১১৩. মাদ্রীসহ পাণ্ডুর বিবাহ । পাণ্ডুর দিগ্বিজয়

ত্রয়োদশাধিকশততম অধ্যায়
মাদ্রীসহ পাণ্ডুর বিবাহ

বৈশম্পয়ান কহিলেন, অনন্তর শান্তনুনন্দন ভীষ্ম নরপতি পাণ্ডুর আর এক বিবাহ দিতে মনস্থ করিয়া প্রধান অমাত্য, ব্রাহ্মণ ও মহর্ষিগণ সঙ্গে লইয়া চতুরঙ্গিণী সেনা-সমভিব্যাহারে মদ্রাধিপতির নগরে গমন করিলেন। মদ্ররাজ শল্য ভীষ্মের আগমনবার্ত্তা শ্রবণমাত্র অতিমাত্র সত্বর হইয়া স্বয়ং প্রত্যুদ্‌গমনপুরঃসর সাদরসম্ভাষণে ও পরম সমাদরসহকারে তাঁহাকে পুরপ্রবেশ করাইলেন এবং বসিবার আসন, পাদ্য, অর্ঘ্য, মধুকর্পাদি প্রদান করিয়া যথোচিত সম্মান করিলেন। পরে আগমনকারণ জিজ্ঞাসিলে কুরুকুলতিলক ভীষ্ম কহিলেন, ”মদ্রপতে! শুনিলাম, পরমরূপবতী মাদ্রী-নাম্নী তোমার ভাগিনী আছে, তুমি আমার ভ্রাতুষ্পুত্র পাণ্ডুর সহিত তাহার বিবাহ দাও; এই মানসে তোমার দেশে আসিয়াছি। দেখ, তোমাদের ও আমাদের যে বংশ, উভয়ই পবিত্রতাগুণে সমান, কোন অংশে বৈলক্ষণ্য নাই, অতএব পাণ্ডুকে ভাগিনী দান করিয়া আমাদিগের সহিত কুটুম্বিতা কর!” ভীষ্মবাক্য শ্রবণ করিয়া মদ্ররাজ বিনয়গর্ব্ববচনে কহিলেন, ”মহাশয়! আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহাতে আমার কদাচ অসম্মতি নাই, শুনিয়া আমার পরম পরিতোষ জন্মিল; কুরুবংশ পরিত্যাগ করিয়া আর কোথায় ভাগিনী দান করিব? আপনাদের কুলগতা হইলে ভাগিনির অনেক সৌভাগ্য মানিতে হইবে, কিন্তু মহাশয়! আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা যে এক বিষম নিয়ম স্থাপন করিয়া গিয়াছেন, আপনি তাহা সবিশেষ জ্ঞাত আছেন; ভাল হউক বা মন্দই হউক, আমি তাহা লঙ্ঘন করিতে পারিব না; আপনাকেও সেই নিয়ম প্রতিপালন করিতে হইবে। কারণ উহা আমাদিগের কুলধর্ম্ম।” ভীষ্ম কহিলেন মাদ্ররাজ! তুমি চিন্তিত হইও না, স্বয়ং প্রজাপতি শুল্কগ্রহণপূর্ব্বক কন্যাদানের নিয়ম নির্দ্ধারিত করিয়াছেন, তোমার কুলধর্ম্ম নির্দ্দোষ ও সাধুসম্মত, অবশ্যই প্রতিপালন করা হইবে।” এই বলিয়া ভীষ্ম শল্যকে রথ, গজ, তুরগ, বসন, ভূষণ ও মণি, মুক্তা, প্রবাল প্রভৃতি দ্রব্যজাত শুল্কস্বরূপ প্রদান করিলেন। শল্য ত্ৎসমুদয় গ্রহণপূর্ব্বক পরম-প্রীত হইয়া অলঙ্কৃত স্বীয় ভগিনী মাদ্রীকে লইয়া ভীষ্ম-হস্তে সমর্পণ করিলেন।
ভীষ্ম মাদ্রীকে লইয়া হস্তিনানগরে গমনপূর্ব্বক রাজবাটিতে রাখিয়া দিলেন এবং কিয়দ্দিন পর শুভলগ্ন দেখিয়া পাণ্ডুর সহিত তাঁহার পরিণয়ক্রিয়া সম্পন্ন করিলেন। উদ্বাহ-সমাপ্তি হইলে পর, মহারাজ পাণ্ডু পরমরমণীয় হর্ম্ম্যমধ্যে নব-প্রণয়িনীর বাসস্থান নিরূপিত করিলেন। কুন্তী ও মাদ্রীর পরস্পর বিলক্ষণ সৌহার্দ্দ্য জন্মিয়াছিল। পাণ্ডু তাঁহাদিগের উভয়কে লইয়া স্বেচ্ছাবিহারে পরমসুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন।

পাণ্ডুর দিগ্বিজয়

এইরূপে ত্রয়োদশ নিশা অন্তঃপুরে বিহার করিয়া পাণ্ডু দিগ্বিজয়বাসনায় বাটী হইতে বহির্গত হইলেন এবং ভীষ্ম প্রভৃতি বৃদ্ধগণ ও জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্রকে অভিবাদন করিয়া ও অন্যান্য কুরুপ্রধান ব্যক্তিদিগকে আমন্ত্রণপূর্ব্বক সকলের অনুমতি লইয়া চতুরঙ্গ সৈন্য সমভিব্যাহারে দিগ্বিজয়ার্থ যাত্রা করিলেন। যাত্রাকালে নগরাঙ্গনারা নানাবিধ মঙ্গলাচরণ ও ব্রাহ্মণগণ আশীর্ব্বচন করিতে লাগিলেন। কুরুকুলের কীর্ত্তিকর পাণ্ডুনরবর প্রথমতঃ দশার্ণদেশে প্রয়াণপূর্ব্বক পূর্ব্বাপরাধী দশার্ণপতিকে সমরে পরাজয় করিলেন। অনন্তর হস্তী, অশ্ব, রথ, ও পদাতি-সঙ্কুল বিপুল বলবৃন্দ সঙ্গে লইয়া মগধদেশে উপস্থিত হইলেন। তথায় আনেকানেক ভূপতিদিগের অপকারী বলদর্পসমন্বিত মগধরাজকে সংহার করিয়া তাঁহার কোষস্থ ধনসমুদয় ও বাহনচয় আত্মসাং করিলেন। পরে মিথিলায় যাইয়া বিদেহদিগকে সংগ্রামে পরাভূত করিলেন। তাহারা তাঁহার একান্ত বংশধর হইল। পরিশেষে কাশী, সুহ্ম, পুণ্ড্র প্রভৃতি অপরাপর দেশে প্রয়াণপূর্ব্বক তত্রস্থ সমস্ত ভূপতিবর্গকে পরাজয় করিয়া কুরুকুলের অক্ষয়-কীর্ত্তি সংস্থাপিত করিলেন। এইরূপে শত্রুকুলাস্থক পাণ্ডু অনলবৎ অস্ত্রশিক্ষায় নরপতিদিগকে দগ্ধ করিতে লাগিলেন। পাণ্ডুর তেজঃপ্রভাবে বলরাজি [সৈন্যসমূহ] বিধ্বংসিত হইলে ভুপালেরা বশীভূত হইয়া কুরুকুলের মঙ্গলকর ব্যাপারে ব্যাপৃত হইলেন; আর মহাবীর পাণ্ডুকে আপনাদিগের একাধিপতি জ্ঞান করিয়া বিনীতভাবে কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহার সমীপে আগমনপূর্ব্বক তাঁহাকে মণি, মুক্তা, প্রবাল, সুবর্ণ, রজত, গো, অশ্ব, রথ, হস্তী, গর্দ্দভ. উষ্ট্র, মহিষ, কম্বল, অজিন, রাঙ্কব [পশুলোমজাত বস্ত্র] আস্তরণ প্রভৃতি নানাবিধ দ্রব্যজাত উপহার প্রদান করিলেন। মহারাজ পাণ্ডু সেই সমস্ত রাজদত্ত বস্তুজাত লইয়া পরমাহ্লাদে হস্তিনানগরাভিমুখে গমন করিলেন। রাজসিংহ শান্তনু ও ধীমান ভরতের যশোজনিত শব্দ বিলুপ্তপ্রায় হইয়াছিল, এক্ষণে পাণ্ডুর প্রভাবে তাহা পুনরুদ্ধৃত হইল। যাহারা পূর্ব্বে কুরুদিগের রাজ্য এবং ধন হরণ করিয়াছিল, হস্তিনাধিপতি পাণ্ডু তাহাদিগের নিকট হইতে করগ্রহণ করিতে লাগিলেন। পাণ্ডুর বীর্য্যবলাকৃষ্ট হইয়া ধন্যবাদ প্রদান করিতে করিতে মন্ত্রিগণ-সমভিব্যাহারে অন্যান্য রাজগণ পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতে লাগিলেন। পাণ্ডু শ্রবণসুখাবহ তৎসমস্ত শ্রবণ করিয়া প্রফুল্লমনে হস্তিনানগরের সমীপবর্ত্তী হইলেন। ভীষ্ম লোকমুখে পাণ্ডুর আগমনবার্ত্তা-শ্রবণে সাতিশয় আহ্লাদিত হইয়া পৌর, জানপদ ও অমাত্যগণ-সমভিব্যাহারে প্রত্যুদগমন করিলেন। কৌরবরা ভীষ্মের সহিত হস্তিনানগর হইতে কিয়দ্দুর গমন করিয়া, পাণ্ডুর সেনারা বিচিত্ররত্নপরিপূর্ণ অসংখ্য যান, হস্তী, রথ, গো, উষ্ট্র, মেষ প্রভৃতি জয়লব্ধ বস্তুজাত লইয়া আসিতেছে, দর্শন করিয়া পরম পরিতুষ্ট হইলেন। তাঁহারা ক্রমে সন্নিহিত হইলে কৌশল্যানন্দবর্দ্ধন সমুচিত সম্মান করিলেন। ভীষ্ম অশেষরাষ্ট্রবিজয়ী প্রত্যাগত পাণ্ডুকে আলিঙ্গন করিয়া আনন্দাশ্রু মোচন করিতে লাগিলেন। তূর্য্য[জয়ঢাক] শঙ্খ, দুন্দুভি প্রভৃতি নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র বাদিত হইতে লাগিল। পৌরবগণের আনন্দের সীমা রহিল না। ভীষ্ম পাণ্ডুকে লইয়া হস্তিনানগরে প্রবেশ করিলেন।