ধনসম্পদের নিঃশর্ত সামাজিক রূপস্বরূপ যে অর্থ তার ক্ষমতা। “সোনা একটা আশ্চর্য জিনিস! যে-ই সোনার মালিক, সে তার সব চাওয়া-পাওয়ারও মালিক সোনার দৌলতে আত্মাগুলোকেও এমনকি স্বর্গে পর্যন্ত চালান করে দিতে পারে।” [ কলাম্বাস-এ জামাইকা থেকে লেখা চিঠি, ১৫০৩] যেহেতু কোন জিনিসটা সোনার রূপাতি হয়েছে সেটা সে ফাস করে দেয়না, সেহেতু, পণ্য হোক, বা না হোক, সব কিছুই সোনায় রূপান্তরিত হতে পারে। সব কিছুই হয়ে ওঠে বিক্রয়হোগ্য এবং ক্রয়যোগ্য। সঞ্চলন পরিণত হয় এমন একটি বিরাট সামাজিক বকযন্ত্রে যার মধ্যে সব কিছুই নিক্ষিপ্ত হয় কেবল আবার স্বর্ণস্ফটিকের আকারে নিষ্ক্রান্ত হবার জন্য। এমনকি সাধুসন্তদের অস্থি পর্যন্ত এই রাসায়নিক প্রক্রিয়া থেকে আত্মরক্ষা করতে পারেনা, তা থেকে ঢের বেশী কমনীয় res sacrosanctae, extra commercium hominum’-এর বেলায় তো আত্মরক্ষার প্রশ্নই ওঠে না।[৫] যেমন পণ্যদ্রব্যাদির প্রত্যেকটি গুণগত পার্থক্যই অর্থে নির্বাণ লাভ করে, ঠিক তেমনি অর্থও আবার আমূল সমতাবাদী হিসেবে তার যে ভুমিকা, সেই ভূমিকায় সমস্ত পার্থক্যকে সমান করে দেয়। [৬]কিন্তু অর্থ নিজেও তো একটা পণ্য, একটা বাহ্য বিষয় যা কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে পারে। এইভাবে সামাজিক ক্ষমতা পরিণত হয় ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষমতায়। এই জন্যই প্রাচীনের। অর্থকে ধিক্কার জানিয়েছেন অর্থনৈতিক ও নৈতিক বিধিব্যবস্থার পক্ষে বিপর্যয়কর বলে। আধুনিক সমাজ-যে সমাজ ভূমিষ্ঠ হবার অব্যবহিত পরেই পৃথিবীর জঠর থেকে [৭] পুটাসকে চুল ধরে টেনে তোলে—সেই সমাজ সোনাকে বন্দনা করে তার পবিত্র পাত্র হিসেবে, তার নিজের জীবনের মৌল তত্ত্বের জ্যোতির্ময় বিগ্রহ হিসেবে।

ব্যবহার মূল্য হিসেবে একটি পণ্য একটি বিশেষ অভাবের তৃপ্তিবিধায়ক এবং বৈষয়িক ধনসম্পদেব একটি বিশেষ উপাদান। কিন্তু একটি পণ্যের মূল্য, বৈষয়িক ধনসম্পদের বাকি সমস্ত উপাদানের জন্য তার যে আকর্ষণ, তা পরিমাপ করে; সুতরাং তা তার মালিকের সামজিক ধনসম্পদও পরিমাপ করে। একজন বর্বরযুগীয় পণ্য মালিকের কাছে, এমনকি একজন পশ্চিম ইউরোপীয় কৃষকের কাছেও, মূল্য আর মূল্যরূপ এক ও অভিন্ন, অতএব তার কাছে সোনা ও রূপার মওজুদ বাড়ার মানে হচ্ছে মূল্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্তি। এটা সত্য যে অর্থের মূল্য এক সময়ে পরিবর্তিত হয় তার নিজের মূল্যে পরিবর্তনের দরুণ এবং অন্য সময়ে পরিবর্তিত হয় পণ্যদ্রব্যাদির মূল্যসমূহে পরিবর্তনের দরুন। কিন্তু তার ফলে একদিকে যেমন ২০০ আউন্স সোনার মূল্যে ১০০ আউন্স সোনার মূল্য থেকে কমে যায় না, অন্যদিকে তেমন বাকি সমস্ত পন্যেৰ সমাৰ্ঘ রূপ হিসেবে এবং সমস্ত মনুষ্য-শ্রমের প্রত্যক্ষ বিগ্রহ হিসেবে চালু থাকা থেকে তা সরে যায় না। মওজুদের জন্য যে লালসা তার শেষ নেই। গুণগত দিক থেকে কিংবা আনুষ্ঠানিক দিক থেকে বিচার করলে, অর্থের কার্যকারিতার কোন সীমা নেই, কেননা অর্থ হচ্ছে বৈষয়িক ধনসম্পদের বিশ্বজনিক প্রতিনিধি অন্যান্য যে-কোনো পণ্যে তা প্রত্যক্ষভাবেই রূপান্তরণীয়। কিন্তু, সেই সঙ্গেই আবার, প্রত্যেকটি আসল অর্থের অঙ্কই কিন্তু পরিমাণে সীমাবদ্ধ এবং সেই কারণেই ক্রয়ের উপায় হিসেবে তার কার্যকরিতাও সীমাবদ্ধ। অর্থের পরিমাণগত সীমাবদ্ধতা এবং গুণগত সীমাহীনতার মধ্যে এই যে বৈপরীত্য, তা মওজুদদারের পক্ষে নিরন্তর কাজ করে তার সঞ্চয়সাধনার ‘সিসিফাস’-সুলভ শ্রমের অনুপ্রেরণা হিসোব। যেমন, একজন বিজেতা এক একটি দেশ জয় করে নিজের রাজ্যের অঙ্গীভূত করে নেবার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পায় নিজের সাম্রাজ্যের নতুন এক সীমানা, তেমন একজন মওজুদদারও নিত্য নতুন মওজুদ-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পায় নতুন নতুন নিশানা।

যাতে করে সোনাকে অর্থ হিসেবে ধরে রাখা যায় এবং মওজুদ হিসেবে রেখে দেওয়া যায়, তার জন্য তাকে সঞ্চলন কিংবা ভোগের উপায় হিসেবে রূপায়িত হওয়া থেকে অবশ্যই নিবৃত্ত করতে হবে। সেই জন্যেই মওজুদদার তার রক্তমাংসের কামনাবাসনা বলি দেয় স্বর্ণপ্রতিমার বেদিমূলে। ভোগ-বৈরাগ্য প্রসঙ্গে শাস্ত্রে যে বিধান দেওয়া আছে, সেই বিধান সে ঐকান্তিক ভাবে মেনে চলে। পক্ষান্তরে, পণ্যের আকারে সে যতটা পরিমাণ সঞ্চলনে নিক্ষেপ করেছে, তার বেশি পরিমাণ সে তুলে নিতে পারে না। যতই সে উৎপাদন বাড়ায়, ততই সে বেশী করে বিক্রয় করতে পারে। সুতরাং কঠোর কর্মঠ, সঞ্চয়লিপ্সা এবং অর্থলোলুপতা হয়ে ওঠে তার প্রধান গুণাবলী আর বেচে বেশি, কেনো কম’-এটাই হয়ে ওঠে তার রাষ্ট্রীয় অর্থ শাস্ত্রের জপতপ। [৮]

মওজুদের স্থূলরূপের পাশাপাশি আমরা প্রত্যক্ষ করি তার নান্দনিক রূপটিকেও —সোনা ও রূপার দ্রব্যসামগ্রীর উপরে স্বত্বাধিকারের আকারে। সভ্য সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এরও ঘটে অগ্রগতি “Soyons riches ou paraissons riches* ( Diderot)। এইভাবে সৃষ্টি হয় একদিকে, অর্থ হিসেবে তাদের যেসব কাজ সেসবের সঙ্গে সম্পর্কহীন সোনা ও রূপার এক ক্রমসম্পসারণশীল বাজার; অন্যদিকে, সরবরাহের একটি প্রচ্ছন্ন উৎস-প্রধানত সংকট ও সামাজিক ঝড়ঝাপ্টার সময়ে যার। শরণ নেওয়া হয়।

ধাতব সঞ্চলনেব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মওজুদ নানাবিধ ভূমিকা পালন করে থাকে। স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার চলাচল যে সব অবস্থার অধীন সেই সব অবস্থা থেকেই ঘটে তার প্রথম ভূমিকাটির উদ্ভব। আমরা দেখেছি কেমন করে পণ্য-দ্রব্যাদির দামের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, অর্থ প্রবাহের পরিমাণেও জোয়ার ভাটা দেখা দেয়। অতএব, অর্থের মোট পরিমাণকে হতে হবে সম্প্রসারণ-ক্ষম এবং সংকোচন-ক্ষম। এক সময়ে অর্থকে আকর্ষিত করতে হবে সঞ্চলনশীল মুদ্রার ভূমিকায় তার কাজ করতে; অন্য সময়ে, তাকে বিকর্ষিত করতে হবে কম-বেশী চলচ্ছক্তিরহিত অর্থের ভূমিকা পালন করতে। যাতে করে, সত্যই চালু আছে এমন অর্থের পরিমাণ সঞ্চলনের আত্মভূত করার ক্ষমতাকে নিরন্তর পরিপূরিত করতে পাবে, তার জন্য প্রয়োজন যে, কোন দেশের সোনা ও রূপার পরিমাণ যেন, মূদ্রা হিসেবে কাজ করার জন্য যে পরিমাণ সোনা ও রূপার দরকার, তা থেকে তা বেশী হয়। অর্থ মওজুদের আকার ধারণ করলেই এই শর্তটি পূর্ণ হয়। সঞ্চলনের মধ্যে যোগান দেবার কিংবা তার বাইরে তুলে আনবার আগম-নিগম নল হিসেবে এই মওজুদ করে; তার ফলে ব্যাংকগুলি কখনো উপচে পড়ে না।[৯]

. প্রদানের উপায়

এই পর্যন্ত আমরা সঞ্চলনের যে সরল পদ্ধতি আলোচনা করেছি, তাতে আমরা দেখেছি যে একটি নির্দিষ্ট মূল্য আমাদের কাছে সব সময়েই উপস্থিত হয় এক দ্বৈত আকারে-এক মেরুতে পণ্য হিসেবে এবং অন্য মেরুটিতে অর্থ হিসেবে। সুতরাং ইতিমধ্যেই যা যা পরস্পরের সমার্থ হয়ে গিয়েছে, যথাক্রমে তার প্রতিনিধি হিসেবেই পণ্যমালিকেরা পরস্পরের সংস্পর্শে আসতেন। কিন্তু সঞ্চলনের বিকাশ লাভের সঙ্গে সঙ্গে এমন সব অবস্থার উদ্ভব ঘটে যার অধীনে পণ্যদ্রব্যাদির পরকীকরণ একটা সময়ের ব্যবধানে, তাদের দামগুলির বাস্তবায়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এইসব অবস্থার মধ্যে যে অবস্থাটি সবচেয়ে সরল, এখানে কেবল সেটির উল্লেখ করাই যথেষ্ট। একটা জিনিস উৎপাদন করতে দরকার হয় দীর্ঘতর সময়ের, আরেকটা উৎপাদন করতে হ্রস্তর সময়ের। আবার, বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন নির্ভর করে বছরের বিভিন্ন ঋতুর উপরে। এক ধরনের পণ্য তার নিজের বাজারের জায়গাতেই ভূমিষ্ঠ হতে পারে, আরেক ধরনের পণ্যকে হয়তো দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে যেতে হয়। সুতরাং এক নং পণ্যের মালিক যখন বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত, দুই নং পণ্যের মালিক তখন ক্রয়ের জন্য প্রস্তুত না-ও হতে পারে। যখন একই লেনদেন একই ব্যক্তিদের মধ্যে নিরন্তর পুনরাবৃত্ত হয়, তখন বিক্রয়ের অবস্থাগুলি নিয়ন্ত্রিত হয় উৎপাদনের অবস্থাগুলির দ্বারা পক্ষান্তরে, একটি নির্দিষ্ট পণ্যের যেমন একটি বাড়ির, ব্যবহারকে বিক্রয় করা হল (চলতি কথায় ভাড়া। দেওয়া হ’ল ) একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। এখানে কেবল সেই নির্দিষ্ট সময়টা অতিক্রান্ত হয়ে গেলেই ক্রেতা কার্যতঃ তার ক্রীত পণ্যটির ব্যবহার মূল্য পেয়ে থাকে। সুতরাং পণ্যটির জন্য কিছু দেবার আগেই সে সেটিকে ক্রয় করে থাকে। বিক্রয়কারী বিক্রয় করে একটি পণ্য যা বর্তমান, ক্রয়কারী তা ক্রয় করে অর্থের,কিংবা বলা উচিত যে যে অর্থ ভবিষ্যতে প্রদেয়, সেই অর্থের প্রতিনিধি হিসেবে। বিক্রয়কারী এখানে হয় ঋণদাতা এবং ক্রেতা হয় ঋণগ্রহীতা। যেহেতু পণ্যদ্রব্যাদির রূপান্তরণ সমূহ, কিংবা তাদের মূল্যরূপের বিকাশপ্রাপ্তি এখানে দেখা দেয় এক নতুন চেহারায়, সেহেতু অর্থও এখানে অর্জন করে নতুন এক ভূমিকা : অর্থ পরিণত হয় প্রদানের উপায়ে।

ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার চরিত্র এখানে সরল সঞ্চলনের ফলশ্রুতি মাত্র। উক্ত সঞ্চলনের রূপ পরিবর্তনই এখানে বিক্রেতা ও ক্রেতাকে নতুন রঙে রঞ্জিত করে। সুং গোড়ার দিকে এই নতুন ভূমিকাদুটি বিক্রেতা এবং ক্রেতার দ্বারা অভিনীত ভূমিকাদুটির মতই ক্ষণস্থায়ী এবং পরস্পর-পরবর্তী এবং পালাক্রমে একই অভিনেতাদের দ্বাৱা অভিনীত নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে দুটি চরিত্রের অবস্থানের বৈপরীত্য আদৌ প্রীতিকর নয় এবং ঢের বেশী সংহতি-সক্ষম।[১০] অবশ্য, পণ্য-সঞ্চলন থেকে নিরপেক্ষ ভাবেও এই দুটি চরিত্র অভিনীত হতে পারে। প্রাচীন জগতের শ্রেণীসংগ্রামগুলি প্রধানতঃ এই ঋণগ্রহীতা এবং ঋণদাতাদের মধ্যে সংঘাতের আকারই পরিগ্রহ করত রোমে যার পরিণতি ঘটল প্লীবীয় ঋণগ্রহীতাদের সর্বনাশে। তারা ক্রীতদাসের দ্বারা স্থানচ্যুত হল। মধ্যযুগে এই সংঘাত সমাপ্ত হল সামন্ততান্ত্রিক ঋণগ্রহীতাদের সর্বনাশে; তারা দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতাও হারালো এবং সেই ক্ষমতার অর্থ নৈতিক ক্ষমতা, তা-ও হারালো। যাই হোক না কেন, ঐ দুই যুগে ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতা—এই দুয়ের মধ্যে যে অর্থ-সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল, তা ছিল কেবল সংশ্লিষ্ট শ্রেণীদুটির অস্তিত্বের সাধারণ অর্থ নৈতিক অবস্থাবলীর মধ্যে গভীরতর বিরোধেরই প্রতিফলন।

আবার পণ্যসঞ্চলনের ব্যাপারটিতে ফিরে যাওয়া যাক। পণ্য এবং অর্থ—এই দুটি সমার্ঘ সামগ্রীর দুই মেরুতে আবির্ভাব এখন যুগপৎ ঘটা থেকে বিরত হয়েছে। অর্থ এখন কাজ করে প্রথমত, বিক্রীত পণ্যের দাম নির্ধারণে মূল্যের পরিমাপ হিসেবে, চুক্তির মাধ্যমে স্থিরীকৃত দাম পরিমাপ করে দেনাদারের বাধ্যবাধকতা তথা একটি নির্দিষ্ট তারিখে সে যে-পরিমাণ অর্থ দিতে বাধ্য থাকবে তার পরিমাণ। দ্বিতীয়ত, অর্থ কাজ করে ক্রয়ের হিসেবে ভাবগত উপায়ে। যদিও তার অস্তিত্ব থাকে কেবল ক্রেতা কতৃক প্রদানের অঙ্গীকারের মধ্যেই, তবু তারই বলে ঘটে পণ্যের হাতবদল। প্রদানের জন্য যে তারিখটি ধার্থ থাকে, তার আগে অর্থ কার্বতঃ সঞ্চলনে প্রবেশ করেনা, বিক্রেতার হাতে যাবার জন্য ক্রেতার হাত পরিত্যাগ করেন। সঞ্চলনশীল মাধ্যমটি পরিণত হয়েছিল মওজুদে, কেননা প্রথম পর্যায়ের পরেই প্রক্রিয়াটি মাঝ পথেই থেমে গিয়েছিল, কেননা পণ্যের রূপান্তরিত আকারটিকে অর্থাৎ অর্থকে সঞ্চলন থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। প্রদানের উপায়টি সঞ্চলনে প্রবেশ করে, কিন্তু তা করে কেবল তখনি যখন পণ্যটি সেখান থেকে প্রস্থান করেছে। অর্থ নামক উপায়টির মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি আর সংঘটিত হয় না। বিনিময় মূল্যের অস্তিত্বের অনপেক্ষ রূপ হিসেবে কিংবা বিশ্বজনিক পণ্য হিসেবে পদক্ষেপ করে অর্থ কেবল উক্ত প্রক্রিয়াটির পরিসমাপ্তি ঘটায়। কোন-না-কোন অভাব পরিতৃপ্ত করবার জন্য বিক্রেতা তার পণ্যকে অর্থে পরিণত করেছিল; পণ্যকে অর্থের আকারে রক্ষা করবার জন্য মওজুদদারও ঐ একই কাজ করেছিল। এবং দেনাদারও তার দেনাপরিশোধের জন্য করেছিল সেই একই কাজ, কেননা সে যদি পরিশোধ না করে তা হলে শেরিফ তার দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয় করে দেবে। এখন বিক্রয়ের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কেবল পণ্যের মূল্যরূপ অর্থাৎ অর্থ; স্বয়ং সঞ্চলন-প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত একটি সামাজিক প্রয়োজনের তাগিদেই এই পরিণতি।

পণ্যকে অর্থে পরিবর্তিত করার আগে ক্রেতা অর্থকে পুনরায় পণ্যে পরিবর্তিত করে, অন্যভাবে বলা যায়, প্রথম রূপান্তরণটির আগেই সে দ্বিতীয় রূপান্তরণটি ঘটিয়ে ফেলে। বিক্রেতার পণ্য সঙ্কলিত হয় এবং তার দামকে বাস্তবায়িত করে কিন্তু তা করে কেবল অর্থের উপরে একটি আইনগত দাবির আকারেই। অর্থে রূপান্তরিত হবার আগে তা রূপান্তরিত হয় ব্যবহার মূল্যে। তার প্রথম রূপান্তরণের সম্পূৰ্ণায়ন ঘটে কেবল পরবর্তী কোনো সময়ে।[১১]

একটি নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে যে সমস্ত বাধ্যবাধকতা পরিপূরণীয় হয়ে ওঠে, সেগুলি পণ্যদ্রব্যাদির দামসমূহের যোগফলের প্রতিনিধিত্ব করে; এই পণ্যদ্রব্যাদির বিক্রয় থেকেই ঐসব বাধ্যবাধকতার উদ্ভব ঘটেছিল। এই মোট দামকে বাস্তবায়িত করতে যে-পরিমাণ সোনার প্রয়োজন তা নির্ভর করে, প্রথমত, প্রদানের উপায়টির সঞ্চলন-বেগের উপরে। এই পরিমাণ দুটি ঘটনার দ্বারা শায়িত : প্রথমত, দেনাদার আর পাওনাদারদের মধ্যকার সম্পর্কসমূহ এমন একটি শেকল রচনা করে যে যখন ‘ক’ তার দেনাদার ‘খ’-এর কাছে থেকে অর্থ পায়, তখন সে তা সোজাসুজি তুলে দেয় তার পাওনাদার ‘গ’-এর হাতে, ইত্যাদি ইত্যাদি। দ্বিতীয়, ঘটনাটি হল বাধ্যবাধকতাসমূহ পরিপুরণের বিভিন্ন দিনের মধ্যে কালগত ব্যবধান। প্রদানের নিরবচ্ছিন্ন ধারা কিংবা ব্যাহত গতি প্রথম রূপান্তরণসমূহের নিরবচ্ছিন্ন ধারা মূলতঃ রূপান্তরণ ক্রমসমূহের পারস্পরিক গ্রস্থিবন্ধন থেকে—যে পারস্পরিক গ্রন্থিবন্ধন সম্পর্কে আমরা এর আগে আলোচনা করেছি—তা থেকে বিভিন্ন। সঞ্চলনশীল মাধ্যমের দ্বারা ক্রেতাদের এবং বিক্রেতাদের মধ্যে যে সম্পর্ক তা কেবল অভিব্যক্তই . সলতের দ্বারাই এই সম্পর্কের উদ্ভব সংঘটিত হয় এবং সঞ্চলনের মধ্যেই এই সম্পর্ক অস্তিত্ব ধারণ করে। প্রতিতুলনাগত ভাবে, প্রদানের উপায়টির গতিশীলতা অভিব্যক্ত করে একটি সামাজিক সম্পর্ক—দীর্ঘকাল আগেই যার অস্তিত্ব ছিল।

অনেকগুলি বিক্রয় একই সময়ে এবং পাশাপাশি সংঘটিত হয়-এই যে ঘটনা, তা মুদ্রা কি মাত্রায় প্রচলন-বেগের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে, সেটা নির্ধারণ করে দেয়। পক্ষান্তরে, এই ঘটনা প্রদানের উপায়টির ব্যবহার-সংকোচনের পক্ষে একটি সক্রিয় হেত, হিসেবে কাজ করে। যে অনুপাতে প্রদানের সংখ্যা একই স্থানে সংকেন্দ্রীভূত হয়, সেই অনুপাতে তাদের শোধবোধ ঘটাবার জন্য বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব ঘটে। মধ্যযুগে ‘লায়ন্স-এ ‘vivenients’-গুলি এই রকমের প্রতিষ্ঠানই ছিল। ‘ক’-এর কাছে ‘খ’-এর যা দেনা, ‘খ’-এর কাছে ‘গ’-এর যা দেনা, ‘গ’-এর কাছে ‘ক’-এর যা দেনা ইত্যাদি ইত্যাদি এই রকমের আরো সব দেনাকে পরস্পরের মুখোমুখি হতে হবে যাতে করে ইতিবাচক রাশি এবং নেতিবাচক রাশি যেমন পরস্পরকে কাটাকাটি করে তেমনি এই দেনা-পাওনাগুলি পরস্পরের সোধবোধ করে দেয়। এইভাবে শেষ পর্যন্ত থেকে যায় প্রদানের মতো একটি মাত্র অঙ্ক। যত বেশী সংখ্যায় এই প্রদানের সংকেন্দ্রীভবন ঘটে আপেক্ষিক হিসেবে এই প্রদেয় অঙ্ক তত কম পরিমাণ হয় এবং সঞ্চলনে প্রদানের উপায়টির অঙ্কও তত কম পরিমাণ হয়।

প্রদানের উপায় হিসেবে অর্থের যে ভূমিকা তার মধ্যে নিহিত থাকে একটি নিরবশেষ দ্বন্দ্ব। যেখানে দেনা-পাওনার লেনদেন। পরস্পরের সমান হওয়া যায়, সেখানে অর্থ কাজ করে কেবল ভাবগত ভাবে হিসেব রাখার অর্থ হিসেবে, মূল্যের পরিমাপ হিসেবে। যেখানে কার্যতই অর্থ প্রদান করতে হবে, সেখানে কিন্তু অর্থ সখলনী মাধ্যম হিসেবে দ্রব্যাদির লেনদেনে ক্ষণকালীন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করনা, যেখানে সে কাজ করে সামাজিক শ্রমের মূর্তরূপ হিসেবে, বিনিময়মূল্যের অস্তিত্বের স্বতন্ত্র রূপ হিসেবে, সর্বজনিক পণ্য হিসেবে। শিল্পগত ও বাণিজ্যগত সংকটসমূহের যেসব পর্যায়কে অর্থগত সংকট বলা হয়, সেইসব পর্যায়ে এই দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।[১২] এই ধরনের সংকট কেবল তখনি ঘটে যখন প্রদানের ক্রমদীর্ঘতর শেকলটি এবং তাদের শোধবোধের একটি কৃত্রিম ব্যবস্থা পরিপূর্ণ ভাবে বিকাশপ্রাপ্ত হয়েছে। যখনি এই প্রণালীটিতে কোনো সাধারণ ও ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটেতা সে ব্যাঘাতের কারণ যাই হোক না কেন, তখনি অর্থ অকস্মাৎ ও অচিরাৎ তার নিছক হিসেবী অর্থের ভাবগত আকার থেকে রূপান্তরিত হয় নগদ টাকায়। অপবিত্র পণ্যসমূহ আর তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। পণ্যদ্রব্যাদির ব্যবহার মূল্য হয়ে পড়ে মূল্যহীন এবং তাদের নিজেদেরই স্বতন্ত্র রূপের সামনে তাদের মূল্য অন্তর্হিত হয়ে যায়। সংকটের প্রাক্কালে বুর্জোয়া, তার উন্মাদনাকর ঐশ্বর্য থেকে স্বয়ং সম্পূর্ণতার বলে ঘোষণা করে যে, অর্থ হচ্ছে একটি অলীক কল্পনা মাত্র। কেবল পণ্যই হচ্ছে অর্থ। কিন্তু আজ একই আওয়াজ শোনা যায় সর্বত্র : একমাত্র অর্থই হচ্ছে পণ্য। যেমন হরিণ ছুটে বেড়ায় জলের সন্ধানে, ঠিক তেমনি তার আত্মাও ছুটে বেড়ায় একমাত্র ধন যে-অর্থ সেই অর্থের সন্ধানে।[১৩] সংকটের কালে পণ্য এবং তার প্রতিপক্ষ মূল্যরূপ, তথা অর্থ, একটি চূড়ান্ত দ্বন্দ্বে উন্নীত হয়। এই জন্যই, এই ধরনের ঘটনাবলীতে, যে-রূপের অধীনে অর্থের আবির্ভাব ঘটে, তার কোনো গুরুত্ব নেই। দেনা-পাওনা সোনা দিয়েই মেটাতে হোক বা ব্যাংক নোটের মতো ক্রেডিট-অর্থে ই মেটাতে হোক, অর্থের দুর্ভিক্ষ চলতেই থাকে।[১৪]

এখন যদি আমরা একটি নির্দিষ্ট সময়কালে চালু অর্থের মোট যোগফল বিবেচনা করে দেখি আমরা দেখতে পাব যে, সঞ্চলনী মাধ্যমটির এবং প্রদানের উপায়টির প্রচলন বেগ যদি নির্দিষ্ট থাকে, তা হলে এই মোট যোগফল হবে : বাস্তবায়িতব্য দামসমূহের মোট যোগ দেয় প্রদানসমূহের মোট বিমোগ, পরস্পরের সঙ্গে সমান হয়ে যাওয়া দেনা পান্ন সমূহ, বিয়োগ সঞ্চলন ও প্রদানের উপায় হিসেবে পালাক্রমে একই মুদ্রাখণ্ড যতটা আবর্তকার্য সমাধা করে। অতএব, এমনকি যখন দাম, অর্থের প্রচলনবেগ এবং প্রদানের ক্ষেত্রে নিত্যব্যবহারের মাত্রা নিদিষ্টও থাকে, তখনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে, যেমন একটি নির্দিষ্ট দিনে, চালু অর্থের পরিমাণ এবং পণ্যের পরিমাণ-এই দুয়ের মধ্যে আর কোনো সঙ্গতি থাকে না। যে-সমস্ত পণ্যকে অনেক আগেই বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে, সেই সব পণ্যের প্রতিনিধিত্ব করে যে-অর্থ, সেই অর্থ কিন্তু চালু থেকে যায়। এমন সব পণ্যও আবার চালু থেকে যায়, যাদের সমার্থরূপ যে অর্থ, একটি ভবিষ্যৎ দিবসের আগে তার দেখা পাওয়া যাবে না। অধিকন্তু, প্রতিদিন যে সমস্ত দেনা-পাওনার চুক্তি হচ্ছে, এবং একই দিনে যে-সমস্ত দেনা-পাওনার শোধবোধের তারিখ পড়েছে—এই দুটি রাশি সম্পূর্ণ অমেয়।[১৫]

প্রদানের উপায় হিসেবে অর্থের যে, ভূমিকা, তা থেকেই ক্রেডিট-অর্থের উদ্ভব ঘটে। ক্রীত পণ্যের জন্য পরিশোধ্য ঋণের ‘সার্টিফিকেট’গুলি অন্যান্যের কঁাধে স্থানান্তরিত হবার জন্য চালু থাকে। পক্ষান্তরে, যে-মাত্রায় ক্রেডিট-প্রথার বিস্তার ঘটে, সেই মাত্রাতেই প্রদানের উপায় হিসেবে অর্থের ভূমিকারও বিস্তার ঘটে। এই চরিত্র অভিনয় কালে অর্থ নানা স্ব-বিশিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে, যে সব রূপে বিরাট বিরাট বাণিত্ত্বিক লেনদেন তা অনায়াসে ভূমিকা নেয়। অন্যদিকে, সোনা ও রূপার মুদ্রাকে প্রধানতঃ ঠেলে দেওয়া হয় খুচরো ব্যবসার গণ্ডীতে।[১৬]

যখন পণ্যোৎপাদন যথেষ্ট ভাবে বিস্তার লাভ করেছে, তখন পণ্য সঞ্চনের। পরিধির বাইরেও অর্থ প্রদানের উপায় হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। অর্থ তখন হয়ে ওঠে, সমস্ত চুক্তির যে বিশ্বজনিক বিষয়বস্তু, সেই বিষয়বস্তুটিতে, সেই পণ্যটিতে।[১৭] খাজনা, কর এবং এই ধরনের অন্যান্য সব প্রদান, দ্রব্য-রূপে প্রদান থেকে, রূপান্তরিত হয় অর্থ-রূপে প্রদানে। এই রূপান্তর কী পরিমাণে উৎপাদনের সাধারণ অবস্থাবলীর উপরে নির্ভর করে, তা বোঝা যায় যখন আমরা এই ঘটনাটির কথা স্মরণ করি যে নোম সাম্রাজ্য তার সমস্ত খাজনা, কর ইত্যাদি অর্থের অঙ্কে আদায় করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল। চতুর্দশ লুইয়ের আমলে ফরাসী দেশের কৃষিজীবী জনগণ যে অবর্ণনীয় দুর্দশার কবলে পড়েছিল—যে দুর্দশাকে বয়িস গিলবার্ট; মার্শাল ভবা প্রমুখ এত সোস্টারে নিন্দা করেছিলেন—সে দুর্দশার কারণ কেবল করের গুরুভারই নয়, সেই সঙ্গে তার কারণ ছিল দ্রব্যের অঙ্কে কর দানের ব্যবস্থাকে অর্থের অঙ্কে দেবার ব্যবস্থায় রূপান্তরণও।[১৮] অন্যদিকে রাশিয়ায় রাষ্ট্রের কর ইত্যাদি দিতে হত দ্রব্যের আকারে খাজনার মাধ্যমে—এই যে ঘটনা তা নির্ভর করত উৎপাদনের এমন সমস্ত অবস্থার উপরে যা প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর নিয়মিকতার সঙ্গে ওতপ্রতভাবে সংঘটিত হত। আর এই প্রদান পদ্ধতির দরুণই প্রাচীন উৎপাদন-পদ্ধতি সেখানে টিকে থেকে যায়। অটোম্যান সাম্রাজ্যের দীর্ঘস্থায়িত্বের গোপন কারণগুলির মধ্যে এটা একটি। ইউরোপীয়রা জাপানের উপরে যে বৈদেশিক বাণিজ্য চাপিয়ে দিয়েছিল, তা যদি দ্রব্যের আকারে দেয় খাজনার বদলে অর্থের আকারে দেয় খাজনার প্রবর্তন ঘটাত, তা হলে সেখানকার দৃষ্টান্ত স্থানীয় কৃষিকার্যের অন্তিম কাল ঘনিয়ে আনত। যে-সংকীর্ণ অর্থনৈতিক অবস্থাবলীর মধ্যে সেই কৃষিকর্ম পরিচালিত হয়, তা ভেসে যেত।

প্রত্যেক দেশেই, বছরের কয়েকটি নির্দিষ্ট দিন অভ্যাসৰশে বড় বড় এবং পৌনঃ পুনিক দেনাপাওনা শোধবোধের দিন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। পুনরুৎপাদনের চক্রটিতে অন্যান্য যেসব আবর্তন ঘটে, সেই সব আবর্তন ছাড়াও, এই তারিখগুলি প্রধানতঃ ভাবে নির্ভর করে ঋতু পরিবর্তনের সময়গুলির উপরে। কর, খাজনা ইত্যাদির মতো যেসব প্রদানের পণ্য সঞ্চলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোনো সম্বন্ধ নেই, সেই সব প্রদানও নিয়মিত হয় এইসব ঋতুপরিবর্তনের সময়গুলির দ্বারা। সারা দেশ জুড়ে ঐ দিনগুলিতে যাবতীয় লেনদেনের শোধবধ করতে যে-পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয় তার ফলে প্রদানের মাধ্যমটির ব্যবহার-পরিমিতি ক্ষেত্রে ঋতুক্রমিক ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়, যদিও তা ভাসা-ভাসা।[১৯]

প্রদানের উপায়টির প্রচলন-বেগের নিয়মটি থেকে আমরা পাই যে, নির্দিষ্ট সময় কাল অন্তর অন্তর যে-সব প্রদান সম্পন্ন করতে হয় তা তার কারণ যা-ই হোক না কেন-(বিপরীতে)[২০] তার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন পড়ে, সেই পরিমাণটি সংশ্লিষ্ট সময়কালে দৈর্ঘ্যের সঙ্গে অনুপাতে সম্পর্কিত।[২১]

প্রদানের উপায় হিসেবে অর্থের পরিণতি লাভের ফলে প্রয়োজন হয় প্রদানের দিনগুলির জন্য অর্থ সঞ্চয় করে বৃখিবার। সভ্য সমাজের অগ্রগতি সঙ্গে সঙ্গে যখন বিত্ত অর্জনের স্বতন্ত্র পদ্ধতি হিসেবে মওজুদীকরণের তিরোধান ঘটে, তখন কিন্তু জমানো অর্থের তহবিল (রিজার্ভ) গড়ে তোেল’র প্রবণতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।

. বিশ্বজনিক অর্থ

অর্থ যখন সঞ্চলনের স্বদেশগত সীমানা অতিক্রম করে, সে তখন তার পরিহিত দাম-মান, মুদ্রা প্রতীক, মূল্য-প্রতিভূ ইত্যাদির স্বদেশী পোশাক-আশাক পরিত্যাগ করে এবং তার আদিরূপে-ধাতুপিণ্ডরূপে-প্রত্যাবর্তন করে। বিশ্বের বিভিন্ন বাজারের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের, পণ্যদ্রব্যাদির মূল্য এমন ভাবে অভিব্যক্ত হয়, যাতে করে তা বিশ্বজনীন স্বীকৃতি পায়। সুতরাং, এই সব ক্ষেত্রে তাদের স্বতন্ত্র মূল্যরূপও বিশ্বজনীন অর্থের আকারে তাদের মুখোমুখি হয়। কেবল বিশ্বের বাজারগুলিতেই অর্থ পূর্ণ মাত্রায় সেই পণ্যটির রূপধারণ করে, যার দেহগত রূপ অমূর্ত মনুষ্যশ্রমের প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক প্রমূর্তরূপ হিসেবে দেখা দেয়। এই আকারে তার বস্তুগত অস্তিত্ব ধারণের পদ্ধতিটি উপযুক্তভাবে তার ভাগবত ধারণাটির সঙ্গে সঙ্গতি লাভ করে।

স্বদেশের সঞ্চলন পরিধির মধ্যে, এমন একটি মাত্র পণ্যই থাকতে পারে, যা মূল্যের পরিমাপ হিসেবে কাজ করে, অর্থ হয়ে ওঠে। বিশ্বের বাজারে কিন্তু মূল্যের দ্বৈত মান গোচরে আসে—স্বর্ণ ও রৌপ্য।[২২]

বিশ্বের অর্থ কাজ করে প্রদানের বিশ্বজনীন মাধ্যম হিসেবে, ক্রয়ের বিশ্বজনীন উপায় হিসেবে এবং সমস্ত ধন-সম্পদের বিশ্বস্বীকৃত মূর্ত বিগ্রহ হিসাবে। এই জন্যই বাণিজ্য-বাদীদের মন্ত্র হয়ে ওঠে বাণিজ্যের ভারসাম্য (Balance of Trade)[২৩] যে-সব সময়ে বিভিন্ন জাতির উৎপন্ন দ্রব্যাদি আদান-প্রদানে প্রথাগত ভারসাম্য হঠাৎ ব্যাহত হয়, প্রধানতঃ ও আবশ্যিক ভাবে সে-সব সময়ে সোনা ও রূপা কাজ করে ক্রয়ের আন্তর্জাতিক উপায় হিসেবে। এবং সর্বশেষে, যখনি প্রশ্নটি দেখা দেয় ক্রয়ের ও বিক্রয়ের প্রশ্ন হিসেবে নয়, দেখা দেয় এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরণের প্রশ্ন হিসেবে এবং যখনি ঘটনাচক্রে অথবা উদ্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রয়োজনবশে পণ্যের আকারে স্থানান্তরণ হয়ে পড়ে অসম্ভব, তখনি বিশ্বের অর্থ কাজ করে সামাজিক ধনের বিশ্বস্বীকৃত বিগ্রহ হিসেবে।[২৪]

যেমন অভ্যন্তরীণ সঞ্চলনের জন্য প্রত্যেক দেশেই অর্থের জমানো তহবিল ( ‘বিজার্ভ) থাকা আবশ্যক, ঠিক তেমনি দেশের বাইরেকার বাজারে সঞ্চলনের জন্যও তার থাকা আবশ্যক একটি ‘রিজার্ভ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে অভ্যন্তরীণ সঞ্চলন ও দেনা-পাওনা নিরসনের মাধ্যম হিসেবে অর্থের যে ভূমিকা, অংশত সেই ভূমিকাটি থেকে, এবং বিশ্বের অর্থ হিসেবে অর্থের যে ভূমিকা, অংশত সেই ভূমিকাটি থেকেই মওজুদের ভূমিকার উদ্ভব।[২৫] দ্বিতীয়োক্ত ভূমিকাটির জন্য, সত্যকার অর্থ-পণ্য-সোনা ও রূপা-আবশ্যক। তাদের কি শুদ্ধ আঞ্চলিক রূপ থেকে তাদেরকে আলাদাভাবে বিশেষিত করার জন্য স্যার জেমস স্টুয়ার্ট সোনা ও রূপাকে নামকরণ; করেছেন বিশ্বের অর্থ” বলে।

সোনা ও রূপার স্রোতটি দ্বিমুখী। একদিকে, বিভিন্ন মাত্রায় সঞ্চলনের বিভিন্ন জাতীয় ক্ষেত্রগুলিতে আত্মভূত হবার উদ্দেশ্য, প্রচলনের নলগুলিকে ভরাট করবার উদ্দেশ্যে, ঘষা ও ক্ষয়ে-যাওয়া সোনা ও রূপার স্থান গ্রহণের উদ্দেশ্যে, বিলাস দ্রব্যটির উপাদান সরবরাহের উদ্দেশ্যে এবং মওজুদ হিসেবে শিলীভূত হবার উদ্দেশ্য তা তার উৎসমূহ থেকে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে।[২৬] এই প্রথম স্রোতটি শুরু হয় সেই দেশগুলি থেকে, যারা পণ্যসম্ভারে বাস্তবায়িত তাদের শ্রমকে বিনিময় করে সোনা ও রূপা উৎপাদনকারী দেশগুলির মাহার্ষ ধাতুসমূহে মূতিপ্রাপ্ত শ্রমের সঙ্গে। অন্যদিকে, সঞ্চলনের বিভিন্ন জাতীয় ক্ষেত্রফলগুলির মধ্যে, সামনের দিকে এবং পেছনের দিকে, নিরন্তর চলতে থাকে সোনা ও রূপার প্রবাহ-এমন একটা স্রোত যার গতি নিভর করে বিনিময়ের ঘটনাক্রমে অবিরাম ওঠা-নামার উপরে।[২৭]

যেসব দেশে বুর্জোয়া উৎপাদন-পদ্ধতি কিছু পরিমাণে বিকাশ লাভ করে, সে-সব দেশ, বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য তাদের ব্যাংকগুলি ‘স্ট্রং-রুমে যে মওজুদ কেন্দ্রীভূত করে রাখে, তার পরিমাণ নূ্যনতম সীমায় বেঁধে রাখে।[২৮] যখনি এই মওজুদের পরিমাণ গড় মাত্রার বেশী উপরে উঠে যায়, তখনি অবশ্য, কয়েকটি বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে, বোঝা যায় যে পণ্যের সঞ্চলনে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে, তাদের রূপান্তরণের সাবলীল ধারায় বাধা সৃষ্টি হয়েছে।[২৯]

————

১. “Une richesse en argent n’est que……… richesse en produc tions, converties en argent” ( Mercier de la Riviere 1.c.) Une valeur en productions n’a fait que changer de former ( 1d., p. 486 )

২. “এই পদ্ধতির দ্বারাই তারা তাদের সমস্ত জিনিস ও শিল্পজাত দ্রব্যের এত নিচু হার বজায় রাখে।”–(Vanderlint lc. পৃঃ ৯৫, ৯৬)।

৩. অর্থ … একটি অঙ্গীকার” (John Bellers : *Essays about the poor, Manufactures, Trade, plantations, and Immorality- Lond:, 1699 পৃঃ ১৩)।

৪. “যথার্থ”-বিচারে ক্রয় মানে এই যে সোনা এবং রূপা ইতিমধ্যেই পণ্য দ্রব্যাদির পরিবর্তিত রূপ পরিগ্রহ করেছে, কিংবা তা পরিণত হয়েছে বিক্রয়ের ফলশ্রুতিতে।

৫. ফ্রান্সের খ্ৰীষ্টীয় রাজা তৃতীয় হেনরি গীর্জাগুলি থেকে প্রত্ন দ্রব্যাদি লুণ্ঠন করে সেগুলিকে অর্থে রূপান্তরিত করেন। ফোসিয়ানদের দ্বারা ডেলফিক টেম্পল লুণ্ঠন গ্রীসের ইতিহাসে কী ভূমিকা নিয়েছিল তা সুপরিজ্ঞাত। প্রাচীনদের কাছে মন্দিরগুলি ছিল পণ্য দেবতাদের বাসস্থান। সেগুলি ছিল পবিত্র ব্যাংক। ফিনীসীয়দের চোখে অর্থ ছিল সব কিছুর মুর্তায়িত রূপ। সুতরাং এতে অস্বাভাবিক কিছুই ছিল না যে প্রেমের দেবী’র মহোৎসবে কুমারী মেয়েরা যখন আগন্তুকদের কাছে দেহ সমর্পণ করত তখন তার বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ তারা দেবীকে দক্ষিণ দিত।

৬. “সোনা, হলুদ চকচকে মহামূল্য সোনা!
তার এতটা কালোকে সাদা করে; মন্দকে ভালো;
অন্যায়কে ন্যায়; হীনকে মহান; বৃদ্ধকে তরুণ; ভীরুকে বীর।
… দেবতার, এটা কি, এটা কেন
যা পুরোহিত ও দাসদের তোমাদের পাশ থেকে টেনে নেয়;
শক্ত মানুষের বালিশ তার মাথার তলা থেকে কেড়ে নেয়।
এই হলদে গোলাম
 ধর্মকে গড়ে এবং ভাঙে; ঘৃণাকে করে বরেণ্য
পলিত কুষ্ঠকে করে তোলে ইষ্ট; তস্করকে দেয় আসন।
দেয় উপাধি অবলম্বন ও মান্যতা,
 দেয় প্রতীক্ষমান পরিষদবর্গ; এই সোনা
উদভ্রান্ত বিধবাকে করে বিবাহে উদ্বুদ্ধ :
 …এসো হে অভিশপ্ত বসুধা,
যদিও নিখিল মানুষের বারবনিতা।

( শেকশিয়র, টাইমন অব এথেন্স)

৭. ‘শেষ ভোজ’-এ যীশু খ্ৰীষ্ট কর্তৃক ব্যবহৃত এবং পরবর্তীকালে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর রক্ত ধারণের জন্য ব্যবহৃত পাত্র বাংলা অনুবাদক।

৮. “Accrescere quanto piu si puo il numero de’ venditori d’ogni: merce, diminuere quanto piu si puo il numero dei compratori questi sono i cardini sui quali is raggiran, tutte le operazioni di economia politica.–(Verri 1.c. p. 52)

৯. “কোন দেশের বাণিজ্য পরিচালনার জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়; ঘটনাবলীর দাবি অনুসারে তা কখনো বৃদ্ধি পায়, কখনো হ্রাস পায়। ……….অর্থের এই জোয়ার-ভাটা রাষ্ট্রনীতিকদের সাহায্য ছাড়াই নিজেকে ব্যবস্থিত করে নেয়। অর্থ যখন কম পড়ে, তখন ধাতুপিণ্ড মুদ্রায়িত হয় আর যখন তা বেশি হয়ে পড়ে, তখন মুদ্রা বিগলিত হয়ে ধাতুপিণ্ড হয়। ( ডি. নর্থ, ‘পোস্টস্ক্রিপ্ট’, পৃ: ৩)। জন স্টুয়ার্ট মিল, যিনি দীর্ঘকাল ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন, জানান যে ভারতবর্ষে রূপার অলংকারাদি এখনো মওজুদ হিসাবে কাজ করে। যখন সুদের হার বেশি হয়, তখন রূপার অলংকারাদি বের করে আনা হয় এবং মুদ্রায়িত করা হয়; আবার যখন সুদের হার কমে যায়, তখন তা আবার যথাস্থানে ফিরে যায়। (জে এস মিল-এর সাক্ষ্য, ‘রিপোর্টস অন ব্যাংক অ্যাক্টস, ১৮৫৭, ২০৮৪)। ভারতের সোনা ও রূপার আমদানি-রপ্তানি সম্পর্কে ১৮৬৪ সালের একটি পার্লামেন্ট বিপোর্ট অনুসারে ১৮৬৩ সালে সোনা ও রূপার আমদানি রপ্তানির তুলনায় ১,৯৩,৭৬৪ বেশি ছিল। ১৮৬৪ সালের ঠিক আগেকার আট বছরে মূল্যবান ধাতুগুলির রপ্তানির তুলনায় আমদানির পরিমাণ বাড়িয়ে ছিল ৫১,৯৬,৫২,৯১৭ বেশি। এই শতাব্দীতে ২০,০০,০০,০০ পাউণ্ডের বেশি ভারতে মুদ্রায়িত হয়েছে।

১০. ১৮ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজ বণিকদের মধ্যে যে দেনাদার-পানা দার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল তার পরিচয় এখানে (এই বইতে) দেখা যাবে। এখানে এই ইংল্যাণ্ডে বাণিজ্যে নিযুক্ত লোকদের মধ্যে এমন একটা নিষ্ঠুরতার মনোভাব বিরাজ করে যা অন্য কোনো লোক-সমাজে বা জগতের অন্ত কোনো রাজ্যে দেখা যাবে না।” (“An Essay on Credit and the Bankrupt Act, Lond. 1707, p. 2.)

১১. ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত আমার বইটির নিমোত অনুচ্ছেদটি থেকে দেখা যাবে কেন আমি মূল অংশে একটি বিপরীত রূপের উল্লেখ করিনি: বিপরীত ভাবে, অপ প্রক্রিয়াটিতে ক্রয়ের একটি বাস্তব উপায় হিসাবে অর্থকে পরকীকৃত করা যায়, এবং এই ভাবে উক্ত অর্থের ব্যবহার মূল্যটি বাস্তবায়িত হবার আগেই এবং পণ্যটি সত্য সত্যই হস্তান্তরিত করার আগেই উক্ত পণ্যের দামটি বাস্তবায়িত করা যায়। আগামি দাম দেবার দৈনন্দিন রীতি অনুসারে এটা নিরন্তর ঘটে। এই রীতি অনুসারেই ইংরেজ সরকার ভারতের রায়তদের কাছ থেকে আফিম ক্রয় করে। এ সকল ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ অর্থ সর্বদাই ক্রয়ের উপকরণ হিসাবে কাজ করে। অবশ্য, মূলধনও আগাম দেওয়া হয় অর্থের আকারে। যাই হোক, এই বিষয়টি সরল সঙ্কলনের নিশ্বলয়ের মধ্যে পড়ে না। Zur Kritik & c.”, pp. 119.120.

১২. উল্লিখিত অর্থগত সংকট সব সংকটেরই একটি পর্যায় কিন্তু অর্থগত সংকট বলেই কথিত অন্য এক সংকট থেকে তার পার্থক্য করতে হবে, যা নিজেই একটি। স্বতন্ত্র সংকট হিসেবে ঘটতে পারে—ঘটতে পারে এমন ভাবে যাতে শিল্প বাণিজ্যের উপরে কেবল পরোক্ষ প্রভাবই পড়ে। এই ধরনের সংকটের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে অর্থরূপী মূলধন আর সেই কারণেই তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় মূলধনের ক্ষেত্রে, যেমন, আমানত, শেয়ার বাজার ও অর্থ।

১৩. ক্রেডিট-ব্যবস্থা থেকে নগদ টাকার ব্যবস্থায় আকস্মিক প্রত্যাবর্তন বাস্তব আতংকের উপরে তত্ত্বগত আশংকা চাপিয়ে দেয়; এবং যেসব কারবারীর মাধ্যমে সঞ্চলন ব্যাহত হয়, তারা, তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পর্কসমূহ যার মধ্যে বিধৃত, সেই দুর্ভেদ্য রহস্যের সামনে কঁপতে থাকে। এ কার্ল মার্কস,,c. পৃ: 126)। গরিবেরা থমকে দাড়ায়, কেননা ধনীদের তাদের নিয়োগ করার মত অর্থ নেই, যদিও তাদের খাদ্য-বস্ত্রের সংস্থান করার মত জমি ও হাত আগেও যেমন ছিল, এখনো তেমন আছে যে-জমি ও হাতই হল জাতির আসল ধনসম্পদ, অর্থ নয়। (জন বেলার্স : *Proposals for Raising a College of Industry”, London 1696, p. 3.)

১৪. নিচেকার নমুনাটি থেকে বোঝা যাবে কিভাবে “amis du commerce এই ধরনের সময়ের সুযোগ গ্রহণ করে। একবার (১৮৩৯) একজন বৃদ্ধ ব্যাংকার ( শহরে ) তার নিজের ব্যক্তিগত কক্ষে যে-ডেঙ্কটির উপরে বসে ছিল তার ঢাকনাটা তুলল এবং তার বন্ধুকে দেখালো তাড়া তাড়া ব্যাংক-নোট এবং বলল, মোট ৫৬,০০,০০০ পাউণ্ড রয়েছে, এই নোটগুলিকে ধরে রাখা হয়েছে টাকার বাজারকে ‘টাইট করার জন্য এবং ঐ দিনই বেলা ৩টা সময় ওগুলিকে ছাড়া হবে। (“The Theory of Exchanges. The Bank Charter Act of 1844” London, 1864, p. 81,) অবজার্ভার নামে একটি আধা-সরকারি মুখপত্রের ২৪শে এপ্রিল ১৮৬৪ তারিখের সংখ্যায় এই অনুচ্ছেদটি প্রকাশিত হয় : “ব্যাংক-নোটর দুষ্প্রাপ্যতা সৃষ্টি করার জন্য যে সব উপায় অবলম্বন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে নানাবিধ কৌতুহলকর জনরব শোনা যাচ্ছে। এই ধরনের কোনো কৌশল গ্রহণ করা হবে সেটা ধরে নেওয়া যদিও প্রশ্নসাপেক্ষ তা হলেও এই রিপোর্টটা এত সর্বজনীন যে তা উল্লেখ করা আবশ্যক।

১৫. কোন একটি নির্দিষ্ট দিনে সম্পাদিত বিক্রয় বা চুক্তির পরিমাণ ঐ বিশেষ দিনটিতে চালু অর্থের পরিমাণটিকে প্রভাবিত করে না, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই চুক্তিগুলি নিজেদেরকে পর্যবসিত করে পরবর্তী বিভিন্ন কাছের বা দূরের তারিখে যে-পরিমাণ অর্থ চালু হতে পারে, তার উপর বহুবিধ দাবি ড্রাফট হিসাবে। আজ যে সব ‘বিল’ মঞ্জুর বা ক্রেডিট’ খোলা হল, আগামীকাল বা পরত যেসব ‘বিল’ বা ক্রেডিট’ মঞ্জুর বা ভোলা হবে, সেগুলির সঙ্গে সে-সবের কোন সাদৃশ্য থাকার দরকার পড়ে নানা পরিমাণের দিক থেকে, না স্থিতিকালের দিক থেকে; এমনকি আজকের অনেক ‘বিল’ ও ‘ক্রেডিট’ যখন ‘দেয়’ (ডিউ’) হবে তখন সেগুলি এমন এক গাদা ‘দায়’-এর ( ‘লায়াবিলিটি’-র) সঙ্গে একত্রে পড়বে, যেগুলির সূচনা ১২, ৬, ৩ বা ১ মাস আগেকার বিভিন্ন সম্পূর্ণ অনির্দিষ্ট তারিখ জুড়ে রয়েছে-যেগুলি এক সঙ্গে পরিণত হবে কোনো একটি বিশেষ দিনের মোট দায়ে।” (The curr ency Theory Reviewed p-139 in a letter to the scottish people. by a Bankers in England 139 Edinburgh 1845 pp. 29, 30 passim. )

১৬. সত্যকার বাণিজ্যিক কারবারে কার্যত কত কম টাকার দরকার হয় তা বোঝাবার জন্য আমি লণ্ডনের একটি বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক আয় ব্যয়ের হিসেব এখানে তুলে দিচ্ছি : ১৮৫৬ সালের হিসেব : আয় ব্যয় বহু মিলিয়ন পাউণ্ড স্টার্লিং এ ঘটেছিল।

১৭. দ্রব্যের বদলে দ্রব্য বিনিময়ের জায়গায় ক্রয়-বিক্রয় চালু হওয়ায় এখন দাম প্রকাশ করা হয় অর্থের অঙ্কে’—(An Essay up on Public Credit: 3rd. Edn. Lond. 1110 p. ৪)।

১৮. “L’argent…est devenu le bourreau de toutes choses.” Finance is the “alambic, qui a fait evaporer une quantite efforyable de biens et de denrees pour faire ce fatal precis.”L’argent declare la guerre a tout le genre humain.” (Boisguillebert : “Dissertation sur la nature des richesses, de l’argent et des tributs.” Edit Daire Economistes financiers, Paris, 1843, t. i. pp. 413, 417, 419, )

১৯. ১৮২৪ সালে হুইটসুনটাইড’ উপলক্ষে এডিনবার ব্যাংকগুলোর উপরে নোটের জন্য এমন চাপ পড়ল যে বেলা ১১টার মধ্যে ব্যাংকের সমস্ত নোট নিঃশেষ হয়ে গেল। তারা তখন বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে লোক পাঠালোনোট ধার দেবার জন্য কিন্তু ধার পেল না এবং এনেক ক্ষেত্রেই দেনা-পাওনা মেটানো হল কেবল কাগজের ‘পি’-এর সাহায্যে। কিন্তু বেলা ৩টা বাজতে না বাজতেই দেখা গেল যে যে ব্যাংক থেকে সেগুলি ‘ইস্যু করা হয়েছিল, সব নোটগুলোই আবার সেই ব্যাংকগুলিতেই ফেরৎ চলে এসেছে ! এটা ছিল কেবল হাত থেকে হাতে স্থানান্তর। যদিও অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাংক-নোটর গড় কার্যকর সঞ্চলন ৩০ লক্ষ স্টার্লিং-এর কম ছিল, তবু বছরের কয়েকটি বিশেষ বিশেষ লেনদেনের দিনে, ব্যাংকারদের অধিকারাধীন প্রায় £ ৭০,০০,০০০ পাউণ্ডের প্রত্যেকটি নোটকে ক্রিয়াশীল করতে হয়। এই দিনগুলিতে এই সব নোটের একটিমাত্র নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করতে হয় এবং যখনি সেই কাজটি হয়ে যায়, তখনি সেগুলি, যেসব ব্যাংক তাদের ইস্যু করেছিল, সেই সব ব্যাংকেই আবার ফিরে যায়। (জন ফুলটন, Regulation of Currencies, Lond. 1845, p. 46.) ব্যাখ্যার জন্য এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ফুলার্টনের কার্য কালে স্কটল্যাণ্ডে আমানত তোলার জন্য চেকের পরিবর্তে নোট হত।

২০. আপাতদৃষ্টিতে এটা একটা ভুল। যখন লেখা হয়েছে বিপরীত’, লেখক তখন বুঝিয়েছেন সরাসরি’-রাশিয়ান সংস্করণের টাকা ইনষ্টিটিউট অব মার্ক্সিজম লেনিনিজম।

২১. “যদি বার্ষিক s০ মিলিয়ন তুলবার মত উপলক্ষ্য দেখা দিত, তা হলে ঐ একই .৬ মিলিয়ন (সোনা): বাণিজ্যের প্রয়োজনমত এই প্রকারের আবর্তন ও সঞ্চলনের পক্ষে যথেষ্ট হত কিনা”—এই প্রশ্নের উত্তরে পেটি তার স্বাভাবসিদ্ধ কর্তৃত্বের ভঙ্গিতে রলেন “আমার জবাব, হ্যা, কারণ ব্যয়ের পরিমাণ ৪০ মিলিয়ন থাকলে, যদি এই পরির্তনগুলি হয় সাপ্তাহিক আবর্তনের মত স্বল্পকালীন-গরিব কারিগর ও মজুরদের বেলায়, যারা মজুরি প্রায় প্রতি শনিবার, তাদের বেলায় যা হয়ে থাকে—তা হলে ১ মিলিয়ন অর্থের ৪ ভাগ এই প্রয়োজন মেটাবে, কিন্তু আমাদের খাজনা ও কর দেবার প্রথা অনুযায়ী আই আবর্তন গুলি যদি হয় ত্রৈমাসিক, তা হলে লাগবে ১০ মিলিয়ন। অতএব, যদি ধরে নেওয়া যায় মজুরি-বেতন প্রভৃতি সাপ্তাহিক থেকে ত্রৈমাসিক নানান ভিত্তিতে দেওয়া হয়, তা হলে ২ ভাগের সঙ্গে যোগ করুন ১০ মিলিয়ন, যার অর্ধেক দাঁড়াবে ৫১, যার ফলে আমাদের হাতে যদি থাকে ৫১ মিলিয়ন, তা হলেই যথেষ্ট।” (Wiliam Petty, Political Anatomy of Ireland. 1672 Edit. London 1691, pp. 13, 14.

২২. কোন দেশের ব্যাংকগুলি কেবল সেই মূল্যবান ধাতুটিবই ‘রিজার্ভ’ গঠন করবে, যে ধাতুটি দেশের অভ্যন্তরে চালু থাকে—যে নিয়মটি এই ব্যবস্থার বিধান দেয়, সেই নিয়মটি এই কারণেই অবাস্তব। ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড’ এই ভাবে যেসব স্বয়ংসৃষ্ট ‘মনোরম সমস্যাবলী’ উদ্ভব ঘটিয়েছিল, তা সুপরিজ্ঞাত। সোনা ও রূপার আপেক্ষিক মূল্যে হ্রাস-বৃদ্ধির ইতিহাসে বড় বড় পর্বগুলির জন্য দেখুন কার্ল মার্কস Zur Kritik, p. 136। রবার্ট স্যার পীল তার ১৮৪৪ ব্যাঙ্ক সালের আইনটির সাহায্যে এই সমস্যাটি অতিক্রম করতে চেষ্টা করেছিলেন। রূপার রিজাভ সোনার রিজাতের এক-চতুর্থাংশের বেশি হবে না-এই শর্চে তিনি ব্যাংক অব ইংল্যাকে রূপার পিণ্ডের পালটা নোট ইস্যু করার অনুমতি দিয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে রূপার মূল্য ধরা হয়েছিল লণ্ডনের বাজারে তার তৎকালীন দাম অনুসারে। [ চতুর্থ জার্মান সংস্করণে সংযোজিত-সোনা ও রূপার আপেক্ষিক মূল্যে গুরুত্বপুর্ণ পরিবর্তনের একটি সময়কালে আবার আমরা আমাদের দেখতে পাচ্ছি, প্রায় ২৫ বছর আগে সোনা ও রূপার আপেক্ষিক মূল্যের পরিচায়ক অনুপাতটি ছিল ১৫: ১; এখন তা প্রায় ২২: ১, এবং এখনো সোনার তুলনায় রূপা কমে যাচ্ছে। এটা মূলতঃ ঘটেছে দুটি ধাতুরই উৎপাদনের পদ্ধতি বিপ্লবের ফলে। আগে সোনা সংগ্রহ করা হত প্রায় একান্ত ভাবেই স্বর্ণবাহী পলি-সঞ্চয় ধৌত করে, যা ছিল স্বর্ণ-শিলা থেকে উৎপন্ন। এখন এই পদ্ধতিটি অনুপযুক্ত হয়ে পড়ায় পিছিয়ে পড়েছে এবং তার বদলে সামনে এসেছে ‘কোয়াৎ লোভ-প্রসেসিং পদ্ধতি, যে পদ্ধতিটি প্রাচীন কাল থেকে জানা থাকলেও, এত দিন ছিল গৌণ। (Diodorus, III, 12-14) [Diodor’s v. Sicilien ‘Historische Bibliothek”, book III 12-14, Stuttgart 1828, pp, 258-261 ] তা ছাড়া, রকি মাউন্টে’-এর পশ্চিমাংশে কেবল বিপুল পরিমাণ রৌপ্য-সঞ্চয় আবিষ্কার হয়নি এইগুলিতে এবং সেই সঙ্গে মেক্সিকোর রূপার খনিগুলিতে রেললাইন পেতে তা সংগ্রহের কাজও শুরু করে দেওয়া হয়েছিল; রেল-লাইন পাতার ফলে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও জ্বালানি বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হওয়ায় অল্প খরচে বেশি রূপা খুড়ে তোলা গিয়েছিল। অবশ্য স্বর্ণ-শিরায় (কোয়াৎস লোভস’-এ) যেভাবে সোনা ও রূপা দুটি ধাতু থাকে, তাতে পার্থক্য আছে। সোনাটা স্বাভাবিক ভাবেই বর্তমান, কিন্তু গোটা শিরাটা জুড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা হিসাবে ছড়িয়ে থাকে। সুতরাং, গোটা শিরাটাকে চূর্ণ করে তাকে ধৌত করে সোনাটা বার করতে হয় অথবা পারদের সাহায্যে তা নিষ্কর্ষিত করতে হয়। প্রায়ই ১০,…০০ গ্রাম আকর থেকে ১-৩ বা কদাচিৎ ৩০-৬০ গ্রাম সোনা পাওয়া যায়। রূপা খুবই বিরল, যাই হোক, বিশেষ বিশেষ আকর-পিণ্ডে তা পাওয়া যায়, তারপরে সেই আকরকে শিরা থেকে অপেক্ষাকৃত সহজেই আলাদা করে ৪০-৯০ শতাংশ রূপা পাওয়া যায়; কিংবা তামা, সীসা ও অন্যান্য আকরের সঙ্গেও কণা-কণা রূপা পাওয়া যায়। এ থেকে বোঝা যায় যে, সোনার বাদে ব্যয়িত শ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্য দিকে রূপার বাবক ব্যয়িত এম হ্রাস পাচ্ছে এবং এরই ফলে রূপার দাম কমে যাচ্ছে। এই দাম আরো কমে যেত যদি না কৃত্রিম উপায়ে তা বেঁধে রাখা না হত। কিন্তু আমেরিকার বিপুল রৌপ্য-সম্পদ এখনো খুব সামান্যই আহরণ করা হয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতে দীর্ঘকাল ধরে রূপার দাম যে আরো কমতে থাকবে তা বোঝা যায়। এই দাম পড়ে যাবার আরেকটা কারণ এই যে, ‘প্লেটিং’-করা জিনিস-পত্র, অ্যালুমিনিয়ম ইত্যাদি রূপার স্থান গ্রহণ করায় সাধারণ ব্যবহার ও বিলাসের দ্রব্যসামগ্রর জন্য রূপা চাহিদা কমে গিয়েছে। বাধ্যতামূলক ভাবে অন্তর্জাতিক দাম বেঁধে দিলেই সোনা ও রূপার মধ্যেকার পুরনো মূল্য-অনুপাত (১: ১৫) ফিরিয়ে আনা যাবে—এই দ্বি-ধাতুবাদী ধারণা যে কত অসার এ থেকেই তা বোঝা যায়। বরং এটাই বেশি সম্ভব যে রূপা বিশ্বের বাজারে তার অর্থ হিসাবে কাজ করার ভূমিকা ক্রমে ক্রমে হারিয়ে ফেলবে।-এফ. ই.

২৩. বাণিজ্যবাদী ব্যবস্থার বিবেচনায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লক্ষ্য হচ্ছে সোনা ও রূপার সাহায্যে দেনা-পাওনার গরমিলের শোধবোধ, এই ব্যবস্থার প্রতিবাদীরা নিজেরা কিন্তু বিশ্বজনিক অর্থের কার্যাবলী সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা পোষণ করতেন। রিকার্ডোর দৃষ্টান্ত দিয়ে আমি দেখিয়েছি সঞ্চলনী মাধ্যমের পরিমাণ কি কি নিয়মের দ্বারা নিয়মিত হয় সেই সম্পর্কে তাদের ভ্রান্ত ধারণা মহার্ঘ ধাতুসমূহে আন্তর্জাতিক চলাচল সম্পর্কিত ধারণার মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। (.c. pp. 150 sq.) “বাড়তি মুদ্রা-সরবরাহ ছাড়া বাণিজ্যিক ভারসাম্য প্রতিকূল হয় না। মুদ্রার রপ্তানির কারণ তার মূল্য হ্রাস এবং এই রপ্তানি প্রতিকূল ভারসাম্যের ফল নয়, কারণ—তার এই ভ্রান্ত ধারণা বান-এর লেখায় আগেই দেখা যায়। বাণিজ্যিক ভারসাম্য বলে যদি কিছু থাকে, তা হলে তা দেশ থেকে অর্থ বাইরে পাঠিয়ে দেবার কারণ নয়; পরন্তু তা উদ্ভূত হয় প্রত্যেক দেশে ধাতু পিণ্ডের (সোনা বা রূপার মূল্যের পার্থক্য থেকে।” (N. Barbon, lc. pp. 59, 60 )। “The Literature of Political Economy, a classified catalogue, London, 1845-49 at 979 বানকে তার ভবিষ্যৎ দৃষ্টির জন্য প্রশংসা করেছেন, কিন্তু যেসব সাদামাটা আবরণে বার্বন তার মুদ্রানীতি’-র ভিত্তিস্থানীয় ধারণাটিকে আবৃত করেছেন, তাকে বিজ্ঞভাবে এড়িয়ে গিয়েছেন। ঐ ‘ক্যাটাগল’-এ সত্যকার সমালোচনার, এমনকি সততার কত অভাব, তার পরাকাষ্ঠা লক্ষ্য করা যায় অর্থের তত্ত্বের ইতিহাস-সংক্রান্ত পরিচ্ছেদগুলিতে। তার কারণ এই যে বইটির ঐ অংশে ম্যাককুলক লর্ড ওভারস্টোন-এর চাটুকারিতা করেছেন, যাকে তিনি অভিহিত করেছেন, ‘facile princeps argentariorum বলে।

২৪. দৃষ্টান্তস্বরূপ অনুদান, যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ঋণ, নগদ টাকায় দাবি মেটানোর জন্য ব্যাংকের প্রয়োজন ইত্যাদির ক্ষেত্রে মূল্যের একমাত্র অর্থ-রূপেরই দরকার হয়, অন্য কোনো রূপেরই নয়।

২৫. ‘একটি বিধ্বংসী বৈদেশিক আক্রমণের আঘাতের পয়ে মাত্র সাতাশ মাসের মধ্যে যেমন অনায়াসে ফ্রান্স, তার অভ্যন্তরীণ মুদ্রাব্যবস্থায় লক্ষণীয় কোনো সংকোচন বা বিশৃংখল না ঘটিয়ে, এমনকি তার বিনিময়ে কোনো আশংকাজনক উত্থান-পতন না ঘটিয়ে, তার উপরে মিত্রশক্তির দ্বারা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া প্রায় ২০ মিলিয়ন ক্ষতিপুরণ পরিশোধ করল, তাও আবার অনেকটাই ধাতু-মুদ্রায়, তার চেয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো সাহায্য ছাড়াই আন্তর্জাতিক লেনদেন মেটাবার প্রত্যেকটি প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদনে ধাতু-মুদ্রা-প্রদানকারী দেশগুলিতে মজুদ ব্যবস্থাটির সুদক্ষতার, অন্য কোনো জোরদার সাক্ষ্য আমি চাই না।” (Fullarton l.c p. 141. [ চতুর্থ জার্মান সংস্করণে সংঘোজিত : ১৮৭১-৭৩ সালে ফ্রান্স যেমন অনায় এই বাধ্যতামূলক ক্ষতিপূরণেরও ১০ গুণ বেশি ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করল, তাও আবার অনুরূপ ভাবে অনেকটাই ধাতু-মুদ্রায়, সেটাও একটা জাজ্জ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ্য।

২৬. L’argent se partage entre les nations relativement au besoin qu’elles en ont…etant toujours attire par les prodactions. (Le Trosne L.c.p. 916) “যে খনিগুলি নিরন্তর সোনা ও রূপার যোগান দিচ্ছে, সেগুলি প্রত্যেকটি জাতিকেই তার এই প্রয়োজনীয় উদ্বত ধাতুপিণ্ড পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করে থাকে। (জে, ভ্যাণ্ডারলিন্ট, পৃঃ ৪০)।

২৭. প্রত্যেক সপ্তাহেই বিনিয়োগের বৃদ্ধি ও হ্রাস ঘটে এবং বিশেষ বছরের কিছু সময় একটি জাতির বিরুদ্ধে উৰ্দ্ধগতি ধারণ করে, আবার অন্য সময় বিপরীতগামীও হয়। ( এন, বারবন l.c, পৃঃ ৩৯)

২৮. যখনি সোনা ও রূপাকে ব্যাংক-নোট রূপান্তরনের তহবিল হিসাবে কাজ করতে হয়, তখনি এই নানাবিধ কাজগুলি পরস্পরের সঙ্গে বিপজ্জনক সংঘাতে আসে।

২৯. ‘অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের জন্য অবশ্য প্রয়োজন ছাড়া অর্থ ‘অকেজো তহবিল … যে দেশে তা থাকে, তাকে তা কোনো মুনাফা দেয়না। (John Bellers, ‘Essays, p. 13) যদি আমাদের অতিরিক্ত মুদ্রা থাকে, কি হয়? আমরা তাকে গলিয়ে তা দিয়ে সোনা বা রূপার পাত্র, বাসন ইত্যাদি বানাতে পারি অথবা যে দেশে তার দরকার পড়ে, সেখানে পণ্য হিসাবে পাঠাতে পারি কিংবা যেখানে সুদের হার বেশি, সেখানে খাটাতে পারি। (W. Petty : Quantulumcunque’, p. 39) অর্থ রাষ্ট্রদেহের চর্বি ছাড়া কিছু নয়, যার বাড়তি হলে তৎপরতা হ্রাস পায়, কমতি হলে অস্থতা দেখা যায়।……..চর্বি যেমন পেশীর গতিকে তৈলাক্ত করে, পুষ্টির ঘাটতি পুষিয়ে দেয়, অসমান কোষগুলিকে ভরাট করে রাখে এবং শরীরকে শ্ৰমণ্ডিত করে, ঠিক তেমনি অর্থ রাষ্ট্রের তৎপরতা বৃদ্ধি করে, স্বদেশে টান পড়লে বিদেশ থেকে রসদ নিয়ে এসে পুষ্টির সংস্থান করে, হিসেব-নিকেশ মিটিয়ে দেয় এবং সমগ্র ব্যবস্থাটিকে সুষমামণ্ডিত করে।” উইলিয়ম পেটি : Political Anatomy of Ireland P. 14.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *