প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১৭. আর্য-অনার্য মতবাদের সংকট

আর ঠিক এই কথাটিকে স্পষ্টভাবে চেনবার পথে বিঘ্ন ঘটায় আধুনিক পণ্ডিত মহলে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি মতবাদ। মতবাদটি হলো, আর্য-অনার্য বা আর্য-দ্রাবিড়-সংক্রান্ত মতবাদ : অনার্যদের এই দেশে প্রবেশ করবার পর শিক্ষিত ও সংস্কৃত আর্যদের চিন্তাধারার মধ্যে কিছু কিছু অসংস্কৃত অনার্য-বিশ্বাস প্রবেশ করেছিলো। কী করে করলো? তাই নিয়ে অবশ্য নানা মুনির নানা মত। ক্ষিতিমোহন সেন(৫৫) বলছেন, এ হলো করুণাময়ের লীলা। পণ্ডিত জবাহরলাল নেহেরু(৫৬) বলছেন, এর কারণ হলো আগন্তুক আর্যদের অসীম সহনশীলতা। এ. বি. কীথ(৫৭) অতো ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টাই করছেন না, শুধু ঘোষণা করছেন যে স্থানীয় অসভ্য মানুষদের নানান ধ্যানধারণা আর্যদের ধ্যানধারণার রাজ্যে ‘সেঁদিয়ে’ গিয়েছিলো।

এখন এই আর্য-অনার্য মতবাদ যে শেষ পর্যন্ত ধোপে কতোখানি টেকবে তা খুব সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এককালে বিদগ্ধ সমাজ এ-মতবাদ নিয়ে যতোখানি উৎসাহ দেখিয়েছিলো আজদের দিনে তার তুলনায় উৎসাহ অনেক কমেছে(৫৮)। এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় পণ্ডিতমহলের ঝোঁকটা দিক বদল করছে : এককালে ঝোঁক ছিলো যা কিছু উন্নত ধরনের চিন্তা তাকেই আর্য আখ্যা দেবার, একালে যেন তথাকথিত দ্রাবিড়দের প্রতিই শ্রদ্ধা ও পক্ষপাতটা বেশি(৫৯)।

অবশ্যই আমাদের পক্ষে এ-জাতীয় তর্কবিতর্কের মধ্যে প্রবেশ করবার সুযোগ হবে না, প্রয়োজনও নেই। আমাদের পক্ষে যেটুকু কথা প্রাসঙ্গিক সেটুকু হলো ভবিষ্যতে এই আর্য-অনার্য মতবাদের কপালে যাই থাকুক না কেন বর্তমানে এ-মতবাদ সত্য নির্ণয় প্রচেষ্টার যে বাধা সৃষ্টি করতে পারে সে-সম্বন্ধে সচেতন হওয়া। আসলে আর্যই বলুন, বৈদিক মানুষই বলুন, বা যাই বলুন না কেন—তাদের নিজেদেরও একটা অসভ্য অতীত ছিলো, এবং সে-অতীতের নানা স্মারক পরের যুগের বৈদিক সাহিত্যেও টেকে থাকতে বাধ্য; তাই সেগুলিকে নির্বিচারে অনার্য বা দ্রাবিড়দের কাছ থেকে গৃহীত মনে করা চলবে না। অর্থাৎ কিনা, এই আর্য-অনার্য মতবাদ সত্যই হোক আর ভ্রান্তই হোক—তারই মোহে আমরা যেন বৈদিক মানুষদেরই নিজস্ব অতীতটার সন্ধান প্রচেষ্টায় উদাসীন না হই।
—————
৫৫. ক্ষিতিমোহন সেন : ভারতের সংস্কৃতি, ভূমিকা।
৫৬. J. Nehoru DI 57, 60, 68, 78.
৫৭. A. B. Keith RPVU 18, 24, 33, 54, 91, 92 ইত্যাদি
৫৮. বাঙালীর ইতিহাস : নীহাররঞ্জন রায়। ভারতের সংস্কৃতি : ক্ষিতিমোহন সেন। S. Radhakrishnan HPEW, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
৫৯. Ibid.