১৩৭. কর্ণের প্রতি ভীমের শ্লেষবাক্য

১৩৭. কর্ণের প্রতি ভীমের শ্লেষবাক্য

সপ্তত্রিংশধিকশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন,—মহারাজ! অনন্তর কর্ণের জনক অধিরথ সূত ঘর্মাক্তকলেবর ও স্খলিতোভরচ্ছদ হইয়া কম্পিতকলেবরে সহসা রঙ্গমধ্যে প্রবেশ করিলেন। মহাবীর কর্ণ পিতাকে নিরীক্ষণ করিয় শরাসন পরিত্যাগ পূর্বক তদীয় গৌরবরক্ষার্থে অভিষেকাৰ্জ মস্তকদ্বারা তাহাকে প্রণাম করিলেন। পুত্রবৎসল সারথি সসমে বস্ত্রদ্বার চরণদ্বয় আচ্ছাদন করিয়া কর্ণকে পুত্র বলিয়া সম্বোধন ও আলিঙ্গন করিলেন এ অভিষেক-জলক্ষালিত তদীয় মস্তক পুনর্বার আনন্দাশ্রুদ্বারা অভিষিক্ত করিলেন। তাহা অবলোকন করি ভীমসেন কর্ণকে সূতপুত্র বিবেচনা করিয়া হাস্যমুখে কহিতে লাগিলেন, কে সূতনন্দন! রণে অর্জুনহস্তে প্রাণবিসর্জন করা তোর পক্ষে কোনরূপে শ্রেয়স্কর নহে। বরং শীঘ্রই কুলোচিত বন্ধু গ্রহণ কর। রে নরাধম! হুতাশন-সন্নিহিত যজ্ঞীয় হবিঃ যেমন কুকুরের অবলেহনযোগর নহে, তদ্রূপ তুইও অঙ্গরাজ্য উপভোগ করিবার উন্মুক্ত নহি। তদীয় এতাদৃশ উদ্ধত বাক্যে কর্ণের অধর ক্রোধে কম্পিত হইতে লাগিল এবং বারম্বার দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক তিনি নভোমণ্ডস্থ সূৰ্য্যকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।

অনন্তর মহাবল দুৰ্য্যোধন মদমত্ত কুঞ্জরের ন্যায় ক্রোধে অধীর হইয়া ভ্রাতৃমধ্য হইতে সহসা উত্থিত হইলেন এবং সম্মুখে আসীন ভীমকর্মা ভীমসেনকে কহিতে লাগিলেন, হে ভীম! কর্ণের প্রতি এরূপ কটূক্তি প্রয়োগ। করা তোমার সমুচিত নহে। ক্ষত্রিয়দিগের বলই শ্রেষ্ঠ এবং ক্ষত্রিয়েরই সহিত যুদ্ধ করিবে; শূরদিগের ও নদীকলাপের প্রভাব নিতান্ত দুয়ে। দেখ, ভগবান জ্বলন, জলরাশি হইতে উত্থিত হইয়া এই চরাচর বিশ্বে ব্যাপ্ত রহিয়াছেন। মহর্ষি দধীচির অস্থি হইতে অসুরকুলনাশক বজ্ৰ উদ্ভূত হইয়াছে। অগ্নি, রুদ্র, গঙ্গা ও কৃত্তিকা, ইহাদিগের পুত্র কার্তিকেয় অসাধারণ পরাক্রমশালী। যাহারা ক্ষত্রিয়কুলোদ্ভব, কালক্রমে তাঁহারাও ব্রাহ্মণ হইয়াছেন; বিশ্বামিত্র প্রভৃতি ক্ষত্রিয় হইয়াও অক্ষয় ব্রহ্মত্ব লাভ করিয়াছিলেন। মহানুভব দ্রোণাচাৰ্য কুম্ভসম্ভব হইয়াও অদ্বিতীয় শস্ত্রধারী হইয়াছেন। গোতমবংশে শরস্তম্ব হইতে গৌতম উৎপন্ন হয়েন। আর তোমাদিগের যেরূপে জন্মলাভ হইয়াছে তাহা আমাদিগের অগোচর নাই; যেমন মৃগীগর্ভে ব্যাঘ্রের উদ্ভক হওয়া নিতান্ত অসম্ভব, কবচ ও কুণ্ডলধারী, সৰ্বলক্ষণসংযুক্ত সূৰ্য্যসঙ্কাশ মহাবীর কর্ণও তদ্রপ সামান্য ব্যক্তি হইতে উৎপন্ন নহেন। কর্ণ অঙ্গরাজ্যের অধীশ্বর হইয়াছেন, ইহা অতি সামান্য বিষয়, ইনি মনে করিলে নিজ ভুবলে ও মদীয় সাহায্য সমস্ত পৃথিবী অধিকার করিতে পারেন। কর্ণের রাজ্যলাভ বিষয়ে যাহার বিদ্বেষ থাকে, তিনি সংগ্রামে প্রবৃত্ত হউন।

অনন্তর রঙ্গমধ্যে সহসা সাধুবাদসহকৃত হাহাকার ধ্বনি উত্থিত হইল। এই অবসরে সূৰ্য্যও অস্তাচলে প্রস্থান করিলেন। তৎপরে মহারাজ দুৰ্য্যোধন কর্ণের করগ্রহণপূর্বক রঙ্গ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। এদিকে পাণ্ডবেরা দ্রোণ, কৃপ ও ভীষ্ম সমভিব্যাহারে স্ব স্ব নিকেতনে প্রস্থান করিলেন। দর্শকমধ্যে কোন ব্যক্তি অর্জুনের, কোন ব্যক্তি কর্ণের, কোন ব্যক্তি দুৰ্য্যোধনের পরাক্রমের প্রশংসা করিতে করিতে আপনাপন আবাসে প্রস্থান করিল। এই অবসরে দিব্যলক্ষণ-লক্ষিত অঙ্গরাজ কর্ণকে গর্ভজাত পুত্রবোধে ভোজদুহিতা কুন্তীর অন্তঃকরণে স্নেহের সঞ্চার হইতে লাগিল। কর্ণের সহায়তা লাভ করিয়া দুর্যোধনের অর্জুনভয় তিরোহিত হইল। ধনুর্বেদবো কর্ণও দুৰ্য্যোধনকে সান্ত্বনাবাক্যে আশ্বস্ত করিলেন। যুধিষ্ঠির কর্ণকে অদ্বিতীয় ধনুর্ধর বলিয়া স্থির করিলেন।