১৪৫. পাণ্ডবনির্বাসনে জনক্ষোভ, পাণ্ডব প্রতি বিদুরের সঙ্কেতবাক্য

১৪৫. পাণ্ডবনির্বাসনে জনক্ষোভ, পাণ্ডব প্রতি বিদুরের সঙ্কেতবাক্য

পঞ্চচত্বারিংশদধিকশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! এদিকে পাণ্ডবগণ বারণাবত নগরে গমনজন্য বায়ুবেগগামী সদশ্বযুক্ত রথে আরোহণ সময়ে পিতামহ ভীষ্ম, রাজ। ধৃতরাষ্ট্র, মহাত্ম। দ্রোণ, কৃপ ও বিদুর প্রভৃতি সমুদায় কুরুবংশীয় ও অন্যান্য বৃদ্ধগণকে প্রণাম করিলেন এবং সমকক্ষ ব্যক্তিদিগকে আলিঙ্গন করিলেন; বালকগণ তাহাদিগকে অভিবাদন করিল। তদনন্তর তাঁহারা সমস্ত মাতৃগণকে প্রদক্ষিণ করিয়া তাহাদের অনুমতি গ্রহণ করিলেন এবং সমুদায় প্রজাগণকে বিনয়নবচনে সাদর সম্ভাষণ করিয়া রণে আরোহণপূর্বক বারণবত নগরে যাত্রা করিলেন। মহাপ্রাজ্ঞ বিদুর প্রভৃতি কতকগুলি কুরুবংশীয় ও পৌরবর্গ শোকাকুলিতচিত্তে তাঁহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। তন্মধ্যে কতিপয় সাহসিক ব্রাহ্মণ পাণ্ডুনন্দনগণের দুঃখে যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইয়া নির্ভয়চিতে কহিতে লাগিলেন, “কুরুকুলকলঙ্কী মন্দবুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্র কেন এরূপ অধর্মানুষ্ঠান করিতে উদ্যত হইয়াছেন। দেখ, মহাত্মা মাদ্রীনন্দনদ্বয়, পুণ্যশীল যুধিষ্ঠির, মহাবল পরাক্রান্ত ভীমসেন ও ধনজয় ইহারা কখনই ধৃতরাষ্ট্রের অনিষ্টাচরণে প্রবৃত্ত হয়েন নাই; তথাপি তিনি ইহাদিগকে স্বীয় পিতৃরাজ্যে অধিকার প্রদান করিলেন না। মহাত্মা ভীষ্মই বা কি প্রকারে পাণ্ডবগণের নির্বাসনরূপ নিতান্ত অধর্ম ও একান্ত অশ্রদ্ধেয় বিষয়ে অনুমোদন করিলেন। পূৰ্বে শান্তনুনন্দন নরপতি বিচিত্রবীৰ্য্য, তৎপরে তাঁহার পুত্র রাজর্ষি পাণ্ডু পিতার ন্যায় আমাদিগকে প্রতিপালন করিতেন। সেই পুরুষশ্রেষ্ঠ পাণ্ডু সুরলোকে গমন করিয়াছেন। সম্প্রতি দুরাত্মা ধৃতরাষ্ট্র তাহার পুত্রগণের সহিত নৃশংস ব্যবহার করিতেছে; অতএব চল, আমরা এই বিষয়ে অনিচ্ছা প্রকাশ করিয়া আপন আপন গৃহ পরিত্যাগপূর্বক এই রম্য হস্তিনানগর হইতে ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের অনুগামী, হই। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির শোকাকুল ব্রাহ্মণগণের বাক্য শ্রবণে ও পৌরগণের দুঃখদর্শনে দুঃখিত হইয়া ক্ষণকাল মনে মনে চিন্তা করিয়া কহিলেন, নরপতি ধৃতরাষ্ট্র আমাদিগের পিতৃতুল্য; তিনি যাহা আজ্ঞা করিয়াছেন, তাহা অশঙ্কুচিতচিত্তে প্রতিপালন করা আমাদিগের অবশ্য কর্তব্য। আপনারা আমাদিগের পরম সুহৃৎ, এক্ষণে আমাদিগকে আশীর্বাদ করিয়া স্ব স্ব গৃহে প্রতি নিবৃত্ত হউন; কাৰ্যকাল উপস্থিত হইলে আমাদের প্রিয় ও হিতসাধন করিবেন। তাহারা যুধিষ্ঠিরের বাক্য শ্রবণানন্তর ‘তথাস্তু’ বলিয়া পাণ্ডবগণকে প্রদক্ষিণপূর্বক আশীর্বাদ করিয়া হস্তিনাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। পৌরগণ প্রতিনিরত্ত হইলে সুচতুর, ধৃতরাষ্ট্রের কৌশল, সর্বধর্মবিৎ ও প্রাজ্ঞ বিহুর সঙ্কেতদ্বারা পাণ্ডবশ্রৈষ্ঠ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নিকটে দুৰ্য্যোধনকৃত মন্ত্রণার মৰ্ম্মোদঘাটনপূর্বক এই প্রকার কহিতে লাগিলেন, যে ব্যক্তি নীতিশাস্ত্রানুসারিণী পর-মতির অভিজ্ঞ হয়, তাহার উচিত এই যে, যাহাতে আপ হইতে নিস্তার পাওয়া যায়, সর্বদ। এরূপ চেষ্টা করেন। তৃণরাশির মধ্যে বিবর খনন করিয়া অবস্থিতি করিলে তৃণদাহক ও শৈত্যনাশক হুতাশন কখনই দগ্ধ করিতে পারে না। যে ব্যক্তি ইহা জানে, সে আত্মরক্ষা করিতে পারে। শত্ৰুদিগের কুমন্ত্রণারূপ অস্ত্র লৌহনিৰ্ম্মিত নহে, অথচ শরীর ছেদন করে; যিনি ইহা জানেন, শক্ৰবৰ্গ তাহাকে কখনই নষ্ট করিতে পারে না। যে ব্যক্তি অন্ধ, সে পথ বা দিঙ্‌ নির্ণয় করিতে পারে না ও অধীর লোকের বুদ্ধিস্থৈর্য থাকে না; আমি এই কথামাত্র বলিলাম, বুঝিয়া লও। সর্বদা ভ্রমণ করিলে পথ জানিতে পারা যায়, নক্ষত্ৰদ্বার। দিও নির্ণয় হইতে পারে এবং ব্যক্তি আপনার পঞ্চেন্দ্রিয় বশীভূত রাখিতে পারে, সে অবসন্ন হয় না।

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সুবিদ্বান্ বিদুরের এই কথা শুনিয়া ‘বুঝিলাম’ এইমাত্র উত্তর প্রদান করলেন। মহাত্মা বিদুর এইরূপে যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ প্রদান করিয়া পাণ্ডবগণের অনুজ্ঞা গ্রহণপূর্বক সবিষাদচিত্তে নিজ গৃহে গমন করিলেন। পরে ভীষ্ম, বিদুর ও পুরবাসিগণ প্রতিনিবৃত্ত হইলে পর, কুন্তী যুধিষ্ঠিরের সন্নিকটে গমন করিয়া কহিলেন, বৎস! ক্ষা জনতামধ্যে গোপনীয়ভাবে তোমাকে যাহা কহিলেন এবং তুমিও তাহাকে ‘বুঝিলাম’ বলিয়া উত্তর প্রদান করিলে, কিন্তু আমরা ত তাহার কিছুমাত্র বুঝিতে পারিলাম না; যদি প্রকাশ করিলে কোন হানি না হয়, তবে আমাদিগকে সবিস্তর প্রকাশ করিয়া বল; শুনিতে নিতান্ত বাসনা হইতেছে। যুধিষ্ঠির মাতার বচন শ্রবণানন্তর অতি বিনীতবচনে কহিলেন, মাতঃ! বিদুর আমাকে কহিলেন যে, দুৰ্য্যোধন তোমাদিগকে দগ্ধ করিবার মানসে জতুগৃহ নির্মাণ করিয়েছে, তোমরা অত্যন্ত সাবধানে বিচরণ করিবে, সমুদায় পথ উত্তমরূপে চিনিয়া রাখিবে ও সর্বদা জিতেন্দ্রিয় হইয়া থাকিবে, তাহা হইলেই অচিরাৎ রাজ্য লাভ করিতে পারিবে। আমি তাহার ঐ উপদেশবাক্য শ্রবণানন্তর, ‘বুঝিয়াছি’ বলিয়া তাহাকে বিদায় করিলাম। হে নৃপতিসত্তম জনমেজয়! তদনন্তর মাতৃসমবেত পাণ্ডবগণ ফাঙ্কনমাসীয় অস্টম দিবসে রোহিণী নক্ষত্রে বারণাবত নগরে সমুত্তীর্ণ হইলেন।