১২২. শ্বেতকেতু-সংবাদ । পুত্রোৎপাদনে কুন্তীর সম্মতি

দ্বাবিংশত্যাধিকশততম অধ্যায়
শ্বেতকেতু-সংবাদ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, কুন্তী ধর্ম্মজ্ঞ পাণ্ডুকে বুষ্যিবাশ্ব-বৃতান্ত শ্রবণ করাইলে তিনি ধর্ম্মযুক্ত বাক্যে তাঁহাকে সন্তনা করিয়া কহিলেন, হে কুন্তী! তুমি যাহা কহিলে, তাহা যথার্থ বটে, রাজা বুষ্যিতাশ্ব দেবতুল্য মনুষ্য ছিলেন; তাঁহাতে সকলই সম্ভবে; তাদৃশ অসম্ভব কার্য্যমাদৃশ লোক হইতে হওয়া অতীব দুরঘট। ধর্ম্মবিৎ মহাত্মা মহর্ষিগণ যাআ প্রদর্শন করিয়া গিয়াছেন, শ্রবণ কর। হে বরাননে! হে চারুহাসিনি! পূর্ব্বকালে মহিলাগণ অনাবৃত ছিল। তাহারা ইচ্ছা মত গমন ও বিহার করিতে পারিত। তাহাদিগের কাআরও অধীনতায় কালক্ষেপ করিতে হইত না। কৌমারাবধি(কৌমারকাল হইতে) এক পুরুষ হইতে পুরুষান্তরে আসক্ত হওলেও তাহাদের শধর্ম্ম হইত না। ফলতঃ তৎকালে ঈদৃশ ব্যবহার ধর্ম্ম বলিয়া প্রচলিত ছিল। তির্য্যগযোনিগত কামদ্বেষবিবজ্জিত প্রজাগন(পশুপক্ষী প্রভৃতি) অদ্যাপি ঐ ধর্ম্মানুসারে কার্য্য করিয়া থাকে। তপঃস্বাধ্যায়সম্পন্ন মহষিগণ এই পরামানিক ধর্ম্মের প্রশংসা করিয়া থাকেন। উত্তর কুরুতে অদ্যাপি এই ধর্ম্ম প্রচলিত রহিয়াছে। হে চারিহাসিনি! এই অঙ্গনানুকূল নিত্যধর্ম্ম যে নিমিত্ত এই প্রদেশে রহিত হইয়াছ, তদ্বিষয়ে সবিশেষ বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ কর।
পূর্ব্বকালে উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন। তাহার পুৎত্রের নাম শ্বেতকেতু। একদা তিনি পিতামাতার নিকট সবিয়া আছেন, এমন সময় এক ব্রাহ্মণ আসিয়া তাঁহার জননীর হস্তধারণপূর্ব্বক কহিলেন, ‘আইস, আমরা যাই।’ ঋষিপুৎত্র পিতার সমক্ষেই মাতাকে বলপূর্ব্বক লইয়া যাইতে দেখিয়া সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইলেন। মহষি ইদ্দালক পুৎত্রকে তদবস্ত দেখিয়া কহিলেন, ‘বৎস! ক্রোধ করিও না; ইহা নিত্যধর্ম্ম। গাভীগণের ন্যায় স্ত্রীগণ সজাতীয় শত সহস্র পুরুষে আসক্ত হ্‌ইলেও উহারা অধর্ম্মলিপ্ত হয় না। ঋষিপুৎত্র পিতার বাক্য শ্রবণ করিয়াও ক্ষান্ত হইলেন না, প্রত্যুত পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া মনুষ্যমধ্যে বলপূর্ব্বক এই নিয়ম স্থাপন করিয়া দিলেন যে, ‘অদ্যাবধি যে স্ত্রী পতি ভিন্ন পুরুষান্তর-সংসর্গ করিবে এবং যে পুরুষ কৌমারব্রহ্মচারিণী বা পতিব্রতা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য স্ত্রীতে আসক্ত হইবে, ইহাদের উভয়কেই ভ্রূণহত্যাসাদৃশ ঘোরতর পাপপঙ্কে লিপ্ত হইতে হইবে। আর স্বামী পুৎত্রোপাদনার্থ নিয়োগ করিলে যে স্ত্রী তাঁহার আজ্ঞা লঙ্ঘন করিবে, তাহারই ঐ পাপ হইবে।’ হে ভীরি! পূর্ব্বকালে উদ্দালকপুৎত্র শ্বেতকেতু এই প্রকার ধর্ম্মানপেত (ধর্ম্মসম্মত) নিয়ম স্থাপন করিয়া গিয়াছেন। আরও দেখ, কল্মাষপাদ রাজার পত্নী মদয়ন্তী ভর্ত্তৃনিয়োগ প্রাপ্ত হইয়া মহর্ষি বশিষ্ঠদেবের নিকট গমনপূর্ব্বক পতির প্রিয় কামনায় তাঁহার ঔরসে অশ্মকনামা পুৎত্র উৎপাদন করয়িাছিলেন। হে কমললোচনে! মহর্ষি বেদব্যাস কুরুবংশ-রক্ষার্থ আমার পতির ক্ষেত্রে যে আমাদিগকে উৎপাদন করিয়াছেন, তুমি তাহাও অবগত আছ; অতএব হে অনিন্দিতে! তুমি এই সমস্ত বিবেচনা করিয়া আমার বাক্য প্রতিপালন কর। হে রাজপুৎত্রি! বেদবিৎ মহাত্মারা কহিয়া গিয়াছেন যে, ঋতুকালে পতি-পরিত্যাগপূর্ব্বক পুরুষান্তর-সংসর্গ করিলেই স্ত্রীদিগের অধর্ম্ম হয়, কিন্তু অন্য সময়ে তাহারা যথেচ্ছ ব্যবহার করিতে পারে, তাহাতে তাদের কোন পাপ নাই। তাঁহারা আরও কহিয়া গিয়াছেন যে, ভর্ত্তা স্ত্রীকে যাহা আজ্ঞা করিবেন ধর্ম্মই হউক বা অধর্ম্মই হউক, নারীকে তাহা অবশ্যই প্রতিপালন করিতে হইবে; অতএব আমার আজ্ঞা লঙ্ঘন করা তোমার কদাচ কর্ত্তব্য নহে। বিশেষতঃ আমি পুৎত্রমুখদর্শনে নিতান্ত উৎসুক হইয়াছি; কিন্তু স্বয়ং সন্তানোৎপাদনে অসমর্থ; হে সুন্দরি! এজন্য আমি কৃতাঞ্জলিপুটে তোমাকে কহিতেছি, তুমি প্রসন্ন হইয়া তপঃস্বাধ্যায়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ হইতে অশেষ-গুণসম্পন্ন পুৎত্রগণ উৎপাদন করিয়া লও, তাহা হইলে আমি পুৎত্রবানদিগের উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিতে পারিব।

পুৎত্রোৎপাদনে কুন্তীর সম্মতি

পাণ্ডু আগ্রহসহকারে এইরূপে বুঝাইলে পতিহিতৈষিণী কুন্তী তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে মহারাজ! আমি বাল্যবস্থায় পিতৃগৃহে অতিথিসৎকারে নিযুক্ত ছিলাম এবং শংসিতব্রত ব্রাহ্মণগণের সতত পরিচর্য্যা করতাম। দৈবযোগে একদিন পরমধার্ম্মিক জিতেন্দ্রিয় মহর্ষি দুর্ব্বাসা তথায় আগমন করিয়া আতিথ্য স্বীকার করেন। আমি সাতিশয় যত্নসহকারে ও পরমসমাদরপূর্ব্বক তাঁহার পরিচর্য্যা করিলাম। মহর্ষি আমার ভক্তি দেখিয়া কহিলেন, ‘বৎসে! আমি তোমার পরিচয্যায় পরম পরিতুষ্ট হইয়াছি, এক্ষণে তোমাকে এক মহামন্ত্র প্রদান করিতেছে, গ্রহণ কর। তুমি এই মন্ত্র উচ্চারণপূর্ব্বক যে যে দেবকে আহ্বান করিবে, তিনি অকামই হউন বা সকামই্ হউন,তাৎক্ষণাৎ আসিয়া তোমার বশবর্তী হইবেন; তুমিও সেই সেই অমরপ্রসাদে পুৎত্রবতী হইবে।’ মহর্ষি এই বলিয়া আমাকে বর ও মন্ত্র প্রদানপূর্ব্বক অন্তর্হিত হইলেন। হে নাথ! ব্রাহ্মণের বাক্য অব্যর্থ; দেখুন, উক্ত মন্ত্র প্রয়োগের সময় উপস্থিত হইয়াছে; এক্ষণে আদেশ করুন, মন্ত্রপাঠ করিয়া কোন্ দেবের আহ্বান করিব? হে রাজর্ষে! আমি তোমার আদেশ প্রতীক্ষা করিতেছি, অনুমতি পাইলেই আপনার অভিলষিত সন্তান উৎপাদন করি।”
রাজর্ষি পাণ্ডু কুন্তীবাক্য-শ্রবণে সাতিশয় আহ্লাদিত হইয়া কহিলেন, “সুন্দরি! দেবতাদিগের মধ্যে ধর্ম্ম সর্ব্বাপেক্ষা শ‌্রেষ্ঠ, লোকমধ্যে তিনিই প্রকৃত পুণ্যভাজন, তাঁহাকেই আহ্বান কর। আমদের ধর্ম্ম কোনরূপে অধর্ম্মের সহিত সংযুক্ত না হয়, লোকে ইহাই ধর্ম্ম বলিয়া স্বীকার করে। ধর্ম্মদত্ত পুৎত্র অবশ্যই ধার্ম্মিক হইবে সন্দেহ নাই, তাহার মন কদাচ অধর্ম্মে প্রবৃত্ত হইবে না, অতএব ধর্ম্মপুরস্কারেই কর্ম্ম করা আমাদের কর্ত্তব্য; তুমি পরমসমাদরপূর্ব্বক সর্ব্বদেবাগ্রগণ্য ধর্ম্মকে আহ্বান করিয়া তাঁহার দ্বারা পুৎত্রোৎপাদন কর।” পতিপরায়ণা কুন্তী ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া স্বামীর অনুমতি গ্রহণপূর্ব্বক তৎক্ষণাৎ তাঁহার অভিলাষিত কার্যসাধনে যত্নবতী হইলেন।