১৪১. জতুগৃহ পৰ্বাধ্যায়

১৪১. জতুগৃহ পৰ্বাধ্যায়

একচত্বারিংশদ ধিকশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন,—তদনন্তর সুবলনন্দন শকুনি, দুৰ্য্যোধন, দুঃশাসন ও কর্ণ দুষ্টমন্ত্রণা করিয়া ধৃতরাষ্ট্রের নিকটে গমন করিল এবং তাঁহার সহিত পরামর্শ করিয়া কুন্তী ও যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চভ্রাতুকে দগ্ধ করিতে মনস্থ করিল। তত্ত্বদর্শী মহাত্মা বিদুর আকার ও ইঙ্গিতদ্বারা ঐ পামরগণের দুষ্টাভিসন্ধি বুঝিতে পারিলেন। ঐ মহাত্মা পাণ্ডবগণের একান্ত হিতাকাঙ্ক্ষী ছিলেন; কুন্তী কুমারগণ, সমভিব্যাহারে অনায়াসে পলায়ন করুন, এই অভিপ্রায়ে তিনি একখানি নৌকা প্রস্তুত করাইলেন। ঐ তরণী,বাতুসহ, যন্ত্রযুক্ত, পতাকাসুশোভিত ও সুদৃঢ়; বায়ুবেগোথিত প্রবল সমুদ্রতরঙ্গও উহাকে হঠাৎ মগ্ন করিতে পারে না। নৌকা প্রস্তুত হইলে বিদুর কুন্তীর নিকটে গমন করিয়া কহিলেন, হে শুভে! কুরুকুলের কীর্তিনাশক বিপরীতবুদ্ধি দুরাত্মা ধৃতরাষ্ট্র নিত্যধর্ম পরিত্যাগ করিতে উদ্যত হইয়াছেন, অতএব তুমি এই উত্তালতরঙ্গবেগসহ তরণী আরোহণ করিয়া সন্তানগণ সমভিব্যাহারে ত্বরায় পলায়ন কর; তাহা হইলেই তোমাদিগের প্রাণ রক্ষা হইবে, নচেৎ আর নিস্তার নাই। কুন্তী বিদুরের বাক্য শ্রবণ করিয়া সাতিশয় ব্যথিত হইলেন এবং তৎক্ষণাৎ কুমারগণ সমভিব্যাহারে নৌকাররাহণ করিয়া গঙ্গা পার হইলেন। পরে বিদুরদত্ত ধনসম্পত্তি গ্রহণপূর্বক তীরে উত্তীর্ণ হইয়া নির্বিঘ্নে পরম রমণীয় কাননে প্রবেশ করিলেন। এদিকে নিষাদী পঞ্চপুত্ৰ সমভিব্যাহারে পুরোননিৰ্ম্মিত জতুগৃহে শয়ানা ছিল। উহারা ছয় জন ভস্মসাৎ হইয়া গেল এবং দুর্মতি ম্লেচ্ছাধম পুরোচন ও ভস্মাবশেষ হইল। নিষাদী ও তাহার পঞ্চপুত্র ভস্মীভূত হওয়াতে ধৰ্তরাষ্ট্রের। বোধ করিল, কুন্তী পঞ্চপুত্র সমভিব্যাহারে অগ্নিতে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন; কিন্তু তাঁহারা যে বিদুরের পরামর্শানুসারে সে স্থান হইতে প্রস্থান করিয়া প্রাণরক্ষা করিয়াছেন,তাহার বিন্দুবিসর্গও ক্লানিতে পারিল না। যাহা হউক, বারণবিতস্থ লোকেরা জতুগৃহ দগ্ধ হইয়াছে দেখিয়া পাণ্ডবগণের গুণরাশি স্মরণ করিয়া যৎপরোনাস্তি শোক করিতে লাগিল। পরে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সমীপে এই সমাচার পাঠাইল, হে কৌরব্য? তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইয়াছে, আর ভয় নাই, তুমি, পাণ্ডবগণকে দগ্ধ করিয়াছ; এক্ষণে পুত্রগণ সমভিব্যাহারে নিঃশঙ্কচিত্তে রাজ্য ভোগ কর। ধৃতরাষ্ট্র, জননীসমবেত পাণ্ডবগণের মৃত্যুবাৰ্তা শ্রবণ করিয়া পুত্রগণ সমভিকাহারে কৃত্রিম শোক প্রকাশ করিতে লাগিলেন এবং তদনন্তর ভীষ্ম ও বিদুর বন্ধুবান্ধবগণ সমভিব্যাহারে তাঁহাদিগের প্ৰেতকাৰ্য্য সম্পাদন করিলেন।

জনমেজয় কহিলেন, হে দ্বিজোত্তম! জতুগৃহ দাহ ও তাহা হইতে পাণ্ডবগণের পরিত্রাণ বৃত্তান্ত বিস্তারিতরূপে শ্রবণ করিতে বাসনা করি। হে ব্ৰহ্মন! জতুগৃহ দাহ অতিশয় দুষ্কর্ম ও নিতান্ত নৃশংস ব্যাপার; উহা শুনিতে আমার অত্যন্ত কৌতূহল হইতেছে, আপনি অনুহ করিয়া সবিশেষ কর্ণন করুন।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! যেরূপে জাহ দগ্ধ হয় এবং পাণ্ডবগণ তাহা হইতে মুক্ত হন, তৎসমুদায় সবিস্তর বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ কর। দুর্মতি দুৰ্য্যোধন ভীমসেনকে মহাবলপরাক্রান্ত ও অর্জুনকে কৃতবিদ্য দেখিয়া সাতিশয় পরিতাপযুক্ত হইল। দুরাত্মা কর্ণ ও শকুনি নানাবিধ উপায় দ্বারা পাণ্ডবগণের হিংসা করিতে লাগিল। পাণ্ডবেরাও বিদুরের মতানুসারে উহার উদ্ভাবন করিতেন না; কেবল যখন যে দুর্ঘটনা উপস্থিত হইত, যথাসাধ্য তাহার প্রতীকার করিতেন। এদিকে যাবতীয় পুরবাসীরা পাণ্ডবগণকে অশেষ গুণসম্পন্ন দেখিয়া সভামধ্যে তাহাদিগের গুণগ্ৰাম বৰ্ণন করিতে আরম্ভ করিল? তাহার কি সভামণ্ডলে, কি চত্বরে, একত্র হইলেই কহে সে, মহাত্মা পাণ্ডুর জ্যেষ্ঠতনয় যুধিষ্ঠির রাজ্য পাইবার উপযুক্ত পাত্র। প্রজ্ঞাচক্ষুঃ রাজা ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ বলিয়া পূর্বে রাজ্য প্রাপ্ত হয়েন নাই, তবে তিনি কি বলিয়া এক্ষণে ভূপতি হইবেন। সত্যপ্রতিজ্ঞ মহাব্ৰত শান্তনুনন্দন ভীষ্ম রাজ্য লইবেন না বলিয়া পূর্বে প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, সুতরাং তিনিও রাজ্যভার বহন করিবেন না, অতএব আমরা যুদ্ধবিদ্যাবিশারদ তরুণবয়স্ক ধর্মাত্মা পাণ্ডবজ্যেষ্ঠকে রাজ্যে অভিষেক করিব। সেই ধর্মাত্মা সত্যশীল, কারুণ্যসম্পন্ন ও বেদবেত্তা; তিনি অবশ্যই শান্তনুতনয় ভীষ্ম ও পুত্রগণসমবেত ধৃতরাষ্ট্রকে যথোচিত পূজা করিবেন এবং তাহাদিগকে বিবিধ রাজভোগ প্রদান করিবেন। মূঢ়মতি দুৰ্য্যোধন যুধিষ্ঠিরানুরক্ত পৌরগণের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া যৎপরোনাস্তি পরিতপ্ত ও ঈর্ষান্বিত হইল এবং সত্বরে স্বীয় পিতা ধৃতরাষ্ট্রের সমীপে গমনপূর্বক তাহাকে একাকী দেখিয়া পাদবন্দনপূর্বক কহিতে লাগিল, হে পিতঃ! পৌরগণ আপনাকে ও ভীষ্মকে পরিত্যাগ করিয়া যুধিষ্ঠিরকে রাজা করিতে চাহে, রাজ্যভোগপরাঙ্মুখ ভীষ্মেরও উহাতে সম্পূর্ণ মত আছে। হে নরনাথ! পৌরবর্গের মুখে এই অশ্রেয়স্কর বাক্য শ্রবণ করিয়া আমার অত্যন্ত মনোব্যথা হইতেছে; দেখুন, পূর্বে মহারাজ পাণ্ডু গুণবান্ বলিয়া পিতৃরাজ্য পাইয়াছিলেন, আপনি জন্মান্ধত্বপ্রযুক্ত জ্যেষ্ঠ হইয়াও রাজ্যলাভ করিতে পারেন নাই। এক্ষণেও যদি পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির পৈতৃক রাজ্য প্রাপ্ত হন, তাহা হইলে তৎপরে তৎপুত্র, তদনন্তর তদীয় পৌত্র, এইরূপে ক্রমশঃ পাণ্ডুবংশীয়েরাই সুখসাম্রাজ্য ভোগ করিতে রহিল, আমরা পুত্রপৌত্রাদিক্রমে রাজবংশে থাকিয়া জনগণের নিকটে হীন ও অবজ্ঞাত হইয়া রহিব। পরপিণ্ডোপজীবি লোকের। সর্বদা নরক ভোগ করে; অতএব হে রাজন্! যাহাতে আমরা ঐ নরক হইতে মুক্ত হইতে পারি, এরূপ কোন পরামর্শ করুন। হে মহারাজ! যদি আপনি পূর্বে এই রাজ্য প্রাপ্ত হইতেন, তাহা হইলে প্রজাগণ, যতই অবশ হউক না কেন, আমরা অবশ্যই রাজত্ব লাভ করিতে পারিতাম।