১২০. পাণ্ডুর ব্রহ্মলোকযাত্রা

বিংশত্যধিকশততম অধ্যায়
পাণ্ডুর ব্রহ্মলোকযাত্রা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহাত্মা পাণ্ডু শুশ্রূষু, অনহঙ্কৃত, সংযতাত্মা ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া সেই শতশৃঙ্গপর্ব্বতে কঠোর তপস্যা করিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি সিদ্ধচারণগণের প্রিয়পাত্র ও তপোবলে সশীরীরে স্বর্গে গমন করিতে সমর্থ হইলেন। শতশৃঙ্গবাসী সিদ্ধাচারণগণ কেহ তাঁহাকে পরম সুহৃৎ,কেহ বা সহোদর ভ্রাতা, কেহ বা পুৎত্র বলিয়া জ্ঞান করিতেন। পাণ্ডু এইরূপে তথায় বহুকাল তপোনুষ্ঠান করিলেন, তপস্যা দ্বারা তাঁহার সমস্ত পাপ বিনষ্ট হইল এবং তিনি মহাপ্রভাশালী ব্রহ্মর্ষির তুল্য হইয়া উঠিলেন।
একদা শতশৃঙ্গবাসী শংসিতব্রত মহর্ষিগণ একত্র হইয়া ভগবান ব্রহ্মাকে দর্শন করিবার নিমিত্ত ব্রহ্মলোকে গমন করিতেছিলেন, এমত সময়ে পাণ্ডু তাঁহাদিগের নিকট গিয়া কহিলেন, ”মহাশয়গণ! কোথায় গমন করিতেছেন?” মহর্ষিগণ কহিলেন, ‘অদ্য অমাবস্যা, ব্রহ্মলোকে দেবগণ, ঋষিগণ ও পিতৃগণের মহান্ সমবায় হইবে; আমরা সর্ব্বলোক-পিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মাকে দর্শন করিতে তথায় যাইতেছি।” পাণ্ডু মহর্ষিগণের বাক্য শ্রবণ করিবামাত্র তাঁহাদের সহিত স্বর্গোপরি গমন করিবার নিমিত্ত সাতিশয় কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া সহসা গাত্রোত্থানপূর্ব্বক পত্নীদ্বয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া তাঁহাদের সহিত উত্তরমুখে গমন করিতে লাগিলেন।
মহর্ষিগণ পাণ্ডুকে সুরলোকে গমনোম্মুখ দেখিয়া কহিলেন, ”হে মহাত্মন! আমরা এই পর্ব্বতের উপর্য্যুপরি ক্রমিক উত্তরমুখে গমন করিয়া দেখিয়াছি ইহার কোন কোন স্থানে অনেকানেক দুর্গ ও দেশসকল শোভা পাইতেছে। কোন কোন স্থলে দেবতা, গন্ধর্ব্ব ও অপ্সরাদিগের বিহারভূমি আছে, কোথাও বা শত শত বিমান সংস্থাপিত রহিয়াছে; কোন কোন স্থলে সংগীতশাস্ত্রবিশারদ গায়কগণ নিরন্তর বীণা, সপ্তস্বরা, মৃদঙ্গ প্রভৃতি মধুর যন্ত্রসকল সংবাদনপূর্ব্বক গান করিতেছেন; কোথাও কুবেরোদ্যান, কোথাও মহানদী, কোথাও বা গিরিগহ্বর সকল বিরাজমান রহিয়াছে। এই পর্ব্বতে স্থানে স্থানে দুর্গম গিরিগহ্বর, স্থানে স্থানে বহুসংখ্যক দুর্গ আ্ছে। মধ্যে মধ্যে এমত অনেকানেক প্রদেশ আছে– যাহাতে পশু, পক্ষী, বৃক্ষ, লতা প্রভৃতি কিছুই নাই। হে ভরতকুলপ্রদীপ! এই সকল ভয়ানক প্রদেশে অন্যান্য জন্তুর কথা দূরে থাকুক, পক্ষীও যাইতে পারে না। কেবল বায়ু ও সিদ্ধমহর্ষিগণই গমনাগমন করেন। এই সুকুমারাঙ্গী অদুঃখোচিতা রাজপুৎত্রীরা কি প্রকারে এই দুর্গম পর্ব্বত অতিক্রম করিবেন? হে মহাত্মান! নিবৃত্ত হও, আমাদিগের সহিত গমন করিও না।”

অপুৎত্রক পাণ্ডুর খেদ

পাণ্ডু মহর্ষিগণের বাক্য-শ্রবণে তাঁহাদিগের অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, ”হে মহাভাগগণ! অপত্যবিহীন লোকের স্বর্গে অধিকার নাই; আমি অনপত্য, পিতৃলোকের ঋণ হইতে মুক্ত হইতে পারি নাই, এ নিমিত্ত আমার মন সর্ব্বদা দুঃখানলে দগ্ধ হইতেছে; আমার জীবন বিড়ম্বনামাত্র। মনুষ্য জন্মিবামাত্র দেবঋণ,ঋষিঋণ, পিতৃঋণ ও মনুজঋণ, এই চতুর্ব্বিধ ঋণে ঋণবান্ হয়। এই সমস্ত ঋণ যথাকালে পরিশোধ করা কর্তব্য। যজ্ঞ দ্বারা দেবঋণ হইতে, বেদাধ্যয়ন ও তপস্যা দ্বারা ঋষিঋণ হইতে, পুৎত্রোৎপাদন ও শ্রাদ্ধতর্পণাদি দ্বারা পিতৃঋণ হইতে এবং অনৃশংসাচরণ দ্বারা মনুজঋণ হইতে বিনির্ম্মুক্ত হয়। যে ব্যক্তি এই সকল ঋণ পরিশোধ করিতে অসম্মত হয়, তাহার সদ্‌গতিলাভ হয় না। হে তাপসগণ! আমি দেবঋণ, ঋষিঋণ ও মনুজঋণ পরিশোধ করিয়াছি, কিন্তু পিতৃঋণ হইতে অদ্যাপি মুক্ত হইতে পারি নাই। অতএব জিজ্ঞাসা করি, মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন যেরূপে আমার পিতার ক্ষেত্রে আমাকে উৎপাদন করিয়াছেন, সেইরূপে আমার ক্ষেত্রে কি অপত্য উৎপাদনের কোন উপায় আছে?” তাপসগণ কহিলেন, ”হে ধর্ম্মাত্মান! আমরা দিব্যচক্ষু দ্বারা দেখিতেছি, তোমার দেবতুল্য পরম সুন্দর পুৎত্র হইবে। তুমি পুৎত্রলাভার্থ প্রযত্ন কর; অবশ্যই তোমার ক্ষেত্রে অশেষ-গুণসম্পন্ন অপত্য জন্মিবে।’

পুৎত্রার্থ কুন্তীর প্রতি পাণ্ডুর আদেশ

পাণ্ডু তাপসগণের বাক্য-শ্রবণান্তর অপতোৎপাদনশক্তির বিনাশকর মৃগশাপ স্মরণ করিয়া সাতিশয় ব্যাকিল হইলেন। অনন্তর যশস্বিনী ধর্ম্মপত্নী কুন্তীকে নির্জ্জনে ডাকিয়া কহিলেন, “হে কুন্তি! তুমি এই আপৎকালে অপতিৎপাদনে যত্নবতী হও। ধর্ম্মবাদী পণ্ডিতগণ কহিয়াছেন, অপত্য বংশের প্রতিষ্ঠা; কি দান, কি তপঃ, কি বিনয়, অনপত্য ব্যক্তির কিছুই সফল হয় না। আমি সন্তানবিহীন, আমার শুভলোক-প্রাপ্তি হইবার কোন সম্ভাবনা নাই। হে চারুহাসিনি! তুমি জ্ঞাত আছ যে, মৃগসাপে আমার পুৎত্রোৎপাদন-শক্তি প্রনষ্ট হইয়াছে, সুতরাং অন্য উপায় দ্বারা অপতোৎপাদনের যত্ন করিতে হইবে। হে পৃথে! ধর্ম্মশাস্ত্রমতে ছয় প্রকার বন্ধুদায়াদ [ধনাধিকারী] ও ছয় প্রকার অবন্ধুদায়াদ পুৎত্র আছে; স্বয়ংজাত, প্রণীত [ক্ষেত্রজ–ব্রাহ্মণের অনুগ্রহে তাঁহার ঔরসে জাত],পরিক্রীত [জননমূলাদানে উৎপাদিত], পৌনর্ভব [পুনর্বিবাহিত পত্নীর গর্ভজাত–প্রথম বিবাহিতের পুৎত্র], কানীন [কন্যাকালে–বিবাহের পূর্ব্বে উৎপন্ন]. স্বৈরিণীজ [বিবাহিত দ্বিচারণীর পুৎত্র], দত্ত, ক্রীত, কৃত্রিম বা স্বয়মুপাগত, সহোঢ় [সগর্ভ–বিবাহিতার পুৎত্র], জ্ঞাতিরেতাৎ এবং হীনযোনিধৃত এই দ্বাদশ প্রকার পুৎত্র। ইহার মধ্যে স্ববংজাতাভাবে প্রণীত, তদভাবে পরিক্রীত, তদভাবে পৌনর্ভব, ইত্যাদিক্রমে পূর্ব্ব পূর্ব্ব প্রকারের অভাবে পর পর প্রকার স্বীকার করা শাস্ত্রসম্মত। এতদ্ভিন্ন আপৎকাল উপস্থিত হইলে দেবর দ্বারাও পূৎত্র উৎপাদন করিয়া লইতে পারা যায়। আর স্বয়ম্ভুব মনু কহিয়াছেন, ঔরসপূত্র অপেক্ষা প্রণীত পূৎত্র শ্রেষ্ঠ ও ধর্ম্মফলদ। হে কুন্তি! আমি স্বয়ং পুৎত্রোপাদনে অসমর্থ; অতএব তোমাকে তুল্যজাতি বা অপেক্ষাকৃত শ্রেষ্ঠজাতি দ্বারা পূৎত্রোৎপাদন করিতে অনুজ্ঞা করিতেছি। দেখ, পূর্ব্বে শরদণ্ডায়ন স্বীয় পত্নীকে পুৎত্রোৎপাদনে নিযুক্ত করিয়া ছিলেন। তাঁহার পত্নী শারদাণ্ডায়নী স্নান সমাপন করিয়া বিচিত্র পুষ্পমাল্য ধারণপূর্ব্বক রজনীযোগে চতুষ্পথে উপস্থিত হইলেন। তথায় এক সিদ্ধ দ্বিজবরকে বরণপুরঃসর অনলে পুংসবন হোম সম্পাদন করিলেন। হোমক্রিয়া সমাপ্ত হইলে ঐ বৃত ব্রাহ্মণ দ্বারা দুর্জ্জয়াদি মহাবলপরাক্রান্ত মহারথ পুৎত্রত্রয় উৎপাদন করিয়া লইলেন। হে কল্যাণি! তুমিও আমার নিয়োগানুসারে তপঃস্বাধ্যায়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ হইতে শীঘ্র অপতোৎপাদন করিতে যত্নবতী হও।”