১০২. কাশীরাজকন্যা অম্বিকাদির স্বয়ংবর

দ্ব্যধিকশততম অধ্যায়
কাশীরাজকন্যা অম্বিকাদির স্বয়ংবর

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে কৌরবনন্দন! চিত্রাঙ্গদ নিহত হইলে বিচিত্রবীর্য্যের বাল্যাবস্থায় ভীষ্ম সত্যবতীর নিদেশানুবর্ত্তী হইয়া রাজ্যশাসন করিতে লাগিলেন। অনন্তর বিচিত্রবীর্য্যকে তরুণবয়স্ক দেখিয়া ভীষ্ম তাঁহার বিবাহ দিবার মানস করিলেন। এই সময় কাশীপতির তিন কন্যা স্বয়ংবরা হইবেন, এই কথা ভীষ্মের কর্ণগোচর হইল। মহারথ ভীষ্ম মাতার অনুমতি লইয়া রথরোহণপূর্ব্বক বারাণসী নগরীতে গমন করিলেন। তথায় দেখিলেন, ভূপতিগণ বিবাহার্থী হইয়া নানা দিগ্দেশ হইতে সেই স্বয়ংবরসভায় সমাগত হইয়াছেন এবং সেই কন্যারাও উপবিষ্ট আছেন। অনন্তর রাজাদিগের নাম কীর্ত্তিত হইলে ভিষ্ম ভ্রাতার নিমিত্ত স্বয়ং সেই কন্যাদিগকে প্রার্থনা করিলেন এবং তাঁহাদিগকে রথে আরোহণ করাইয়া অতি গম্ভীরস্বরে মহীপালদিগকে কহিতে লাগিলেন,”কেহ কন্যাকে বিচিত্র বস্ত্রালঙ্কারে আচ্ছাদিত করিয়া ধনদানপূর্ব্বক গুণবান্ পাত্রে সমর্পণ করেন, কেহ কেহ গোমিথুন [দুইটি গো] প্রদানপূর্ব্বক কন্যাকে পাত্রসাৎ করেন; কেহ বা প্রতিজ্ঞাত ধনদান পুরঃসর কন্যা সম্প্রদান করেন, কেহ বলপূর্ব্বক বিবাহ করিয়া থাকেন, কেহ বা প্রণয়-সম্ভাষণে রমণীর মনোরঞ্জনপূর্ব্বক তদীয় পণিপীড়ন করেন; কেহ প্রমত্তাআ নারীর পাণিগ্রহণ করেন; কেহ বা আর্ষ [ঋষিসম্মত] বিধির অনুসারে দারপরিগ্রহ করিয়া থাকেন; কেহ কেহ কন্যার মাতাপিতাদিগকে বিপুল অর্থদানপূর্ব্বক বিবাহ করেন। ধর্ম্মশাস্ত্রবিদ্ পণ্ডিতেরা এই অষ্টবিধ বিবাহবিধি নির্দ্দিষ্ট করিয়াছন। স্বয়ংবরও উত্তম বিবাহমধ্য পরিগণিত। রাজারা স্বয়ংবর বিবাহকেই অধিক প্রশংসা করেন। পরাক্রম প্রদর্শনপূর্ব্বক অপহৃত কন্যার পাণিগ্রহিতাকে ধর্ম্মবাদীরা ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছেন; অতএব হে মহীপালগণ! আমি বলপূর্ব্বক ইহাদিগকে হরণ করি; তোমরা যুদ্ধ অথবা অন্য যে-কোন উপায় দ্বারা পার, ইহাদিগের উদ্ধারসাধনে যত্ন কর। আমি যুদ্ধার্থে প্রস্তুত আছি।”

ভীষ্ম-কতৃক কাশীরাজকন্যাহরণ

বারাণসীস্বর ও অন্যন্যা রাজাদিগকে এই কথা বলিয়া মহাবল ভীষ্ম সেই কন্যাদিগকে গ্রহণপূর্ব্বক আপন রথে আরহণ ও সকলকে আমন্ত্রণ করিয়া দ্রুতবেগে প্রস্থান করিলেন। তর্দ্দশনে ভূপালগণ ক্রোধে কম্পান্বিতকলেবর হইয়া দশনে দশনে দৃঢ়তর নিষ্পীড়নপূর্ব্বক বাহ্বাস্ফোটন [হস্ত দ্বারা স্ববাহুতে বীরত্ব শব্দ] করিতে লাগিলেন। সকলে ব্যস্ত হইয়া সত্বর অলঙ্কার উন্মোচন ও কবজ ধারণ করাতে রাজসভা ঘোরতর সমাকূল হইয়া উঠিল। উত্তরীয় ও আভরণসকল ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হওয়াতে বোধ হইল যেন, অন্তরীক্ষ হইতে তারকাসকল ভূতলে পতিত হইতেছে। প্রবলপরাক্রান্ত বীর-পুরুষেরা নানাপ্রকার অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জীভূত হইয়া রোষকষায়িত ও ভ্রূকুটিকুটিলনয়নে ক্ষিপ্রজব [দ্রুতবেগগামী] ঘোটক-সংযুক্ত ও সূত [সারথি] রক্ষিত রথে আরহণপূর্ব্বক আয়ুধ-সকল উত্তোলন করিয়া শান্তনবের [ভীষ্মের] পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন।
অনন্তর একাকী ভীষ্মের সহিত সেই বহুসংখ্যক বীরপুরুষের ঘোরতর সংগ্রাম উপস্থিত হইল। সেই সমরসাগরের ভীষণতা দর্শনে গাত্র রোমাঞ্চিত হ‌ইতে লাগিল। বিপক্ষেরা ষুগপৎ দশ সহস্র বাণ তাঁহার প্রতি নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। কিন্তু ভীষ্ম অবলীলাক্রমে সেই সমস্ত শরজাল প্রচণ্ড শরবর্ষণ দ্বারা মধ্যস্থলেই শতধা খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। যেমন বর্ষাকালের জলদমালা পর্ব্বতোপরি মুষলধারে জলবর্ষণ করে, তদ্রূপ বিপক্ষেরা চতুর্দ্দক্ বেষ্টন করিয়া ভীষ্মের উপর অনবরত বাণবর্ষণ করিতে লাগিলেন। তিনি শরজাল দ্বারা শত্রুবর্গের বাণবর্ষণ অপবারিত করিয়া পরিশেষে তিন তিনটি বাণ দ্বারা সকলকে বিদ্ধ করিলেন। তাঁহারা ভীষ্মের প্রতি পাঁচ পাঁচটি শর নিক্ষেপ করিলেন। মহাবল ভীষ্ম পরাক্রম প্রদর্শনপূর্ব্বক পুনর্ব্বার তাঁহাদিগকে দুই দুই বাণ দ্বারা বিদ্ধ করিলেন । দেবাসুর-সংগ্রামের ন্যায় সেই যুদ্ধ অতি ভয়ঙ্কর ও অস্ত্রশস্ত্রে সমাকুল হইল। মহারথ ভীষ্ম শত শত সহস্র সহস্র ব্যক্তির ধনু, ধ্বজাগ্র, বর্ম্ম ও মস্তকচ্ছেদন করিলেন। তাঁহার অসাধারণ রণনৈপুণ্যে ও যুদ্ধস্থলে আত্মরক্ষা দর্শনে শত্রু-পক্ষীয়েরাও ভূরি ভূরি ধন্যবাদ করিতে লাগিল।
অস্ত্রবিদ্যাবিশারদ ভীষ্ম ক্রমে ক্রমে সকলকে পরাজিত করিয়া কন্যাদিগের সমভিব্যাহারে নগরাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। পথিমধ্যে মহারথ শাল্বরাজ বিজিগীষু হইয়া তাঁহার সম্মুখীন হইলেন। যেমন কোন যুথাধিপ মাতঙ্গ দন্তাঘাত দ্বারা বারণান্তরের [অন্য হস্তীর] জঘনদেশ বিদীর্ণ করিয়া মাতঙ্গীর প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ কামিনীকাম মহাবলপরাক্রান্ত মহাবাহু শাল্ব মহীপতি ঈর্ষা ও ক্রোধপরবশ হইয়া ভীষ্মকে ”তিষ্ঠ তিষ্ঠ” এই কথা বলিলেন। অরাতিকুলনিহন্তা পুরুষব্যাঘ্র ভীষ্ম তাঁহার গর্ব্বিত বাক্য শ্রবণ করিয়া ক্রোধে ব্যাকুলিত ও বিধুম অগ্নির ন্যায় প্রজ্জলিত হইয়া উঠিলেন।

শাল্বের সহিত ভীষ্মের যুদ্ধ

ভীষ্ম অশঙ্কিত ও অসঙ্কুচিতচিত্তে ক্ষাৎত্রধর্ম্ম অবলম্বনপূর্ব্বক ধনুর্ব্বাণ-ধারণ ও ভ্রূকুটি-বন্ধন করিয়া তৎক্ষণাৎ রথবেগ সংবরণ করিতে আজ্ঞা দিলেন। তর্দ্দশনে অন্যান্য রাজগণ সমুৎসুক হইয়া ভীষ্ম ও শাল্বের সমর-সমারোহ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। যেমন কোন গাভীকে লক্ষ্য করিয়া মহাবল বৃষদ্বয় গভীর নিনাদ করিয়া পরস্পরের প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ মহাবলপরাক্রান্ত সেই বীরযুগল ক্রোধভরে মহাড়ন্বরপুর্ব্বক তর্জ্জন-গর্জ্জন করিতে লাগিলেন। শাল্বরাজ ভীষ্মের প্রতি উপর্য্যুপরি সহস্র সহস্র বাণবর্ষণ করাতে শান্তনব প্রথমতঃ সাতিশয় পীড়িত হইলেন; তর্দ্দশনে তত্রত্য ভূপতিগণ বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া শাল্বরাজের ভূরি ভূরি প্রশংসা ও বারংবার সাধুবাদ করিতে লাগিলেন।
শান্তনব শাল্বরাজের প্রতি ক্ষৎত্রিয়গণের সাধুবাদ শ্রবণানন্তর ক্রোধভরে ‘তিষ্ট তিষ্ট’ এই কথা বলিয়া সারথিকে আজ্ঞা করিলেন, “যেখানে শাল্বরাজ আছে, শীঘ্র তথায় রথ-চালনা কর; আমি অদ্যই তাহাকে শমনভবনে প্রেরণ করিব।” অনন্তর মহাবীর ভীষ্ম বরুণাস্ত্র দ্বারা শাল্বের রথসংযুক্ত ঘোটক-চতুষ্টয় বিনষ্ট করিলেন এবং স্বীয় অস্ত্র দ্বারা সপত্নের [শত্রুর−বিপক্ষের] অস্ত্রশস্ত্র-সকল নিবারণপূর্ব্বক তদীয় সারথির মস্তকচ্ছেদন করিলেন; পরে ঐদ্রাস্ত্র দ্বারা অপরাপর উত্তমোত্তম অশ্বসকল বিনষ্ট করিলেন। এইরূপ নৃপবরকে পরাজয় করিয়া জীবিতাবস্থায় তাঁহাকে পরিত্যগ করিলেন। রাজা শাল্বও প্রাণ পাইয়া স্বীয় রাজধানী প্রত্যাগমনপূর্ব্বক ধর্ম্ম-প্রমাণ রাজ্য শাসন করিতে লাগিলেন। যে-সমস্ত রাজগণ স্বয়ংবর দর্শন করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁরাও স্ব স্ব রাজ্যে গমন করিলেন। তদনন্তর মহবীর ভীষ্ম জয়লব্ধ সেই সকল কন্যা রত্ন লইয়া হস্তিনাপুরে প্রস্থান করিলেন। তথায় ধর্ম্মাত্মা বিচিত্রবীর্য্য রাজা ছিলেন। তিনি স্বীয় পিতা নৃপোত্তম শান্তনুর ন্যায় ধর্ম্মানুসারে রাজ্যশাসন করিতেন। অমিতবিক্রম গঙ্গাসূত অরাতিকুল সমূলে উন্মুলনপূর্ব্বক অচিরে নদ, নদী, বন, উপবন ও ভূধর প্রভৃতি নানাস্থান অতিক্রম করিয়া ভ্রাতার নিমিত্ত কাশীশ্বরদুহিতাদিগকে আনয়ন করিলরন। তিনি সেই কামিনীদিগকে স্নুষার ন্যয় এবং দুহিতার ন্যায় পরমযত্নে আনয়ন করিয়া কৌরবগণ-সমীপে আগমন করিলেন এবং ভ্রাতাকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত বিক্রমাহৃদ সর্ব্ব-গুণযুত সেই কন্যাদিগকে যবিষ্ঠ [কনিষ্ঠ] ভ্রাতা বিচিত্রবীর্য্যের হস্তে সমর্পণ করিলেন।

বিচিত্রবীর্য্যের মৃত্যু

ভীষ্ম এই সমস্ত দুরূহকার্য্য-সম্পাদনান্তে গোপনে সত্যবতীর সহিত পরামর্শ স্থির করিয়া ভ্রাতার বিবাহের উদ্‌যোগ করিতেছেন। এই অবসরে কাশীপতির জ্যেষ্ঠা কন্যা হাসিতে হাসিতে কহিলেন, ” আমি ইতিপূরে্ব্ব মনে মনে শাল্বরাজকে পতিত্বে বরণ করিয়াছি এবং তিনিও আমাকে প্রার্থনা করিয়াছেন, আর এ বিযয়ে আমার পিতারও সম্পূর্ণ অভিলাষ আছে; অধিক কি বলিব, আমি স্বয়ংবরসভায় মনে মনে শাল্বের করে করার্পণ করিয়াছি; ইহা বিবেচনা করিয়া আপনার ধর্ম্মতঃ যেরূপ অভিরূচি হয়,তাহা সম্পাদন করুন। ভীষ্ম ব্রাহ্মসমাজে সেই কন্যার এবম্প্রকার উক্তি শ্রবণে সাতিশয় চিন্তাকূল হইলেন। অনন্তর বেদপারগ ব্রাহ্মগণের সহিত পরামর্শ স্থির করিয়া সর্ব্বজেষ্ঠা অম্বাকে স্বেচ্ছানুরূপ কার্য্য করিবার অনুমতি প্রদান করিলেন এবং অম্বিকা ও অম্বালিকাকে স্বীয় যবিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্রবীর্য্যের সহিত বিবাহ দিলেন। তরুণবয়স্ক পরমসুন্দর বিচিত্রবীর্য্য সেই কামিনীযুগলের পাণিগ্রহণ করিয়া এককালে কুসুমায়ুধের [মদনের] অধীন হইলেন। সেই নিবিড়নিতম্বিনী [স্থূলকাঞ্চী−মোটা পাছা] দ্বয়ের পায়োধরযুগল পীন, কটিদেশ ক্ষীণ ও নখসকল রক্তবর্ণ ছিল। তাঁহাদিগের ঘন বিকুঞ্চিত শ্যামল কেশপাশে কি অনির্ব্বচনীয় শোভা হইয়াছিল,তাহা বর্ণনাতীত। তাঁহারা আপনাদিগকে অনুরূপভর্ত্তৃভাগিনী জানিয়া প্রীতি-প্রফুল্লচিত্তে পতিসেবা করিতে লাগিলেন। অশ্বিনীকুমারসদৃশ রূপবান, দেবতুল্য পরাক্রমশালী ও প্রমদাজনমনোহারী ভূপাতি বিচিত্রবীর্য্য মহিষীদিগের সহিত ক্রমাগত সাত বৎসর নিরন্তর বিহার করিয়া যৌবনকালেই যক্ষারোগে আক্রান্ত হইলেন। তাঁহার বন্ধুবান্ধবগণ সুবিচক্ষণ চিকিৎসক দ্বারা তদীয় পীড়ার নানাপ্রকার প্রতিকারচেষ্টা করিলেন, কিন্তু সকলই বিফল হইল। যেমন দিননাথ নিয়তিক্রমে অস্তাচলে গমন করেন, তদ্রূপ সেই তরুণবয়স্ক প্রজানাথ শমনসদনে গমন করিলেন। ভীষ্ম ভ্রাতৃশোকে নিতান্ত কাতর ও একান্ত বিষণ্ণ হইয়া জ্ঞাতিবর্গ ও ঋত্বিক্‌গণ-সমভিব্যাহারে তাঁহার প্রেতকার্য্য সমাধান করিলেন।