প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০৫. ভারতের ঐতিহ্য

সেখান থেকে একালের কথায় আসা যাক। একালের কথাটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কেননা, লোকায়ত দর্শনের পুঁথিপত্রগুলি যতোকাল আগেই বিলুপ্ত হয়ে যাক না কেন, হাজার হোক আমরা তো আজকের দিনে এ-আলোচনার তাৎপর্য কতোখানি সে-কথাও ভেবে দেখা দরকার বই কি।

আজকের দিনে আমরা বারবার শুনতে পাই, বস্তুবাদী দর্শনটার সঙ্গে আমাদের দেশের প্রাচীন সভ্যতার কোনো সম্পর্ক নেই। এ-দর্শন নেহাতই বিদেশী ব্যাপার, পশ্চিমী ব্যাপার—দেশের জমিতে এর কোনো শিকড় ছিলো না। আমাদের দেশের ইতিহাস আলাদা, জীবনের আদর্শ আলাদা,–সব কিছুই অন্য রকমের। পশ্চিমের আদর্শটা হলো বস্তুবাদী আদর্শ, ভোগের আদর্শ,–ভুল আদর্শ। তারই মোহে পড়ে আজকের পশ্চিমী সভ্যতা কী রকম উন্মাদের মতো আত্মনাশের পথে এগিয়ে চলেছে! তার বদলে, আমাদের দেশের আদর্শ হলো ত্যাগের আদর্শ, আধ্যাত্ম-চেতনার আদর্শ। আজ বরং আমাদের দেশের এই আদর্শকেই গ্রহণ করতে পারলে পশ্চিমী সভ্যতা অমন ভয়াবহ ধ্বংসের পথ থেকে ফিরে আসতে পারবে। কিন্তু তার বদলে আমরা যদি আমাদের নিজস্ব আদর্শটিকে ছেড়ে এই প্রাচ্যের জমিতে ওই পশ্চিমী বস্তুবাদের বীজ বুনতে যাই তাহলে অঘটন ঘটবে, জন্মাবে এক বিষবৃক্ষ,–তার ফল আমাদের কল্যাণ করবে না।

এই কথাগুলিই এতোবার, এতোভাবে(২২), আমাদের বলা হয়েছে যে শুনতে শুনতে অনেকেই মনে করেছেন, সত্যিই হয়তো বা তাই। সত্যিও বুঝি আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শনের কোনো স্থান নেই, সত্যিই বুঝি আমাদের দেশের জমিতে শুধু অনাবিল অধ্যাত্মবাদেরই বিকাশ ঘটেছে।

অথচ এতোগুলি কথার মধ্যে একটিও সত্যি কথা নয়।

প্রথমত, পাশ্চাত্য দর্শন যে বস্তুবাদী দর্শন, এই কথাটাই ভুল। আজকের পাশ্চাত্য দেশগুলি যে বস্তুবাদের মোহে পড়েই অমন আত্মনাশের পথে এগিয়ে চলেছে, সে-কথাটা আরো বেশি ভুল। আত্মনাশের আয়োজন যে নেই তা নয় : পৃথিবীর বুক থেকে একটা মহাযুদ্ধের ক্ষত শুকোতে না শুকোতে শোনা যায় আর একটা মহাযুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে। কিন্তু তার সঙ্গে বস্তুবাদী দর্শনের সম্পর্কটা কী রকম? ঐকান্তিক বিরোধের সম্পর্কই। কেননা আজকের দিনে যাঁরা সত্যিই এই মৃত্যুর মহাযজ্ঞের বড়ো বড়ো যজমান তাঁদের কাছে বস্তুবাদ দর্শনই বিরাট বিভীষিকার মতো। তাই তাঁদের মুখপাত্ররা বস্তুবাদকে হাজারবার খণ্ডন করেও স্বস্তি পান না, আবার নতুন করে খণ্ডন করবার জন্যে উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠেন(২৩)। এবং বস্তুবাদকে খণ্ডন করে অধ্যাত্মবাদী আর ভাববাদী মতবাদকে রকমারি মুখোস পরিয়ে রকমারি উপায়ে প্রচার করতেই তাঁরা আজ ব্যস্ত। অবশ্যই, আজকের ইয়োরোপের দার্শনিক পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করবার অবকাশ আমরা এই বইতে পাবো না। যাঁরা সে-বিষয়ে আলোচনা করেছেন, এবং দেখাচ্ছেন আজকের দিনে স্বার্থান্ধ যুদ্ধবাদীরা কী ভাবে বস্তুবাদকে ধূলিস্যাৎ করে তারই ধ্বংসস্তুপের উপর অধ্যাত্মবাদ আর ভাববাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়,–পাদটীকায় তাঁদের বই-এর নাম উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হতে হলো(২৪)।

আমাদের বর্তমান আলোচনায় বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হলো অপর প্রশ্নটি : ভারতীয় দর্শন সত্যই কি অনাবিল অধ্যাত্মবাদী ও ভাববাদী দর্শন?

————–
২২. যথা… “the fundamental characteristic of Indian thought was an idealistic one” : G. Tucci PFIPC-1925, 35.
২৩. Philosophy for the Future দ্রষ্টব্য।

২৪. H. K. Wells – Pragmatism of Imperialism ইত্যাদি