১১৫. গান্ধারীর দুর্য্যোধনাদি শতপুৎত্র-প্রসব। দুর্য্যোধনের জন্মকালীন অশুভ লক্ষণ

পঞ্চদশাধিকশততম অধ্যায়
গান্ধারীর দুর্য্যোধনাদি শতপুৎত্র-প্রসব

বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর ধৃতরাষ্ট্রের গান্ধারীগর্ভে শত পুৎত্র ও বৈশ্যাপত্নীর গর্ভে এক পুৎত্র জন্মে এবং ধর্ম্ম প্রভৃতি পঞ্চদেব হইতে কুন্তী ও মাদ্রীর গর্ভে পাণ্ডুর মহারথপঞ্চপুৎত্র জন্মগ্রহণ করেন, তাঁহাদের হইতে এই কুরুবংশ রক্ষা পাইতেছে। জনমেজয় কহিলেন, হে দ্বিজোত্তম! গান্ধারীর গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের শত পুৎত্র কিরূপে জন্মিল ও কতদিন পরেই বা তাহাদের আয়ুঃশেষ হইল? আর বৈশ্যার গর্ভে বা ধৃতরাষ্ট্র কিরূপে পুৎত্রোৎপাদন করিলেন? তিনি অনুকূলকারিণী ধর্ম্মচারিণী প্রণয়িনী গান্ধারীর সহিত কিরূপ ব্যবহার করিতেন এবং দেবগণ হইতে কিরূপে শাপগ্রস্ত মহাত্মা পাণ্ডুর পাঁচ পুৎত্র উৎপন্ন হইল, এই সমস্ত আনুপূর্ব্বিক বর্ণন করিয়া আমার অপরিতৃপ্ত চিত্তকে পতিতৃপ্ত করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, একদা মহর্ষিদ্বৈপায়ন সাতিশয় ক্ষুৎপিপাসায় শ্রমান্বিত হইয়া ধৃতরাষ্ট্রের ভবনে সমুপস্থিত হইলে, গান্ধারী পরম-সমাদরে তাঁহার শুশ্রূষা করিলেন। মহর্ষি সেবায় সন্তুষ্ট হইয়া বর প্রদান করিতে চাইলে গান্ধারী কহিলেন, ”যদি অনুকূল হইয়া থাকেন, তবে এই বর প্রদান করুন যে, যেন আমার গর্ভে আমার ভর্ত্তার সমানগুণশালী শত পূৎত্র জন্মে।” ব্যাস ‘তথাস্তু’ বলিয়া প্রস্থান করিলেন। কিয়দ্দিনানন্তর ধৃতরাষ্ট্রের সহযোগে গান্ধারী গর্ভবতী হইলেন। তাঁহার গর্ভধারণের পর দুই বৎসর অতীত হইল, তথাপি তিনি সন্তান প্রসব করিলেন না। একদিন গান্ধারী শুনিলেন যে, কুন্তীর বালসূর্য্য-সমপ্রভ এক পুৎত্র জন্মিয়াছে। তৎশ্রবণে তিনি সাতিশয় ঈর্ষান্বিতা হইয়া ধৃতরাষ্ট্রের অজ্ঞাতসারে আপনার গর্ভপাত করিলেন। ঐ গর্ভে সংহতা [নিবিড়-দুর্ভেদ্য] লোহষ্ঠিলার[লৌহপিণ্ড-লোহার গোলক] ন্যায় এক দ্বিবর্ষ-সম্ভৃতা [দুই বৎসর যাবৎ ধৃত বা পোষিত] মাংসপিণ্ড ভুমিষ্ঠ হইল। গান্ধারী তদ্দর্শনে সাতিশয় দুঃখিত হইয়া সেই মাংসপেশী পরিত্যাগ করার উপক্রম করিতেছেন, এমন সময় ভগবান ব্যাস তথায় উপস্থিত হইয়া মাংসপেশী দর্শনপূ্ব্বক গান্ধারীকে কহিলেন, ‘সৌবলেয়ি! এ কি করিয়াছ?” গান্ধারী মহষি-সমীপে আপনার অভিপ্রায় গোপন না করিয়া কহিলেন, ”মহাত্মান! অগ্রে কুন্তীর পুৎত্র জন্মিয়াছে শুনিয়া আমি সাতিশয় দুঃখিত হইয়া এই গর্ভপাত করিয়াছি। আপনি আমাকে পুর্ব্বে বর প্রদান করিয়াছেন, আমার গর্ভে শত পুৎত্র জন্মিবে, এক্ষণে এই মাংসপেশী হইতে শত পুৎত্র উৎপন্ন করুন।” ব্যাস কহিলেন , ”সৌবলেয়ি! আমার বাক্য কখন মিথ্যা হইবার নহে। মাংসপেশী নষ্ট করিও না। ইহা হইতে অবশ্যই তোমার শত পুৎত্র উৎপন্ন হইবে। তুমি গুপ্ত প্রদেশে ঘৃতপূর্ণ শতসংখ্যক কুম্ভ স্থাপন করাইয়া এই মাংসপেশীর উপর জলসেচন কর।” গান্ধারী ব্যাসের বচনানুসারে কুম্ভ প্রস্তুত করিয়া মাংসপেশীর উপর জলসেচন করিতে লাগিলেন। জলসেচের পর কিয়ৎক্ষণমধ্যে মাংসপেশী একাধিকশত খণ্ডে বিভক্ত হইয়া গেল। উহার এক এক খণ্ড অঙ্গুষ্ঠপর্ব্বপরিমিত [বুড়ো আঙ্গুলের পাবের মত] হইল। অনন্তর গান্ধারী সেই সকল খণ্ড পূর্ব্বপ্রস্তুত কুম্ভ-সকলের মধ্যে গূঢ়রূপে স্থাপিত করিয়া সাবধানে রক্ষা করিতে লাগিলেন। ভগবান্ ব্যাস গান্ধারীকে কহিলেন, ” হে সৌবলেয়ি! আর দুই বৎসরের পর এই সকল কুম্ভ উদঘাটন করিও।” ইহা বলিবা মহর্ষি তপস্যা করিবার নিমিত্ত হিমাচলে প্রস্থান করিলেন।

দুর্য্যোধনের জন্মকালীন অশুভ লক্ষণ

অনন্তর দুই বৎসর অতীত হইলে প্রথমতঃ দুর্য্যোধন জন্মিল। ঐ দিবসেই মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেনের জন্ম হয়। যুধিষ্ঠির জন্মানুসারে সর্ব্বজ্যেষ্ঠ হইলেন। দুরাত্মা দুর্য্যোধন জাতমাত্র গর্দ্দভেদ ন্যায় কর্কশধ্বনি করিতে আরাম্ভ করিল; গর্দ্দভ, গৃধ্র [শকুন], গোমায়ু [শৃগাল], বায়স প্রভৃতি অমঙ্গলসূচক জন্তুগণ সেই ধ্বনি শ্রবণ করিয়া ভয়ানকস্বরে চীৎকার করিতে লাগিল। সেই সময়ে বায়ু প্রবলবেগে বহিতে লাগিল; দিগ্‌দাহ আরম্ভ হইল। ফলতঃ তৎকালে অশেষবিধ অমঙ্গলসূচক ঘটনা উপস্থিত হইল। রাজা ধৃতরাষ্ট্র তাহা শুনিয়া সাতিশয় ভীত ও ব্যাকুল হইয়া বিজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ, ভীষ্ম, বিদুর, অন্যান্য সুহৃদগণ ও কুরুগণকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, ”মহাশয়েরা সকলে উপস্থিত আছেন, রাজপুৎত্র যুধিষ্ঠির সর্ব্বজ্যেষ্ঠ ও গুণবান্, অতএব এ রাজ্য তিনিই পাইবেন, তদ্বিষয়ে আমার কিছু বক্তব্য নাই। এক্ষণে এই জিজ্ঞাস্য যে, আমার এই জ্যেষ্ঠ-পুৎত্র যুধিষ্ঠিরের পর রাজ্যভাগী হইবে কি না? আপনারা কি বিবেচনা করেন, বলুল।” ধৃতরাষ্ট্রের বাক্যাবসান হইলে ভয়ঙ্কর ক্রব্যাদগণ [শ্মশানের শবাদির মাংসভোজী জন্তু] ডাকিতে লাগিল; অমঙ্গলসূচক শিবাগণ কর্কশধ্বনি করিতে আরম্ভ করিল। ব্রাহ্মণগণ ও ধীমান বিদুর সেই সমস্ত দুর্নিমিত্ত লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, ”রাজন! আপনার জ্যেষ্ঠপুৎত্র জন্মিবামাত্র এই সকল দুর্নিমিত্ত উপস্থিত হইল, অতএব স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, এই দুরাত্মা হইতেই কুরুকুল ধ্বংস হইবে। আমাদের মতে ইহাকে পরিত্যাগ করাই কর্ত্তব্য; রাহিলে মহান্ অনর্থ ঘটিবে। মহীপাল! যদি বংশ-রক্ষা করিবার বাসনা থাকে, তবে এই দুরাত্মাকে পরিত্যাগ করিয় অপর একোনশত পুৎত্রের সহিত সুখে কালযাপন করুন। ইহাকে পরিত্যাগ করিলেই আপনার বংশের ও জগতের মঙ্গল করা হয়। শাস্ত্রকারেরা কহিয়া গিয়াছেন, যদি একজনকে পরিত্যাগ করিলে কুলরক্ষা হয়, তাহা অবশ্যই করিবে; যদি কুল পরিত্যাগ করিলে গ্রামরক্ষা হয়, তাহা করা কর্ত্তব্য; গ্রাম-পরিত্যাগ দ্বারা যদি জনপদরক্ষা হয়, তাহা করা উচিত এবং সমস্ত পৃথিবী পরিত্যাগ করিলেও যদি আত্মরক্ষা হয়, তাহাও বিধেয়!” তাঁহারা সেই সদুপদেশ প্রদান করিলেও রাজা ধৃতরাষ্ট্র পুৎত্রস্নেহবশতঃ তাঁহাদের বাক্যানুসারে কার্য্য করিলেন না। দুর্য্যোধনের জন্মের কিয়দ্দিন পরে ধৃতরাষ্ট্রের অপর ঊনশত পুৎত্র ও এক কন্যা জন্মিল; ফলতঃ এক মাসের মধ্যেই ধৃতরাষ্ট্রের শত পুৎত্র ও এই কন্যা সমুৎপন্ন হইল।
যৎকালে গান্ধারী গর্ভবতী ছিলেন, তখন তিনি গর্ভভারাক্রান্ত হইয়া নিতান্ত ক্লিশ্যমান হন। সেই সময় একজন বৈশ্যা ধৃতরাষ্ট্রের পরিচর্য্যায় নিযুক্ত ছিল। ঐ বৈশ্যা ধৃতরাষ্ট্রের সহযোগে গর্ভবতী হয় এবং যথাকালে এক পুৎত্র-সন্তান প্রসব করে; ঐপুৎত্রের যুযুৎসু নাম হইয়াছিল। হে রাজন! এইরূপে ধীমান ধৃতরাষ্ট্রের গান্ধারীর গর্ভে শত পুৎত্র ও এক কন্যা এবং বৈশ্যার গর্ভে যুযুৎসুনামা এক পুৎত্র জন্মিল।