১০৪. ক্ষেৎত্রজ পুৎত্রোৎপাদনের বিবিধ দৃষ্টান্ত

চতুরধিকশততম অধ্যায়
ক্ষেৎত্রজ পুৎত্রোৎপাদনের বিবিধ দৃষ্টান্ত

ভীষ্ম কহিলেন, ”যিনি পিতৃবধামর্ষে [পিতৃহত্যার জাতক্রোধে] প্রদীপ্ত হইয়া তীক্ষ্ণধার কুঠার দ্বারা হৈহয়াধিপতির প্রাণসংহার করিয়াছিলেন; যিনি মহাবীর্য্য কার্ত্তবীর্য্যের ভুজবলচ্ছেদন করিয়াছিলেন, যিনি শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক অনবরত মহাস্ত্র বর্ষণ করিয়া একবিংশতিবার পৃথ্বীকে নিঃক্ষৎত্রিয়া করিয়ছিলেন এবং অরাতিশোণিতজলে পিতৃলোকদিগের তর্পণ করিয়াছিলেন, সেই মহর্ষি জামদগ্ন্য পরিশেষে বেদপারগ ব্রাহ্মণগণ দ্বারা অপতোৎপাদন করাইয়া বিনাশোম্মুখ ক্ষৎত্রিয়কুল পুনর্ব্বার রক্ষা করিয়াছেন।

দীর্ঘতমা ঋষির জন্মবৃত্তান্ত

বেদে এরূপ প্রমাণ আছে যে, ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপন্ন্ হইলে সেই পুৎত্র পাণিগ্রহীতারই হইয়া থাকে; সেই সনাতন ধর্ম্ম স্মরণ করিয়া ক্ষৎত্রিয়পত্নীরা ব্রাহ্মণগণ-সমীপে অভিগমন করিতেন এবং ক্ষৎত্রিয়দিগের পুনর্ভববিধি [পত্যন্ততগ্রহণ] লোকেও দৃষ্ট হইতেছে। ক্ষৎত্রয়কুল এইরূপে পুনর্ব্বার বদ্ধমূল হইয়াছে। হে রাজ্ঞি! এই বিষয়ে আর একটি অতি প্রাচীন ইতিহাস আছে, বলিতেছি , শ্রবণ করুন। পূর্ব্বে উতথ্য নামে এক সুবিখ্যাত মহর্ষি ছিলেন। তাঁহার মমতানাম্নী এক সহধর্ম্মিণী ছিলেন। একদা মহর্ষি উতথ্যের যবিষ্ঠ ভ্রাতা দেবপুরোহিত মহাতেজাঃ বৃ্হস্পতি মদনাতুর হইয়া মমতার নিকট উপস্থিত হইলেন। মমতা দেবরকে সম্মোধন করিয়া কহিলেন, ”হে মহাভাগ ! আমি তোমার জ্যেষ্ঠের সহযোগে আন্তর্ব্বত্নী [গর্ভিণী] হইয়াছি, অতএব রমণেচ্ছা সংবরণ কর। আমার গর্ভস্থ উতথ্য কুমার কুক্ষিমধ্যেই ষড়ঙ্গ বেদ অধ্যয়ন করিয়াছেন। তুমিও অমোঘরেতাঃ; এক গর্ভে দুই জনের সম্ভব নিতান্ত অসম্ভব। অতএব অদ্য এই দুর্ব্যবসায় [নিন্দিত চেষ্টা] হইতে নিবৃত্ত হও।’ বৃহস্পতি মদনবাণে নিতান্ত আহত ও সাতীশয় অধীর হইয়াছিলেন, সুতরাং স্বীয় চঞ্চলচিত্তকে কোনক্রমেই স্থির করিতে না পারিয়া মমতার অসম্মতি থাকিলেও তিনি বলপূর্ব্বক তাঁহাতে আসক্ত হইলেন!
অনন্তর গর্ভস্থ ঋষিকুমার বৃহস্পতিকে কামক্রীড়ায় আসক্ত দেখিয়া কহিলেন, ‘ভগবান! মদনবেগ সংবরণ করুন। স্বল্পপরিসর কুক্ষিতে উভয়ের সম্ভব অত্যন্ত অসম্ভব। আমি পূর্ব্বে এই গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছি, অতএব অমোঘরেতঃপাত দ্বারা আমাকে পীড়িত করা আপনার নিতান্ত অযোগ্য কর্ম হইতেছে, সন্দেহ নাই।’ বৃহস্পতি বালকবাক্যে কর্ণপাতও না করিয়া স্বীয় নিকৃষ্ট প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিতে লাগিলেন। গর্ভস্থ মুনিকুমার বৃহস্পতির এইরূপ অসাধুব্যবহার দর্শনে অসহিষ্ণু হইয়া পাদ দ্বারা তদীয় শুক্রের পথরোধ করিলেন। রেতঃ প্রবেশমার্গ না পাইবা প্রতিহত হইয়া সহসা ভূতলে পতিত হইল। তন্নিরীক্ষণে ভগবান্ বৃহস্পতি রোষপরবশ হইয়া গর্ভস্থ উতথ্যনন্দনকে ভর্ৎসনাপূর্ব্বক অভিসম্পাত করিলেন, ‘যেহেতু, সর্ব্বভূতের অভিলষিত ঈদৃশ সময়ে আমাকে এমন কথা বলিলে, এই অপরাধে তুমি যাবজ্জীবন অন্ধত্ব প্রাপ্ত হইবে।’ বৃহস্পতি-শাপপ্রভাবে উতথ্যতনয় অন্ধ হইয়া জন্মগ্রহণ করিলেন, তাহাতেই তাঁহার নাম দীর্ঘতমা হইল। সেই জন্মান্ধ বেদবিৎ প্রাজ্ঞ ঋষি স্বীয় বিদ্যাবলে প্রদ্বেষীনাম্নী এক পরমরূপলাবণ্যবতী যুবতী ব্রাহ্মণতনয়ার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন। পরে তিনি গৌতম প্রভৃতি কতিপয় সুবিখ্যাত পূৎত্র উপাদন করিয়া মহর্ষি উতথ্যের বংশরক্ষা করিলেন। অনন্তর বেদবেদাঙ্গপারগ ধর্ম্মাত্মা দীর্ঘতমা সৌরভেয়ের নিকট নিখিল গোধর্ম্ম অধ্যয়ন করিয়া নিঃশঙ্কচিত্তে তদাচরণে প্রবৃদ্ধ হইলেন। অনন্তর তাঁহাকে স্বধর্ম্ম-ভ্রষ্ট দেখিয়া তত্রত্য সমস্ত মহর্ষিগণ ক্রোধান্ধ হইয়া কহিলেন, যে ব্যক্তি স্বীয় ধর্ম্ম পরিত্যাগ করে, সে আমাদিগের আশ্রমের নিতান্ত আযোগ্য, অতপর এই পাপিষ্ঠের সহবাস পরিত্যাগ করাই উচিত।’ তাঁহারা পরস্পর এইরূপ মন্ত্রণা করিয়া মহর্যি দীর্ঘতমাকে আর সাদর-সম্ভাষণ বা তাঁহার সন্তোষষজনক কার্য্য করিতেন না এবং তাঁহার পত্নীও এক্ষণে পূর্ব্বের ন্যায় সমাদর ও শুশ্রূষাদি দ্বারা তদীয় সন্তোষবর্দ্ধন করিতেন না। দীর্ঘতমা পত্নীর এইরূপ অদৃষ্টপূর্ব্ব অভক্তি-দর্শনে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কি নিমিত্ত আমার প্রতি বিদ্বেষ প্রদর্শব করিতেছ? প্রদ্বেষী কহিলেন, স্বামী ভার্য্যার ভরণপোষণ ও প্রতিপালন করেন বলিয়া তাঁহাকে ভর্ত্তা এবং পতি বলিয়া থাকে; কিন্তু তুমি জন্মান্ধ, তাহার কিছুই করিতে পার না, প্রত্যুত আমি তোমার ও ত্বদীয় পুৎত্রগণের চিরকাল ভরণপোষণ করিয়া নিতান্ত শ্রান্ত ও একান্ত পীড়িত হ‌ইয়াছি; অতএব অতঃপর আমি তোমাদিগের আর ভারবহন করিতে পারিব না।”

স্ত্রীজাতির প্রতি দীর্ঘতমার শাপ

মহর্ষি পত্নীবাক্য-শ্রবণানন্তর ক্রোধান্বিত হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, এই অর্থ গ্রহণ কর; বলবতী অর্থস্পৃহা-নিবন্ধন তোমাকে ক্ষৎত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করিতে হইবে”। প্রদ্বেষী কহিলেন, হে বিপ্রেন্দ্র ! দুঃখের নিদানভূত ত্বৎপ্রদত্ত ধনে আমার অভিলাষ নাই; তোমার যেমন অভিরুচি হয় কর। আমি পূর্ব্বের ন্যায় তোমার ও তোমার সন্তানবর্গের ভরণপোষণ করিতে পারিব না। ‘দীর্ঘতমা পত্নীর সগর্ব্ব বচন শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘আমি অদ্যাবধি পৃথিবীতে এই নিয়ম প্রতিষ্ঠিত করলাম যে, স্ত্রীজাতিকে যাবজ্জীবন একমাত্র পতির অধীন হইয়া কালযাপন করিতে হইবে। পতি জীবিত থাকিতে অথবা পঞ্চপ্রাপ্ত হইলে, নারী যদি পুরুষান্তর ভজনা করেন, তাহা হইলে তিনি আবশ্যই পতিত হইবেন, সন্দেহ নাই। আর পতিবিহীনা নারীগণের সর্ব্বপ্রকার সমৃদ্ধি থাকিলেও তাহা ভোগ করিতে পারিবে না; বিষয়ভোগ করিলে অকীর্ত্তি ও পরিবাদের সীমা থাকিবে না। ব্রাহ্মণী স্বামীর এই সমুদয় বাক্য শ্রবণে অত্যন্ত কুপিতা হইয়া গৌতম প্রভৃতি পুৎত্রদিগকে আদেশ করিলেন, ”ইহাকে গঙ্গায় নিক্ষেপ কর”। লোভ ও মহাভিভূত পাষাণহৃদয় পুৎত্রেরা তাঁহাকে উড়ুপে বন্ধনপূর্ব্বক গঙ্গায় নিক্ষেপ করিয়া স্বচ্ছন্দে গৃহে প্রত্যাগমন করিল। অন্ধ সেই উড়ুপমাত্র অবলম্বন করিয়া স্রোতে ভাসিতে ভাসিতে নানাদেশ অতিক্রম করিয়া চলিলেন। পরম-ধার্ম্মিক বলিরাজ গঙ্গাস্নানে গমন করিয়াছিলেন, তিনি তরঙ্গোপরি ভাসমান দীর্ঘতমাকে দেখিবামাত্র গ্রহণ করিলেন এবং অদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত পরিজ্ঞাত হইয়া তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিলেন, ”মহাভাগ ! কৃপা করিয়া আপনাকে মদীয় পত্নীর গর্ভে ধর্ম্মার্থকুশল পুৎত্র উৎপাদন করিতে হইবে।” মহাতেজাঃ ঋষি এই প্রার্থনায় সম্মত হইলে পর, রাজা স্বীয় মহিষী সুদেষষ্ণাকে তাঁহার নিকট প্রেরণ করিলেন। রাজমহিষী অন্ধ ও বৃদ্ধতম দেখিয়া তাঁহার নিকট গমন করিলেন না। তিনি আপন ধাত্রেয়িকাকে [ধাত্রী] বৃদ্ধের নিকট প্ররণ করিলেন। ঋষি সেই শূদ্রযোনিতে কাক্ষীবৎ প্রভৃতি একাদশ পুৎত্র উৎপাদন করিলেন। অনন্তর রাজা সেই সকল পুৎত্রদিগকে অধ্যয়নানুরক্ত অবলোকন করিয়া ঋষিকে কহিলেন, ”ইহারা আমার পুৎত্র’?” ঋষি কহিলেন, ”মহারাজ! ইহারা আপনার পুৎত্র নহে; রাজমহিষী আমাকে অন্ধ ও বৃদ্ধতম দেখিয়া আমাকে অবজ্ঞা করিয়া তাঁহার ধাত্রেয়িকাকে আমার নিকট প্ররণ করেন, আমি সেই শূদ্রযোনিতে কাক্ষীবৎ প্রভৃতি এই একাদশ পুৎত্র উৎপাদন করিয়াছি, অতএব ইহারা আমার পুৎত্র।’

অঙ্গরাজাদির জন্ম-বর্ণন

অনন্তর রাজা মুনিকে প্রসন্ন করিয়া পুনর্ব্বার মহিষী সুদেষ্ণাকে তাঁহার নিকট প্রেরণ করেন। দীর্ঘতমা রাজমহিষীর অঙ্গ স্পর্শ করিয়া কহিলেন, ‘তোমার গর্ভে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম এই পাঁচ পুৎত্র হইবে। তাহারা সূর্য্যের ন্যায় তেজস্বী হইবে এবং তাহাদিগের অধিকৃত দেশসকল অধিকারীর নামানুসারে কথিত হইবে। অঙ্গের অধিকৃত দেশের নাম অঙ্গ , বঙ্গের বঙ্গ , কলিঙ্গের কলিঙ্গ , পুণ্ড্রের পুণ্ড্র , সুহ্মের অধিকৃত দেশের সুহ্ম হইবে। এইরূপে মহর্ষি দীর্ঘতমা দ্বারা বলিরাজবংশ বিস্তৃত হইল এবং ব্রাহ্মণগণ দ্বারা ক্ষৎত্রিয়কুল পুনর্ব্বার বদ্ধমূল হইল। হে মাতঃ! এই সমস্ত শ্রবণ করিলেন, এক্ষণে আপনার যে অভিরুচি হয়, অনুষ্ঠান করুন।”