প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১৪. ভাষাজ্ঞান ও হিন্দুশাস্ত্র

অথচ, আশ্চর্যের ব্যাপার বলতে হবে, দেশবিদেশের এতো বড়ো বড়ো সংস্কৃতজ্ঞরা বৈদিক সাহিত্যের সঙ্গে অমন নিবিড়ভাবে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও এই জাতীয় চিহ্নগুলিত তাৎপর্য নিয়ে বিশেষ কোনো আলোচনাই তোলেন নি। অনুমানে মনে হয়, তার আসল কারণ হলো তাঁরা একালের ধ্যানধারণাকেই একমাত্র সম্বল করে বৈদিক-সাহিত্য পাঠ করেছেন। ফলে, স্মারকগুলির—বিশেষ করে বামাচারের স্মারকগুলি,–কোনো রকম তাৎপর্য নির্ণয় করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি : অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা বৈদিক সাহিত্যের শুধু শব্দ-রাশিই গ্রহণ করেছেন। কেননা, বৈদিক সাহিত্য আর যাই হোক একালের ব্যাপার নয়। তাই শুধুমাত্র একালের ধ্যানধারণার সাহায্য নিলেই বৈদিক শব্দরাশি সম্বন্ধে হাজার স্পষ্ট জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও বৈদিক চিন্তাজগতের পুরো খবরটা পাওয়া সম্ভব হবে না। আর্থার এ্যাভেলন, ওরফে স্যর জন উড্রফ্‌(৫১), তন্ত্র-প্রসঙ্গেই বলেছিলেন, শুধুমাত্র ভাষাজ্ঞানের সাহায্যে হিন্দুশাস্ত্র বুঝতে পারা যাবে না, ভাষাজ্ঞান ছাড়াও আরো কিছুর দরকার আছে :

…more is required for the understanding of a Hindu Shastra than linguistic talent, however great.

বলাই বাহুল্য ভাষাজ্ঞানকে কোনো ভাবে ছোটো করবার চেষ্টায় তাঁর এই উক্তি উদ্ধৃত করছি না। বস্তুত, ভারতীয় পুঁথিপত্র বোঝবার ব্যাপার দেশ-বিদেশের দিকপাল বিদ্বানেরা গত কয়েক শতাব্দী ধরে যে অসামান্য পরিশ্রম এবং অতুলনীয় প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন তার উপর নির্ভর করতে না পারলে আজ আমরা অনেকাংশেই অন্ধ হয়ে থাকতাম। কিন্তু প্রাচীনেরাই বলেছেন, বেদবেদান্তের প্রকৃত তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করবার পথে শব্দার্থরাশি-গ্রহণ প্রথম সোপান হলেও সব নয়(৫২), তারপর আরো কিছুর দরকার পড়ে।

বৈদিক সাহিত্য বিচারে এ-কথা যে কতোখানি গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা প্রতিপদেই দেখতে পাবো। আর সেই সঙ্গে দেখতে পাবো, ঠিক কোন অর্থে কথাটা সত্যি। কেননা, প্রাচীনেরা যে-অর্থে কথাটা বলতেন তা ঠিক নয়।

এখানে অবশ্যই সব কথা আলোচনা করা যাবে না : বাক্যজন্য-জ্ঞান ছাড়াও প্রাচীন পুঁথিপত্রকে বোঝবার জন্যে আরো কী প্রয়োজন, শুধুমাত্র তার ইঙ্গিতটুকু দেওয়া যায়।

কিসের প্রয়োজন? একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির। তাই সমস্যা হলো, কোথা থেকে তা পাওয়া যাবে?

সমস্যাটা যদি কেবল আমাদের দেশের পুরানো পুঁথিপত্রের তাৎপর্য খোঁজবার সমস্যা হতো তাহলে না হয় অন্য কথা ছিলো। কিন্তু তা নয়। যে-কোনো দেশেরই পুরোনো কালের পুঁথিপত্র বোঝবার ব্যাপারে সমস্যা ওঠে, এবং মানবজাতির অভিজ্ঞতা যেহেতু সবদেশেই মোটের উপর এক ধরনের সেইহেতু সব দেশের বেলাতেই এ-সমস্যা মোটামুটি একই।

সমস্যাটা মোটের উপর সমান বলে এমন তো হতেই পারে যে আমাদের দেশের পুরোনো পুঁথিপত্র নিয়ে আলোচনা খুবই জরুরী হবে। কেননা যদি কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে অন্য কোনো দেশের পুরোনো দলিল নিয়ে আলোচনা সার্থক হয়ে থাকে তাহলে সেই পদ্ধতির প্রয়োগ করেই প্রাচীন ভারতীয় চিন্তাধারার অনেক দুর্বোধ্য বিষয় আমরা হয়তো বুঝতে পারবো।

আর এইদিক থেকেই আমার সবচেয়ে বড়ো ঋণ অধ্যাপক জর্জ টম্‌সনের কাছে। যদিও তিনি ভারততত্ত্ববিদ্‌ নন, সংস্কৃতজ্ঞ নন,–গ্রীক ও লাতিন সাহিত্যে বিশেষজ্ঞ। বস্তুত আজকের পৃথিবীতে তাঁর মতো বড়ো গ্রীকতত্ত্ববিদ খুব কমই আছেন।

বৈদিক সাহিত্য নিয়ে আমরা যে-সব সমস্যার সম্মুখীন হই অধ্যাপক জর্জ টম্‌সন গ্রীক সাহিত্যে নিয়েও মোটের উপর তার অনুরূপ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এবং শেষ পর্যন্ত কোন পদ্ধতির সাহায্যে তিনি এ-সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছেন তার আলোচনা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদেই করেছি। কেননা, এই পদ্ধতির কথাটাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। এবং আমার স্থির বিশ্বাস, একালের ওই গ্রীকতত্ত্ববিদের অভিজ্ঞতা থেকে ভারততত্ত্ববিদরাও যদি লাভবান হতে রাজী হন তাহলে ভারততত্ত্বের আলোচনাতেও যুগান্তর আসবে। ব্যক্তিগত সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে সচেতন হয়েও আমি প্রাচীন পুঁথিপত্রের নানান রকম দুর্বোধ্য কথাবার্তার অর্থ নির্ণয়ে সাহসী হয়েছে তা প্রধাণত এই পদ্ধতির সাহসেই।

কিন্তু যে-কথা হচ্ছিলো : বৈদিক সাহিত্যে লোকায়তিক চেতনা এবং এমন কি বামাচারী ধ্যানধারণার স্মারক নিয়ে কথা। এ-ধরনের স্মারক যে অজস্র রয়েছে তার প্রমাণ হল বৈদিক সাহিত্যই, নমুনা দেখা যাবে পরের পরিচ্ছেদে। অথচ, উত্তরকালে আমাদের দেশে বৈদিক ও লোকায়তিক ঐতিহ্য এমনই বিরুদ্ধ হয়েছে যে খোদ বৈদিক সাহিত্যেই এ-জাতীয় স্মারক শর্ষের মধ্যে ভূতের মতো মনে হতে পারে। এমন ব্যাপার কী করে সম্ভবপর হলো?

————————-
৫১. A. Avalon PT preface x