১৫৪. ভীম-হিড়িম্বের যুদ্ধ, ভীম কর্তৃক হিড়িম্ব-বধ

১৫৪. ভীম-হিড়িম্বের যুদ্ধ, ভীম কর্তৃক হিড়িম্ব-বধ

চতুঃপঞ্চাশবিকশতম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন,—মহারাজ! এদিকে কুন্তী পুত্ৰচতুষ্টয়ের সহিত জাগরিত হইয়া সমীপস্থিত। হিড়িম্বার অতিমানুষ রূপ দর্শনে সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইয়া সান্ত্ববাদপূর্বক হিড়িম্বাকে সম্বোধন করিয়া সুমধুরস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, হে বরবৰ্ণিনি! তুমি কে? কাহার পত্নী? কি নিমিত্ত এই স্থানে আসিয়াছ? হে দেবগৰ্ভাভে! তুমি কি এই বনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী? কি কোন অপ্সরা? আর কি জন্যই বা এস্থানে রহিয়াছ? সবিশেষ ব্যক্ত করিয়া বল। হিড়িম্বা কহিল, হে দেবি! এই যে গগনস্পর্শী বৃক্ষরাজীসমাকুল সুনীল জেলধরসদৃশ শ্যামল অরণ্যানী নিরীক্ষণ করিছেন, ইহা রাক্ষসেন্দ্র হিড়িম্ব ও আমার আবসস্থান। ঐ রাক্ষসরাজ আমার সহোদর; সে তোমাকে ও তোমার পুলদিগকে সংহার করিবার মানসে এই স্থানে আমাকে পাঠাইয়াছিল। আমি সেই ঐ রবুদ্ধির বচনানুসারে এখানে আসিয়া তপ্তকাঞ্চনসদৃশ কলেবর, মহাবলপরাক্রান্ত তোমার পুত্রকে নিরীক্ষণ করিলাম। হে শুভে! তাহাকে দেখিবামাত্র আমি সর্বভূতচিত্তচারী ভগবান্ কুসুমচাপের শরসন্ধানের বশবর্তিনী হইয়া তাহাকে পতিত্বে বরণ করিলাম। আমি তোম দিগকে লইয়া এস্থান হইতে পলায়ন করিবার অনেক চেষ্টা পাইয়াছিলাম, কিন্তু তোমার পুত্র কোনমতেই আমার বাক্যে সম্মত হইলেন না। হে ভদ্রে। এ স্থানে আমার অনেক বিলম্ব হওয়াতে আমার ভ্রাত। তোমাদিগকে সংহার করিকার নিমিত্ত স্বয়ং আসিয়াছিল। এক্ষণে তোমার সেই পুত্র বলপূর্বক এস্থান হইতে তাহাকে লইয়া গিয়াছেন। ঐ দেখ, তাহারা দুইজনে পরস্পর গর্জন ও বিক্ৰম প্ৰকাশপূর্বক যুদ্ধ করিতেছেন।

হিড়িম্বার বচন শ্রবণমাত্র মহাবীৰ্য্য যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল ও সহদেব সত্বরে ভীমসমীপে সমুপস্থিত হইলেন এবং দেখিলেন, ভীমপরাক্রম ভীমসেন ও রাক্ষস পরস্পর জয়াশ করিয়া মহাবল পরাক্রান্ত সিংহদ্বয়ের ন্যায় ঘোরর সংগ্রাম করিতেছেন। তাঁহাদিগের চরণাঘাতে পার্থিব-ধূলিপটল গগনমণ্ডলে সমুখিত হইয়া দাবাগ্নিধূমের শোভা ধারণ করিয়াছে। তাহারা বসুধারেণুপরিবীতাঙ্গ হইয়া নীহারমণ্ডিত শৈলরাজদ্বয়ের ন্যায় শোভা পাইতেছেন। তখন মহাবলশালী অর্জুন ভীমসেনকে রাক্ষসের যুদ্ধে ব্যথিতপ্রায় দেখিয়া ঈষৎ হাস্য করিতে করিতে কহিতে লাগিলেন, হে মহাবাহু ভীমসেন! তুমি কি এই দুর্বৃত্ত রাক্ষসের সহিত যুদ্ধ করিয়া সাতিশয় পরিশ্রান্ত হইয়াছ? ভয় নাই, আমি তোমার সহায়তা করিতেছি; নকুল ও সহদেব মাতাকে রক্ষা করুক। ভীম কহিলেন, ভ্রাতঃ! কিছুমাত্র শঙ্কা করিও না; নিরুদ্বিগ্নচিত্তে যুদ্ধ দর্শন কর; এই দুরাত্মা আমার হস্তগত হইআছে, আর ইহার নিস্তার নাই। অর্জুন কহিলেন, হে ভীম! আর বিলম্ব করিও না, পাপাত্মা রাক্ষসকে শীঘ্রই নিপাত কর; আমাদের এ স্থান হইতে অতি ত্বরায় প্রস্থান করা কর্তব্য। ঐ দেখ, পূৰ্বদিক্‌ রক্তবর্ণ হইয়াছে; অতি শ্যই প্রভাত হইবে; দিবাভাগে রাক্ষসগণ অধিকতর প্রবল হইয়া উঠে। হে বৃকোদর! সত্বর হও; আর বৃথা ক্রীড়া করিও না; উহাকে শীঘ্র বধ কর; কিঞ্চিৎ বিলম্বেই ঐ দুরাত্মা মায়া প্রকাশ করিবে।

মহাবল পরাক্রান্ত ভীমসেন অর্জুনের বচন শ্রবণে পূৰ্ব্বাপেক্ষা অধিকতর ক্রোধান্বিত হইয়া স্বীয় জনক বায়ুকে আহ্বান করত তদীয় জগৎসংহারক বল গ্রহণ করিলেন এবং সেই নীলাম্বুদশ্যামল রাক্ষসের প্রকাণ্ড দেহ ঊর্দ্ধে উত্তোলনপূর্বক মহাবেগে বিঘূর্ণিত করিতে করিতে কহিলেন, অরে দুষ্ট নিশাচর! তুই বৃথা এত কাল মাংস ভক্ষণ করিয়া বৰ্দ্ধিত হইয়াছিস্; তোকে ধিক্! অতএব তোকে এক্ষণেই অপঘাতে সংহার করিয়া এই বন নিষ্কণ্টক ও মঙ্গলযুক্ত করিব। আর তুই নর হত্যা করিয়া ভক্ষণ করিতে পারিবি না। অর্জুন কহিলেন, হে ভীমসেন! যদি এই রাক্ষসকে তোমার ভার বোধ হইয়া থাকে, তবে বল? আমি তোমার সাহায্য করিতেছি। ইহাকে শীঘ্র সংহার কর, অথবা আমিই ইহাকে বিনাশ করিতেছি; তুমি অনেক পরিশ্রম করিয়াছ, ক্ষণকাল বিশ্রাম কর।

অর্জুনের এই বাক্য শ্রবণে ভীমসেনের ক্রোধ দ্বিগুণিত হইয়া উঠিল। তখন তিনি আর কিছুমাত্র বিলম্ব না করিয়া রাক্ষসকে বলপূর্বক ভূতলে নিক্ষেপ করত পশুর ন্যায় বধ করিলেন। হিড়িম্ব মরণকালে ভয়ঙ্করস্বরে চীৎকার করিতে লাগিল। তাহার গভীর গর্জন দ্বারা সেই মহারণ্য পরিপূর্ণ হইল। তৎপরে বৃকোদর রাক্ষসকে বলপূর্বক ধারণ করিয়া তাহার মধ্যদেশ ভয় করিয়া ফেলিলেন। রাক্ষস নিহত হইয়াছে দেখিয়া, পাণ্ডবচতুষ্টয়ের আহলাদের পরিসীমা রহিল না। তাহারা পরম সমাদরপূর্বক ভীমসেনকে ধন্যবাদ প্রদান ও আলিঙ্গন করিলেন। তখন অর্জুন পরম আহলাদে অরাতিবিনাশন বৃকোদরকে পূজা করিয়া কহিলেন, হে মহাত্মন! বোধ হয়, এই বনের অনতিদূরেই নগর আছে, চল, অমর। ত্বরায় এস্থান হইতে প্রস্থান। করি; কি জানি, দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন কোন না কোন উপায় দ্বারা আমাদের অনুসন্ধান পাইলেও পাইতে পারে। তাহারা সকলেই অর্জুনের বাক্যে অনুমোদন করিয়া তথা হইতে গমন করিতে লাগিলেন। রাক্ষসী হিড়িম্বাও তাহাদের সমভিব্যাহারে চলিল।