১৬৩. রাক্ষসসমীপে ভীমের গমন, রাক্ষসের সহিত ভীমের যুদ্ধ

১৬৩. রাক্ষসসমীপে ভীমের গমন, রাক্ষসের সহিত ভীমের যুদ্ধ

ত্ৰিষষ্ট্যধিকশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির স্বীয় জননী কুন্তীর মুখে এই প্রকার ধৰ্ম্মোপেত বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, মাতঃ! আপনি করুণাপ্রযুক্ত দুঃখার্ত ব্রাহ্মণের উপকারার্থে অনুমতি করিয়া যৎপরোনাস্তি সুশীলতার কাৰ্য্য করিয়াছেন। আপনি ব্রাহ্মণের প্রতি সাতিশয় সদয় হইয়াছেন। আপনার এই পুণ্যবলে ভীমসেন অবশ্যই সেই নরমাংসলোলুপ দুষ্ট নিশাচরের প্রাণনাশ করিয়া প্রত্যাবর্তন করিবে, সন্দেহ নাই। আপনি অগ্রহপূর্বক ব্রাহ্মণকে কহিবেন যে, নগরবাসী,জনগণ যেন এই সমস্ত বৃত্তান্ত জানিতে না পারে।

এইরূপে সমস্ত দিবারাত্রি অতিবাহিত হইলে, প্রাতঃকালে ভীমসেন অন্ন লইয়া রাক্ষসের অধিবাসস্থানে গমন করিলেন। তথায় সমুপস্থিত হইয়া সেই রাক্ষসের নামোচ্চারপূর্বক তাহাকে আহ্বান করিতে করিতে আনীত অন্ন স্বয়ংই উপযোগ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাকায় রাক্ষস ভীমের সেই আহ্বান বাক্য শ্রবণে সাতিশয় সংক্রুদ্ধ হইয়া তাহার সমীপে সমুপস্থিত হইল। ঐ রাক্ষসের চক্ষুঃ, কেশ ও শ্মশ্রু লোহিতবর্ণ; মুখবিবর অকর্ণবিস্তৃত, কর্ণদ্বয় গর্দভশ্রবণের ন্যায় দার্থ। ভীষণমূভি রাক্ষস তথায় অগিমনপূর্বক তাহাকে সেই সমস্ত অন্ন ভক্ষণ করিতে দেখিয়া পূর্বাপেক্ষা অধিকতর ক্রুদ্ধচিত্তে ত্ৰিশিখ, কুটী বন্ধন ও অধরোষ্ঠ দংশন পুরঃসর ঘূর্ণিতনয়নে কহিতে লাগিল, “অরে! কোন্ দুর্বুদ্ধি আমার সমক্ষে আমার নিমিত্ত আনীত অন্ন ভক্ষণ করিতেছে? শমনসদনে গমন করিতে কাহার বাসনা হইয়াছে?” ভীমসেন রাক্ষসের বচন শ্রবণে ঈষৎ হাস্য করিয়া তাহার বাক্যে কর্ণপাত না করিয়া ভোজন করিতে লাগিলেন। তখন রাক্ষস ভয়ানক চীৎকার ও বাহুদ্বয় উত্তোলনপূর্বক ভীমসেনকে সংহার করিবার মানসে তাহার নিকট ধাবমান হইল। শত্রুপক্ষ-ক্ষয়কারী ভীমসেন তাহাতে কিছুমাত্র মনোযোগ না করিয়া নিঃশঙ্কচিত্তে ভোজন করিতে লাগিলেন। রাক্ষস ক্রোধে কম্পান্বিত কলেবরে ভীমসেনের পশ্চাদ্ভাগে দণ্ডায়মান হইয়া তাহার পৃষ্ঠে দুই হস্তে চপেটাঘাত করিতে লাগিল। বৃকোদর সেই প্রকারে অহিত হইয়াও রাক্ষসের প্রতি দৃষ্টিপাত মাত্রও না করিয়া স্বচ্ছন্দে উপযোগ করিতে লাগিলেন। রাক্ষস তদ্দর্শনে পূৰ্ব্বাপেক্ষা অধিকতর ক্রোধান্বিত হইয়া বৃক্ষ গ্রহণপূর্বক ভীমসেনকে আঘাত করিবার মানসে ধাবমান হইল। তখন ভীমসেন ক্রমে জমে সমস্ত অন্ন ভক্ষণানন্তর আচমন করিয়া যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত হইলেন এবং হাসিতে হাসিতে বাম হস্ত ধার রাক্ষসের হস্তস্থিত বৃক্ষ কাড়িয়া লইলেন। রাক্ষস তদ্দর্শনে যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ হইয়া বহুবিধ বৃক্ষ অনিয়ন করিয়া ভীমসেনকে প্রহার করিতে লাগিল। বৃকোদরও তাহাকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপ রাক্ষসকৃত বৃক্ষসংগ্রামে সেই বন পাদপশূন্য হইয়া গেল। তখন বক “অরে দুরাত্মন্! তুই বকনিশাচরের হস্তে পতিত হইয়াছি, আর তোর নিস্তার নাই” এই বলিয়া দ্রুতবেগে ভুজয়দ্বারা ভীমসেনকে আক্রমণ করিল। মহাবীর ভীমসেন ও বলপূর্বক রাক্ষসকে ধারণ করিয়া আকর্ষণ করিতে লাগিলেন। রাক্ষস ভীনসেন কর্তৃক কৃষ্যমাণ হইয়া সাতিশয় ক্লান্ত হইল। সেই মহাবীরদ্বয়ের বেগে পৃথিবী কম্পিত হইতে লাগিল এবং বৃক্ষ সমুদায় চূর্ণ হইয়া গেল। এইরূপে দিবারাত্রি যুদ্ধে বৃকে। দর রাক্ষসকে ক্ষীণবীৰ্য্য দেখিয়া তাহাকে ভূতলে নিক্ষেপ করিলেন। তিনি জানুয়দ্বারা তাহার পৃষ্ঠদেশে দৃঢ় নিষ্পাড়ন করিয়া দক্ষিণ হস্তে গ্রীব। ধারণ করিলেন এবং বাম হস্তদ্বার। কটিদেশের বস্ত্র ধরিয়া তাহার মধ্যদেশ ভঙ্গ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। দুরাত্মা। বক মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন কর্তৃক দৃঢ়তর নিস্পীড়িত হইয়া পূৰ্ব্বাপেক্ষা দ্বিগুণতর চীৎকার করিতে করিতে রুধির বহন করিতে লাগিল।