১৬২. ভীমের রাক্ষসসমীপেগমনে ভ্রাতৃগণের বৈমত্য

১৬২. ভীমের রাক্ষসসমীপেগমনে ভ্রাতৃগণের বৈমত্য

দ্বিষষ্ট্যধিকশততম অধ্যায়

বৈশম্পায়ন কহিলেন,–হে রাজন! ভীমপরমি ভীমসেন ব্রাহ্মণের হিতানুষ্ঠান করিতে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইলে যুধিষ্ঠিরাদি অপুর ভ্রাতৃচতুষ্টয় ভিক্ষা করি। গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন; পাণ্ডুনন্দন যুধিষ্ঠির স্বীয় মাতা কুন্তী, ব্রাহ্মণ ও ভামসেনের আকার প্রকারদ্বারা সমস্ত বৃত্তান্ত বুঝিতে পারিয়া স্বীয় জননীকে একান্তে লইয়া গিয়া কহিলেন, মাতঃ! মহাবল পরাক্রান্ত ভীমসেন এ কি অসমসাহসিকের কার্য করিতে সমুদ্যত হইয়াছে। সেই দুষ্কর কাৰ্য্য করিতে ভীম কি স্বয়ং প্রবৃত্ত হইয়াছে? অথব! আপনি উহাকে অনুমতি দিয়াছেন? কুন্তী কহিলেন, বৎস! ভীমসেন আমার আজ্ঞানুসারে ব্রাহ্মণের উপকারার্থে ও নগরের হিতসাধনের নিমিত্ত এই কর্মে প্রবৃত্ত হইয়াছে। যুধিষ্ঠির কহিলেন, মাতঃ! আপনি এ বিষয়ে ভীমকে অনুমতি প্রদান করি সজ্জনবিগহিত ও অতিমাত্র সাহসের কাৰ্য্য করিয়াছেন। আপনি কি নিমিও পরপুরক্ষার্থে স্বীয় পুত্রবিনাশরূপ লোকবেদবিরুদ্ধ কাৰ্যানুষ্ঠান করিতে উদ্যত হইলেন? দেখুন, যাহার বাহুবলমাত্র আশ্রয় করিয়া অমির। দুর্জনাপহৃত রাজ্য পুনঃ প্ৰত্যুদ্ধার করিতে কৃতনিশ্চয় হইয়া মুখে নিদ্র! যাই; যাহার পরাক্রম চিন্তা করিয়া দুরাত্মা দুর্য্যোধন শকুনি সমভিব্যাহারে রজনীযোগে নিদ্রিত হইতে পারে না; যাহার বীৰ্যপ্রভাবে আমরা জতুগৃহ ও অন্যান্য অনেক অনিষ্ট হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছি; আমরা যে মহাবীরের পরাক্রমমাত্র অবলম্বন করিয়া এই বপূর্ণ। বসুন্ধরা আপনাদিগের হস্তগত বলিয়া মনে করি, আপনি কোন্ সাহসে সেই মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদরকে পরিত্যাগ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন? বোধ হয়, দুরবস্থায় পতিত হওয়াতে আপনার বুদ্ধিবিলুপ্ত হইয়াছে।

কুন্তী কহিলেন, বৎস যুধিষ্ঠির! তুমি কেন এ বিষয়ে বৃথা সন্তাপ করিতেছ? আমি সে বুদ্ধিদৌর্বল্যপ্রযুক্ত এই কাররয্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছি, এরূপ সন্দেহ করিও না। দেখ, আমরা এই ব্রাহ্মণের নিকেতনে পরমসুখে বাস করিতেছি, ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ ইহার বিন্দুবিসর্গও জানে না। ব্রাহ্মণ আমাদের যথেষ্ট সংকার ও সম্মান করিয়া থাকেন। হে পুত্র! আমি তজ্জন্য এই মহোপকারক ব্রাহ্মণের হিতসাধনাৰ্থে এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হইয়াছি। যে ব্যক্তি পরকৃত উপকার প্রাণান্তেও বিস্মৃত হয় না ও অন্যে যে পরিমাণে উপকার করিয়াছে, তদপেক্ষ। বহুগুণ উপকারবার। তাহার প্রতিশোধ দেয়, সেই যথার্থ মনুষ্য। বিশেষতঃ আমি জতুগৃহ দাহ ও হিড়িম্ববধ সময়ে ভীমের পরাক্রম বিলক্ষণ। জানিতে পারিয়াছি। ভীমপরাক্রম ভীমসেন অযুত মহস্তিতুল্য বলশালী। ঐ মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর আমাদিগকে বারণাবত নগর হইতে বহির্গত করিয়াছে। উহার তুল্য বলশালী আর কেহই নাই, বোধ হয়, সে যুদ্ধে পুরুষোত্তম চক্রপাণিকেও জয় করিতে পারে। ভীমসেন জামাত্র আমার ক্রোড় হইতে গিরিপৃষ্ঠে নিপতিত হয়, পৰ্বত উহার দেহভারে চূর্ণ হইয়া যায়। অতএব হে পাণ্ডব! আমি স্বীয় প্রজ্ঞাদ্বারাই ভীমসেনের বলবিক্রম বুঝিতে পারিয়া ব্রাহ্মণের প্রত্যুপকারার্থে এই বিষয়ে অনুমতি প্রদান করিআছি। আমি লোভ বা অজ্ঞানতা প্রযুক্ত এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হই নাই, বুদ্ধিপূর্বকই ইহা করিয়াছি। হে যুধিষ্ঠির! এই কাৰ্য সম্পাদনদ্বারা আমাদের দুইটি মহৎকাৰ্যানুষ্ঠান হইবে; প্রথম, আশ্রয়দাতার প্রত্যুপকার, দ্বিতীয়, ধর্মানুষ্ঠান। হে পুত্র! পূর্বে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন আমাকে কহিয়াছেন, সে ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের কাৰ্যকালে তাহার সাহায্য করে, সে চরমে শুভলোকপ্রাপ্ত হয়; যে ক্ষত্রিয় ক্ষত্রিয়ের প্রাণরক্ষা করে, সে ইহকাল ও পরকালে মহতী কীৰ্ত্তি লাভ করে; যে ক্ষত্রিয় বৈশ্যের সাহায্য করে,সে সর্বলোকে প্রজারঞ্জক হয় এবং যে ক্ষত্রিয় শরণাগত শূদ্রকে বিপদ হইতে পরিত্রাণ করে, সে এই রাজপূজিত ক্ষত্রিয়কুলে পুনর্বার জন্ম গ্রহণ করে। হে পৌরববংশাবতংস! আমি বেদব্যাসের এই উপদেশ স্মরণ করিয়া এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিয়াছি।