প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১২. লোকায়ত ও সাংখ্য

এক : সাংখ্য। সাংখ্য-দর্শনের মূল কথাগুলি সামগ্রিকভাবে ভারতীয় চিন্তাধারাকে কতোখানি প্রভাবিত করেছে সে-কথা ভারতীয় দর্শনের ছাত্রমাত্রেই অবগত আছেন। কিন্ত এর জন্মবৃত্তান্ত আজো অস্পষ্ট—বেলভেলকার(৪১), রানাডে(৪২), জনস্টন(৪৩) প্রমুখ আধুনিক পণ্ডিতেরা সে-বৃত্তান্তের সন্ধানে এগিয়ে শেষ পর্যন্ত কী রকম যেন দিশেহারা হয়ে গিয়েছেন,–খুব জোর গলায় কোনো কথা বলতে পারছেন না। তার প্রধাণ কারণ হলো, এ-বিষয়ে প্রাচীন পুঁথিপত্রের কয়েকটি মূল্যবান নির্দেশকে এঁরা সকলেই অগ্রাহ্য করছেন। একটি নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে, জৈনদের লেখা থেকে। সূত্র-কৃতাঙ্গ-সূত্র(৪৪) নামের জৈন পুঁথিতে লোকায়ত নাস্তিকদের ঠিক পরেই সাংখ্য মতের আলোচনা তোলা হয়েছে এবং সেই প্রসঙ্গেই ভাষ্যকার শীলাঙ্ক(৪৫) বলছেন, লোকায়ত ও সাংখ্যের মধ্যে খুব কিছু তফাত নেই।

কথাটা উড়িয়ে দেবার মতো নয়। কেননা এই নিরীশ্বর প্রধানকারণবাদের সঙ্গে পরের যুগে ঈশ্বরতত্ত্ব জুড়ে দিয়ে একে যতোই আস্তিক সাজাবার চেষ্টা করা হোক না কেন, আদি অকৃত্রিম অবস্থায় এর সঙ্গে অধ্যাত্মবাদের সম্পর্ক যে ছিলোই না এ-কথা আশা করি ভারতীয় দর্শনের ছাত্রমাত্রেই স্বীকার করবেন। মূল সাংখ্যের সঙ্গে লোকায়তিকদের ঘনিষ্ঠতার কথা পুরোনো কালেরই আরো কিছু কিছু বইতে স্পষ্টভাবে রয়েছে। সেগুলির আলোচনা পরে তোলা হবে।

আপাতত যে-কথা হচ্ছিলো : সিদ্ধিদাতা গণেশই আমাদের মনে করিয়ে দেন, আজ আমরা ব্যাপক অর্থে যে-সব ধ্যানধারণাকে বামাচারী বলে উল্লেখ করে থাকি তার সঙ্গে মৌলিক সাংখ্যের সম্পর্ক ছিলো কি না তা ভালো করে ভেবে দেখা দরকার।

প্রথমে দেখা যাক, তান্ত্রিক শক্তিবাদের সঙ্গে সিদ্ধিদাতার সম্পর্কটা কী রকম?

গোপীনাথ রাও-এর(৪৬) ‘এলিমেণ্টস্‌ অব হিন্দু আইকনোগ্রাফি’-র পাতা ওল্টালেই চোখে পড়বে ভারতবর্ষের কতো জায়গায় কতো দেবালয়ে আজো গণেশকে দেখতে পাওয়া যায় এক নগ্ন নারীমূর্তির সঙ্গে মৈথুনরত অবস্থায়। এই মূর্তিগুলির নাম শক্তি-গণপতি। অবশ্যই আজকের দিনে আমি-আপনি গণেশকে ওই অবস্থায় দেখে চোখ নামিয়ে নেবো, কিন্তু যাঁরা ওই মূর্তি রচনা করেছিলেন তাঁদের মনে আধুনিক যুগের, আধুনিক সমাজের, রুচিবোধ বা নীতিবোধ নিশ্চয়ই ছিলো না। কেননা তাহলে তাঁরা এ-জাতীয় মূর্তিকে অন্তত দেবালয়ে স্থান দিতে পারতেন না। তাই প্রাচীন কালের,–অর্থাৎ কিনা, সমাজবিকাশের অতি প্রাচীন স্তরের—ধ্যানধারণাগুলিকে বুঝতে হলে এই শক্তি-গণপতির সাক্ষ্যকেও তো সত্যিই উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। শক্তিকে ওইভাবে আঁকড়ে ধরে গণপতি যেন বলছেন : এই হলো সৃষ্টির মূলতত্ত্ব,–সৃষ্টিরহস্য যদি জানতে চাও তাহলে এই শক্তিকে চেনো।

সৃষ্টির মূলে শক্তি। নারী। প্রকৃতি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ওই শক্তির সঙ্গে সাংখ্যের প্রকৃতির কি কোনো মিল নেই? আপনি বলবেন, সাংখ্যের প্রকৃতি নেহাতই অমূর্ত দার্শনিক ধারণামাত্র, আমাদের দেশের মানুষ তাকে কখনোই তান্ত্রিক শক্তির মতো মূর্ত নারীমূর্তি হিসাবে কল্পনা করে নি।

কিন্তু আজকের দিনে এ-কথাও আপনি খুব জোর গলায় বলতে পারবেন না। কেননা, সিন্ধু আর ইরাবতীর কিনারা থেকে হাজার কয়েক বছরের পুরোনো ধুলো সরিয়ে সম্প্রতি নানারকম নারীমূর্তি পাওয়া গিয়েছে। এবং অন্তত স্যর জন মার্সাল(৪৭) তো দাবি করছেন, এগুলিকে প্রকৃতিমূর্তি বলেই সনাক্ত করতে হবে। তছাড়া মনে রাখবেন, ভারতবর্ষে প্রত্নতত্ত্বমূলক কাজ যতোখানি হওয়া দরকার তার তুলনায় কিছুই যেন হয় নি। তাই কোনখানে মাটির তলায় যে কোন ধরনের সাক্ষী গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে তার হদিস সত্যি আমরা জানি না। দেশে যে ঠিক কী নেই এ-কথা বলবার আগে কিছুটা হুঁশিয়ার হওয়ার দরকার।

————–
৪১-৪৩. আমরা দ্বিতীয় খণ্ডের ‘সাংখ্য দর্শনের উৎস’ অধ্যায়ে এই মতগুলির উল্লেখ করেছি
৪৪. S. N. Dasgupta op. cit. 3:527.
৪৫. Ibid
৪৬. T. A. G. Rao EHI Vol. I. Part I.
৪৭. J. Marshall MIC 1:51.