প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০৮. ওরা কাজ করে

জ্ঞানের সঙ্গে কর্মের সম্পর্ক নিয়ে ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে সুদীর্ঘ আলোচনা হয়েছিলো। তার বিস্তারিত দলিলপত্র সংগ্রহ করা কঠিন নয়। সাধারণভাবে, দর্শনের একটি মূল সমস্যাকে বোঝবার জন্যে এই দলিলগুলি মহামূল্যবাদ। দর্শনের ওই মূল সমস্যাটি হলো বস্তুবাদ-বনাম-ভাববাদের সমস্যা : চেতনা আগে না বস্তুজগৎ আগে, চেতনা প্রাথমিক না বস্তু প্রাথমিক? আমাদের দেশের দার্শনিক পরিভাষায় সমস্যাটা অনেক সময় চেতনকারণবাদ-বনাম-অচেতনকারণবাদ হিসাবে দেখা দিয়েছে : চেতনপদার্থকেই বা চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্মকেই পরম সত্য বলবো, না, অচেতন পদার্থকেই পরম সত্য বলা হবে?

আমাদের দেশের দার্শনিক দলিলগুলিকে বিচার করলে দেখা যায়, চিন্তানায়কদের সঙ্গে স্বাভাবিক কর্মজীবনের যোগসূত্র যতোই বিচ্ছিন্ন হয়েছে ততোই তাদের চেতনা থেকে বিপুপ্ত হয়েছে বহির্বাস্তবের অমোঘ যাথার্থের কথা। অর্থাৎ কিনা, কর্মকে নীচবৃত্তি মনে করতে পারবার দরুনই মানুষ ভাববাদের দিকে অগ্রসর হতে পেরেছে। কিন্তু সব মানুষই তো আর কর্মকে খাটো করতে পারে না। তাহলে যে সমাজ টিকবে না, পৃথিবীর বুক থেকে মানুষের চিহ্ন মুছে যাবে। অন্ন-উৎপাদনের দায়িত্বটা অন্তত একদল মানুষকে গ্রহণ করতেই হবে। বস্তুত, যতোক্ষণ না একদল মানুষ ওইভাবে অন্ন উৎপাদনের দায়িত্বটা পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারে ততোক্ষণ পর্যন্ত আর একদলের পক্ষে এ-কাজকে হীন, অধমের লক্ষণ বলে মনে করা সম্ভবই নয়। তাই কর্মকে শুধু সেই শ্রেণীর মানুষই খাটো করতে পারে যে-শ্রেণী কিনা কর্মের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে। আর ঠিক এই কারণেই ভাববাদী বা অধ্যাত্মবাদী দর্শনে সমাজের সব-শ্রেণীর মানুষের চেতনাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তার বদলে পাওয়া যায় শুধু মাত্র সেই শ্রেণীর চেতনা যে শ্রেণী কর্মের দায়িত্ব গ্রহণ না করেও অপরের কর্মফলটুকু উপভোগ করবার অধিকার পেয়েছিলো।

এই তত্ত্বটিকে বোঝবার জন্যে ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে দলিলপত্র এতো রয়েছে যে অন্য কোনো দেশে তা খুঁজে পাওয়া সম্ভবই নয়। তার কারণ, আমাদের দেশে সমাজ-ইতিহাসের ওই পর্যায়ের বিকাশ—যে-পর্যায়ে ধীরে ধীরে পরান্নজীবী শ্রেণীর উৎপত্তি—খুবই দীর্ঘদিনস্থায়ী হয়েছিলো। ফলে অজস্র রচনায় তা প্রতিফলিত হয়েছে। অন্য কোনো দেশে এমনটা হয়েছে কিনা খুবই সন্দেহের কথা। আর সেই কারণেই দলিলগুলি সত্যিই মহামূল্যবান। কেননা, ভারতীয় ইতিহাসে যে-কথা স্পষ্ট ও প্রকট ভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তারই সাহায্যে অন্যান্য দেশের ইতিহাসে যে-কথা অস্পষ্ট আর আবছা হয়ে গিয়েছে তা বুঝতে পারবার সুযোগ হতে পারে।

ভাববাদের উৎস নিয়ে আলোচনা তুলতে হবে। কিন্তু আমাদের যুক্তির এই অবসথায় যেটুকু কথা একান্ত প্রাসঙ্গিক সেটুকু হলো, জনসাধারণের দর্শন আর বস্তুবাদী দর্শ্ন এই দুটি কথা আমাদের দেশে কেন দুটো আলাদা নাম পায় নি।

যারা মাটি কামড়ে পড়ে ছিলো মাটির পৃথিবীটাকেই তারা সত্যি বলে মেনেছে। লোকায়তিকদের কাছে বার্ত্তা বা চাষবাসের চেয়ে বড়ো বিদ্যা আর কিছুই ছিলো না। আর তাই জন্যেই তাদের চেতনায় এই মূর্ত মাটির পৃথিবীই সবচেয়ে বড়ো সত্যি।

তাই বলেছিলাম, খুব মোটা কথায় বললে বলা যায়, দেশের সাধারণ মানুষ খেটে খাওয়ায় বিশ্বাস হারায় নি। আর তাই জন্যেই তারা বস্তুবাদী দর্শনকে অমনভাবে আপন করে নিয়েছিলো।

সত্যিই কী আশ্চর্য ওই ‘লোকায়ত’ নামটি! এই নামের মধ্যেই খেটে খাওয়ার ইঙ্গিতটুকুও খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। কেননা, নামটার মূলে রয়েছে দুটি শব্দ : লোক + আয়ত। তার মধ্যে আয়ত কথাটা কী করে পাওয়া সম্ভব তাই ভাবতে ভাবতে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত(৩৬) বলছেন ‘আ+যৎ+অ’ করে কথাটা সিদ্ধ হওয়া অসম্ভব নয়। এখন ‘আ’ উপসর্গের অর্থ হলো ‘সম্যক ভাবে’। আর ‘যৎ’ ধাতুর  মানে হলো চেষ্টা করা, উদ্যম করা, কাজ করা। তাই আয়ত বলতে ‘সম্যকভাবে চেষ্টা করবার’ অর্থও বোঝাতে পারে বই কি। এই তো গেলো ‘আয়ত’ শব্দের মানে। আর ওই ‘লোক’ বলে কথাটার মানে কী? এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে মনিয়ার-উইলিয়াম্‌স্‌(৩৭) বলছেন, ‘লোক’ কথাটির সঙ্গে লাতিন শব্দ locus এবং লিথুনিয়ান laukas শব্দের তুলনা করা যায়। লিথুনিয়ান শব্দটির মানে, চাষের জমিই। আর লাতিন শব্দটির মানে, a clearing of forest—চাষের জন্য জঙ্গল-সাফ-করা জায়গা। সংস্কৃততেও ‘লোক’ শব্দের আদি ও অকৃত্রিম অর্থের সঙ্গে যে চাষের-জমির সম্পর্ক ছিলো না, এমন কথাও খুব জোর করে বলা যায় না। কেননা মনিয়ার-উইলিয়াম্‌স্‌-ই বলছেন, শুরুতে লোক শব্দের আগে একটা উ থাকতো—উলোক। এই উলোক=উরুলোক। এবং তার মানেই হলো জমি, মাঠ ইত্যাদি।

তাই লোকায়ত মানেও যা, বার্ত্তাকেই একমাত্র বিদ্যা মনে করাও তাই। একই কথা। কৃষকদের কথা।

ওরা কাজ করে। ওরা মাটির বুকে ফসল ফলায়। তাই ওদের চেতনার নাম হলো লোকায়ত।

 ——————————
৩৬. S. N. Dasgupta op. cit. 3:514