০৩৪. দশম অধ্যায় – বিভূতিযোগ

৩৪তম অধ্যায়

দশম অধ্যায় – বিভূতিযোগ

“ভগবান্‌ কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! তুমি আমার বাক্যশ্রবণে নিতান্ত প্রীত হইতেছে; এক্ষণে আমি তোমার হিতবাসনায় পুনরায় যে সমস্ত উৎকৃষ্ট বাক্য কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। মহর্ষি ও সুরগণও আমার প্রভাব অবগত নহেন; আমি সকল বিষয়েই তাঁহাদিগের আদি। যিনি আমাকে অনাদি, জন্মবিহীন ও সকল লোকের ঈশ্বর বলিয়া জানেন, তিনি জীবলোকে মোহবিরত ও পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া থাকেন। আমি বুদ্ধি, জ্ঞান, ব্যাকুলতা, ক্ষমা, সত্য, দম, শম, সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয়, অভয়, অহিংসা, সমতা, তুষ্টি, তপঃ, দান, যশঃ ও অযশ। আমা হইতেই প্রাণীগণের ভিন্ন ভিন্ন ভাব উৎপন্ন হইতেছে। পূর্ব্বতন সনকাদি চারিজন ও ভৃগু প্রভৃতি সাতজন মহর্ষি এবং মনুসকল [স্বায়ম্ভুবপ্রমুখ] আমারই প্রভাবসম্পন্ন ও আমারই মন হইতে সমুৎপন্ন হইয়াছেন। তাঁহারা এই লোক ও প্রজা সৃষ্টি করিয়াছেন। যিনি আমার এই বিভূতি ও সর্ব্বজ্ঞতাদি ঐশ্বর্য্য [সমস্ত জানিবার শক্তি] সম্যক্‌ বিদিত হইয়াছেন, তিনি সংশয়রহিত জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েন, সন্দেহ নাই। পণ্ডিতেরা আমাকে সকলের কারণ ও আমা হইতে সমস্ত প্রবর্ত্তিত জানিয়া প্রীতমনে আমার অর্চনা করেন। তাঁহারা আমাতে মনঃ ও প্রাণ সমর্পণ করিয়া আমাকে বিদিত হয়েন এবং আমার নাম কীর্ত্তন করিয়া একান্ত সন্তোষ ও পরম শান্তিলাভ করিয়া থাকেন। আমি অনুকম্পা প্রদর্শন করিবার নিমিত্ত তাঁহাদিগের বুদ্ধিবৃত্তিতে অবস্থিত হইয়া দীপ্তিশীল জ্ঞানপ্রদীপদ্বারা অজ্ঞানান্ধকার নিরাকরণ [দূর] করিয়া থাক।’

“অর্জ্জুন কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! ঋষিগণ, দেবর্ষি নারদ, অসিত, দেবল ও ব্যাসদেব তোমাকে পরম ব্রহ্ম, পরম ধাম, পরম পবিত্র, শাশ্বত, পুরুষ, দিব্য, আদিদেব ও জন্মবিহীন বলিয়া থাকেন এবং তুমিও আপনাকে ঐরূপ নির্দেশ করিলে। এক্ষণে তুমি যেরূপ কহিতেছ, আমি তদ্বিষয় অনুমাত্রও [অতি অল্প পরিমাণও] সন্দেহ করি না। দেব ও দানবগণ তোমাকে সম্যক্‌ অবগত নহেন; তুমি আপনিই আপনাকে বিদিত হইতেছ। হে দেবদেব! হে ভূতভাবন [প্রাণীগণের উৎপাদন কারক]! তুমি যে সমস্ত বিভূতিদ্বারা এই লোকসমুদয় ব্যাপ্ত করিয়া রহিয়াছ, এক্ষণে সেইসকল দিব্যবিভূতি সম্যক্‌রূপে কীর্ত্তন কর, আমি কিরূপে তোমাকে সতত চিন্তা করিয়া অবগত হইতে সমর্থ হইব এবং কোন্‌ কোন্‌ পদার্থেই বা তোমাকে চিন্তা করিব? এক্ষণে তুমি পুনরায় সবিস্তার আপনার ঐশ্বর্য্য ও বিভূতি কীর্ত্তন কর; তোমার এই অমৃতোপম বাক্য শ্রবণ করিয়া কিছুতেই আমার তৃপ্তিলাভ হইতেছে না।’

“বাসুদেব বলিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! আমার বিভূতির ইয়ত্তা নাই; অতএব প্রধান প্রধান বিভূতিসকল কীর্ত্তন করিতেছে, শ্রবণ কর। হে অর্জ্জুন! আত্মা ও সকল প্রাণীর অন্তঃকরণে অবস্থান করিতেছি। আমি সকলের আদি, মধ্য, ও অন্ত; আমি আদিত্যগণের মধ্যে বিষ্ণু, জ্যোতির্ম্মণ্ডলীর মধ্যে সমুজ্জ্বল সূর্য্য, মরুদ্‌গণের মধ্যে মরীচি ও নক্ষত্রগণের মধ্যে চন্দ্র। আমি বেদের মধ্যে সাম, দেবগণের মধ্যে ইন্দ্র। ইন্দ্রিয়সমুদয়ের মধ্যে মন ও ভূতগণের মধ্যে চৈতন্য। আমি রুদ্রগণের মধ্যে শঙ্কর, যক্ষরাক্ষসের মধ্যে কুবের, বসুগণের মধ্যে পাবক, পর্ব্বতের মধ্যে সুমেরু, পুরোহিতগণের মধ্যে সর্ব্বপ্রধান বৃহস্পতি, সেনানীদিগের মধ্যে কার্ত্তিকেয় জলাশয়সকলের মধ্যে সাগর। আমি মহর্ষিগণের মধ্যে ভৃগু, বাক্যসকলের মধ্যে ওঁকার, যজ্ঞসমুদয়ের মধ্যে জপযজ্ঞ, স্থাবরগণের মধ্যে হিমালয়, বৃক্ষসমূহের মধ্যে অশ্বত্থ, দেবর্ষিগণের মধ্যে নারদ, গন্ধর্ব্বগণের মধ্যে চিত্ররথ ও সিদ্ধসমুদয়ের মধ্যে মহামুনি কপিল। আমি অশ্বগণমধ্যে অমৃতমন্থনোদ্ভূত [অমৃতমন্থনকালে সমুদ্র হইতে উত্থিত] উচ্চৈঃশ্রবা, মাতঙ্গমধ্যে ঐরাবত, মনুষ্যমধ্যে রাজা, আয়ুধমধ্যে বজ্র ও ধেনুগণমধ্যে কামধেনু। আমি উৎপত্তিহেতু কন্দর্প [কাম], সবিষ ভুজঙ্গগণের মধ্যে বাসুকি, নির্বিষ ভুজঙ্গগণের মধ্যে অনন্ত, জলচরসকলের মধ্যে বরুণ, পিতৃগণের মধ্যে অর্য্যমা, নিয়ামকদিগের [শাসনদ্বারা সপথে প্রবর্ত্তক] মধ্যে যম ও দৈত্যগণের মধ্যে প্রহ্লাদ। আমি গণনাকারীদিগের মধ্যে কাল, মৃগগণের মধ্যে মৃগেন্দ্র [সিংহ] পক্ষিমধ্যে বৈনতেয়, বেগবানদিগের মধ্যে পবন, শস্ত্রধারীদিগের মধ্যে দাশরথি রাম, মৎস্যগণমধ্যে মকর ও স্রোতস্বতীর [নদীর] মধ্যে জাহ্নবী। আমি সৃষ্টপদার্থ সকলের আদি, অন্ত ও মধ্য, বিদ্যাসকলের মধ্যে আত্মবিদ্যা, বাদিগণের বাদ, অক্ষরসকলের মধ্যে আকার, সমাসমধ্যে দ্বন্দ্ব। আমি অনন্ত কাল, সর্ব্বতোমুখ [সকল দিকেই মুখবিশিষ্ট—সর্ব্বত্র অস্তিত্বসম্পন্ন] বিধাতা, সর্ব্বসংহারক মৃত্যু ও অদ্ভুদয়লাভের যোগ্য প্রাণীদিগের অদ্ভুদয় [মঙ্গল]। আমি নারীগণমধ্যে কীর্ত্তি, শ্রী, বাক্‌ [বাক্য], স্মৃতি, মেধা, ধৃতি ও ক্ষমা। আমি সামবেদের মধ্যে বৃহৎ সাম, ছন্দের মধ্যে গায়ত্রী, মাসের মধ্যে মার্গশীর্ষ [অগ্রহায়ণ], ঋতুর মধ্যে বসন্ত, প্রভারকদিগের দ্যূত ও তেজস্বীদিগের তেজঃ। আমি জয়, ব্যবসায় ও সত্ত্ববানদিগের সত্ত্ব। আমি বৃষ্ণিবংশীয়দিগের মধ্যে বাসুদেব, পাণ্ডবমধ্যে ধনঞ্জয়, মুনিদিগের ব্যাস ও কবিগণের মধ্যে শুক্র। আমি শাসনকর্ত্তাদিগের দণ্ড, জয়াভিলাষীদিগের নীতি, গোপ্য বিষয়ের মধ্যে মৌনভাব, জ্ঞানবান্‌দিগের জ্ঞান ও সকল ভূতের বীজ। হে অর্জ্জুন! এই চরাচর ভূত আমা হইতে স্বতন্ত্র নহে; সুতরাং আমি দিব্যবিভূতির ইয়ত্তা নাই। হে পার্থ! আমি সংক্ষেপে এই বিভূতিবিস্তার [ঐশ্বর্য্যের বিস্তৃত বৃত্তান্ত] কীর্ত্তন করিলাম; বস্তুতঃ যে যে বস্তু ঐশ্বর্য্যযুক্ত ও প্রভাববলসম্পন্ন, সেই সমস্তই আমার প্রভাবের অংশদ্বারা সম্ভূত হইয়াছে। হে অর্জ্জুন! আমি একাংশদ্বারা বিশ্বসংসারে ব্যাপ্ত হইয়া অবস্থান করিতেছি; অতএব এক্ষণে আমার বিভূতির বিষয় পৃথকরূপে জানিবার প্রয়োজন নাই।’ “