১১৮. পাণ্ডুর প্রতি মৃগরূপী মুনির সাপ

অষ্টাদশাধিকশততম অধ্যায়
পাণ্ডুর প্রতি মৃগরূপী মুনির সাপ

জনমেজয় কহিলেন, হে তপোধন! ব্যাসবরজনিত ধৃতরাষ্ট্র সন্তানগণের জন্ম ও তাহাদের প্রত্যেকের নাম আনুপূর্ব্বিক আপনার নিকট শ্রবণ করিলাম। এক্ষণে পাণ্ডবদিগের জন্মবৃত্তান্ত কীর্ত্তন করুন। আপনি দেবগণের অংশাবতরণ-বর্ণসময়ে কহিয়াছেন যে, ইন্দ্রসম পরাক্রান্ত মহাত্মা পাণ্ডবগণ দেব-অংশে জন্মগ্রহণ করেন, এক্ষণে সেই মহাত্মাদিগের জন্মবৃত্তান্ত সবিশেষ কীর্ত্তন করিয়া আমার অভিলাষ পূর্ণ করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! শ্রবণ করুন। একদা মৃগয়াবিহারী মহীপাল পাণ্ডু মৃগব্যালসেবিত মহারণ্যমধ্যে ভ্রমণ করিতেছিলেন, এমত সময়ে দেখিতে পাইলেন, একমৃগযূথপতি তথায় মৃগীর সহিত ক্রীড়ারসে ব্যাপৃত রহিয়াছে। তিনি মৃগ ও মৃগকে একবারে প্রমত্ত দেখিয়া তাহাদের উপর উপর্য্যুপরি পাঁচ বাণ নিক্ষেপ করিলেন। মহারাজ! ঐ মৃগ প্রকৃত মৃগ নহে, মহাতেজাঃ এক ঋষিপুৎত্র; ঋষিতনয় ভার্য্যার সহিত মৃগরূপ পরিগ্রহ করিয়া পরমসুখে ক্রীড়া করিতেছিলেন, পাণ্ডুর বজ্রসম শরাঘাতে ব্যাকুলেন্দিয় হইয়া তৎক্ষণাৎ ধরাতলে পতিত হইলেন এবং আর্ত্তনাদসহকারে নানা বিলাপ করিয়া পাণ্ডুকে কহিলেন, ”মহারাজ! যাহারা নিতান্ত কামক্রোধপরতন্ত্র, অত্যন্ত নির্ব্বোধ ও একান্ত পাপাসক্ত, তাহারাও ঈদৃশ বিষয় নৃশংসাচরণে পরাঙ্মুখ হয়, তুমি পরম ধর্ম্মাত্মাদিগের অকলঙ্ক কুলে জন্মগ্রহণ করিয়া এই দুষ্কর্ম্ম করিলে! রাজন! তর্কবাদ দ্বারা বিধির নাশ হয় না, কিন্তু বিধির দ্বারা তর্কবাদ নষ্ট হইবা থাকে, অতএব বিধিবিরুদ্ধ কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা ভবাদৃশ প্রজ্ঞলোকের কর্ত্তব্য নহে।” পাণ্ডু কহিলেন, ”রাজাদিগের শত্রুবধ যেমন কর্ত্তব্য, মৃগবধও সেইরূপ কর্ত্তব্য; প্রচ্ছন্ন বা প্রকাশ্যই হউক, মৃগ পাইলেই বধ করিবে! দেখ, মহর্ষি আগস্ত্য যজ্ঞানুষ্ঠানজন্য মৃগয়া করিয়াছিলেন। মৃগবসা দ্বারা তাঁহার হোমকার্য্য নির্ব্বাহ হইয়াছিল, অতএব আমাকে আর বৃথা তিরস্কার করিও না।” মৃগ হইল, রাজন! যাহা কহিলেন, যথার্থ বটে, কিন্তু ব্যসনসময়ে শত্রুর উপর শর-নিক্ষেপ করা প্রজ্ঞালোকের কর্ত্তব্য নহে; ন্যয়যুদ্ধেই শত্রুবধ করিবার বিধি প্রদান করিয়াছেন।’ পাণ্ডু কহিলেন, ”মত্ত, ভূত, বা পলায়িত শত্রুকে বধ করাই অবিধেয়, কিন্তু ভবাদৃশ মৃগ বধ করা কোনক্রমেই অবিধেয় নহে।” মৃগ কহিল, ”মহারাজ! তুমি আমাকে যে মৃগভ্রমে বধ করিয়াছ, তাহাতে তোমাকে দোষ দিতে পারি না, কিন্তু আমার বিহার-বিরতিকাল প্রতিক্ষা করা তোমার অবশ্যই উচিত ছিল। কোন ভদ্রলোক অসময়ে ইন্দ্রিয়াসক্ত মৃগকে বধ করিয়াছে? হে রাজেন্দ্র! আমি পুরুষার্থফললিপ্সু [পুৎত্রকামী] হইয়া এই মৃগীতে আসক্ত হইয়াছিলাম, তুমি আমাকে তদ্বিষয়ে নিতান্ত নিরাশ ও একান্ত বঞ্চিত করিলে, মহারাজ! তুমি অনিন্দ্যকর্ম্মা পৌরবদিগের নির্ম্মল কুলে জন্মিয়াছ, তোমার এতাদৃশ নৃশংস, লোকবিগর্হিত, অস্বর্গ্য [স্বর্গবিরধী], অযশস্কর, অধর্ম্মিষ্ঠ, কর্ম্ম করা কোনক্রমেই সঙ্গত ও উচিত হয় নাই। তুমি শাস্ত্রজ্ঞ ধর্ম্মার্থতত্ত্বজ্ঞ ও রতিকোবিদ[কামকলানিপুণ]; তোমার ঈদৃশ দুষ্কর্ম্ম করা অত্যন্ত অবিধেয় হইয়াছে। হে পার্থিবেন্দ্র! নৃশংসাচারী পাপপরায়ণ ধর্ম্মার্থকামবিহীন দুরাচারগণের দণ্ডবিধান করা তোমার কর্ত্তব্য, তাহা না করিয়া এই অসদনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়া স্বয়ংই দণ্ডার্হ হইলে। হে নরনাথ! আমি ফলমুলাহারী অরণ্যবাসী নিরপরাধ মুনি, মৃগবেশ ধারণ করিয়া বিহার করিতেছিলাম, আমাকে মারিয়া তুমি কি দুষ্কর্ম্ম করিলে! হে রাজন! তুমি যেমন আমাকে ভার্য্যার সহিত অপবিত্র সময়ে বধ করিলে, আমি শাপ দিতেছি, তোমারও ঈদৃশ অপবিত্র সময়ে মৃত্যু হইবে। আমি তপোনিরত মুনি, আমার নাম কিন্দম, আমি লোকলজ্জাভয়ে মৃগরূপধারণপূর্ব্বক গহন বনে আসিয়া এই মৃগীতে আসক্ত হইয়াছিলাম, তুমি আমাকে ব্রাহ্মণ বলিয়া জানিতে পার নাই। মৃগভ্রমেই আমার উপর শরনিক্ষেপ করিয়াছ, এ নিমিত্ত তোমার ব্রহ্মহত্যার পাপ হইবে না, কিন্তু সঙ্গমসময়ে আমাকে বধ করাতে তোমার যে পাপ হইয়াছে, তাহার ফল অবশ্যই তোমাকে ভোগ করিতে হইবে। তুমি যে সময়ে স্ত্রীসংসর্গ করিবে, সেই সময়ে তোমার মৃত্যু হইবে। তুমি যে পত্নীর সইত সংসর্গ করিয়া কালগ্রাসে পতিত হইবে, তিনি ভক্তিভাবে তোমার সহগামিনী হইবেন। হে রাজন! তুমি যেমন সুখের সময়ে আমাকে দুঃখ দিলে, সেইরূপ তোমাকেও সুখকালে দুঃখ পাইতে হইবে।
হে কুরুবংশাবতংস জনমেজয়! মৃগরূপধারী মুনি পাণ্ডুকে এই প্রকার শাপ প্রদান করিয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। নরপতি পাণ্ডু তদ্দর্শনে সাতিশয় দুঃখিত হইলেন।